আমিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টারআওয়ামী লীগ দলীয় নেতা,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম উপদেষ্টা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ৫১ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ০৯ নং দলিল থেকে বলছি…

ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন একটি দলের পক্ষে এত বেশী আসন লাভ করার নজির ইতিপূর্বে আর দেখা যায়নি। নির্বাচনে বাংলার মানুষ আওয়ামলীগের ৬ দফার পক্ষে পূর্ণভাবে তাদের রায় ঘোষণা করেন।

নির্বাচনের পর ‘৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষনা করেন আওয়ামী লীগের কেউ বেঈমানী করলে জ্যান্ত কবর দেবেন। জনসভার প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধু নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ গ্রহন করান। এই ধরনের গণশপথ পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর কিছুদিন পর নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল একটি সাব কমিটি গঠন করে। দলের নির্দেশ অনুযায়ী সাব কমিটি শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরু করে। ২৭শে জানুয়ারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে এক বিরাট প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় আসেন।

নির্বাচনের পর পর ভুট্টো ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার বিরোধিতা শুরু করেন। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসার জন্য আলোচনার দরজা বঙ্গবন্ধু খোলা রাখেন। ভুট্টো ও তার প্রতিনিধিদলের সাথে সর্বপ্রকার যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের হুইপ হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমার ওপর অর্পণ করেন। ভুট্টো ও তার প্রতিনিধি দলকে যথেষ্ট সম্মান ও সৌজন্য দেখানো হয়। ভুট্টো বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন। আমাদের দলের কয়েকজন নেতা এবং ভুট্টোর প্রতিনিধি সদস্যরা একদিন নৌপথে লঞ্চের মধ্যে এক বৈঠকে মিলিত হন।

ভুট্টোর কয়েকজন বিশিষ্ট সহকারীর সাথে আমার আলোচনা হয়। এদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় সহকারী ব্যারিষ্টার কামাল আফছার আমার সার্কিট হাউজ রোডের বাসভবনে আমার সাথে দেখা করেন। ভুট্টোর দলের নেতাদের সাথে আলোচনার পর একটা জিনিস বুঝতে পারি। তারা ইতোমধ্যেই ধরে নিয়েছে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। ভুট্টো ও তার সহযোগীদের অনমনীয় মনোভাব থেকে এটা সুস্পষ্ট বুঝা গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আলোচনার পূর্বে ও পরে ভুট্টোকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে আনা নেয়ার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। এক দিন আলোচনার পর ভুট্টোকে নিয়ে গাড়ীতে করে যখন হোটেলে যাচ্ছিলাম, তখন তাকে ভীষণ গম্ভীর দেখি। আমি গাড়ীতেই ভুট্টোকে বলি এমন একটি শাসনতন্ত্র রচনা করা উচিত যাতে বাংলাদেশের এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী সাধারণ মানুশের আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। আর তা যদি না করা হয় তাহলে সামরিক শাসনের বেড়াজাল থেকে পাকিস্তান কোন দিন মুক্তি পাবে না। আমার কথায় প্রচ্ছন্ন এই ইঙ্গিত ছিল যে, শাসনতন্ত্র রচনায় আমাদের সাথে সহযোগিতা না করলে ভুট্টোর কোন লাভ হবে না। বরং সামরিক জান্তারই বেশী সুবিধা হবে। আমার কথার জবাবে ভুট্টো একটি তাৎপর্যপূর্ন উক্তি করেন। তিনি বলেন, ‘ডোন্ট ফরগেট আমিরুল ইসলাম, দ্যাট আই গট লারজেস্ট নাম্বার অব ভোটস ইন দি ক্যানটনমেন্ট’। এই একটি কথায় বুঝে নিতে আমার জন্য যথেষ্ট ছিল যে, পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে ভুট্টোর কী সম্পর্ক রয়েছে। অন্যান্য দিনের মত ভুট্টো সেদিন হোটেলে না গিয়ে তখনকার গভর্নর হাউজে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি তাকে সেখানে নামিয়ে দেয়ার সময় দেখলাম, সিঁড়ির নীচে গভর্নরের এ ডি সি ভুট্টোর জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি ভুট্টোকে বলেন জেনারেল আকবর ফোনে তার জন্য অপেক্ষা করছেন।

আমার মনে হয় এ দুটো ঘটনা আলোচনার ভবিষ্যৎকে সন্দিহান করে তোলে। ফিরে এসে আমি বঙ্গবন্ধুকে এই ঘটনা জানাই। ৩১শে জানুয়ারি ভুট্টো সদলবলে ঢাকা ত্যাগ করেন। যাবার কালে ভুট্টো বলে যান আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্র তৈরী করা হবে। কিন্তু করাচী ফিরে ভুট্টোর সুর বদলে যায়। তিনি বলতে থাকেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দেয়ার এখতিয়ার আওয়ামী লীগের নেই। আসন্ন গনপরিষদের অধিবেশনে তিনি যোগ দেবেন না এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অন্য কাউকে যোগ দিতে দেবেন না। পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে তিনি জেনারেলদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। বিভিন্ন ঘটনাবলী থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান সামরিক জান্তার জেনারেলদের ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন সদিচ্ছা নেই। কেন না তারা বুঝতে পারে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে সামরিক জান্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। আর এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে জেনারেলদের সাথে গোপনে ভুট্টোও হাত মিলান।

ফেব্রুয়ারী মাসে আমাদের দ্বিতীয় দফা ও শেষ প্রচেষ্টা ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র রচনা। পহেলা মার্চ সকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শাসনতন্ত্র রচনাকারী কমিটির পক্ষ থেকে খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়। এই বৈঠকে পাঞ্জাবের মালিক সরফরাজসহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়কজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। আমাদের প্রণীত খসড়া শাসনতন্ত্র কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন লাভ করে। এই ব্যাপারে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু সংসদীয় দলের উপর ন্যস্ত করেন।

সকালের বৈঠকের পর হোটেল পূর্বানীতে বিকেলের বৈঠকের স্থান ধার্য করা হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সময় বেলা ১ টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান বেতারে এক বিবৃতিতে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। বাংলার মানুষকে বিক্ষুব্ধ করার জন্য এই একটি ঘোষণাই যথেষ্ট ছিল। ঢাকা শহরের সকল শ্রেনীর মানুষ এই ঘোষণার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। জনতার জোয়ারে ভেসে যায় ঢাকার প্রতিতি অলিগলি রাজপথ। মিছিলকারী জনতার হাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের লাঠি ও লোহার রড। জনতার মুখে একটি শ্লোগানই শোনা যায় ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশকে স্বাধীন কর’। ‘৬দফা, না এক দফা, এক দফা এক দফা’। সারা শহর থেকে খন্ড খন্ড মিছিল পল্টন ময়দানে এসে জমায়েত হয়। পল্টনের সভায় বক্তৃতা করেন তোফায়েল আহমেদ, নুরে আলম সিদ্দিকী, আ,স,ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আবদুল মান্নান প্রমুখ। এই সভায় ডঃ কামাল হোসেন ও আমি উপস্থিত ছিলাম। জনতা সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি কামনা করছিল। আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠক উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু ও সংসদ সদস্যরা হোটেল পূর্বাণীতে উপস্থিত হয়েছেন।

বেলা সাড়ে চারটায় হোটেলে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আমরা যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে পূর্ণ দিসব হরতাল পালনের আহবান জানান। তিনি বলেন, আগামী ৭ই মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে এক জনসভায় তিনি ভবিষ্যত কর্মসূচী ঘোষণা করবেন। শেখ সাহেব সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে হোটেল প্রাঙ্গনে হাজার হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎ কর্মসূচী গ্রহনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়। তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য হবে।

২রা মার্চ থেকে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের শুরু হয়। নীতি নির্ধারনী বিষয়াদি ঠিক করার জন্য প্রতিদিন এই বৈঠক বসে। বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, তাজউদ্দিন আহমদ এবং এ,এইচ এম কামরুজ্জামানকে নিয়ে দলীয় হাইকমান্ড গঠন করা হয়। তাজউদ্দিন আহমদকে কর্মসূচী বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁকে সাহায্য করার জন্য ডঃ কামাল হোসেন এবং আমাকে বলা হয়। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে সংগ্রাম কমিটির গঠনের জন্য সকল জেলা, মহকুমা ও থাকাকে নির্দেশ দেয়া হুয়। আমার দায়িত্ব ছিল প্রতিদিন সন্ধ্যায় সকল জেলার সংগ্রাম পরিষদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা। তাছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী সংস্থার সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার দায়িত্বও আমার ওপর ছিল। ব্যাংক কর্মচারী, ডাক, তার, টেলিফোন বিভাগের কর্মচারীদের সাথে আমরা যোগাযোগ করি। তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ডঃ কামাল হোসেন ও আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় বৈঠকে বসে আন্দোলনের কর্মসূচী তৈরী করি। এসব বৈঠক কখনও বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আবার কখনও ডঃ কামালের চেম্বারে অনুষ্ঠিত হত। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবেলার তীক্ষ্ণ মেধাশক্তি ছিল তাজউদ্দিন আহমদের। মাঝে মাঝে ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তা বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন। টেলিফোন বিভাগের একজন বড় অফিসার নুরুল হক সাহেব তখন খুবই সহযোগিতা করেন। তাঁকে পাক বাহিনী ২৫শে মার্চের রাতে হত্যা করে।

পশ্চিম পাকিস্তানে সকল প্রকার টেলেক্স, তার বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধুমাত্র বিদেশী সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট কথায় টেলেক্স সুবিধা দেয়া হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আমরা তিন জন উদ্ভূত অবস্থার প্রেক্ষিতে একটা খসড়া তৈরী করে রাত আটটার দিকে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতাম। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে বঙ্গবন্ধু তার সমাধান করে দিতেন। এরপর সংবাদপত্রে যা দেয়ার তা দিয়ে দেয়া হত। নতুন কোন সিদ্ধান্ত থাকলে জেলা সংগ্রাম কমিটিকে জানিয়ে দেয়া হতো। সে সময় চট্টগ্রাম এবং খুলনা আন্দোলনের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম,এ, হান্নান, আবদুল হান্নান প্রমুখ এবং খুলনা থেকে শেখ আবদুল আজিজ আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ঢাকা শহরের আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে সর্বদা সতর্ক রাখা হয়। তাছাড়া জনগনের সুবিধার্থে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে লাইব্রেরী কক্ষটিকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এখানে থাকতেন। তাজউদ্দিন আহমদ এবং ডঃ কামাল হোসেন নীতি নির্ধারণী হাইকমান্ডের বৈঠকে প্রায়ই ব্যস্ত থাকতেন বলে অফিসের দায়িত্ব বেশীরভাগ সময় আমাকে পালন করতে হত। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের লোক নানা সমস্যা নিয়ে ছুটে আসতেন। সারা দিন ধরে বাজত টেলিফোন। এগুলির সঠিক সমাধানের দায়িত্ব ছিল কন্ট্রোল রুমের। বাসভবনের নীচের কক্ষটিতে টেলিফোন ও কাগজপত্র নিয়ে আমরা কাজ করতাম। হাইকমান্ডের অধিকাংশ বৈঠক হত বঙ্গবন্ধুর কক্ষে। বাড়ির প্রাঙ্গণে সর্বদাই থাকত অগণিত উৎফুল্ল জনতা ও সাংবাদিকদের ভিড়।

৩রা মার্চ ছাত্রলীগ আয়োজিত পল্টনে বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় দেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ রাখার আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই সঙ্গীতকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ঘোষণা করায় হয়। তাছাড়া সেদিনের সভা মঞ্চে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাও দেখা যায়।

৬ই মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পুনরায় ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের আহবান করেন। বাংলার মাঠে ঘাটে, হাটে বাজারে সর্বত্র আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। এদিকে বিভিন্ন স্থানে সামরিক জান্তার গুলীতে বেশ কিছু লোক হতাহত হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। বঙ্গন্ধু ১লা মার্চ নিজেই বলেছেন ৭ই মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী ঘোষণা করবেন। বিভিন্ন দেশ থেকে থেকে বহু সাংবাদিক বাংলাদেশে আসেন। ধানমন্ডির ৩২নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭ নম্বর বাড়ী সংগ্রামের সূতিকাগারে পরিণত হয়। সকালে বিকালে দেশী বিদেশী সাংবাদিক এই বাড়ীতে এসে ভীড় জমান। তারা সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধুর নিকট থেকে বিভিন্নভাবে আন্দোলন ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচী জানতে চান।

আর পাক বাহিনীও সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকে। শোনা যায়, রেসকোর্সের জনসভাকে লক্ষ্য করে ঢাকা সেনানিবাসে কামান বসানো হয়। শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তাহলে জনসভায় গোলা বর্ষণ করা হবে।

ইতিমধ্যে লক্ষ্য করলাম বঙ্গবন্ধু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। সারা দেশের মানুষের প্রাণঢালা ভালবাসা ও সমর্থন তাঁকে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে। তখন তাঁর প্রতিটি কথাই ছিল বাঙ্গালির মনের কথা।

বঙ্গবন্ধুর মনের কথা তাজউদ্দিন আহমদের জানা ছিল। বঙ্গবন্ধুর ইঙ্গিতই তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল। বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের খসড়া আমরা রচনা করে দিতাম। নেতার নির্দেশ অনুযায়ী তা করা হতো। তাজউদ্দিন আহমদ মুষ্টিবদ্ধ হাত মুখে রেখে কান পেতে কথা শুনতেন। একজন নিখুঁত শিল্পীর মত আমাদের রচিত খসড়াগুলো তিনি শুনতেন। এরপর তিনি বক্তব্যের খসড়া বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যেতেন। আমাদের রচিত খসড়া বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর পছন্দ হতো। কোন কোন সময় তিনি কিছু পরিবর্তন করতেন।

৭ই মার্চের বক্তৃতা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনার পর বক্তব্যের ব্যাপারে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে খসড়া বক্তব্য লিখার নির্দেশ দেন। ৭ই মার্চ অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসে রেসকোর্সের ময়দানে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি সেদিন তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতির পথ নির্দেশ করেন। তিনি বাঙালি জাতির দীর্ঘদীনের ক্ষোভ, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের কথা উল্লেখ করেন, বাঙালি জাতিকে মরণপন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তির বাণী শোনান। বক্তৃতা একদিকে ছিল যেমন আবেগময়ী, অপরদিকে ছিল নির্ভুল যুক্তি ও গভীর আত্মপ্রত্যয়ী।

প্রকৃতপক্ষে পহেলা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়। বক্তৃতার পর বঙ্গবন্ধু বলেন আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এখন দেশবাসীর দায়িত্ব হল হানাদার বাহিনীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা। বাংলার মুক্তিপাগল মানুষ সে দায়িত্ব পালন করেছে একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর।

কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতাকে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সাথে তুলনা করেন। বঙ্গবন্ধু জীবনে ৭ই মার্চের আগে ও পরে অসংখ্য বক্তৃতা করে গেছেন। ৭ই মার্চের বক্তৃতার সাথে তাঁর অন্য কোন বক্তৃতার তুলনা হয় কি? মুক্তিযুদ্ধকালে ৭ই মার্চের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই আমি মনে করি, ৭ই মার্চের বক্তৃতা এক অনন্য বক্তৃতা, যারা সাথে পৃথিবীর অন্য কোন বক্তৃতারই তুলনা চলে না। তাই বাঙ্গালি জাতি যতদিন বিশ্বের বুকে বেঁচে থাকবে ততদিনই এই বক্তৃতার দ্বারা আলোড়িত হবে। বাঙালি জাতির জীবনে এই বক্তৃতা অক্ষয় ও অম্লান হয়ে থাকবে।

৭ই মার্চের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের নয়া কর্মসূচী ঘোষণা করেন। দেশের সর্বত্র শহরে বন্দরে নগরে গ্রামে গঞ্জে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জনসভা, বিক্ষোভ মিছিল ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৫ই মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। এই নির্দেশের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সর্বময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৭ই মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। এদিন সকালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের এক বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মতামত ব্যক্ত করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। বৈঠকে উপস্থিত দুই-একজন ছাড়া সকলেই এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে পাক সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবেলা সশস্ত্রভাবেই করতে হবে। এই বৈঠকে অন্য একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেটা হল এই পরিস্থিতিতে আমরা বিদেশের কাছ থেকে কি রকম সাড়া বা সাহায্য পেতে পারি।

