আবদুল মালেক উকিলআওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় পরিষদ সদস্য, নোয়াখালী;অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিশেষ প্রতিনিধি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ৩৬ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ০৭ নং দলিল থেকে বলছি…

আবদুল মালেক উকিল

১৯৭১ সালে আমি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের (লক্ষীপুর ও ফেনী জেলাসহ) সভাপতি ছিলাম। একজন এম.এন.এ. হিসেবে আমিই ’৭১ সালে জেলা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হই। ইতিপূর্বে আমি ১৯৫৬, ৬২ এবং ৬৫ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি ও সম্মিলিত বিরোধী দলের নেতা হিসেবে কাজ করেছি। নিখিল পাকিস্তান বার কাউন্সিল-এর নির্বাহী কমিটির নির্বাচিত সদস্য হিসেবে ও নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য হিসেবে ১৯৬৬ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি লাহোরের গুলবাগে নিখিল পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে আমি সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতিত্ব করি এবং ঐ অধিবেশনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন।

ঐ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন, অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ আমরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ছয়জন প্রতিনিধি ছিলাম। তার পরের ইতিহাস খুবই করুণ হলেও বাঙালী জাতির মুক্তিসনদ হিসেবে শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের জি. এম. সৈয়দ হারিনেতা, কাজী ফয়জুল্লাহ, সীমান্ত ও বেলুচিস্তান প্রদেশের আরবাব সেকান্দার হায়াত খান, মানকি শরিফের পীর আতাউল্লাহ খান মঙ্গল, গাউস বক্স বেজেঞ্জো, রেয়াছানী, শেখ মঞ্জুরুল হক, খলিল তিরমিজিসহ সকলেই প্রকাশ্যে ছয় দফা সমর্থন দিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকেই আমরা একই সাথে ঢাকায় দিনের পর দিন আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠক ও ৬ দফার ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র রচনার কার্যে নিয়োজিত ছিলাম।

১৫ই মার্চ ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান আসার পূর্ব পর্যন্ত, বিশেষ করে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের জরুরি অধিবেশন কখনও কখনও সারা রাত্রী ধরে চলতো। পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এবং সংলাপের সময় আমরা দৈনন্দিন অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের মতামত ব্যক্ত করতাম। কিন্তু ২৪শে মার্চ বঙ্গবন্ধু হঠাৎ আমাদেরকে অবিলম্বে ঢাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দেন এবং তদনুযায়ী আমি ২৪শে মার্চ নোয়াখালীতে (মাইজদি) চলে যাই। স্মরণ করা যেতে পারে, ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার ও ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাজেই আমাদের নিজ নিজ এলাকায় চলে যেতে এবং নির্দেশের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

২৫ মার্চ রাত ১১টা আমার মাইজদিস্থ বাসভবনে আমার নিজস্ব টেলিফোনে আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর ৩২ নম্বর বাড়ির বিখ্যাত ৪২৫১ টেলিফোনে যোগাযোগ করি। একবার ঐ বাড়িতে অবস্থানরত হাজি গোলাম মোর্শেদ (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী) টেলিফোনে আমার সাথে কথা বলেন এবং তিনি সতর্ক করে দেন যে, “যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে”। বঙ্গবন্ধু শুধু চিৎকার করে বলেছিলেন, “এখনও বসে আছ? সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে”।

২৬শে মার্চ সকালেও আমরা বিভিন্ন সূত্রে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা এবং হানাদার বাহিনীর গণহত্যার কথা অবহিত হই। এ সময় নোয়াখালী জেলার ডেপুটি কমিশনার ছিলেন জনাব মনযুর উল করীম (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব)। আমি তাঁর মারফতে জেলা ও দায়রা জজ গাজী শামসুর রহমান (বর্তমানে প্রেস কাউন্সিলের সভাপতি) এবং পুলিশ সুপার শহীদ আব্দুল হাকিম সহ মহকুমা প্রশাসক ও সকল সরকারী কর্মচারী, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারকে নোয়াখালী সার্কিট হাউসে ২৬ তারিখে ১০টার মধ্যে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানাই। আওয়ামী লীগের সমস্ত এমপি এ, এম এন এ ও বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও ঐ সমাবেশে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করি। নির্ধারিত সময়ে পূর্বেই সমস্ত সার্কিট হাউস এবং সম্মুখের ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। উক্ত সমাবেশে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসেবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম করার জন্য দলমত ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে আহ্বান জানাই। উপস্থিত সর্বস্তরের জনগণ এবং জেলা ও দায়রা জজসহ সকল স্তরের কর্মচারী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বাধীন বাংলার পক্ষে সংগ্রাম করার শপথ গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে আকস্মিকভাবে ডেপুটি কমিশনার জনাব মনযুর উল করীম বঙ্গবন্ধু মুজিব কর্তৃক ঘোষিত একটি ইংরেজিতে টাইপ করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আমার হাতে দেন। সেটি ছিলঃ

