অমর ১৭ই সেপ্টেম্বর স্মরনে
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
পাকিস্তান সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিবাদে বাংলাদেশের দীর্ঘকালব্যাপী সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর একটি স্মরণীয় দিন। এই দিন বাংলাদেশের ছাত্ররা বুকের রক্ত দিয়ে সরকারী শিক্ষানীতির প্রতিবাদ করেছিল। সেই থেকে এই দিন বাংলাদেশের সর্বত্র শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, স্বতন্ত্র পরিস্থিতিতে, দেশব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামের মাঝে ১৯৬২ সালের শিক্ষা-আন্দোলনের শহীদদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।
পাকিস্তান সরকারের শিক্ষানীতি চিরকালই ছিল জনসাধারণের স্বার্থের থেকে বিযুক্ত। নানারকম প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সার্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা দেশে প্রবর্তিত হয়নি, বয়স্কদের শিক্ষার ব্যাপারেও
উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। শিক্ষালাভের সুযোগের ক্ষেত্রেও দেশের দুই অংশে ইচ্ছাকৃতভাবে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার। পশ্চিম পাকিস্তানে এর সংখ্যা ছিল অনেক কম। গত বছরে বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা দাঁড়িয়ে ২৪ হাজার আর পশ্চিম পাকিস্তানে সে সংখ্যা স্ফীত হয়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজারের চেয়ে বেশি।
শুধু স্কুল-কলেজের সংখ্যা নিয়েই কথা নয়। সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্কুলকলেজের যে পাঠ্য তালিকা তৈরী করা হয়, তা প্রকৃত শিক্ষার অগ্রগতির সহায়ক ছিল না; বরঞ্চ ভাষার চাপ, সাম্প্রদায়িক বিষয়বস্তুর অবতারণা এবং অগণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রবর্তনে এই পাঠ্য তালিকা ছিল গঠনশীল চিত্তের পক্ষে ক্ষতিকর। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে চিন্তার ও বক্তব্যের স্বাধীনতা হরণ ছিল সরকারী শিক্ষানীতির অঙ্গ। শিক্ষার প্রশাসনের ক্ষেত্রেও সরকার যে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, তাও স্বাধীন ও ফলপ্ৰসূ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পথ রুদ্ধ করেছিল। মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষাদানের বিষয়েও সরকারী উদাসীনতা ছিল এই নীতির অংশস্বরূপ।
আইয়ুব সরকারের আমলে যে নতুন শিক্ষানীতির অবতারণা হয়, তাতেই এই অগণতান্ত্রিক শিক্ষা পদ্ধতির সম্পূর্ণ চেহারাটা ধরা পড়ে। বাংলাদেশের শিক্ষক ও ছাত্ররা স্বভাবতঃই এই শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু এই প্রতিবাদকে আন্দোলনের রূপ দেওয়ার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ছাত্রসমাজের প্রাপ্য। ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সেই আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী দিবস হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।
সরকারী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের সূচনা হলেও, তা শুধু শিক্ষানীতির প্রতিবাদস্বরূপ ছিল না। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খান যে একনায়কত্ববাদী শাসনের প্রবর্তন করেন, ১৭ই সেপ্টেম্বরের বিক্ষোভ সেই অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল। যখন সারাদেশ প্রকৃতপক্ষে এক সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে পীড়িত হচ্ছিল, তখন ছাত্ররাই বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছিল এবং প্রাণের বিনিময়ে সে আন্দোলনে তারা সাফল্য অর্জন করেছিল। একনায়ক আইয়ুবের সেই ছিল প্রথম পশ্চাদপসরণ। আর এর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে ১৯৬৯ সালে- যখন আইয়ুবকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হয়।
এরপর ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া-সরকারের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে দেখা গেল শিক্ষাসংক্রান্ত আন্দোলনের আরো স্বীকৃতি ঘটেছে। প্রস্তাবিত নীতিতে শিক্ষা-প্রশাসনের গণতন্ত্রীকরণের ধারণা কিছুটা গৃহীত হয়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা পদ্ধতির জন্য যে দাবী শিক্ষক ও ছাত্ররা করেছিলেন, তা স্বীকার করা হয়নি। মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষাদানের প্রস্তাবও সেখানে ছিল না। কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা, এই শিক্ষা সংস্কারের প্রস্তাবও শেষ পর্যন্ত ধামাচাপা দেয়া হয় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যকেই মেনে নেয়া হয় নীতি হিসাবে। আশা করা গিয়েছিল যে, দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষানীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা সম্ভবপর হবে।
কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। তার আগেই সামরিক শাসনের বর্বরতম আঘাত নেমে এসেছে দেশের মানুষের উপর।
আজ বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। দেশকে শত্রু মুক্ত করার পরে সার্বিক পুনর্গঠনের সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার নব রূপায়ণ ঘটবে। যে শিক্ষাব্যবস্থায় দেশের শতকরা আশি ভাগ লোক নিরক্ষরতার অভিশাপগ্রস্ত, সেই শিক্ষাব্যবস্থা দেশের কলঙ্কস্বরূপ। শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে সকলকে। শিক্ষার ভিত্তি প্রসারিত করে গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে আমাদের। শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে কাজের সুযোগ। সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার এই অভিপ্রেত পুনর্গঠন সম্ভবপর হবে না।
আজ আমরা সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধে ব্যাপৃত। ইতিহাসে অতুলনীয় ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন উষার স্বর্ণদ্বার যেদিন উদঘাটিত হবে, সেদিনই ১৭ই সেপ্টম্বরের আন্দোলন সার্থকতায় উপনীত হবে।
(ডক্টর আনিসুজ্জামান রচিত)