আমি এই বৈঠকে আমার-বক্তব্য তুলে ধরি। চার্চিলের ‘উই আর এলোন অন দি ব্রিজ’ এই উদ্ধৃতি দিয়েই বক্তৃতা শুরু করি। বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে বিদেশের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। সত্তরের ১২ই নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়ের পর বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন বাড়তে থাকে। এরপর জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর ঐতিহাসিক আন্দোলনের খবর বহির্বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিদেশের কোন সরকারের কূটনৈতিক বা উচ্চপর্যায়ের লবির সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে তুলনায় আমাদের বলতে গেলে কোন যোগাযোগই ছিল না।

আমার বক্তৃতার পর তাজউদ্দিন আহমদ বক্তৃতা করেন। তিনি আমার বক্তব্য সমর্থন করে কর্তব্য সম্পর্কে ইঙ্গিত দেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও জনগনের ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যুদ্ধে পাকিস্তানের সাথে মোকাবেলা আমাদের সম্ভব নয়। তাই সংগ্রামকে গণভিত্তিক সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত করতে হবে। সভাপতির ভাষণে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র যুদ্ধের মোকাবেলায় সকলকে প্রস্তুত থাকার ইঙ্গিত দেন।

এদিন ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার সহকর্মীদের সাথে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের আলোচনা অব্যাহত থাকে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদের আহ্বানে প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। ঐ দিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ বাংলাদেশের সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

ঐদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টের কাছে শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া পেশ করা হয়। এই খসড়াটির মূল অংশগুলো মেনে নেয়া হবে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটা ধারণা দেয়া হয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবার কথা পরবর্তী বৈঠকে। ২৪শে মার্চ প্রেসিডেন্টের পক্ষ নীরব থাকে এবং সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতন শুরু করে। ইতিমধ্যে আমরা খবর পেয়ে গেছি যে প্রত্যহ বিমানে করে পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম থেকে আমরা খবর পেলাম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ‘সোয়াত’ জাহাজে করে অস্ত্র এসেছে। বঙ্গবন্ধু হাজী গোলাম মোর্শেদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার কাছে একটি নির্দেশ প্রেরণ করেন। খবরটি ছিল সোয়াত জাহাজ থেকে যেন অস্ত্র নামাতে না দেয়া হয়। এ ব্যাপারে মেজর জিয়া কোন সক্রিয়া ভূমিকা পালন না করায় পরবর্তীকালে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয় নি।

২৩শে মার্চ সকালে ঢাকা থেকে সকল জেলা সদরে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম কমিটির কাছে একটি নির্দেশ প্রেরণ করা হয়। নির্দেশে বলা হয়, যেকোন সময় পাক বাহিনী আমাদের ওপর হামলা চালাতে পারে। পাল্টা আঘাত হানার জন্য সকলকে প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের পতাকা ইতিমধ্যেই দেশের সর্বত্র তৈরী হয়ে গেছে।

২৪শে মার্চ বিকেল থেকেই বঙ্গবন্ধু সকলকে ঢাকা ছেড়ে যাবার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর পেছনের ঘরে প্রায় প্রত্যেকের সাথে এক মিনিট করে কথা বলেন। অনেক সময় ভিড়ের মধ্যে বাথরুমেও কারো কারো সাথে তিনি কথা বলেন।

২৫শে মার্চ তারিখেও এ ধরনের শলাপরামর্শ চলে। বঙ্গবন্ধু একে একে সকলকে বিদায় দিচ্ছেন। বিকেল থেকেই যেন ৩২ নম্বরের বাড়ীতে থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে। বিকেল প্রায় ৪ টায় আমার বন্ধু তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব রিজভী বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কথা বলার সময় আছে কিনা। সময় থাকলে তার সাথে চা খেতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। রিজভীর বাসা বঙ্গবন্ধুর বাড়ী থেকে ২০০ গজ দূরে। আমি রিজভীর সাথে তার বাসায় গেলাম। রিজভী আমাকে বলেন, অস্বাভাবিক একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এদেশ বসবাসের কোন যোগ্য থাকবে না। তিনি এখনই স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সেনানিবাসে তার ভগ্নিপতির বাসায় চলে যাচ্ছেন। রিজভী তার পাঠান দারোয়ানের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, আমি কোন সময় গেলে যেন আমাকে থাকার আশ্রয় দেয়া হয়। তিনি বলেন, ইচ্ছা করলে আমি তার বাড়ী ব্যবহার করতে পারি। পেছনের একটি দরজা দেখিয়ে বলেন, বিপদের সময় পলায়নের রাস্তা রয়েছে। পরে জেনেছিলাম শহিদুল্লাহ কায়সার কিছুদিন আগে এই বাড়ীতে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফিরে এসে তাড়াতাড়ি হাতের কাজগুলো শেষ করি। রিজভীর কাছে শোনা বক্তব্য এক ফাঁকে বঙ্গবন্ধুকে জানাই। বঙ্গবন্ধু শুনে গম্ভীর হয়ে যান। এর ক’দিন পূর্বে এরকম পরিস্থিতিতে আত্মগোপনের কথা নিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করি। আমরা বঙ্গবন্ধুকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মগোপনের জন্য চাপ দেই। তিনি আত্মগোপনের কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, আত্মগোপনের জন্য তিনি পূর্ব থেকেই বঙ্গবন্ধুকে বলে আসছেন। তিনি কিছুতেই রাজী হচ্ছেন না।

বঙ্গবন্ধু একদিন তাঁর বেডরুমে হাইকম্যান্ডের বৈঠকের সময় তাজউদ্দিন আহমদ ও আমাকে ডাকেন। আমি আমার সহ-হুইপ আবদুল মান্নানকে নিয়ে সেখানে যাই। বৈঠকে আত্মগোপনের জন্য আমরা সকলে মিলে বঙ্গবন্ধুকে চাপ দেই। তিনি প্রশ্ন করেন আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগোপন সম্ভব না। আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।

২৫শে মার্চ বিকেলে আমার আবার ইচ্ছা হলো আত্মগোপন করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ জানাই। মনে মনে ঠিক করলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন আসলে সকলে মিলে বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় শেষ অনুরোধ জানাবো। তাঁরা দু’জন অন্য কাজে বাইরে ছিলেন। আমি জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর শেষ বক্তব্যের খসড়া তৈরী করতে ব্যস্ত। আমার খসড়া প্রস্তুত হলো। বঙ্গবন্ধু একটু দেখে ঠিক করে দেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সামনে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করেন।

আমি বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে বেরিয়ে পাশে বদরুন্নেছা আহমদের বাসায় খোঁজ নিতে যাই। নুরুদ্দিন ভাই বলেন, সেনানিবাস থেকে শিগগিরই ট্যাংক বেরিয়ে আসবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো জনতার ওপর আক্রমণ শুরু হবে। আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে ফিরে এসে দেখি তিনি ওপরে চলে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে আবার বেরিয়ে আসি। আমি এখনো আশায় করছি তাজউদ্দিন আহমদ ও কামাল হোসেনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে শেষ আলোচনা করবো। তাজউদ্দিন ভাইয়ের বাড়ীতে গিয়ে দেখি নূরজাহান মোর্শেদ এম,পি বসে আছেন। বাড়ীর ভেতরে তাজউদ্দীন ভাই জোরে জোরে ভাবীর সাথে কথা বলছেন। কথা বুঝলাম তাজউদ্দিন ভাইয়ের মন খারাপ। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছু না বলেই বাড়ি ত্যাগ করি। উদ্দেশ্য কামাল হোসেনের সাথে দেখা করা। গাড়ীতে নূরজাহান মোর্শেদকে নিয়ে নিলাম। তাকে নামিয়ে আমার বাসায় আসার পথে দেখি পাক সৈন্যরা বেতার ভবন দখল করে নিয়েছে।

সার্কিট হাউজ রোডের ৪ নম্বর বাড়ীতে আমি থাকি। কামাল হোসেন থাকেন ৩নম্বর বাড়ীতে। আমার বাড়ীতে যাওয়ার পূর্বে কামাল হোসেনের বাড়ীতে যাই। তিনি বাড়ীর বাইরে দাঁড়িয়ে আহমেদুল কবীর ও তাঁর স্ত্রীকে বিদায় দিচ্ছেন। বিদায়ের সময় লম্বা না করার জন্য আমি তাঁদের তাড়া দিলাম। তাঁদের বিদায় দিয়ে ডঃ কামাল কি করা যা বলে আমাকে জিজ্ঞেস করেন। বললাম পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনি প্রস্তুত হোন। আমি বাসায় লীলাকে বলে আসি।

১ লা মার্চ থেকে বাড়ীতে দুপুরে খাওয়ার সময় আসি। স্ত্রী ও পুত্র-কন্যার সাথে এক প্রকার কথাবার্তা হয় না বললেই চলে। আমার শ্বশুর আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খান সাহেব এম, ওসমান আলী ১৯শে মার্চ ইন্তেকাল করেন। স্ত্রী তখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পিতৃহারা স্ত্রীকে সান্তনা দেয়ার সময়ও আমার হয়ে ওঠে নি।

ঘরে প্রবেশ করে লীলাকে বললাম, আমাকে এখন চলে যেতে হবে। সে শুধু জানতে চাইলো আমার কাছে টাকা আছে কিনা। পকেটে ২/১০ টাকা থাকতে পারে। আমার পরনে পাজামা, গায়ে পাঞ্জাবী, আর পায়ে সেন্ডেল। ‘ভালো থাক’ এ কথা বলেই স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। পূর্বের মত দেয়াল টপকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে কামাল হোসেনের বাসায় আসি। তিনি প্রস্তুত ছিলেন।

পথে দেখি শাহবাগের মোড়ে জনতা গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে। এই পথে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। বহু কষ্টে কর্মীদের সহযোগিতায় রাস্তার ব্যারিকেড সরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় পৌছি। বঙ্গবন্ধু যে আত্মগোপন করতে নারাজ গাড়ীতে ডঃ কামালকে সে কথা জানাই। ৩২ নম্বরের বাড়ীতে প্রবেশ করে দেখি বঙ্গবন্ধু নীচের তলায় খাবার শেষ করেছেন। দৃশ্যটি দেখে আমার ‘লাস্ট সাপারের’ কথা মনে পড়লো। বঙ্গবন্ধুর পরনে লুঙ্গি ও গায়ে গেঞ্জী ছিল। আমাদের দু’জনকে দেখে তিনি দরজায় আসেন। আমরা সংক্ষেপে শহরের অবস্থা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের সাথে চলে যাবার জন্য পুনরায় অনুরোধ জানাই। বঙ্গবন্ধু তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল। তিনি বললেন, তোমরা প্রতিজ্ঞা পাঠ করেছ, আমি যা নির্দেশ করবো তাই শুনবে। তারপর তিনি আমাদের দু’জনের পিঠে দু’হাত রেখে বলেন, ‘কামাল, আমিরুল আমি কোনদিন তোমাদেরকে কোন আদেশ করিনি। আমি তোমাদের আজ আদেশ করছি, এই মুহূর্তে তোমরা আমার বাড়ী ছেড়ে চলে যাও। আর তোমাদের দায়িত্ব তোমরা পালন করবে’। আর শহরের অবস্থার কথা শুনে তিনি বলেন, আমি বাড়ী ছেড়ে চলে গেলে হানাদাররা আমার জন্য ঢাকা শহরের সকল লোককে হত্যা করবে। আমার জন্য আমার জনগণের জীবন যাক এটা আমি চাই না।

বঙ্গবন্ধুর বাড়ী থেকে মোহাম্মদ মুসার বাড়ীতে যাই। আমার গাড়ী সেই বাড়ীতে রেখে মুসার গাড়ীতে উঠি। মুসার ড্রাইভার গাড়ী চালায়। আমরা তাজউদ্দিন আহমদের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হই। তাজউদ্দিন ভাইকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করি। তাঁকে জানাই, বঙ্গবন্ধু সকলকে আত্মগোপনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ইতস্তত করেন।

এ সময়ে বি ডি আর এর একজন হাবিলদার এসে আমাদের বলে গেলেন, বি ডি আর এর সকল বাঙ্গালি সদস্যরা বেরিয়ে পড়েছে। আজ রাতে তারা পাক বাহিনীর হামলার আশংকা করছে। তাজউদ্দিন ভাইকে তাড়াতাড়ি তৈরী হতে বললাম। তিনি ভেতরে গেলেন। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ডঃ কামালকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছিল। ডঃ কামাল গাড়ীযোগে অন্যত্র যেতে চাইলেন। আমি বললাম, এটা ঠিক হবে না। তাজউদ্দিন আহমদের কিছুটা দেরী হলো। তিনি বেরিয়ে আসলেন। তাঁর পরনে লুঙ্গি ও গায়ে পাঞ্জাবী। কাঁধে একটি ব্যাগ ঝোলানো রয়েছে। আর তাঁর ঘাড়ে একটি রাইফেল। তাঁর এই বেশ দেখে আমি বললাম, শিকারে যাচ্ছেন নাকি?

তাজউদ্দিন ভাই গত কিছুদিন যাবৎ আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথা বলছিলেন। তিনি ইতিমধ্যে রাইফেল ট্রেনিং নিয়ে নিয়েছেন। আরহাম সিদ্দিকী তাঁকে এই রাইফেল যোগাড় করে দেন। কিন্তু এই রাইফেল পরবর্তীকালে আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। রাইফেল বেশী দূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়
নি।

সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো এই এলাকায় পাক সৈন্য এসে যাবে। পুরাতন ঢাকার একটা বাড়ীতে সকলের একত্র হবার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবন থেকে বাইরে আসতে রাজী না হওয়ায় সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ী ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্তে নেতাদের মন ভেঙ্গে যায়। তাজউদ্দিন আহমদ ভগ্নমনোরথ অবস্থায় বাড়ীতে বসে ছিলেন। তিনি নিজেকে এক রকম ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। আঘাত হানার পূর্বেই আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার চেষ্টা করি। এরপর ভাবলাম, ১লা মার্চ থেকে তাজউদ্দিন আহমদ, ডঃ কামাল হোসেন ও আমি একত্রে কাজ করেছি। এই ৩ জনকে যেকোন মূল্যে একত্রে থাকতে হবে। ১৫ নম্বর সড়কের কাছাকাছি এলে ডঃ কামাল গাড়ী থামাতে বলেন। তিনি বলেন, সকলে এক বাড়ীতে না থেকে আমি এখানে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ীতে থেকে যাই।

আমার চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধা দিতে পারলাম না। তবে মনে মনে খুবই বিরক্ত হলাম। কামাল হোসেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু তার একক সিদ্ধান্ত নেয়ার ধরনটা মেনে নিতে পারলাম না। তবুও কামাল হোসেন গাড়ী থেকে নেমে গেলেন। কথা রইলো পরদিন সুযোগ পেলেই তিনি মুসা সাহেবের বাড়ীতে যাবেন। আমরাও সেখানে যাব, না হয় যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেব। কিন্তু এটা আর হয়ে ওঠেনি। ডঃ কামাল মুসা সাহেবের বাড়ী যেতে পারেন নি, আর আমরাও পারি নি ডঃ কামালের সাথে যোগাযোগ করতে। পরবর্তীকালে তিনি পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। নির্যাতিত হন পাকিস্তানী কারাগারে। আর আমরা বঞ্চিত হই তার সুযোগ্য নেতৃত্ব থেকে। ডঃ কামালের সেদিনের একক সিদ্ধান্ত আজও আমাকে পীড়া দেয়। যদ্দিন তিনি পাকিস্তানী কারাগার থেকে ফিরে না এসেছেন, তদ্দিন নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয়েছে। কেন সেদিন জোরে বাধা দিতে পারিনি।

ইতিমধ্যে ধানমন্ডির বিদ্যুৎ চলে গেলো। রাস্তা জনমানব শুন্য। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের দুই একটা গাড়ী মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর মত দেখা যায়। কালবিলম্ব না করে লালমাটিয়ায় রেলওয়ের এককালের চীফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়ীর কাছে গিয়ে দু’জন নেমে গেলাম। ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে মুসা সাহেবের বাড়ী চলে গেলো।

গফুর সাহেব আমাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। আমরা তাকে পূর্বে কোন খবর দেইনি। তবুও তিনি আমাদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করলেন। আমরা বাড়ীতে ঢুকার ৫/৭ মিনিটের মধ্যেই এক প্রচণ্ড শব্দে সমস্ত ঢাকা শহর কেঁপে উঠলো। পরে জেনেছি এটা ছিল আঘাত শুরু করার সংকেত।