To the people of Bangladesh and also the world:
Pakistan Armed Forces suddenly attacked the EPR Base at Peelkhana and Police Line at Rajarbag at .00 hrs. of 26-3-71, Killing lots of people, Fierce fighting is going on with the EPR and police forces in the streets of Dacca. People are fighting gallantly with the enemy forces for the cause of Freedom of Bangladesh. Every sector of Bangladesh is asked to resist the enemy forces at any cost in every corner of Bangladesh.

May Allah bless you and help you in your struggle for freedom.

Joy Bangla
Sk. Mujibur Rahman

(অনুবাদ)
বাংলাদেশ ও বিশ্ববাসীর প্রতিঃ

পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ২৬-৩-৭১ তারিখ রাত ১২টার সময় হঠাৎ পিলখানার ইপিআর ব্যারাকে এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলা করেছে, অনেক মানুষ হত্যা করেছে। ইপিআর এবং পুলিশ বাহিনীর সাথে ঢাকার রাস্তায় ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মানুষ বীরত্বের সাথে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরকে যে কোন মূল্যে বাংলাদেশের সকল প্রান্তে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হলো।

স্বাধীনতা সংগ্রামে আল্লাহ্‌ আপনাদের রহমত করুণ এবং সহায় হোন।

জয় বাংলা
শেখ মুজিবুর রহমান

এটি হুবহু বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চের রাতে ওয়্যারলেস মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন। কিছুক্ষণ পরেই সমবেত জনতা সর্বোচ্চ কণ্ঠে জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে এবং আমার নেতৃত্বে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলে সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করে। ঐ মিছিলের শ্লোগান ছিল ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা মানি না’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে সর্বস্তরের নাগরিক ও কর্মচারীগণ শুধু শপথ করেই ক্ষান্ত হননি তারা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করে এবং আমার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এমনকি রিজার্ভ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত অফিসার মি. খান অস্ত্রাগারের চাবি আমার হাতে অর্পণ করে বলেন যে, আজ থেকে আমরা আপনাদের হুকুমে পরিচালিত হবো এবং বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ অনুগত থাকবো। (From now onwards we are under your command ) ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে আমার নিকট কয়েকটি জরুরি টেলিগ্রাম আসে। জনাব মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী ও জনাব আখতারুজ্জামান চৌধুরী (বর্তমানে জেলা, দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি) টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে নিশ্চয়তার জন্য। যেহেতু আমি ই.পি.আর-এর ওয়্যারলেস-এর মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার কপি ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সাথে সরাসরি আলোচনা করেছি এবং যেহেতু সে সময় ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ও অন্যান্য জরুরি টেলিফোন যোগাযোগ চট্টগ্রামের সাথে বিচ্ছিন্ন ছিল, সে জন্য আমাকে টেলিফোনে বারবার নিশ্চয়তা দিতে হয়েছিল। সকল সরকারী ও আধা সরকারী কর্মচারী সেদিনই আমাকে তাদের এক দিনের বেতন দিয়ে যুদ্ধ তহবিলে চাঁদা প্রদান করেন। নোয়াখালী টাউন হলে আমরা কন্ট্রোল রুম স্থাপন করি এবং মাইজদির রৌশন বাণী সিনেমা হলে আমাদের খাদ্য ও সাহায্য সামগ্রী রাখার ব্যবস্থা করি। পুলিশ লাইন ও জেলা স্কুলে তৎক্ষণাৎ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়।

নোয়াখালীর সর্বস্তরের জনগণ পুলিশ, ই.পি.আর., আনসারসহ ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলা হানাদারমুক্ত রাখে। এ সময়ে আমরা সামরিক পোশাকে বেলুনিয়া ও নোয়াখালী সীমান্তে অবস্থিত পাক বি.ও.পি. হতে আগত অস্ত্রশস্ত্রসহ হাজার হাজার ই.পি.আর. ও আনসারকে সংগঠিত করি। ৪০/৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে বন্দি অবস্থায় রাখি, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল, শিক্ষাকেন্দ্র ও রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা করি। বেলুনিয়া বর্ডারে অবস্থিত পাক বি.ও.পি থেকে উদ্ধারকৃত মেশিনগানসহ অনেক অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয় যা আমরা পরে ২ নম্বর সেক্টরে এবং নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর ও বিশেষ করে শুভপুরের যুদ্ধে কাজে লাগাই।

২রা এপ্রিল চাঁদপুর থেকে মিজান চৌধুরী রায়পুর হয়ে নোয়াখালী আসেন। আমি মিজান চৌধুরী এবং ফেনীর এম.এন.এ. মরহুম খাজা আহমেদ সহ ছোতাখোলা হয়ে ভারতীয় বি.এস.এফ. এর মেজর প্রধান এর সহায়তায় প্রথম সীমান্ত অতিক্রম করি। প্রথমে রামগড় ও পরে উদয়পুর হয়ে আগরতলায় যাই। উল্লেখ্য যে, রামগড়ে আমরা মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন রফিকসহ কয়েকজন সামরিক অফিসার ও তদানীন্তন পার্বত্য চট্টগ্রামের ডি.সি. জনাব তৌফিক ইমামের সঙ্গে আলোচনা করি।

ঐ দিনই সন্ধ্যায় আগরতলা পৌঁছার পরপরই অমৃতবাজার পত্রিকার শ্রী অনিল বিশ্বাসের বাসভবনে বিবিসি ও ভয়েস অভ আমেরিকার প্রতিনিধিসহ অনেক সাংবাদিক আমাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন এবং আমাদের কথা টেপ করেন। সম্ভবত বাংলাদেশে গণহত্যা ও সর্বাত্মক যুদ্ধ সম্পর্কে এটাই বহির্বিশ্বের প্রথম প্রচারিত বাণী। কারণ আমরা (আমি এবং মিজান চৌধুরী) যে সাক্ষাৎকার প্রদান করি তা শুনেই আমেরিকায় নিযুক্ত তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত (মিনিস্টার ও পরে পররাষ্ট্র সচিব) জনাব এনায়েত করিম, তাঁর এক ভাগ্নে ও অন্য একজনকে কলকাতায় কিড স্ট্রিটে সরাসরি আমাদের কাছে পাঠান। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে অন্তত বাংলাদেশের দুইজন আওয়ামী লীগ নেতা জীবিত আছেন এবং তাদেরকে আগরতলা বা কলকাতায় পাওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নোয়াখালী বোধহয় একক ও অনন্যভাবে সরকারী কর্মচারী ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একক নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রায় এক মাস যুদ্ধে করে সমগ্র এলাকা হানাদারমুক্ত রেখেছিল। তারপর আমরা নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল ও ফরিদপুরের বেশকিছুসংখ্যক নির্বাচিত এম.পি ও এম.এন.এ. আগরতলায় একত্রিত হই। এ সময় আমাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষার প্রধান লিয়াজোঁ নির্বাচিত করা হয়। সে সময় কর্নেল ওসমানী, লে. কর্নেল আব্দুর রব এম.এন.এ. সহ কয়েকজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। আমরা আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে একমত হই। ত্রিপুরা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শচীন বাবু এবং বিখ্যাত স্বদেশী নেতা কলকাতার ১৪ নং ক্ষুদিরাম বোস লেনের শ্রী পান্নালাল দাসগুপ্ত আমাদের এই কাজে বিশেষ উৎসাহ প্রদান করেন।