শুরু হলো চারদিক থেকে ব্রাশ ফায়ার। অবস্থা জানতে আমি ও তাজউদ্দিন ভাই বাড়ীর ছাদে যাই। পাক বাহিনীর ব্যপক হামলার মাঝে আমাদের ছেলেদের ৩০৩ রাইফেলের বিচ্ছিন্ন শব্দ। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পাই। পাশাপাশি মোহাম্মদপুরের কয়েকটি বাড়ি থেকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনা গেলো। আমরা মোহাম্মদপুরের কাছাকাছি ছিলাম। তবে একদিক থেকে আমাদের বাড়ী নিরাপদ মনে হলো। কেননা অবাঙালি অধ্যুষিত মোহাম্মদপুর এলাকায় পাক বাহিনী কোন হামলা করবে না। আক্রমণের ব্যাপকতা ও আকস্মিকতায় আমরা একেবারে ‘থ’ হয়ে গেছি।

আমাদের ওপর হামলা হবে একথা জানতাম। সেটা হবে রাজনীতিবিদ, ছাত্র ও কর্মীদের ওপর। কিন্তু আধুনিক সমর সজ্জিত পাক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা ভাবতে পারি নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের নজির আর কোথাও দেখিনি। গফুর সাহেবের বাড়ীর অসম্পূর্ণ ছাদের ইট-সুরকির ওপর বসে আমরা দু’জন পাক সৈন্যদের হামলার মুখে ভয়ার্ত মানুষের আর্তচিৎকার শুনছি। এক সময় তীব্র নীলাভ এক উজ্জ্বল আলোতে ঢাকা শহর আলোকিত হয়ে উঠল। বিভিন্ন স্থানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের কালো ধোঁয়ায় ঢাকার আকাশ ক্রমশঃই কালো হয়ে উঠছে।

মধ্যরাতের দিকে ব্রাশ ফায়ার ও বিকট শব্দ শুনে তাজউদ্দিন বলে ওঠেন, এবার দস্যুরা ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে হামলা করছে। এ সময় তিনি কেঁদে উঠলেন। বঙ্গবন্ধু কি তাঁর বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন? বঙ্গবন্ধু যখন কোন অবস্থাতেই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে অসম্মত হন, তখন আমাদের সর্বশেষ অনুরোধ ছিল, তাঁর বাড়ীর পেছনে জাপানীদের অফিসে যেন তিনি চলে যান। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কথা, তাঁর পরিবার পরিজনের কথা, দলের বিভিন্ন নেতাদের কথা বার বার মনে হতে লাগলো।

এক সময় আমরা দুইজন ছাদ থেকে নেমে এলাম। নীচে এসে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। শুধু ভাবছি আর ভাবছি। এমনিভাবে রাত ভোর হতে চলল। চারদিক থেকে গুলির শব্দ আসছে। শরীর ও মন অবসন্ন হয়ে উঠছে।

সকালে আমি বাথরুমে গেলাম। আয়নায় নিজের চেহারা দেখলাম। মনে হলো এক রাতে একটা শতাব্দী পার হয়ে গেছে।

পাশে পড়ে ছিল গফুর সাহেবের ব্লেড। ১৯৬১ সালে লণ্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ার সময় সযত্নে রক্ষিত ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি কেটে নিলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর তাজউদ্দিন ভাই অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকালেন। বুঝলাম, দাড়ি কাটা কাজ দেবে। ২৬ শে মার্চ সকালে দু’জন বসে গত রাত থেকে ঘটনাগুলো বুঝবার চেষ্টা করলাম। নিজেদের কর্তব্য স্থির করতে দেরী করিনি। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রথম কাজ হলো এই বাড়ী ত্যাগ করা। বাড়ীর সামনে দিয়ে পাক বাহিনীর টহলদার জীপ আসা-যাওয়া করছে। রুমাল বেঁধে কিছু লোক জীপে করে পাক সেনাদের সাথে ঘুরছে। তারা বাঙালি নেতা-কর্মীদের বাড়ীঘর, অবস্থান পাক বাহিনীকে দেখিয়ে দেয়ার কাজে সহায়তা করছে আন্দাজ করলাম।

স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির একটি চালাঘরে কয়েকজন কর্মী আত্মগোপন করে রয়েছে। তাদের কাছে একটা রেডিও ছিল। ওরা রেডিওর খবরাখবর শুনছে।

২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বক্তৃতা দেন। আমরা দেয়ালে কান পেতে বেতারে ইয়াহিয়ার বক্তৃতা শুনি। পাক প্রেসিডেন্ট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিষোদ্গার করেন। জনগনের শতকরা ৯৭ ভাগ ভোট লাভকারী আওয়ামী লীগকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেআইনী ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়ার গলা থেকে সুতীব্র ক্রোধ বেরিয়ে আসে। ইয়াহিয়ার বক্তৃতা ও গত কয়েক ঘন্টার নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমরা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি।

দু’জনে ঠিক করলাম, পাক বাহিনীর এই বর্বরোচিত হামলার খবর যে কোন ভাবে বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে। ২৫ শে মার্চে ঢাকার গণহত্যার খবর ভারত কিংবা বিশ্বের কোন বেতারে প্রচারিত হয় নি। তবে ২৬ শে মার্চ রাতে অস্ট্রেলিয়া বেতার ঢাকার গণহত্যর খবর প্রচার করে।

পাক বাহিনী আমাদের বাড়ী সার্চ করতে পারে এই আশংকায় আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ি। প্রথম সমস্যা তাজউদ্দিন আহমদের রাইফেল। যদ্দিন আমরা এই বাড়ীতে ছিলাম, এর সমাধান করতে পারি নি। দ্বিতীয় সমস্যা, আমরা তিনজন পুরুষ মানুষ ছাড়া এ বাড়ীতে কোন মেয়ে মানুষ নেই। মেয়ে লোক না থাকাতে আমাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে।

এই অবস্থায় তাজউদ্দিন ভাই এর নাম মহম্মদ আলী আর আমার নাম রহমত আলী ঠিক করে নেই। সার্চ হলে বলা হবে মহম্মদ আলী চাঁদপুরে গফুর সাহেবের ঠিকাদারীর কাজ তদারকি করেন। আর আমার বাড়ী পাবনা, আমি গৃহস্বামীর ভাই এর ছেলে। ঢাকায় বেড়াতে এসেছি।

২৬শে মার্চ সারাদিন গফুর সাহেবের বাড়ীতে আটক থাকি। বাইরএ কার্ফু। চারদিকে মিলিটারী জীপ টহল দিচ্ছে। ফিজিক্যাল এডুকেশন কলেজের উপর সেনাবাহিনীর ক্যাম্প করেছে। উপরে সার্চ লাইটের মতো কি যেন একটা বসানো হয়েছে। এটা দেখে মনে হয় একটা যুদ্ধের ছাউনী। কলেজের ছাদের ওপরে মেশিনগান তাক করে ওরা কন্ট্রোল রুম থেকে সকল এলাকা পাহারা দিচ্ছে। আমরা যে বাড়ীতে আছি সে বাড়ী থেকে সব দেখা যাচ্ছে। আমরা আশংকা করছি যে কোন মুহূর্তে বাড়ী বাড়ী তল্লাশী শুরু হতে পারে।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করলাম, কার্ফু ও গোলাগুলির মধ্যেও সাধারণ মানুষের গতি অব্যাহত রয়েছে। সামনে রাজপথ নিয়ে লোকজনের চলাচল নেই। কিন্তু ভেতরের রাস্তা দিয়ে সাধারণ মানুষ চলাচল করছে। ছোট ছোট ছাপড়া দোকানগুলো ঝাপ উঠিয়ে সওদা বিক্রয় করছে। কাজের মেয়েরা কলসী দিয়ে পানি নিচ্ছে। মনে মনে ঠিক করলাম, সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গেলে আমার চলাচলেও কোন অসুবিধা হবে না।

আমি একাই বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়ি। যে কোনভাবে সাত মসজিদ রোড পার হতে হবে। আমার অবস্থান থেকে সাত মসজিদ রোড বেশ দূরে। আমার খুবই পরিচিত কুষ্টিয়ার আতাউল হক সপরিবারে সাত মসজিদ রোডের কাছাকাছি থাকেন। গলি দিয়ে পার হচ্ছি। পথে একজন মৌলানাকে পেলাম। এমনিতেই তার সাথে কথা বলি। তিনি লালমাটিয়ার পুরাতন অধিবাসী। মৌলানা সাহেব আতাউল হককে চিনেন। তার সাহায্যে আতাউল হকের বাড়ীতে পৌছি। মৌলানাকে বললাম, আমি হক সাহেবের আত্মীয়, পাবনা থেকে এসেছি। ওরা আমাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারে নি। পরে জড়িয়ে ধরে বাড়ীর ভেতর নিয়ে গেল।

মৌলানাকে ঐ বাড়ীতে আমার আত্মীয় মহম্মদ আলী আছেন, তাকে নিয়ে আসার জন্য বললাম। কিছুক্ষণ পর মহম্মদ আলী এসে হাজির হলেন।

হক সাহেবের বাড়ীতে আমাদের নাশতা তৈরী করতে ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে আমি আবার বেরিয়ে পড়েছি। বিভিন্ন বাড়ীর পেছনের অলিগলি দিয়ে পথ চলছি। আমার আশংকা হচ্ছিল এই বাড়ী থেকে বেরোতে না পারলে আটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোন কোন স্থানে হামাগুড়ি দিয়ে সাত মসদিজ রোডে পৌছার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করে একটি মিলিটারী জীপ এই রাস্তায় ঢুকে পড়ে। রাস্তায় ঢুকেই ওরা এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ে। আমি একটি বাড়ির পাশে নিজেকে লুকিয়ে রাখি। জীপটি ফিরে যেতেই আমি আতাউল হকের বাড়ীতে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পর এ ধরনের গোলাগুলি চরম আকার ধারণ করে। কোথাও আগুন জ্বলছে। ভয়ার্ত মানুষের আর্তচীৎকারে পরিবেশ ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

আতাউল হকের ঘরের বেড়া ও চাল টিন দিয়ে তৈরী। টিনের বেড়া ফুটো করে গুলী যে কোন একজনের গায়ে লাগতে পারে। গৃহকর্ত্রী বলেন, পাশের পাকা বাড়ীতে চাকর ছাড়া অন্য কোন লোকজন নেই। আমরা ইচ্ছা করলে দেয়াল টপকে সেখানে যেতে পারি। তার কথায় আমি পাশের পাকা বাড়ীতে যাই। তাজউদ্দিন ভাই ঐ বাড়ীতে গেলেন না।

এলোপাথাড়ি গুলি প্রায় আধা ঘন্টা ধরে চলে। পরে শুনেছি, এটা ছিল প্রথম পর্যায়ের অপারেশন। পাক বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশকে আতংকিত করে ঢাকাবাসীকে গ্রামের দিকে ঠেলে দেয়া। বস্তি এলাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নীড়হারা বস্তির হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। ছিন্নমূল মানুষগুলো সামান্য আসবাবপত্র ও ছোটছোট ছেলেমেয়েদের কোলে দিয়ে এসেছে এখানে। কার্ফু জারী থাকা অবস্থায়ও এলোপাথাড়ি গুলি চলে। এমন সময় একটি মাইকে কেউ বলে গেল, কিছুক্ষণের জন্য কার্ফু তুলে নেয়া হয়েছে।

সে সময় একজন ছাত্র এ বাড়ীতে আসে। সে আমাদেরকে চিনতে পারে। তার মুখে শহরের টুকরো টুকরো খবর পেলাম। আমাদের প্রধান জিজ্ঞাসা ছিল ৩২ নম্বরে কি হয়েছে? ছাত্রটি সঠিক কিছু বলতে পারলো না। তবে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে দু’ধরনের খবর শুনেছে। কেউ বলেছে বঙ্গবন্ধু সরে গেছেন। আবার কেউ বলেছে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বাইরে কার্ফু না থাকায় আমরা বাড়ী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের দুজনের হাতে ১টি করে বাজারের থলি। যেন আমরা বাজার করতে যাচ্ছি। তাজউদ্দিন ভাই এর পরনে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী, মাথায় সাদা টুপি। বাজারের থলির নীচে তার নিজের ব্যাগ রাখা হয়েছে।

আমরা সাত মসজিদ রোডে পৌছি। আর একটু এগিয়ে ডান দিকে মোড় নিলে ১৯ নম্বর রাস্তা। সেটা পার হলেই রায়ের বাজার। এমন সময় আমাদের পেছনে একটি মিলিটারী জীপ এলো। জীপটি চলে যেতেই আমরা আবার রাস্তায় চলে আসি। ডানে মোড় নিলে লালমাটিয়ার সীমানা পেরিয়ে ১৯ নম্বর সড়ক। ডানে মোড় নেব এ সময় তাজউদ্দিন ভাই থমকে দাঁড়ান। আর একটু এগুলেই ডান পাশে তার বাড়ি। তিনি তার বাড়ী যেতে চাইলেন। আমি জোর আপত্তি জানাই। যুক্তি দিলাম, আপনার বাড়ী নিশ্চই আক্রান্ত হয়েছিল। হায়েনার দল এখনো বাড়ীর আশেপাশে আড়ি পেতে বসে থাকতে পারে। তাজউদ্দিন ভাই-এর মনে পড়লো তার ঔষধগুলোর কথা। সেগুলো বাড়ীতে রয়ে গেছে। বাড়ীতে আর যাওয়া হলো না।

ডান দিকে মোড় নিয়ে আমরা রায়ের বাজারে পৌছি। এখানে আওয়ামী লীগ কর্মীদের একটি শক্ত ঘাঁটি তখনো রয়েছে। নির্ভীক কর্মীরা সংগ্রাম কমিটির অফিস পাহারা দিচ্ছে। এদের সাহস দেখে একদিকে যেমন বিস্মিত হলাম, অপরদিকে আমার হাসিও পেল। কেননা প্রবল প্রতিদ্বন্দী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এ ধরনের মোকাবেলা সাহসের দিক দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দী হলেও কৌশলের দিক দিয়ে একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়।

পাক বাহিনীর হামলা তখনো আসে নি। এলাকাবাসীর মনের ভয়ের লেশমাত্র নেই। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও অন্যান্য নেতাকর্মীদের সাথে আমাদের কথা হলো। তারা আমাদের কাছে এই মুহুর্তের করণীয় জানতে চাইল। আমরা সংক্ষেপে তাদের কয়েকটি নির্দেশ দেই।

রায়ের বাজার থেকে দুজন লোককে দু’দিকে পাঠালাম। একজন গেল ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর খোঁজখবর জানতে, আর অপরজনকে পাঠালাম মুসা সাহেবের বাসায় ডঃ কামাল এসেছেন কিনা তা জানার জন্য। ৩২ নম্বরের খোঁজ নিয়ে আমাদের প্রেরিত লোক ফিরে এসে জানায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর সামনে পুলিশ নিহত হয়ে পড়ে রয়েছে। বাড়ীতে কোন লোকজন নেই। পরস্পর জানতে পেরেছে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। আর মুসা সাহেবের বাড়ীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ডঃ কামাল হোসেন সেখানে পৌছুতে সমর্থ হন নি।

সংগ্রাম কমিটির এই অফিসে চারদিক থেকে বিচ্ছিন্নভাবে খবর আসছে। মানুষের মুখে মুখে খবর প্রচার হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেল শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুল রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ প্রমূখ নদী পার হয়ে জিনজিরার দিকে চলে গেছেন। শেখ কামাল ও শেখ জামাল বাসা থেকে পালিয়ে গেছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান প্রমুখ নেতৃবৃন্দের কোন খোঁজ-খবর জানতে পারলাম না।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা এ স্থান ত্যাগ করব। সেখানে জমায়েত নেতাকর্মীদের বললাম, সংগ্রামকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক বেরিয়েছি। তারা সময়ে সময়ে নির্দেশ পাবে।