অতঃপর ১০ই এপ্রিল জনাব ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি এবং মেজর জেনারেল আব্দুর রবকে ডেপুটি করে, বঙ্গবন্ধু মুজিবকে রাষ্ট্রপতি এবং নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, জনাব তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি অস্থায়ী মন্ত্রীসভা ও সরকার গঠন করা হয়। অতঃপর শ্রী পান্নালাল দাসগুপ্ত আমাকে ও কয়েকজন এম.এন.এ. ও এম.পি.কে তাঁর কর্মস্থল ও পত্রিকা অফিস কলকাতার ১৪ নং ক্ষুদিরাম বোস লেনে নিয়ে যান। ওখান থেকে আমরা বি.এস.এফ-এর হেড কোয়ার্টার ২/এ, লর্ড সিনহা রোডে গিয়ে জনাব নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন, মনসুর আলীসহ বিপ্লবী সরকারের সব মন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাই। পরবর্তীকালে আমরা ‘তালা’য় অবস্থিত আন্দামান ফেরত বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ শ্রী অমর গাঙ্গুলী ও মণি গাঙ্গুলীর বাড়িতে অবস্থান করে মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন বিষয়ে মতামত বিনিময় করি। কিছুদিন পর ওখান থেকে আমরা উত্তর কলকাতায় অবস্থিত ৩০নং মদন মোহন তালা স্ট্রিটে শ্রী শ্যামাপদ সাহা, শ্রী বাদল সেন, শ্রী অমল সেন, প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরিচিত হই। পরবর্তীতে তাদের প্রেরণা ও সহায়তায় আমরা শিয়ালদহ, সল্ট লেকসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত লক্ষ লক্ষ অসহায় বাস্তুহারাকে দেখাশুনা করি। অতঃপর আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নড়াইলের তৎকালীন এম.পি.এ. মি. শহীদ ও তদানীন্তন পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব হোসেন আলীর বিশেষ সহকারী মি. জাকির আহমেদ-এর সহায়তায় আমি হাইকমিশনারকে বাংলাদেশের পক্ষে Defect করার প্রস্তাব করি। তিনি প্রায় সব বাঙালী কর্মচারীসহ Defect করতে রাজি হন। তবে তিনি সমস্ত কর্মচারীর নিরাপত্তা, ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য বিষয় আলোচনার জন্য সরাসরি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্য একটি প্রস্তাব করেন।

সে মতে আমি তাঁর পক্ষে এই প্রস্তাব নিয়ে ২/এ লর্ড সিনহা রোডে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে একটি তৃতীয় স্থানে বৈঠকের ব্যবস্থা করি। ঐমতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে পার্ক সার্কাসের ৯ নং এভিন্যুতে অবস্থিত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার অফিস বাংলাদেশ মিশন হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

ইতিমধ্যে ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় দেশি-বিদেশি প্রায় শতাধিক সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য তিনজনকে মন্ত্রী, জনাব ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি ও নয়জনকে সেক্টর কমান্ডার করে বিপ্লবী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ঐ দিন রাতেই আমরা কলকাতায় ফিরি। তার পূর্ব থেকেই আমাকে কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসনের এম.এন.এ. ইনচার্জ করে বিধান রায়ের বাড়ি ৪৭ প্রিন্সেপ স্ট্রিটে দফতরের ভার দেয়া হয়। অধ্যাপক ইউসুফ আলীকেও পরে যুক্তভাবে এই পদে একই জায়গায় নিয়োগ করা হয়। পরে পরিচয়পত্র প্রদান, ইত্যাদি ব্যাপারে কাজের চাপ অসম্ভব বেড়ে যাওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান তাঁর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে নেন। সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের আরো দুইটি অতিরিক্ত অফিস নেয়া হয়। একটি ৩/১, কামাক স্ট্রিটে এবং অন্যটি ১নং বালিগঞ্জে। শ্রী জি. এস. ভৌমিক Defected জেলা দায়রা জজকে রিলিফ কমিশনার হিসেবে আমার অধীনে ন্যস্ত করা হয়। জনাব কাওসার আলী সহ অনেকে যুক্তভাবে আমাকে সহায়তা করেন। প্রবাসী মুজিবনগর সরকার ৯ মাস যুদ্ধকালে আর কোনো মন্ত্রী নিয়োগ করেননি। আমাদের এম.এন.এ. ইনচার্জদের মন্ত্রীর স্ট্যাটাস দেয়া হয়। ৩/১, কামাক স্ট্রিটে বিদেশ হতে প্রাপ্ত টাকা, চেক, ইত্যাদি গ্রহণ করা হতো। এখানে জনাব কামরুজ্জামান, ইউসুফ আলী এবং আমি ছাড়া আর কোনো লোকের প্রবেশাধিকার ছিল না।