ইতিমধ্যে আমরা অনেক ভেবেছি। পাক বাহিনীর নগ্ন হামলার জবাব দিতে হবে। বাংলার দামাল যুবকদের পুনর্গঠিত করতে হবে। ২৭শে মার্চ রায়ের বাজারের কর্মীদের কাছ থেকে আমরা বিদায় নিলাম। এই বিদায় ছিল মর্মস্পর্শী। তাজউদ্দিন ভাইকে আমি বলি, এখন পথই আমাদের ঠিকানা, পথই আমাদের সঠিক পথে পৌঁছে দেবে। বিদায়ের সময় রায়ের বাজারের একজন কর্মী জিজ্ঞাসা করেন আমাদের পরিবারের জন্য কিছু বলার আছে কিনা। আমরা দু’জনে দু’টুকরো কাগজ নিয়ে কিছু লিখে তাদের হাতে দিলাম। কর্মীরা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিলেন। তাজউদ্দিন ভাইয়েরটা পৌঁছুল, আমারটা কর্মীরা পৌঁছাতে পারেনি। শুনেছি আমার বাড়ীওয়ালী কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি। আমার খোঁজে কেউ আসলে তাকে ভয় দেখাতেন।

পরবর্তীকালে দু’জনে আলাপ করে দেখেছি স্ত্রীর কাছে আমাদের দু’জনের লেখার মাঝে আশ্চর্য রকমের মিল ছিল। আমাদের বক্তব্যের সারমর্ম ছিল আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছি। কবে এর শেষ হবে জানি না। আট কোটি মানুষের সাথে মিশে যাও। যদি বেঁচে থাকি, তাহলে দেখা হবে।

আমরা আবার যাত্রা করি। তাজউদ্দিন আহমদের পায়ে কাপড়ের জুতা। হাঁটতে তার কষ্ট হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে তার পায়ে ফোসকা পড়ে যায়। জুতা খুলে তিনি হাঁটতে থাকেন।

আমরা রায়ের বাজার থেকে নদী পার হয়ে নবাবগঞ্জ থানায় যাব। অগণিত লোক পার হয়ে যাচ্ছে। পার হয়ে হেঁটে চলেছি। ঢাকা থেকে ভাগ্যাহত মানুষ যাচ্ছে। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ রয়েছে। পাক বাহিনীর বর্বর অত্যাচারে লোকজন ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মানুষের মিছিলে সর্বশ্রেণির মানুষ রয়েছে। এই মিছিলে আমরা মিশে গেছি। কেউ জানে না আমরা কারা। শুধু জানি আমিও ওদের একজন। চলতে চলতে এক সময় হয়তো এক বৃদ্ধার মাথার পুঁটলিও নিজের হাতে নিয়েছি। কখনো বা কোন ছোট শিশুকে কোলে করে পার করে দিয়েছি।

আমাদের গতি দ্রুত। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হাজার হাজার মানুষ উত্তপ্ত বালির ওপর দিয়ে চলেছে। রাস্তার দু’পাশে গ্রামের মানুষ মিছিলের মানুষকে উদার হস্তে খাওয়াচ্ছে, আশ্রয় দিচ্ছে। ডেকে ডেকে মানুষকে খাওয়াচ্ছে। আতিথেয়তার প্রতিযোগিতা ছিল প্রতিটি গৃহে। সেদিন বাঙ্গালির জন্য বাঙ্গালিদের দরদ দেখেছিলাম, এতে আমি নিশ্চিন্ত হই যে বাংলার স্বাধীনতা কেউ ঠেকাতে পারবে না।

চলার পথে একজন সিপাই যুবকের সাথে কথা হলো। তার পরনে লুঙ্গি। ২৫শে মার্চ রাতে সে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ছিল। সে রাতে কিভাবে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলো, কিভাবে তার সঙ্গী সাথীরা পাক বাহিনীর বর্বরতার শিকার হলো, এই ভয়াবহ কাহিনী তার মুখ থেকে শুনলাম। অন্য একজন সিপাই। সে মিটফোর্ড হাসপাতালে একজন রাজবন্দীর পাহারায় ছিল। অতি কষ্টে সে জীবন নিয়ে চলে এসেছে।

কাফেলাতে শুধু জীবন্ত মানুষ নয়, এখানে রয়েছে লাশ। কয়েক দিনের পুরনো লাশও রয়েছে। প্রিয়জনের মৃতদেহ ওরা ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যাচ্ছে। পথে পথে অনেক জানাজা হতে দেখলাম। ঢাকাতে যারা শহীদ হয়েছে তাদের লাশ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

পথিমধ্যে তাজউদ্দিন ভাইকে অনেকে চিনে ফেলে। একজন আওয়ামী লীগ কর্মী আমাদের আপত্তি সত্ত্বেও এক প্রকার জোর করে তার বাড়ী নিয়ে গেলেন। তার জোর দাবী কিছু মুখে দিয়ে যেতে হবে।

আমরা ক্ষুধা তৃষ্ণা এক প্রকার ভুলে গেছি। চা ও বিস্কুট খেলাম। কিছু বিস্কুট পকেটে নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করি।

যাবার আগে কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলে গেলাম, সংগ্রাম কমিটির আওতায় সব কিছু পরিচালনা করতে হবে। শত্রুদের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। শত্রুদের খবর পেলে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

পথ চলতে চলতে এক সময় বেলা পড়ে গেল। সামনে নদী। এই নদী পার হলে নবাবগঞ্জ থানা পার হয়ে আমরা দোহার থানায় যাব। খেয়া নৌকায় লোকজনকে পার করে দেয়া হচ্ছে। তবুও নদীর দু’ধারেই মানুষের ভিড়। তবে মানুষকে পার করে কেউ কোন পয়সা নিচ্ছে না। আশেপাশের মানুষ নিজেদের নৌকা দিয়ে ভাগ্যাহত জনতাকে পার করে দিচ্ছে। আমরাও অন্যান্য যাত্রীর সাথে একটি নৌকায় পার হই। নৌকাওয়ালা পয়সা নিতে রাজী হলো না।

ওপারে নেমেই দেখি একজন যুবক দাঁড়িয়ে। আমাদেরকে জড়িয়ে ধরল। সে যেন আনন্দে আত্মহারা। যুবক মোটর সাইকেল নিয়ে এসেছে। সে বলল, আপনাদের নেয়ার জন্যই আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।

মোটর সাইকেলে দুইজনের বেশী ওঠা যায় না। প্রথমে তাজউদ্দিন ভাইকে নিয়ে গেল তার গ্রামে। আমি হাটতে থাকি। পরে আমাকেও নিয়ে গেল। সে গাঁয়ে আওয়ামী লীগের এক বিশিষ্ট নেতার বাড়ীতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। স্বাভাবিকভাবেই আমরা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। বাড়ীর সামনে পানি ভরা পুকুর। সন্ধ্যা হওয়া সত্ত্বেও দু’জনে গোছল করি। এরপর বৈঠকে বসি। ইতিমধ্যে এই বাড়ীতে অনেক লোক জমা হয়ে গেছে। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা শেষে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হলো।

আহার শেষে দু’জনে এক চৌকিতেই ঘুমাতে যাই। পরদিন ভোরে আমাদের যাওয়ার জন্য ২টি মোটর সাইকেলের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের অবস্থান থেকে পদ্মার দূরত্ব ৫০ মাইল। মোটর সাইকেলযোগে রওনা হয়ে রোদ উঠতে না উঠতে আমরা সুবেদ আলী এমপি’র বাড়ীতে পৌছি। সুবেদ আলী টিপু ব্যারিষ্টারী পড়তে বিলেত গিয়েছিলেন। বিলেতে থাকাকালে তার সাথে আমার পরিচয়। তিনি একজন উৎসাহী দলীয় সদস্য।

এই বাড়ীতে আমরা আবার বৈঠকে বসি। সেখানে কৃষক নেতা জিতেন বাবুর সাথে দেখা হলো। তিনি ন্যাপ এর সদস্য। ঘন্টাখানেক পরে আমরা আবার যাত্রা করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা অপর একজন এমপি এ আশরাফ চৌধুরীর বাড়ীতে পৌঁছে যাই। গৃহস্বামী মাত্র ১ ঘন্টা আগে বাড়ী পৌঁছেছেন। তিনি ২৫শে মার্চের কালরাতে ঢাকায় ছিলেন। বিরাট দ্বিতল বাড়ী। পানি এনে স্নানের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে কিছু খেয়ে আবার পথ চলা শুরু করি। পথ দেখাবার জন্য স্কুলের একজন বাঙালি দফতরী আমাদের সাথে রয়েছেন। পদ্মার তীরে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। প্রমত্ত পদ্মার বুকে তখন প্রচণ্ড ঢেউ। কয়েকটি নৌকা তীরে বাঁধা রয়েছে। বহু অনুরোধ সত্ত্বেও কোন নৌকা আমাদের ওপারে নিয়ে যেতে সাহস পেল না। অগত্যা তীর থেকে আমরা আগারগাঁও নামক একটি গ্রামে ফিরে এলাম। আমাদের দলীয় একজন কর্মী-বন্ধুর বাড়িতে রাত্রি যাপন করি।

বাড়ীর লোকেরা তাঁতের কাজ করে খায়। স্নান করে খেতে যাব, হঠাৎ স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান কানে ভেসে আসলো। ঘোষক বেতারে বলছেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হাজির হতে বেতারে নির্দেশ দেয়া হলো। প্রথমে এদের নাম-ধাম কিছুই বুঝা গেল না। ঠাওর করে উঠতে পারলাম না, কারা কোত্থেকে এই বেতার চালাচ্ছে। পরে বেতারে মেজর জিয়ার কন্ঠ শোনা গেল। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান।

মেজর জিয়ার আহবান বেসামরিক, সামরিক তথা বাংলার সর্বশ্রেণীর মানুষকে সংগ্রামে উজ্জীবিত করে। পরদিন এই বেতার থেকে টিক্কা খানের আহত হবার কথা শুনি। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের অনেক খবর প্রচার করা হয়।

আমরা দু’জন গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম যে অবিলম্বে একটি সরকার গঠন করা প্রয়োজন। পরদিন ভোরবেলা আবার রওনা হই। পদ্মা তখন শান্ত। মাঝ নদীতে চর পড়েছে। আমাদের তাই দুই অংশে পার হতে হবে। আমাদের সাথে আশরাফ আলী চৌধুরীর স্কুলের পিওন রয়েছে।

পদ্মার ঘাটে ছোট বড় অনেক নৌকা। অনেক নৌকা খুলনা বরিশালে ধান কাটতে যাচ্ছে। আমরা ভাবছি এবারে ফসল কেটে সব নৌকা কি ঘরে ফিরতে সমর্থ হবে? এমনিভাবে ভাবতে ভাবতেই নদী পার হওয়ার জন্য নৌকায় উঠছি। সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলছি। সকলের মনেই ভীতির ভাব। এমন সময় আইডব্লিউটিএ’র একটি মোটর যান দেখা গেল শব্দ করে আমাদের দিকে আসছে। কেউ কেউ এটাকে পাক সামরিক বাহিনীর মোটর যাব ভেবে আশংকা প্রকাশ করে। আমি বললাম, এত তাড়াতাড়ি ওরা ঢাকা ছেড়ে আসতে পারে না। মোটর যানটি কাছে আসার পর দেখা গেল এতে কিছু সাধারণ যাত্রী রয়েছে। পরে শুনেছি, পাক বাহিনী যাতে ব্যবহার না করতে পারে এ জন্য শ্রমিকরা এই বোটগুলোকে নিয়ে এসেছিল।

আমরা নদীর ওপারের খবর জানি না। সেখানে একটি বাজার দেখা যাচ্ছে। একটি নৌকা করে আমরা নদীর ওপারে যাই। আর নদীর এপার থেকেই পথ দেখাতে আসা স্কুলের পিওনকে বিদায় করে দেই।

বাজারের পাশেই একটা মাঠ। মাঠে কেউ লাঙ্গল চালাচ্ছে কেউ বা অন্যান্য কাজ করছে। চারদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হলো। এই অবস্থায় আমরা বাজারে গিয়ে পৌছি। বাজারে গিয়েই সেখানকার সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের সাথে দেখা হলো।

আমরা এখান থেকে ফরিদপুর যাব। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ছাড়া অন্য কোন পথে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি পায়ে হাঁটা পথও ভাল নয়। খাল, বিল, নালা পেরিয়ে যেতে হবে। তবে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া যায়। অগত্যা আমরা দুটি ঘোড়াই ভাড়া নেই। এই বাজার থেকে ৭ মাইল দূরে ফরিদপুর শহর। ঘোড়ায় চড়ে শহরের এক প্রান্তে নামি। সেখান থেকে রিক্সাযোগে আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি ইমামউদ্দিনের বাড়িতে উপস্থিত হই। বাড়ীতে পা দিয়েই বুঝলাম লোকজন বেশ শংকিত। গত রাতে শহর থেকে লোকজন গ্রামে চলে গেছে। ঢাকা থেকে লোকজন এসে সেখানকার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বর্ণনা দিয়েছে। ঢাকার মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের কথা শুনেই লোকজন রাতের বেলা শহর থেকে চলে যায়।

ইমামউদ্দিনের স্ত্রী খুবই সাহসী মহিলা। বাড়ীতে তিনি একা। ইমামউদ্দিন বাড়ীতে নেই, তিনি সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীদের নিয়ে আশেপাশের পুলিশ ও বি ডি আর-এর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। স্ত্রীর কাছ থেকে খবর পেয়ে ইমাম সাহেব বাড়ী আসেন। তাড়াতাড়ি ডালভাত রান্না হলো। শহরের লোক আশংকা করছে এখানে যশোরের পাক সৈন্যরা যে কোন সময় হামলা করতে পারে।

আমরা সবে মাত্র খেতে বসেছি। এমন সময় খবর এলো পাক সৈন্য এদিকে আসছে। কোন দিক দিয়ে আসছে সে সময় তা বুঝা গেল না। চারদিক লোকজন ছুটোছুটি করছে প্রাণ ভয়ে। মনে মনে ঠিক করলাম এখান থেকে মাগুরার পথে রওনা হবো। সেখান থেকে যশোর সেনানিবাস ও আশেপাশের খবর পাওয়া যাবে।

স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনা শেষে আমরা ফরিদপুর ত্যাগ করি। রাস্তার বিভিন্ন অংশ কেটে দেয়া হয়েছে পাক সৈন্যরা গতি রোধ করার জন্য। একটা রিক্সাযোগে আমরা কামারখালীর পথে চলেছি। কোথাও কোথাও নিজেরা রিক্সা পার করেছি। এমন সময় ফরিদপুরের দিকে একটি জীপ আসতে দেখি। জীপটি কার তা দেখার জন্য আমরা রাস্তার আড়ালে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম জীপটিকে অসামরিক লোক রয়েছে। জীপে চালকের সাদা পোশাক পরিহিত একজন ভদ্রলোক বসা। রাস্তায় এসে জীপটি থামাবার ইঙ্গিত দেই। পরিচয় নিয়ে জানলাম তিনি রাজবাড়ীর মহকুমা প্রশাসক। নাম শাহ ফরিদ। তার কাছে টুকরো টুকরো খবর পেলাম।

শাহ ফরিদ মেহেরপুর গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি চুয়াডাঙ্গার সাথে যোগাযোগ করেছেন। তিনি জানান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তওফিক ইলাহী চুয়াডাঙ্গার পুলিশ ও বি ডি আর এর সাথে যোগাযোগ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ঝিনাইদহ, যশোর, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়ার জনগণ পাক সৈন্যের বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টি করছে। সেখানে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। এসব খবর শুনে আমরা দু’জন আশান্বিত হই।

শাহ ফরিদ আমাকে চিনল কিনা বুঝলাম না। ঢাকার পরিস্থিতি তাকে জানাই। আমি বললাম, আমরা আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে এই এলাকার পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে এসেছি। পরে শাহ ফরিদ পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।

রাজবাড়ী ও ফরিদপুরের পুলিশ ও বিডিআরদের কুষ্টিয়ার মুক্তিসংগ্রামীদের সাথে মিলিত হবার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে নি। আরো কিছুক্ষণ এগিয়ে রিক্সা ছেড়ে দেই। স্থানীয় একটি বাসে অন্যান্য কয়েকজন যাত্রীর সাথে আমরাও উঠি। কিছুদূর যেয়ে বাসটি আর যেতে পারলো না। এখন আমার সাথে অনেক যাত্রী। কামারখালী পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।

সামনে নদী পার হতে হবে। একটি মাত্র খেয়া নৌকা। যাত্রী বেশি। নদীর স্রোত অত্যন্ত প্রবল। নৌকা প্রায় ডুবে যাওয়ার অবস্থা। অনেক কষ্টে নদী পার হলাম। আকাশে চাঁদ ঝলমল করছে। হাঁটতে আমাদের বেশ সুবিধা হলো। এখান থেকে মাগুরা ৮ মাইল। আমাদের সাথে আরো অনেকে রয়েছে। তারা ঢাকা থেকে এসেছে। এদের মধ্যে কিছু ছাত্র-যুবকও রয়েছে। আমরা এদের মধ্যে অচেনা রয়ে গেছি, যেমনি ছিলাম সারা পথে। ঘনিষ্ঠ কর্মী ছাড়া কারো কাছে নিজেদের পরিচয় দেই নি।

সন্ধ্যাবেলা কামারখালী ঘাটে রেডিও শুনি। রেডিওর কাছে বহু লোক ভিড় করে। বেতারে টুকরো টুকরো খবর প্রচার হয়। ‘মুক্তিবাহিনীর গুলিতে টিক্কা খান আহত,’ পাক বাহিনী পালিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। বেতারে সকলকে সতর্ক থাকার আহবান জানানো হয়।

মাগুরা খালের ওপর কাঠের পুলটি পুড়তে দেখলাম। শত্রুদের গতিরোধ করার জন্য নিজেরাই পুল পোড়াচ্ছে। টর্চের আলোতে ওপারে সঙ্গীন দেখা গেল। বললাম, আমরা বন্ধু। পার হবার জন্য একটি মাত্র ছোট নৌকা ছিল। দুই জনের বেশী নৌকায় ওঠা যায় না। আমরা দুইজন সকলের শেষে পার হই।

ওপারে গেলে সকলের দেহই তল্লাশি করা হলো। আমার পর তাজউদ্দিন ভাই-এর পালা। মুখের দিকে তাকিয়েই তাকে জড়িয়ে ধরলো। নেতাকে চিনতে পেরেছে। তাজউদ্দিন ভাইও তাকে জড়িয়ে ধরেন।

রাত তখন অনেক। একটি রিক্সাওয়ালাকে বাড়ী থেকে ডেকে আনা হলো। আমরা দু’জনে রিক্সায় আর সে হেঁটে চলে। অনেক রাতে আমরা আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব হোসেনের বাড়ি পৌছি। সোহরাব ভাই-এর স্ত্রী রাতের বেলা আমাদের জন্য রান্না করেন। খেতে খেতে ভোর হয়ে গেল।

সোহরাব হোসেন এখান থেকে সংগ্রাম পরিচালনা করছেন। মাগুরার মহকুমা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। স্থানীয় কর্মীরা তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন।

সিদ্দিকী আমার পূর্ব পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অন্যান্য কয়েকজনের সাথে সিদ্দিকীকেও বহিষ্কার করা হয়েছিল। আমি তার পক্ষে কৌসুলি ছিলাম। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালেও সিদ্দিকী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

আমরা দু’জন ও সোহরাব ভাই জীপযোগে জেলা বোর্ডের রাস্তা দিয়ে ঝিনাইদহ পৌছি। সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আজিজের বাসায় উঠি। আমরা সেখানে পৌঁছে এসডিপিও মাহবুবউদ্দিনকে খবর পাঠাই। মুক্তিযুদ্ধকালে মাহবুবের ভূমিকা ছিল স্বর্ণোজ্জ্বল। পরে তিনি ঢাকার পুলিশ সুপার হন।

মাহবুব ঝিনাইদহে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে। আমাদের দেখে খুবই উৎফুল্ল হলো। এই কন্ট্রোল রুম থেকে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। যশোর সেনানিবাসের চারদিক জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা অবরোধ করে রেখেছে। হাজার হাজার লোক বজ্রকন্ঠে শ্লোগান দিচ্ছে সেনানিবাস পুড়িয়ে দেবার জন্য। জনতার হাতে বন্দুক, রাইফেল, বল্লম, বর্শা, দা, কুড়ালসহ স্থানীয় অস্ত্রশস্ত্র। কুষ্টিয়াতে তিন শতাধিক পাক সেনা মুক্তিবাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ।

কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ থেকে ২৮ মাইল দূরে। চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। চুয়াডাঙ্গার অবাঙালি মহকুমা প্রশাসককে হত্যা করা হয়েছে। কুষ্টিয়ার অবরোধ জোরদার করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। বিভিন্ন জরুরি নির্দেশ দিয়ে আমরা দুইজন ও মাহবুব চুয়াডাঙ্গা চলে যাই। সেখানে পৌঁছে তওফিক এলাহী ও মেজর ওসমানের সাথে ব্যাপক আলোচনা হয়। চুয়াডাঙ্গার সকল আওয়ামী লীগ কর্মীকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করি। ইতিমধ্যে আমরা চুয়াডাঙ্গা থেকে একটি বিডিআর বাহিনী কুষ্টিয়া প্রেরণ করি।

কুষ্টিয়াতে পাক সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। গ্রাম থেকে অগণিত লোক শহরে আসে। হাজার হাজার মানুষের শ্লোগানে শহর কেঁপে ওঠে। মানুষের হাতে বিভিন্ন শ্রেণীর সাধারণ অস্ত্র। পুলিশের সকল রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। অবাঙালি এডিসি সার্কিট হাউজে পাক সেনাদের সাথে অবরুদ্ধ। এডিসি নিহত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে। তিনি একজন পাক জেনারেলের আত্মীয়।

কুষ্টিয়ার সর্বশ্রেণীর লোক যুদ্ধে অংশ নেয়। এমনকি মেয়েরা পর্যন্ত। সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত, ডিম, রুটি, পিঠা, মিষ্টি ইত্যাদি পাঠায়। আমাদের অগণিত সৈনিকদের রসদের কোন অভাব হয় নি। ঝিনাইদহ থেকে খবর পাই, কিছুসংখ্যক পাক সৈন্য ভয়ে পালিয়ে গেছে ।

সারাগঞ্জ ব্রিজ আমার বাড়ির পাশে। যশোর-কুষ্টিয়ার মধ্যে সংযোগকারী রাস্তার ওপর এই ব্রীজ দিয়েই যশোর থেকে পাক বাহিনী কুষ্টিয়া আসতে পারে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ব্রীজের পাশে মাটি কেটে এর উপর চট বিছিয়ে দেয়। চটের মধ্যে আলকাতরা দিয়ে রাস্তার পিচের মত কালো করা হয়। কুষ্টিয়া থেকে পাক সেনাদের একটি পলাতক জীপ সেই খাদে পড়ে যায়। গ্রামের লোক ওদের পিটিয়ে মারে। এমনিভাবে কুষ্টিয়ার গ্রামের মানুষ পালিয়ে যাওয়া পাক সেনাদের পিটিয়ে মারে।

চুয়াডাঙ্গা থেকে খবর পাই, কুষ্টিয়াতে আমরা জয়ী হয়েছি। ওরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পলায়নোন্মুখ। এদের একজনও যশোর সেনানিবাসে ফিরে যেতে পারেনি। দুপুরে চুয়াডাঙ্গা থেকে কুষ্টিয়ার বীর জনতার প্রতি একটি অভিনন্দন বাণী পাঠাই। আমার এই বিবৃতি ভারতে কয়েকটি কাগজে প্রকাশিত হয়।

চুয়াডাঙ্গা গিয়ে তিন ভাগে বৈঠক করি। একটি রাজনৈতিক, একটি সামরিক ও অপর বৈঠকটি করি তওফিক ও মাহবুবকে নিয়ে। তওফিক একাধারে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক। সেখানে বসে পাবনার খবর পাই। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের যোগ দিয়েছেন। মাগুরা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুরে আমাদের অবস্থা ভাল। যশোর সেনানিবাস বীর জনতার দ্বারা তখনো অবরুদ্ধ।

ঢাকার অবস্থা আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। চট্টগ্রামের খবর বিপ্লবী বেতারযোগে পেয়েছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, সারা বাংলায় গণযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই যুদ্ধ চলছে। বাংলার সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশসহ সর্বশ্রেণীর লোক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। বীর জনতার মনোবল থেকে আমরা বিশেষভাবে আশান্বিত। বিভিন্ন স্থানে খণ্ড যুদ্ধে আমরা জয়ী হলেও বিশাল পাক বাহিনীর সাথে লড়াই করার মত অস্ত্রসম্ভার এই মুহূর্তে আমাদের নেই। তবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে জনতার শক্তি দানা বেঁধে উঠেছে, একে সুসংহত করতে হবে। জনযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যোদ্ধাদের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র তুলে দিতে হবে। শত্রুর কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার কৌশল আমাদের যোদ্ধাদের শিখাতে হবে।

চুয়াডাঙ্গায় তৌফিক, মাহবুব ও মেজর ওসমানের সাথে আবার বৈঠক করি। ডাঃ আসহাবুল হক আমাদের সাথে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করছেন। অস্ত্রের জন্য ভারতে যে আমাদের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।

বেলা ৩টার দিকে আমি ও তাজউদ্দিন ভাই সীমান্তের পথে রওনা হই। তওফিক ও মাহবুব আমাদের সাথে ছিল। পলায়নী মনোবৃত্তি নিয়ে সীমান্ত পার হবো না বলে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। স্বাধীন সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ্য মর্যাদা নিয়েই আমরা ভারতে যাব। স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের গ্রহণ করলেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে আমাদের আলোচনা সম্ভব।

সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট খালের ওপর একটি বৃটিশ যুগের তৈরী কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দিন ভাই ও আমি বসে আছি। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে তওফিক ও মাহবুবকে ওপারে পাঠাই।

তাজউদ্দিন ভাইকে বিষণ্ন মনে হলো। তার বিষণ্নতার কারণ জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন, ছোটবেলার একটা কথা তার মনে পড়ছে। তিনি বলতে থাকেন ছোটবেলা হিন্দু সহপাঠীরা বলতেন, তোদের পাকিস্তান টিকবে না। আমি পাল্টা জোর দিয়ে বলতাম অবশ্যই টিকবে। ছোটবেলার সহপাঠীদের কথা তার মনে পড়ছে। সূর্য ডুবু ডুবু করছে বাংলাদেশের আকাশে আবার কখন নতুন সূর্যের উদয় হবে, তা ভাবতে আমরা দু’জনেই কালভার্টের ওপর শরীর এলিয়ে দেই।
তওফিক এলাহী ও মাহবুব চলে যাওয়ার পর অনেক্ষণ কেটে গেল। ওরা ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে গেছে। জঙ্গলের ভেতর বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। জনবসতি নেই বললেই চলে।

চারদিকে আগাছায় ভরে গেছে। আরো কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। তাজউদ্দিন ভাইকে ডেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াই। শব্দ ক্রমশঃ আমাদের দিকেই আসছে। আগন্তুকরা কাছে এসেই অস্ত্র উঁচু করে সামরিক কায়দায় আমাদের অভিবাদন জানান। অফিসারটি জানান, আমাদেরকে তিনি যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ছাউনিতে নিয়ে যেতে এসেছেন।

আগন্তুক অফিসারের সাথে আমরা ছাউনিতে চলে যাই। ছাউনিতে গিয়ে জানতে পারি যে, আমাদের আগমনের খবর ইতিমধ্যে কোলকাতায় পৌঁছে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার ছাউনীতে এসে পৌঁছলেন। আমরা আমাদের সংগ্রামে ভারতে সর্বাত্মক সাহায্যের আবেদন জানাই।

মজুমদার বলেন, আপনাদের আবেদনের জবাব শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীই বলতে পারেন। তিনি জানান, আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। তার সাথে কোলকাতা যাওয়ার জন্য আমাদের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে, তার পক্ষে ছোট ছোট অস্ত্রশস্ত্র দেয়া সম্ভব। তবে দিল্লীর সাথে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব না। তওফিক এলাহী ও মাহবুবকে বিদায় দিয়ে মজুমদারের জীপে করে আমি ও তাজউদ্দিন ভাই কোলকাতা যাত্রা করি।

মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে আসেন। তিনি জানান, আমাদের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লী থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। তার এ কথা শুনে আমরা কিছুটা আশ্চর্য হই। রাতেই তার সাথে যোগাযোগ করেন। জীপ থেকে নামিয়ে আমাদের অপেক্ষাকৃত বড় কালো রঙ এর একটি গাড়ীতে তোলা হলো। বিমান থেকে ছ’ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়ীতে উঠলেন। মজুমদার তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএসএফ এর প্রধান রুস্তমজী।

রুস্তমজী এক সময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর নিরাপত্তা প্রধান ছিলেন। নেহেরু পরিবারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন।

এদিকে আমার কাপড় চোপড়ের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। গাড়ীতেই শুরু হয় আলোচনা। রুস্তমজীর প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কোথায়? মজুমদারের প্রথম প্রশ্নও ছিল এটাই। এর পরেও আরো অনেকের সাথে দেখা হয়েছে সকলেরই প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরী ছিলাম। দলীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের সাথে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে আমরা একই উত্তর দিয়েছি। আমরা যা বলতে চেয়েছি তা হলো বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাচ্ছি। তিনি জানেন, আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। সময় হলে বা প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি উপযুক্ত স্থানে আমাদের সাথে দেখা করবেন।

একটি সুন্দর বাড়ীতে (আসাম হাউজ) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দিন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজী। আমরা খুবই ক্লান্ত। স্নান করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সাথে অতিরিক্ত কোন কাপড় নেই। রুস্তমজী আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তার ইস্ত্রি করা পায়জামা ও কোর্তা দিলেন। ছ’ফুট লম্বা মানুষের কোর্তা সামাল দেয়া আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

তখন প্রায় মধ্যরাত। স্নানের কাজ সেরে নিলাম। এত রাতে খাবার পাওয়া কষ্টকর, তবুও গোলক মজুমদার আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। খাওয়ার পর টেবিলের ওপর রাখা একটি মানচিত্রের দিকে আমরা চোখ রাখি। কোনদিন যুদ্ধ করি নি বা এর কথা ভাবি নি। অথচ আজ যুদ্ধের পরিকল্পনায় অংশ নিতে হচ্ছে। রুস্তমজী রণকৌশলী। আমাদের মূল উদ্দেশ্য তাকে জানালাম। আজ রাতেই আমাদের অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আমাদের প্রথম কাজ হলো দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের একত্রিত করে তাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা। আর দ্বিতীয় কাজ হলো, মুক্তিযুদ্ধকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করা। বিএসএফ-এর বিভিন্ন প্রধানদের এই গভীর রাতে ডাকা হয়। তার যোগাযোগ প্রধানের সাথে এই রাতেই যোগাযোগ করা হলো। আওয়ামী লীগের এমএলএ, এমপিসহ নেতাদের একটি তালিকা তৈরি করে এতে তাদের সম্ভাব্য অবস্থানের কথা উল্লেখ করা হয়। এসব নেতার সাথে যোগাযোগের জন্যে এই তালিকা বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়িতে প্রেরণ করা হয়। আমরা বিশেষ ক’জন দলীয় নেতার কথা জানালাম যাদের সাথে আমাদের সহসাই যোগাযোগ প্রয়োজন। যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ, কুষ্টিয়াতে আমরা জয়লাভ করেছি এবং চুয়াডাঙ্গাতেও আমাদের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে অতি দ্রুত আমাদের সুসংবদ্ধ হয়ে উঠতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের এই খবর পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। বিএসএফ এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাসহ নেতৃবৃন্দের কাছে নির্দেশ পৌঁছে দেয়া শুরু করি।

যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসম্ভব সাহয্য দিতে বিএসএফ রাজী হলো। পরামর্শ করতে রাত প্রায় শেষ হয়ে গেল। ভোরের দিকে কিছুক্ষণের জন্য আমরা বিছানায় যাই। ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে রেডিওর শব্দ শুনি। বিএসএফ-এর চট্টোপাধ্যায় এই রেডিও দিয়েছিলেন। রেডিওতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী শুনি। আমাদের মা-বোনদের ওপর বর্বর অত্যাচারের কথা শুনে মনের অজ্ঞাতেই বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মত দু-চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো।

বিএসএফ আমাদের আতিথেয়তার ভার নেয়। চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। ৯ মাস আমাদের সাথে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে কাজ করেছেন। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো কার্যকরী করার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। একজন বিদেশী রাষ্ট্রের কর্মচারী হয়ে এমন নিষ্ঠার সাথে কাজ করেও কোন দিন কোন কৃতিত্বের দাবী করেন নি। মিঃ চট্টোপাধ্যায় আমার জন্য একটি প্যান্ট ও একটি শার্ট যোগাড় করলেন।