পরে মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আমাকে তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিনিধি (Personal envoy) হিসেবে মনোনীত করেন এবং জুন মাসে বিভিন্ন রণাঙ্গনে, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ও নেপালে সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন। পালাটোনায় ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, এম.এন.এ. ও ভারতীয় ক্যাপ্টেন ধর আমাকে নিয়ে প্রায় দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধার শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। মেলাঘরে প্রায় চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আমার হাতে শপথ গ্রহণ করে। মেজর খালেদ মোশারফ, ক্যাপ্টেন হুদা, মেজর হায়দার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনুরূপভাবে আমি রাজনগর, ধর্মনগর, ছোতাখোলা, বিলোনিয়া, বেগুলা, মাঝদিয়া, চরিলাম, সাবরুম, পূর্বাঞ্চলীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও করিমপুর, শিকারপুর, ইছামতি, ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত বহু ক্যাম্পে গমন করি এবং বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা, অস্ত্রশস্ত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা করি। উল্লেখ্য যে, আমাদের বহু খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধা দেশের অভ্যন্তরে থেকেই সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। জনাব রুহুল আমিন ভুঞা, খালেদ মোহাম্মদ আলী এম.এন.এ., মাহমুদুর রহমান, বেলায়েত ও আমার দুই ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন ও বাহার উদ্দিনসহ এরা প্রায় ৯ মাস দেশের অভ্যন্তরেই ছিলেন।

১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করার পরই আমি কিছু নগদ টাকা ও দুই ট্রাক ত্রাণ সামগ্রী যথা রেইন কোট, কিটস, ইত্যাদি নিয়ে আগরতলায় এসে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিতরণ করি। জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৬৩ জন এম.পি.এ., এম.এন.এ.-এর উপস্থিতিতে আমার সভাপতিত্বে পূর্বাঞ্চলীয় সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ইতিপূর্বে এ পদ নিয়ে খুব দলাদলি ও দ্বন্দ ছিল। ইতিমধ্যে আমি নিজের কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী আনয়ন ও পরিবারের স্ত্রী, মাতা, পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে, সকলের খোঁজ-খবর নেয়া এবং নোয়াখালী জেলার সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ২৪শে এপ্রিল বেলুনিয়া হয়ে নোয়াখালী প্রবেশ করি। মাইজদি গিয়ে দেখি বাসা ফাঁকা, সব মালপত্র আছে কিন্তু বাড়িতে কোনো মানুষ নেই। অনুরূপভাবে জেলা প্রশাসক, জজ, পুলিশ সুপার সকলেই নিজ নিজ বাসস্থান ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ হানাদার বাহিনী লাকসাম হয়ে রেল লাইন ধরে দ্রুত নোয়াখালীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। গভীর রাতে আমি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে শুধু ঘন্টাখানেকের জন্য আমার স্ত্রী ও বড় মেয়ে ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের সাথে দেখা করি। সঙ্গে সঙ্গেই একটি জিপ ঐ বাড়িতে আসে এবং রিজার্ভ পুলিশের ইন্সপেক্টর মি. খান এসে বলেন, স্যার, এখনই আপনাকে চলে যেতে হবে, কাল আর বর্ডার ক্রস করতে পারবেন না। হানাদার বাহিনী মাইজদি টাউন হতে মাত্র ১০/১৫ মেইল দূরে চৌমুহনীর উত্তরে অবস্থান নিয়েছে। কাজেই ঐ মুহূর্তে হতভম্বের মত আবার নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করলাম। সঙ্গে ছিল আমার ল্যান্ড রোভার জিপ আর ড্রাইভার মাহমুদ, চৌমুহনী বিদ্যামন্দিরের হেডমাস্টার সালাউদ্দিন এবং সোনাইমুড়ির গোলাম মোস্তফা। সামান্য কিছু টাকা নিয়ে আঁকাবাঁকা পথে ২৫শে এপ্রিল বর্ডার ক্রস করে বেলুনিয়া পৌঁছি। আসার সময় স্ত্রীকে বলে আসি, “খোদা হাফেজ, চরাঞ্চলে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে চেষ্টা করো।” বর্ডারের কাছে এসে এক নিরাপদ স্থানে জনাব সালাউদ্দিন ও গোলাম মোস্তফাকে নামিয়ে দেই। এস্কর্ট পার্টি হিসেবে মি. খানের জিপ ৩/৪ জন পুলিশ বর্ডার পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিল। যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিশ্বস্ত ড্রাইভার মাহমুদ বাবা-মা ছেড়ে আমার সঙ্গে ছিল।