আমাদের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো। যেসব স্থানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান কেন্দ্র গড়ে উঠেছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কিছুক্ষণ পর চুয়াডাঙ্গার সাথে যোগাযোগ হলো। চুয়াডাঙ্গাকে আমরা বিপ্লবী সরকারের রাজধানী করার পরিকল্পনা মনে মনে ঠিক করেছি। পরদিন দেখি, সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই খবর ফাঁস না করার জন্য ডাঃ আসহাবুল হককে আমি অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, আনন্দের আতিশয্যে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছ তিনি তা বলে দিয়েছেন। ডাঃ আসহাবুল হক, মেজর ওসমান ও তওফিক ইলাহীর সাথে আমাদের ফোনে যোগাযোগ হলো। মেজর ওসমানকে বললাম তার সাথে সহসাই আমাদের দেখা হবে। তিনি বেশ প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদের একটি তালিকা তৈরী করে রাখেন।

সেদিন ছিল কোলকাতা ‘বন্ ধ’। বাংলাদেশের আন্দোলনের সমর্থনে এই ‘বন্ ধ’ ডাকা হয়। কোলকাতার জনজীবন একেবারে স্তব্ধ। গাড়ী ঘোড়া সবকিছু বন্ধ। কোলকাতার ভাইরা সেদিন আমাদের আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। কোলকাতাস্থ পাক সরকারের কার্যালয়ের চারদিকে হাজার হাজার জনতা বিক্ষোভ প্রকাশ করেন।

আমাদের জন্য একটা বাড়ী দরকার। রুস্তমজী বাড়ির সন্ধানে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পাকিস্তান কনস্যুলেট এর কাছে আমাদের জন্য একটি বাড়ি নির্বাচিত হলো।

ঘরে ফিরেই তাজউদ্দিন ভাই ও আমাই তিনটা খসড়া পরিকল্পনায় হাত দেই। এগুলো হলো দলের সাংগঠনিক, সরকার গঠন ও সামরিক পরিকল্পনার কাজ। যা মাথায় এসেছে, তাই লিখেছি। সাথে সাথে ছক কেটে তীর চিহ্ন দিয়ে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করেছি। এরপর মুক্তিযুদ্ধের জন্য সারাদেশকে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয়।

পরদিন আমাদের দিল্লী যাওয়ার কথা। বিএসএফ ও অন্যরা খুবই সাবধানতা অবলম্বন করছে আমাদের অবস্থান গোপন রাখার জন্য। পরদিন সকালে সীমান্তের দিকে যাই। খবর অনুযায়ী মেজর ওসমান অস্ত্রশস্ত্রের একটা তালিকা তৈরি করে নিয়ে আসেন। মেজর ওসমানকে কিছু অস্ত্র দেয়া হলো। এর মধ্য এলএমজিও ছিল। ইতিমধ্যে খবর এলো পাক সৈন্যরা যশোর সেনানিবাস থেকে বের হবার চেষ্টা করছে। তাকে এক্ষুনিই যেতে হবে। মেজর ওসমান সদ্য পাওয়া এলএমজি কাঁধে নিয়ে দ্রুত রওনা হলেন।

চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর অঞ্চলে স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর ওসমানের সাথে তার স্ত্রীও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। এই তেজস্বী মহিলা অশেষ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সাহসী এই বীরের স্ত্রী বেগম ওসমান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। একদিকে তিনি স্বামীকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতেন, অপরদিকে বিডিআর জোয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতেন। নিজের হাতে রান্না করে তিনি যুদ্ধ শিবিরে পাঠিয়ে দিতেন।

১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর সেনা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ওসমান নিহত হন।

১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল। আজ আমরা দিল্লী যাচ্ছি। গোলক মজুমদার আমাদের সাথে আছেন। সরজিৎ চট্টোপাধ্যায় বিমানবন্দরে আমাদের সাথে দেখা করার কথা রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট কক্ষে আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। সাংবাদিক ও অন্যান্য যাত্রীর দৃষ্টি এড়িয়ে আমাদের যেতে হবে। ইতিমধ্যে চট্টোপাধ্যায় আমাদের দুজনের জন্য একটি স্যুটকেস ও একটি ব্যাগ নিয়ে এসেছেন। হাত ব্যাগে কাগজপত্র, কলম, পেন্সিল ইত্যাদি রয়েছে। স্যুটকেসে আমাদের পরিধেয় কাপড়, তোয়ালে ও সাবান। রাত ১০ টার দিকে জীপে করে একটি মিলিটারী মালবাহী বিমানের কাছে আমাদের নিয়ে আসা হল। মই দিয়ে আমরা বিমানের ককপিটে উঠি। পাইলট ও তার সহকারীদের ছাড়া নিমানে বসার জন্য কোন আসন নেই। শুধুমাত্র কেনভাসের বেল্ট দিয়ে আমাদের চারজনের বসার ব্যবস্থা করা হল। বিমানের পিছন দিক উন্মুক্ত। এদিয়ে অনায়াসে মাল উঠা-নামা করা যায়। তখনও এতে মাল ভর্তি ছিল। এই মালবাহী সামরিক বিমানে নেয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সকল এজেন্সী থেকে আমাদের যাত্রা গোপন রাখা।

এটা ছিল একটা পুরনো রাশিয়ান বিমান। এর শব্দ ছিল বিকট। বিমানের যাত্রা শুরু হল। সমস্ত ককপিট কাঁপছে। তাজউদ্দিন ভাই বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও ওভাবে বসে থাকতে পারলেন না। দিল্লী পৌছতে রাত শেষ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর একটা কেনভাস বিছিয়ে আমি ও তাজউদ্দিন ভাই মেঝেতে শুয়ে পড়ি। গরমে আমরা ঘামছিলাম। বিমানের কাঁপনের সাথে আমাদের শরীরও কাঁপছিল। এমনি করে আধা ঘুমে আধা জেগে ভোরের দিকে আমরা দিল্লী পৌছি। সেখানে মিলিটারী বিমান বন্দরে আমাদের জন্য একটি গাড়ি প্রস্তুত ছিল। একজন কর্মকর্তা আমাদের নিয়ে গেলেন। চট্টপাধ্যায় আমাদের সাথে ছিলেন। মজুমদার গেলেন তাঁর মেয়ের বাসায়। প্রতিরক্ষা কলোনীর একটি বাড়িতে আমাদের রাখা হলো। পরে জেনেছি বাড়িটি ছিল বিএসএফ-এর একটি অতিথিশালা। এ বাড়ীতে অন্য আর কেউ নেই। আমি ও তাজউদ্দিন ভাই এক ঘরে, চট্টপাধ্যায় অন্য ঘরে। আমাদের দুটি বিছানা রয়েছে। ঢাকা থেকে বেরোবার পর থেকে দু’জন একত্রেই থাকছি। এতে সুবিধা অনেক। রাতে ঘুম না আসা পর্যন্ত সব কিছু পর্যালোচনা করার সুযোগ পাই। গোলক মজুমদার ও রুস্তমজী ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমাদের একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করার কাজে লিপ্ত রয়েছেন। আমাদের কিন্তু বিলম্ব সইছে না। ইতিমধ্যেই দিল্লীর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা প্রশ্ন তুলছে যে মোহম্মদ আলী প্রকৃতই তাজউদ্দিন আহমেদ এবং রহমত আলী ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম কিনা।

ভারতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্হার আচরণে কখনো অবাক হয়েছি আবার কখনো ভীত হয়েছি। তবে ‘র’ RAW নামক একটি গোয়েন্দা সংস্থা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় খুবই ব্যস্ত ছিল। এই সংস্থাটির কার্যকলাপে কখনই সন্তুষ্ট হতে পারি নি। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের সাথে আলাপ করে। তারা নিশ্চিত হতে চায় আসলেই আমরা আওয়ামী লীগের লোক কিনা। তাদের আলোচনার পর সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মিঃ কউলের কিছুটা বিশ্বাস জন্মে যে সত্যিই আমরা আওয়ামী লীগের লোক।

মেজর ওসমানের অস্ত্রের তালিকাটা তখনো আমার পকেটে। কথায় কথায় মিঃ মীরন আমাদের জানান যে, আলোচনার মাধ্যমে অস্ত্র পেতে আমাদের বিলম্ব হবে। মিঃ মীরনের কাছে আমরা জানতে পারি, লণ্ডনে মিনহাজ উদ্দিনের সাথে তাদের কথা হয়েছে। আমাদের কোন খবর থাকলে তিনি তা পৌঁছে দিতে পারেন।

মিনহাজ আমার পূর্ব পরিচিত। আমি তাকে চিঠি লিখি। আমি চিঠিতে অস্ত্রের একটা তালিকা পাঠাই। তাকে জানাই, লণ্ডনস্থ বাঙালিরা ইচ্ছা করলে আমাদের জন্য অস্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারে। তখনো বুঝে উঠতে পারি নি অস্ত্র কেনা বা তা সরবরাহ করা তত সহজ নয়।

ইতিমধ্যে আমরা খবর পেলাম, রেহমান সোবহান ও ডঃ আনিসুর রহমান দিল্লীতে পৌঁছেছেন। তাছাড়া এম, আর সিদ্দিকী, সিরাজুল হক বাচ্চু মিয়া ও যুবনেতা আব্দুর রউফ তখন দিল্লীতে ছিলেন। তাদের সকলের সাথে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের বৈঠক হয়। এম আর সিদ্দিকীর কাছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের মোটামুটি কিছু খবর পাই। তাঁর কাছে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের কাহিনীও শুনি। তিনি জানান, মেজর জিয়া একটা জীপে করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগের নেতারা এক প্রকার জোর করে জিয়াকে দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করান। তিনি আরো জানান চট্টগ্রাম থেকে তারা একটি ট্রান্সমিটার আগরতলাতে নিয়ে এসেছেন, এবং তা দিয়ে প্রচার কাজ চালানো হচ্ছে। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ও জনগণ তাদেরকে সর্বপ্রকার সাহায্য করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। একটি সরকার গঠন করার জন্য তিনি আমাদের অনুরোধ জানান। কর্মীদের প্রতি শুভেচ্ছা নিয়ে তিনি আগরতলা চলে যান। তবে তাকে সরকার গঠন করার ইঙ্গিত দিয়ে দিলাম। আবদুর রউফকে নির্দেশসহ রংপুর পাঠিয়ে দেই।

এ সময় ময়মনসিংহ থেকে রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ও সৈয়দ আবদুস সুলতানের চিঠি পেলাম। সৈয়দ সুলতান বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

এমনিভাবে দিল্লী আসার পর ২ দিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেছেন। আমরা তাদের দু’জনকে এ কথা বুঝাতে সক্ষম হই যে, বাঙালি হলেও আমাদের জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় সত্ত্বা বাংলাদেশের ভূ-খন্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা আমাদের ৫৪ হাজার বর্গমাইল ভূ-খন্ডের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করি।

৪ঠা এপ্রিল তাজউদ্দিন ভাই ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তাদের কোন সহযোগী ছিল না। বৈঠকে উপস্থিত না থাকলেও পূর্বাপর আলোচনার বিষয় আমার জানা ছিল। সাক্ষাতে যাওয়ার পূর্বে তাজউদ্দিন ভাই আমার সাথে কয়েক ঘন্টা ধরে সম্ভাব্য আলোচনা সূচী নিয়ে আলোচনা করে যান।

মিসেস গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের পর তাজউদ্দিন ভাই আমাকে সব কিছু জানান। মিসেস গান্ধী বারান্দায় পায়চারী করছিলেন। তাজউদ্দিন ভাই-এর গাড়ী পৌঁছে যাওয়ার পর তাকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী স্টাডি রুমে নিয়ে যান। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন। ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?’ এই প্রশ্ন সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। কেননা এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদেরকে আরো অনেকবার হতে হয়েছে। মিসেস গান্ধীর প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দিন ভাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫শে মার্চের পর তাঁর সাথে আমাদের আর যোগাযোগ হয় নি। সাক্ষাতে তাজউদ্দিন ভাই আরো বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোন মূল্যে এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে। তাজউদ্দিন ভাই বললেন, পাকিস্তান আমাদের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাতে পারে। যে কোন মূল্যে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। তাজউদ্দিন ভাই বলেন, আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য। মাতৃভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধে তাজউদ্দিন ভাই ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশের নেতা জানান, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোট নিরপেক্ষ। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। বাংলার মানুষের সংগ্রাম মানবতার পক্ষে ও হিংস্র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা আমরা চাই।

আমরা একটি সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করি। কেননা ভারত সরকারের সাথে একটি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের কথা বলা উচিৎ। এদিকে সরকার গঠনের জন্য বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে চাপ আসা অব্যাহত রয়েছে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে তাজউদ্দিন ভাইকে খুবই চিন্তিত মনে হয়। অস্ফুটস্বরে তিনি বলে ফেলেন বঙ্গবন্ধু আমাকে কী বিপদে ফেলে গেলেন। আমি বিরক্তির সাথে জানতে চাইলাম সরকার গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দিন ভাই দ্বিধাগ্রস্থ কেন? জবাবে তাজউদ্দিন ভাই বলেন, আপনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন রাজনীতি জানেন না। সরকার গঠন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝি। জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই তা প্রয়োজন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতাদের অনুপস্থিতিতে সরকার গঠন করে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।

আমার সরল মনের কাছে দেশের এমন ভয়াবহ একটি পরিস্থিতিতে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিক চেতনার দিক দিয়ে প্রথম ও প্রধান কর্তব্য বলে মনে হয়।

তাজউদ্দিন ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেন কাকে নিয়ে সরকার গঠন করা হবে? আমি স্বাভাবিক উত্তর দিলাম। বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করে রেখে গেছেন। আমি বললাম, যে ৫ জন নিয়ে বঙ্গবন্ধু হাই কমাণ্ড গঠন করেছিলেন, এই ৫ জনকে নিয়েই সরকার গঠন করা হবে। দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু, সাধারণ সম্পাদক ও তিনজন সহ-সভাপতি নিয়ে এই হাই কমাণ্ড পূর্বেই গঠিত হয়েছিল। তাজউদ্দিন ভাই পুনরায় প্রশ্ন করেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? দ্বিধা না করে এবারও জবাব দিলাম, ২৫শে মার্চের পর থেকে আজ পর্যন্ত যিনি প্রধান দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনিই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের দায়িত্ব পালন করবেন।

তাজউদ্দিন ভাই অনেকক্ষন ভাবলেন। আমার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা কোনভাবেই তিনি নাকচ করতে পারলেন না। তিনি এত বেশি কেন ভাবছিলেন তার উত্তর জানতে আমার অনেক সময় লেগেছিল।

তাজউদ্দিন ভাই নিষ্ঠাবান ও সংগ্রামী পুরুষ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দল ও দেশের স্বার্থে কাজ করতেন। নিজে বেশিরভাগ কাজ করেও তিনি কৃতিত্বের দাবি করতেন না। সকল কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে তিনি নিজেকে সর্বদাই দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাই আমি যখন বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করি, তখন এই প্রস্তাব মেনে নিতে তাঁর খুবই কষ্ট হচ্ছিল। এই দায়িত্বের গুরুভার সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি আবার আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথা স্মরণ করেন। তাঁরা কে কোথায় কী অবস্থায় আছেন, এ নিয়ে তিনি বিশেষভাবে চিন্তা করছেন। পত্রিকাতে ইতিমধ্যে অনেকের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। অবশ্য পত্রিকাতে নিহতের তালিকায় তাজউদ্দিন ভাই এবং আমার নামও রয়েছে।

নিহতের তালিকায় আমাদের দু’জনের নাম দেখে ভেবেছিলাম, আমাদের নেতারাও হয়তো জীবিত রয়েছেন। আমাদের আর একটি চিন্তা হলো বঙ্গবন্ধুকে সরকারের প্রধান করা হলে আমাদের আন্দোলনের ব্যাপারে কি প্রতিক্রিয়া হবে। অথবা তাঁর জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কারণ দেখা দিবে কিনা। এ নিয়ে দু’জনে অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা করি। পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দেই আবার খণ্ডন করি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, ফলাফল যাই হোক, বঙ্গবন্ধুকে সরকারের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে হবে।

তাজউদ্দিন ভাই বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসেবে তাঁর সাথে কাজ করেছি। তবে এই ব্যাপারে আমি স্থির নিশ্চিত যে, কোন প্রকার ভয় ভীতি বা চাপের মাধ্যমে পাক সরকার বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কোন বিবৃতি দিতে সমর্থ হবে না।

আমরা যেহেতু একটি যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম এবং বঙ্গবন্ধু তখন শত্রুর কারাগারে বন্দী কাজেই সে সময় আমাদের সব কিছুই ভাবতে হয়েছিল। তাছাড়া ভাবাভাবির বেশি সময়ও ছিল না। কেননা আমাদের ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। একটা সরকার গঠন করা ছাড়া কাজে এগুনো যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সিপাহশালার শত্রুর হাতে বন্দী। আবার তাঁকে বাদ দিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধের কথা কল্পনাও করা যায় না।

তারপর কথা উঠলো দেশের নাম কী হবে। আমি বললাম, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ তাজউদ্দিন ভাই এর পছন্দ হলো। নামটি ঠিক করার সময় আমাদের মাথায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কথা মনে হচ্ছিল। এ সময় সরকারী কাগজপত্র ব্যবহারের জন্য একটি মনোগ্রাম ঠিক করা দরকার। মনোগ্রাম আমাদেরই ঠিক করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের যে মনোগ্রাম সরকারী কাগজপত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা আমার হাতে আঁকা। চারপাশে গোলাকৃতি লাল-এর মাঝে সোনালী রং- এর মানচিত্র। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তাঁর প্রথম সরকারী অনুমোদন।

এই দিন সন্ধ্যার পর রেহমান সোবহান ও ডঃ আনিসুর রহমান আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। রেহমান সোবহান এর আগে একবার দেখা করে গেছেন। এ সময় আনিসুর রহমান স্বচক্ষে দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাক বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন। তিনি নিজের বাসার গেটে তালা ঝুলিয়ে অন্যদিক দিয়ে বাসায় ঢুকে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে বাসার মেঝেতে শুয়ে রাত কাটান এবং জানালা দিয়ে সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখেন। পাক দস্যুরা তার বাসার গেটে দরজা দেখে চলে যায়। সারাদিন আমি তাজউদ্দিন ভাই-এর বক্তৃতা তৈরী করেছি। রেহমান সোবহান বক্তৃতার খসড়া রচনায় আমাকে সহায়তা করেন। সেদিনই তার কাছে জানতে পারি যে, ডঃ কামাল হোসেন গ্রেফতার হয়েছেন। রেহমান সোবহান জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করবেন। তার ইংরেজী খসড়ার একটা অংশ আমার খুব ভাল লেগেছিল। সেটা ছিল ‘পাকিস্তান ইজ ডেড এণ্ড বারিড আন্ডার মাউন্টেন অব কর্পসেস’ বাংলায় এর অনুবাদ করি পর্বত ‘প্রমাণ লাশের নিচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে’। শেষ অনুচ্ছেদ আমি লিখি, ‘আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছেলেদের রক্ত ও ঘামে মিশে জন্ম নিচ্ছে নতুন বাংলাদেশ।’ এক সময় চোখের জলে বক্তৃতার খসড়ার এক অংশ ভিজে গেল। চোখ মুছে আবার লিখতে শুরু করি। লেখা শেষ হলে সমস্ত বক্তৃতাটা তাজউদ্দিন ভাইকে শোনাই।

রাজনৈতিক খসড়া প্রণয়নে তাজউদ্দিন ভাই খুবই দক্ষ। কোন একটি খসড়া করার পর তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, মাথা নাড়তেন, কোন স্থানে থেমে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে বলতেন। প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতেন। এমনিভাবে চূড়ান্ত বক্তব্য তৈরী হতো। আমাদের দু’জনের মন ও চিন্তা যেন একইভাবে কাজ করছিল।

আমার হাতের লেখা খুব ভাল নয়। তাজউদ্দিন ভাই-এর বক্তৃতা টেপ করতে হবে। আমি একটি টেপ রেকর্ডারের ব্যবস্থা করি। তিনি সমস্ত বক্তৃতা নিজের হাতে লিখে নিলেন। চট্টপাধ্যায় তার নিজের হাতে আরো একটি কপি করে নেন। তখন তিনজনের হাতে বক্তৃতার তিনটি কপি হয়ে গেল। পরদিন তাজউদ্দিন ভাই দ্বিতীয়বারের মত ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধী জানান, বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই খবর পাকিস্তান সরকার তখনো সরকারীভাবে প্রকাশ করে নি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাজউদ্দিন ভাই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, তাঁদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের খবরা খবর প্রচারের জন্য একটি বেতার ষ্টেশন স্থাপনের বিষয়েও আলোচনা হয়।

এদিকে আমাদের নেতারা যে কোথায় আছেন সে খবর আমরা এখনো জানি না। তাঁদের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য একটি ছোট বিমানের ব্যবস্থা করা হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য ভারত সরকার একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে আমাদের সাথে দেন। ঐ জেনারেলের নাম নগেন্দ্র সিং। তাঁর বয়স ৬০ এর উর্ধ্বে। তিনি সামরিক ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ দেবেন। জেনারেল সিং মনে-প্রাণে একজন খাঁটি সৈনিক। ব্যক্তিগত জীবনে খুবই ধর্মপ্রাণ। এছাড়া মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ। আমাদের সংগ্রামের প্রতি তিনি আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাশীল। দিল্লীতে বসেই তাজউদ্দিন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করা হয়। বক্তৃতার পূর্বে আমার কণ্ঠ থেকে ঘোষণা প্রচারিত হয় এখন তাজউদ্দিন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেবেন। এরপর তাজউদ্দিন ভাই বক্তৃতা শুরু করেন।

আমরা বিমানে করে আবার কলকাতায় ফিরে এলাম। এখানে এসে জানলাম মনসুর ভাই ও কামরুজ্জামান (হেনা ভাই) এসেছেন। তাঁদের কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। খবর নিয়ে জানলাম কলকাতায় গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে কামরুজ্জামান ভাই থাকেন। শেখ ফজলুল হক মনি ঐ বাড়িতে আছেন। পরে আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ ও সিরাজুল ইসলাম খান এই বাড়িতে ঘাঁটি গড়েন।

আমি ও তাজউদ্দিন ভাই কামরুজ্জামান ভাইয়ের কাছে দেখা করতে গেলাম। আমরা তাঁর কাছে এ পর্যন্ত ঘটনাবলী ব্যক্ত করি। কামরুজ্জামান ভাইয়ের মনে একটা জিনিস ঢুকানো হয়েছে যে আমরা তাড়াহুড়া করে দিল্লী গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেছি। নেতাদের জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল।

শেখ মনি আমাকে অন্য একটি ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে এটা বুঝালেন যে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমাদের বিলম্বে সাক্ষাৎ হওয়ার কারণ হলো তাঁরা এখান থেকে ক্লিয়ারেন্স দেন নি। তিনি বুঝাতে চাইলেন তাঁরা একটি শক্তিশালী গ্রুপ এবং তাঁদের সাথে ইন্দিরা গান্ধীর পূর্ব থেকেই যোগাযোগ রয়েছে।

আমাদের সরকার গঠনের ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন এমন অনেক এমপিএ, এমএনএ ও আওয়ামী লীগ নেতা কলকাতায় এসেছেন। প্রিন্সেস স্ট্রীটের এমএলএ হোষ্টেলে ওরা উঠেছেন।

একটা জিনিস বুঝতে পারলাম আমাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ শুরু হয়ে গেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে আলাপ-আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে কামরুজ্জামান ভাইকে নিয়ে কতিপয় এমপি ও নেতা প্রিন্সেস স্ট্রীটে একটি বৈঠক করেছেন। আর এতে ভালভাবে সুর মিলিয়েছেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তাজউদ্দিন ভাই আমাকে ডেকে বললেন, আপনাকে আগেই বলেছিলাম এই দল দিয়ে কি স্বাধীনতা যুদ্ধ হবে?

আমরা বিএসএফ এর লর্ড সিনহা রোডের একটি অফিসে অবস্থান করছি। ভারত সরকার আমাদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা ভারতে মাটিতে, ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এই কথা প্রকাশ করতে রাজী নয়।

আমাদের নেতাদের বিভিন্নমুখী বৈঠকে তাজউদ্দিন ভাই ও আমি বিশেষভাবে বিব্রতবোধ করছি। কামরুজ্জামান ভাই খুবই সুবিবেচক মানুষ। তিনি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বললেন। রাতের বেলা লর্ড সিনহা রোডে আমাদের বৈঠক বসল। উপস্থিত বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন কামরুজ্জামান, মিজান চৌধুরী, শেখ মনি, তোফায়েল আহমদ ও আরও অনেকে। শেখ মনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দী, বাংলার যুবকরা বুকের তাজা রক্ত দিচ্ছে, এখন কোন মন্ত্রীসভা গঠন করা চলবে না।

মন্ত্রী-মন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময়। সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে।

তাজউদ্দিন ভাই ও আমি ছাড়া বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সকলে শেখ মনির বক্তব্য সমর্থন করেন। তাজউদ্দিন ভাই যেহেতু নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, তাঁর পক্ষে পাল্টা জবাব দেয়া সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত আমাকেই উঠে দাঁড়াতে হলো। উপস্থিত প্রায় সকলেরই ধারণা ছিল আমি ও তাজউদ্দিন ভাই আগেভাবে দিল্লী গিয়েছি ক্ষমতা কুক্ষীগত করার জন্য।

আমি আমাদের দিল্লী যাওয়ার সমর্থনে ও শেখ মনির বক্তব্যের বিপক্ষে কয়েকটি যুক্তি পেশ করি। আমার প্রথম যুক্তি ছিল, দিল্লী যাত্রার পূর্বে আমাদের জানা ছিল না কারা বেঁচে আছেন এবং কাকে কোথায় পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় যুক্তি হলো, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দিন ভাই দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলেছেন। দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলার এখতিয়ার তাজউদ্দিন ভাইয়ের রয়েছে। তাছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে মাত্র। ভবিষ্যতে আরও আলোচনা হবে। তখন দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করতে সমর্থ হবেন। তৃতীয়ত আমরা বঙ্গবন্ধু নিয়োজিত হাই কম্যাণ্ড নিয়ে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীসভা গঠনের পরিকল্পনা করেছি মাত্র।

আমি আরও বললাম, বাংলাদেশ বার ভুঁইয়ার দেশ। বারটি বিপ্লবী কাউন্সিল গড়ে ওঠা বিচিত্র কিছু নয়। আমাদের অবশ্যই আইনগত সরকার দরকার। কেননা, আইনগত সরকার ছাড়া কোন বিদেশী রাষ্ট্র আমাদের সাহায্য করবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ খুব কমই হয়েছে। স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার অধিকার একটি আন্তর্জাতিক নীতি। যে কোন জনগোষ্ঠীর তাদের নির্বাচিত সরকার দ্বারা শাসিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের সে গণতান্ত্রিক অধিকারের অবমাননা করেছে। তাই আমাদের সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার হরণই হচ্ছে জনগণের অধিকার হরণ।

শেখ মনির বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য দু’টি যুক্তি দিলাম। শেখ মনির প্রস্তাবিত বিপ্লবী কাউন্সিল যদি বিভিন্ন মতাবলম্বীরা দুইটি, পাঁচটি বা সাতটি গঠন করে তাহলে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা কোনটির আদেশ মেনে চলবে না। কোন কাউন্সিলের সাথে বিদেশের সরকার সহযোগিতা করবে। এই ক্ষেত্রে একাধিক কাউন্সিল গঠনের সম্ভাবনাই নয় কি?

সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকারই হচ্ছে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আজকে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে অন্য কোন বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হলে জনগণের মৌলিক অধিকারকে অবমাননা করা হবে। সেটা নিশ্চয়ই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমার বক্তব্যের পর মিজান চৌধুরী ও শেখ মনি ছাড়া উপস্থিত প্রায় সকলে তাঁদের পূর্বের মনোভাব পরিবর্তন করেন।

কামরুজ্জামান ভাই আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, শেখ মনির কথানুযায়ী বিপ্লবী পরিষদ গঠন করা যায় কিনা। আমি তাঁকে বললাম, তা করা হলে যুদ্ধ বিপন্ন হবে। তিনি আমার কথার আর কোন প্রতিবাদ করলেন না। আমি তাঁকে বলি তার সাথে দেখা করে আমি বিস্তারিত সব বলবো।

সভার শেষ পর্যায়ে তাজউদ্দিন ভাই বক্তৃতা দেন। উপস্থিত সকলে সরকার গঠন করার ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য মেনে নিলেন।

১০ই এপ্রিল বিভিন্ন অঞ্চল সফরের জন্য আমাদের বের হবার কথা। একটি ছোট্ট বিমানের ব্যবস্থা করা হলো। বিমানটি খুব নিচু দিয়ে উড়তে পারেন। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করাই এই সফরের উদ্দেশ্য। মনসুর ভাই, কামরুজ্জামান ভাই ও তোফায়েল আহমেদ একই বিমানে আমাদের সাথে যাবেন।

পরদিন খুব ভোরে গাজা পার্কের বাড়ীতে কামরুজ্জামান ভাই-এর সাথে দেখা করে তাঁকে বিস্তারিত সব কিছু অবহিত করি।

তাঁর সাথে বলতে গেলে আমার আত্মিক যোগাযোগ ছিল। তিনি প্রাণখোলা সহজ-সরল মানুষ। দু’জনে একান্তে প্রায় আধ ঘন্টা আলোচনা করি। আলোচনার মাধ্যমে তাঁর মনের জমাট মান অভিমান দূরীভূত হয়ে গেল। বিপ্লবী পরিষদ গঠনের জন্য যুবকদের প্রস্তাব যে অযৌক্তিক ও অবাস্তব এবং এটা যে যুদ্ধের সহায়ক হবে না তাও তিনি মেনে নিলেন।

তাজউদ্দিন ভাই-এর অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে তাঁর আর কোন আপত্তি রইলো না। আমাদের সাথে বিমানে আগরতলা যাওয়ার জন্য কামরুজ্জামান ভাইকে বললাম। তিনি বলেন, যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর কোন আপত্তি ছিল না। তিনি খবর পেয়েছেন, তাঁর পরিবার পরিজন কোলকাতার পথে দেশ ত্যাগ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁর এখানে থাকা প্রয়োজন। আমি খুশি মনে বিদায় নেই।

১০ই এপ্রিল। বিমানে আমাদের আগরতলা রওনা হওয়ার কথা। তাজউদ্দিন ভাই, মনসুর ভাই, শেখ মনি, তোফায়েল আহমেদ ও আমি লর্ড সিনহা রোড থেকে সোজা বিমানবন্দরে যাই। অন্যানের মধ্যে মিঃ নগেন্দ্র সিং আমাদের সঙ্গী হলেন। বিমানটি খুবই ছোট। এতে বসার মত ৫/৬ টি আসন ছিল।

খুব নিচু দিয়ে বিমান উড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তৈরি অব্যবহৃত বিমানবন্দর বমলার কয়েকটিতে আমরা নামি। এগুলো বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছাকাছি।

ছোট ছোট বন্দরগুলো বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছাকাছি। একটি বিমান বন্দরে আমরা দুপুরের খাবার খাই। বিএসএফ-এর মাধ্যমে খবর দেয়া হলো কোন আওয়ামী লীগ নেতার খোঁজ পেলে পরবর্তী কোন বিমানবন্দরে তৈরি রাখতে।

উত্তর বঙ্গ তথা রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা অঞ্চলের কোন নেতা খুঁজে পাওয়া গেল না। এদের বেশীর ভাগ কোলকাতা এসে গেছেন। কিছুক্ষণ পর আমরা বাগডোগরা বিমান বন্দরে নামি। সেখান থেকে জীপে করে শিলিগুড়ি যাই। শহর থেকে অনেক ভেতরে সীমান্তের খুব কাছাকাছি একটি বাংলোতে উঠলাম। গোলক মজুমদার এখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী এখানের কোন একটি জঙ্গল থেকে গোপন বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দিন ভাই-এর বক্তৃতা প্রচারিত হবে। এ সময় তোফায়েল আহমেদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেখ মনি বলেন, তোফায়েল আহমদের কলকাতা যাওয়া দরকার। শেখ মনি কিছু নির্দেশসহ তোফায়েল আহমদকে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন।

মনসুর ভাই-এর জ্বর এসে গেছে। তিনি শুয়ে আছেন। আমি তাঁর পাশে বসে আছি। তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করলাম। তিনি মত দিলেন তাজউদ্দিন ভাই প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কোন আপত্তি করবেন না। এরপর মনসুর ভাই বা কামরুজ্জামান ভাই প্রধানমন্ত্রী পদের ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন তোলেন নি।