২৬ এপ্রিল তারিখে নোয়াখালীর পতন হয়। সমগ্র শহর হানাদার বাহিনী দখল করে নেয়। আগরতলায় এসে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ও বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এবং অন্যান্যের সঙ্গে বিশেষ করে ২নং সেক্টরের মেজর খালেদ মোশারফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রেরণের ব্যবস্থা করি।

ইতিমধ্যে মুজিবনগর থেকে জরুরি ভিত্তিতে কলকাতা গমনের জন্য আমার ডাক আসে। আমি পূর্বেই সব কিছু জহুর আহমদ চৌধুরীকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাই। ৯নং সার্কাস এভিনিউ অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ মিশন’-এ দেশি-বিদেশি অনেক ব্যক্তি, বিশেষ করে পিটার হেজেল হার্স্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরের প্রতিনিধি হেনরি হাওয়ার্ড গেস মার্ক গায়েন এর সঙ্গে আমি বাংলাদেশের গণহত্যা এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করি। এখানে প্রয়াত ড. মুজাফফর আহমদও উপস্থিত ছিলেন। কখনও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদও উপস্থিত থাকতেন।

ইতিমধ্যে খবর পেলাম আমার গ্রামের বাড়ি(রাজাপুর), শ্বশুরবাড়ি(আবদুল্লাহপুর) এবং দুই বোনের বাড়ি (যথাক্রমে করিমপুর ও বারইপুর) হানাদাররা আক্রমণ করেছে। আমার মাইজদির পাকা দ্বিতল বাড়ি অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার শ্বশুরবাড়িতে সৌভাগ্যবশতঃ স্ত্রী ও বড় দুই মেয়ে সেদিন উপস্থিত ছিল না। ঐ দিনই সন্ধ্যায় রাতে তারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল। ছোট দুই মেয়ে লিলি ও মায়া (১০ বৎসর, ৭ বৎসর)সহ বাড়ির সমস্ত স্ত্রী পুরুষকে বন্দি করে বাহির বাড়িতে উঠিয়ে নেয় এবং সমস্ত পুরুষকে ট্রাকে করে মাইজদি ক্যাম্পে নিয়ে আসে। দীর্ঘ ৪ মাস কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রেখে তাদের উপর নির্যাতন করে, এবং গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দেয়। ৪ জনকে গুলি করে হত্যা করে। পরে অবশ্য তারা বাড়ির সমস্ত মহিলা ও শিশুকে এক বালুচ ক্যাপ্টেনের নির্দেশে ছেড়ে দেয়। ভাগ্যক্রমে আমার বড় ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন (লাতু) পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে কচুরীপানার নিচে দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। হানাদাররা দুই বোনের সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। ছোট বোনটির মৃত্যু এর পূর্বেই হয়েছিল এবং তার স্বামীও জীবিত ছিল না। একমাত্র ভাগ্নে মফিজ তখন সামরিক বিভাগের চাকুরিতে পশ্চিম পাকিস্তানের কোহাটে আটক। ভাগ্নী জামাই মমিনউল্লাহ এবং তার বড় ভাইয়ের কলেজে পড়ুয়া দুই ছেলে নূরউদ্দিন, শাহাবুদ্দিনসহ নয়জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে হানাদার বাহিনী ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করে। এই মর্মান্তিক খবর আমাকে জানানো হয়নি। যেমন জহুর আহমদ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ ছেলের মৃত্যু সংবাদও তাঁর নিকট গোপন রাখা হয়েছিল। আ স ম আব্দুর রব ও অন্যান্যের চেষ্টায় আমার স্ত্রী, কন্যা ও মৃত ভগ্নীর ছেলে মনজু এবং আমার ছোট ভাই এনায়েত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বেলোনিয়ায় পৌঁছে। এ সময় মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় তীব্রভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। স্মর্তব্য, কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ এবং আলীগড়সহ ভারতের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মুসলমান যুদ্ধের প্রথম দিকে তীব্রভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে। তাদের ধারণা ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তাদের ভ্রমাত্মক ধারণা দূর করার জন্য মুজিবনগর সরকার বিশেষ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর আলী আমাকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত হিসেবে নদীয়া, কৃষ্ণনগর, বহরমপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠান। এ সময় ফরিদপুর থেকে লক্ষাধিক তপশীলী সম্প্রদায়ের লোক উপরিউক্ত এলাকাগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে বহরমপুর সীমান্তে একদিনেই প্রায় ১০ হাজার নমশুদ্র ঢাল সড়কি নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আল্লাহর রহমতে আমি, মরহুম গোলাম কিবরিয়া এম.এন.এ., আজিজুর রহমান আক্কাছ এম.এন.এ. ও অন্যান্য এমপি এবং বহরমপুরের তরুণ আই এ এস অফিসার মি. ডি কে ঘোষ-এর সহযোগিতায় প্রত্যেক মুসলমানের বহিঃ বাড়ির ঘর, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সমস্তই বাস্তুহারাদের আশ্রয়ের জন্য ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে সফলকাম হই। এমনকি সরকারী নির্দেশে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মারওয়ারীদের বিরাট বিরাট পাটের খালি গুদাম বাস্তুহারাদের জন্য খালি করে দেয়া হয়। মিসেস সুভদ্রা এমপি ও তদানীন্তন কংগ্রেসের মহাসচিব হেনরি অস্টিন সহ আমরা উত্তরাঞ্চলের আলীগড়, মীরাট ও অন্যান্য স্থানের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কাজে বিভিন্ন স্থানে জনসভা ও গণসংযোগ করি। এ সময় আমার নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদলকে নেপালে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি সরকারী নির্দেশ দেন । অপর দুই সদস্য ছিলেন শ্রী সুবোধ মিত্র ও আব্দুল মমিন তালুকদার এম, এন, এ । আমার নেপাল যাওয়ার পূর্বে দিল্লীস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন হতে যে দুইজন ডিপ্লোম্যাট কে , এম সাহাবুদ্দিন এবং জনাব আমজাদুল হক ডিফেক্ট করেছিলেন তাঁদের সাথে যোগাযোগ রেখে প্রায় দুসপ্তাহ দিল্লীতে অবস্থান করি। এ সময় আমার আমরা সর্বভারতীয় সংগ্রামী নেতা শ্রী আচার্য কৃপালনি ( যিনি কলকাতার কনভোকেশনে গভর্নরকে গুলি ছুড়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে আন্দামান হতে ফিরেছিলেন ) , শ্রী পান্নাপাল দাসগুপ্ত ও শ্রী অমর সাহার সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা করে অনেক তথ্য ও মূল্যবান উপদেশ লাভ করি ।

এরপর আমরা নেপাল যাই । নেপাল তখন ছিল পাকিস্তানের খুব ঘনিষ্ঠ ও সহযোগী রাষ্ট্র। সৌভাগ্যের বিষয় এই সময় কাঠমুন্ডুতে তিনজন পাকিস্তানী কূটনীতিকের মধ্যে দুইজন বাঙালি । জনাব মোস্তাফিজুর রহমান সি,এস,পি, এবং জনাব মোখলেছউদ্দিন সি,এস,পি ছিলেন । সচিবালয়ের একজন প্রবীন লোক ছিলেন তিনিও ছিলেন ভোলার অধিবাসী । এঈ সফরে আমরা নেপালের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী ঋষিকেশ সাহা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী থাপা ও অন্যান্য বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ , সাংবাদিক , সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করি । তাঁরা সকলেই “বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি” নাম দিয়ে বাস্তুহারাদের সাহায্য এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের পক্ষে জোরালো সমর্থন দেন। তাঁরা কয়েকটি ছাত্র-যুবসমাবেশের এবং একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্তমান নেপালের রাজার পিতা শ্রী বীরেন্দ্র তখন জীবিত ছিলেন। বর্তমান রাজার আপন মামা ছিলেন প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও জাতিসংঘে নেপালের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী ঋষিকেশ সাহা। তাঁদের মাধ্যমে আমরা রাজদরবারে মুজিবনগর সরকারের ছবি ও কাগজপত্র প্রদান করি।

নেপাল হতে প্রত্যাবর্তন করে আবার ১ নং বালিগঞ্জে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে যোগদান করি । ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত উক্ত কাজেই নিয়োজিত ছিলাম । ১৬ই ডিসেম্বর এর পরে আমি আগরতলা হয়ে নোয়াখালী চলে যাই । ইতিপূর্বে ৬ই ডিসেম্বর হতেই নোয়াখালী হানাদার মুক্ত হতে থাকে । কাজেই আগরতলা ,উদয়পুর এবং বেলোনিয়ায় অবস্থানরত হাজার হাজার শরণার্থী ও প্রায় অধিকাংশ বাস্তুহারা এবং এম পি এ, এম এন এ ও অন্যান্য প্রায় সব নেতৃবৃন্দ এবং তাদের পরিবার-পরিবর্গ নোয়াখালী প্রত্যাবর্তন করেন । এমনকি আমার দুই ছেলে ও তখন নোয়াখালীতে । কাজেই আমার স্ত্রী ও পাঁচ কন্যা শুধু আমার অপেক্ষায় উদয়পুরে অধীর আগ্রহে এবং উদ্বিগ্ন হয়ে বসেছিল ।

ইতিপূর্বে পূর্বাঞ্চলের চেয়ারম্যান আমাকে সমগ্র নোয়াখালী (ফেনী ও লক্ষীপুরসহ) জেলার প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং আমার মন্ত্রীসভার যোগদানের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমি উক্ত দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম।

এখানে অত্যন্ত গর্বের সাথে উল্লেখ করতে পারি যে নোয়াখালী জেলা হানাদারমুক্ত হবার ও আমাদের প্রশাসনিক দায়িত্ব নেয়ার পরে কোনো স্থানে কোনো হত্যাকাণ্ড বা লুটতরাজ অথবা রাহাজানি হয়নি। এমনকি ইতিপূর্বে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও মুক্তিযোদ্ধারা যাদের হত্যা করেছিল তাদেরও কোনো মালামাল বা ঘরবাড়ি লুটপাট করেনি। আমি মুজিব বাহিনী, মুক্তিবাহিনী এবং শ্রমিক সংগঠনের বিভিন্ন বাহিনীকে নোয়াখালী জেলা স্কুল, হরিনারায়ণপুর স্কুল ও অন্যান্য স্থানে অস্ত্রশস্ত্রসহ শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থানের নির্দেশ দেই। ফেনী, লক্ষীপুর, রামগতি, কোম্পানীগঞ্জসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে ৪/৫ হাজার নগদ টাকা এবং নোয়াখালী সেন্ট্রাল স্টোরে রক্ষিত কাপড়, কম্বল, চাউল-গম-ডাল ইত্যাদি সরবরাহ করি। বিশেষ করে ডেলটা জুট মিলের ও দোস্ত মোহাম্মদ টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে চাল সরবরাহ করি। সৌভাগ্যের বিষয় রাজাকার তহবিলে গচ্ছিত প্রায় ৮০ লাখ টাকা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এবং ছাত্র শ্রমিক ও বিভিন্ন বাহিনীর নেতৃবৃন্দের তত্ত্বাবধানে বিলি বণ্টন করি। পরে তদানীন্তন কুমিল্লা গ্যারিসনের কমান্ডার মেজর জিয়াকে মাইজদিতে নিয়ে ১০ই জানুয়ারির পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে অনেক আগ্নেয়াস্ত্র আমাদের নিকট প্রত্যার্পণ করার আহ্বান জানাই এবং জমা নেই।

-আব্দুল মালেক উকিল
১ জুলাই, ১৯৮৪।

Scroll to Top