পাঁচজন নেতার মধ্যে তিনজনের সাথে আলাপের পর আমার খুব বিশ্বাস হয়েছিল যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দিন ভাই-এর প্রধানমন্ত্রীত্বে কোন আপত্তি করবেন না। তাছাড়া তাঁকে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। এখন বাকি রইলো খন্দকার মোশতাক আহমদ। শুধু তিনি আপত্তি করতে পারেন।

তবুও চারজন এক থাকলে মোশতাক ভাইকেও রাজী করানো যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন ভাই-এর প্রথম বক্তৃতা প্রচার করার পালা। তাজউদ্দিন ভাই প্রচারের জন্য চোখে অনুমতি দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করা বক্তৃতার ক্যাসেট গোলক মজুমদারের কাছে দেয়া হলো।

শেখ মনি তাজউদ্দিন ভাই-এর সাথে একান্তে আলাপ করতে চাইলেন। আমি বাইরের ঘরে বিএসএফ-এর আঞ্চলিক কর্মকর্তার সাথে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা ও শত্রুদের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করলাম।

শেখ মনির সাথে কথাবার্তা শেষে তাজউদ্দিন ভাই আমাকে ডাকেন। তিনি জানান, শেখ মনি এখন সরকার গঠনের ব্যাপারে রাজী নন। আগরতলা গিয়ে দলীয় এমপি, এমএনএ ও নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক শেষে শেখ মনি সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন। আর এটা করা না হলে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

আমি সরকার গঠনের পক্ষে পুনরায় যুক্তি দিলাম। আমি বললাম, সরকার গঠন করতে বিলম্ব হলে সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে এবং এতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া সরকার গঠনের পরিকল্পনা তো নতুন কিছু নয়। মনসুর ভাই ও কামরুজ্জামান ভাই তাজউদ্দিন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খন্দকার মোশতাক আহমদের তখনো দেখা নেই। তাঁরা কে কোথায়, কি অবস্থায় আছেন, সে খবর এখনো আসে নি। ইতোমধ্যে বন্ধুরাষ্ট্রের সাথে আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সরকার গঠনে বিলম্ব হলে তাও নস্যাৎ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে ভারত সরকারকে আমরা আশ্বাস দিয়েছি। তাতে বিলম্ব হলে আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কেও তারা সন্দেহ পোষণ করবেন। আমাদের মধ্যে যে কোন্দল রয়েছে কোন অবস্থাতেই তা বাইরে প্রকাশ হতে দেয়া উচিত নয়। ভারত সরকারও জানেন, আমাদের বক্তৃতা শিলিগুড়ির এই জঙ্গল থেকে আজ প্রচারিত হবে। আমার এসব কথা শেখ মনি মানতে রাজী নন। বেশি করে বুঝাতে চাইলে শেখ মনি জানান, তারা বঙ্গবন্ধু থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারো প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। এ সময় তাজউদ্দিন ভাই আমাকে বলেন, আমি যেন গোলক মজুমদারকে জানিয়ে দেই যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা আজ প্রচার করা সম্ভব হবে না। এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তাঁকে যথাসময়ে জানানো হবে।

গোলক মজুমদারকে ফোন করে জানাই যে আজ বক্তৃতা প্রচার করা হবে না। এ কথা শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিলম্ব করা কি ঠিক হবে? তিনি বলেন, যে মুহূর্তে সব কিছু ঠিক ঠাক সে মুহুর্তে তা স্থগিত রাখলে সব মহলে প্রশ্ন দেখা দেবে। তা আমরা ভেবে দেখছি কিনা। ইতিমধ্যে রেকর্ড করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে (জঙ্গলে) পৌঁছে গেছে।

আমি গোলক মজুমদারকে বললাম ক্যাসেট যদি পাঠিয়ে থাকেন, প্রচার করে দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটি মাত্র সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছিলাম। এই দিন ছিল দশই এপ্রিল। রেডিও অন করে রেখে খেতে বসেছি। খাওয়ার টেবিলে তাজউদ্দিন ভাই ও শেখ মনি আছেন। রাত তখন সাড়ে ন’টা। সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আসলো। প্রথমে আমার কন্ঠ ভেসে আসলো। ঘোষণায় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বক্তৃতা দেবেন। প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা প্রচারিত হলো। সারা বিশ্বব্যাপী শুনলো স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতা। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়লো।

বক্তৃতা প্রচারিত হলো। আমাদের তিনজনের কারো মুখে কোন কথা নেই। আমি শুধু বললাম, গোলক মজুমদার শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা প্রচার বন্ধ করতে পারেন নি। মনসুর ভাই রুটি খেয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি বক্তৃতা শুনতে পান নি।

পরে একক সিদ্ধান্তে বক্তৃতা প্রচারের জন্য তাজউদ্দিন ভাই-এর কাছে ক্ষমা ও শাস্তি প্রার্থনা করি। তিনি বলেছিলেন যে, সে সময় আমার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। সেদিন বক্তৃতা প্রচার না করলে গোলমাল আরো বৃদ্ধি পেত বৈকি।

শেখ মনি তাজউদ্দিন ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে তিনি আগরতলা গিয়ে সকল প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু আগরতলা গিয়ে শেখ মনি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি কসবাতে সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বাড়িতে চলে যান।

তাজউদ্দিন ভাই-এর বক্তৃতা প্রচারের পর অনেক রাতে কর্নেল (অবঃ) নুরুজ্জামান (সেক্টর কমান্ডার) ও আবদুর রউফ (রংপুর) আসেন। গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের সাথে আলোচনা করি। উত্তর বঙ্গে কয়েকটা সেক্টর রয়েছে। একটি সেক্টরের দায়িত্ব রয়েছেন কর্নেল জামান। তারা জানান, গেরিলা কায়দায় আকস্মিক হামলায় শত্রুদের পর্যুদস্ত করা হচ্ছে।

আমি অবাঙালিদের ওপর হামলা না করার পরামর্শ দিলাম। অবাঙালি বিহারীদের ওপর জনগণ ক্ষুব্ধ। রংপুর ও সৈয়দপুরে বেশ কিছু বিহারী রয়েছে। অবশ্য ইতিমধ্যে কোন কোন স্থানে এদের ওপর বিচ্ছিন্ন হামলা হয়ে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব হামলা বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। সরকার গঠনে তারা আনন্দ প্রকাশ করলেন।

পরদিন ১১ই এপ্রিল সকালে নাশতা করে আমরা বিমানে উঠি। আগের রাতে প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কের অবসান হওয়ায় মনসুর ভাই যেন বেশ খুশী।

খুব নিচু দিয়ে আমাদের ছোট বিমান উড়ছে। দু’দেশের নেতাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বিশেষভাবে খোঁজ করার জন্য ময়মনসিংহ সীমান্তে আমরা খবর দিয়ে রেখেছিলাম। সৈয়দ নজরুলকে পাওয়া যেতে পারে এমন একটি স্থানে গিয়ে প্রথমে শুনলাম, নেতৃত্বস্থানীয় কাউকে পাওয়া যায় নি। পরে বিএসএফ-এর স্থানীয় অফিসার জানান, ঢালু পাহাড়ের নীচে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নান রয়েছেন। এ কথা শুনে আমরা ‘ইউরেকা’ বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠি।

মাত্র আড়াই ঘন্টা পরে তাঁরা দু’জন আসলেন। নজরুল ভাই জীপ থেকে প্রথমে নামেন। আমার সহকারী হুইপ আবদুল মান্নানকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে জানালাম ২৫শে মার্চের পর থেকে মান্নান সাহেব খুব কষ্টে দিনকাল কাটিয়েছেন। পাক বাহিনীর ভয়ে দু’দিন পায়খানায় পালিয়ে ছিলেন। টাঙ্গাইল থেকে সড়ক পথে হেঁটে ময়মনসিংহ এসেছেন। তিনি একেবারে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছেন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। আমাদের খবর পেয়ে নজরুল ভাই ও তাঁর ভাই যথেষ্ট উৎসাহিত হন। নজরুল ভাইকে তাজউদ্দিন ভাই ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলী তাঁকে অবহিত করা হয়। আমরা বাইরে বসে আছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন ভাইকে বিমানে মোবারকবাদ জানান। এই দৃশ্য দেখে আমরা সকলেই উৎফুল্ল হই। আমরা আবার বিমানে উঠি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল আগরতলা। আমরা বিমানে আসন গ্রহন করি। সামনের আসনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর ভাই। নজরুল ভাই বিমানে বসে ঢাকা থেকে পলায়নের কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি ডঃ আলীম চৌধুরীর ছোট ভাই-এর বাসায় থাকতেন। তিনি ছিলেন নজরুল ভাই-এর আত্মীয়। সেই বাসা থেকে পরচুলা ও মেয়েদের কাপড় পরিধান করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। মনসুর ভাই এ কথা নিয়ে এমনভাবে ঠাট্টা করলেন যে বিমানে কেউ না হেসে থাকতে পারলেন না। আমাদের আগরতলা পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

ইতিমধ্যে আগরতলায় অনেক নেতা এসে পৌঁছেছেন। কর্নেল ওসমানীর সাথে দেখা হলো। তাঁর চেহারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত গোঁফ তিনি কেটে ফেলেছেন। প্রথমে চিনতেই পারছিলাম না। আমার নিজেরও দাড়ি কেটে ফেলেছি। দু’জনেই দু’জনকে ডেকে হাসি ঠাট্টা করলাম।

আগের রাতে খন্দকার মোশতাক এসেছেন। ডঃ টি হোসেন ঢাকা থেকে তাকে নিয়ে এসেছেন। এম আর সিদ্দিকী কয়েক দিন পূর্বে আগরতলা এসেছেন। চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমদ চৌধুরী এবং সিলেট থেকে আবদুস সামাদও এসে গেছেন। তাছাড়া তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলী চাষী ছিলেন।

আগরতলা সার্কিট হাউজ পুরোটা আমাদের দখলে। ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং ভিন্ন একটি ঘরে অবস্থান করছেন।

ওসমানী যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা তৈরী করে ফেলেন। আধুনিক সমরসজ্জায় সজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে আমাদের পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব না। ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি এর পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজসরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন।

রাতে খাবারের পর নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন। খন্দকার খুবই মনঃক্ষুণ্ণ। নাটকীয়ভাবে তিনি বললেন, আমরা যেন তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেই। আর মৃত্যুকালে তার লাশ যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি ডঃ টি হোসেনের মাধ্যমে মোশতাক সাহেবের মনোভাব জানতে চাইলাম। মোশতাক ও টি হোসেন-এর মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। দু’জনেই এক জেলার লোক। পারিবারিক পর্যায়েও তাদের সম্পর্ক খুবই মধুর। তিনিই তাকে নিয়ে এসেছেন আগরতলায়।

টি হোসেনের সাথে আলাপ করে জানলাম, মোশতাক সাহেব প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী। সিনিয়র হিসেবে এই পদ তারই প্রাপ্য বলে তিনি জানিয়েছেন। সারা রাত পরামর্শ হলো।

অনিদ্রা ও দীর্ঘ আলোচনায় আমি খুবই ক্লান্তি অনুভব করি। এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী সভায় থাকতে রাজী হলেন, তবে একটা শর্ত হলো, তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। তাজউদ্দিন ভাই আমাকে একথা জানান। সবাই এতে রাজি হলেন। কেননা, একটা সমঝোতার জন্য এই ব্যবস্থা একেবারে মন্দ নয়। অবশেষে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের বিষয়টি সুরাহা হলো। একজন হেসে খবর দিলেন, তিনি যোগদানে রাজি হয়েছেন। উপস্থিত সকলে এক বাক্যে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। সকলে জহুর ভাইকে মোনাজাত করতে অনুরোধ করলেন। তিনি কয়েকদিন পূর্বে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করে এসেছেন। তাঁর মাথায় তখনো মক্কা শরীফের টুপি। তিনি আধ ঘন্টা ধরে আবেগপ্রবণভাবে মোনাজাত পরিচালনা করেন। তাঁর মোনাজাতে বঙ্গবন্ধুর কথা, পাক দস্যুদের অত্যাচার, স্বজন হারানো, দেশবাসীসহ শরণার্থীদের কথা এলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনেকের চোখে পানি এসে গেল। এই মোনাজাতের মাধ্যমে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিলাম।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠককে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। তাজউদ্দিন ভাই ও আমার প্রচেষ্টায় যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল বৈঠকে সবগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়।

এদিকে ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং-এর বৈঠকে যুদ্ধের বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়। বৈঠকে এক পর্যায়ে আমি অংশ নেই। এর পূর্বে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে দিল্লী কলকাতাসহ দেশের বাইরে ভেতরে সীমাবদ্ধ আলোচনা হয়েছে। সব ক’টিতে আমি গভীরভাবে জড়িত ছিলাম। যুদ্ধের ব্যাপ্তি, প্রকৃতি, সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝবার চেষ্টা করি।

১৩ই এপ্রিল ছোট বিমানে কলকাতা ফিরে গেলাম। মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও আবদুস সামাদ আজাদ ও কর্নেল ওসমানী কলকাতা আসেন। অন্যান্যরা কলকাতায় রয়ে গেলেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পৌঁছার ব্যাপারে আমরা ২টি প্রবেশ পথ ঠিক করি। এর একটি হচ্ছে আগরতলা। এই পথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেটের লোকজন প্রবেশ করবে। অন্যান্য জেলার লোকজনের জন্য প্রবেশ পথ করা হয় কলকাতা। পরে অবশ্য সিলেটের জন্য ডাউকি, ময়মনসিংহের জন্য তোরা পাহাড়, রংপুরের জন্য ভুরুঙ্গামারী, দিনাজপুরের জন্য শিলিগুড়ি, বরিশালের জন্য টাকি-এ রকম বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পথ ঠিক করা হয়।

মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ই এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ই এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গা রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকে নি। চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলো।

এই নিয়ে গোলক মজুমদারের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন, পাক বাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।

শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারন করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের জন্য নির্বাচিত স্থানের নাম আমি, তাজউদ্দিন ভাই, গোলক মজুমদার এবং বিএসএফ-এর চট্টপাধ্যায় জানতাম। ইতিমধ্যে দ্রুত কতগুলো কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।

অনুষ্ঠানের কর্মসূচী নির্ধারন ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদনও বাংলা ভাষায় করা হয়েছিল। ইংরেজী কপি বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে দেয়া হয়। সবচেয়ে বড় কাজ হলো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা।

আমি আর তাজউদ্দিন ভাই যে ঘরে থাকতাম, সে ঘরের একটি ছোট্ট স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে লেখার কাজ করি। আমার কাছে কোন বই নেই, নেই অন্য দেশের স্বাধীনতার ঘোষণার কোন কপি।

আমেরিকার ইন্ডিপেনডেন্স বিল অনেকদিন আগে পড়েছিলাম। সেই অরিজিনাল দলিল চোখের সামনে ভাসছে। আর সেই বড় বড় হাতের স্বাক্ষরগুলো। কিন্তু ভাষা বা ফর্ম কিছুই মনে নেই। তবে বেশি কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম না। শুধু মনে করলাম, কি কি প্রেক্ষিতে আমাদের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। এমনি চিন্তা করে ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া তৈরি করলাম। স্বাধীনতার ঘোষণায় অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয়া হলো।

স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়া রচনার পর তাজউদ্দিন ভাইকে দেখালাম। তিনি পছন্দ করলেন। আমি বললাম, আমরা সকলে এখন যুদ্ধে অবতীর্ণ। এই দলিলের খসড়াটি কোন একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভাল হতো। তিনি বললেন এই মুহূর্তে কাকে আর পাবেন, যদি সম্ভব হয় কাউকে দেখিয়ে নিন।

ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্যে সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। আমি তার লেখা কিছু নিবন্ধ পড়েছি বলে মনে হলো। বিএসএফ-এর মাধ্যমে রায় চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন। বালিগঞ্জে তার বাসা। আমার পরিচয়, ‘রহমত আলী’ নামে। সুব্রত রায় চৌধুরীর বাসায় পৌঁছে তাকে আমার প্রণীত ঘোষণাপত্রের খসড়াটি দেখালাম। খসড়াটি দেখে তিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। এই খসড়া আমি করেছি কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দেই। তিনি বলেন, একটা কমা বা সেমিকোলন বদলাবার প্রয়োজন নেই।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার, তা মানবাধিকারের একটা অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখবেন। এই ঘোষণাপত্রের একটা কপি তাকে দেয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এরপর আইন ব্যবসা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরু করেন। তার রচিত বইটির নাম হচ্ছে ‘জেনেসিস অব বাংলাদেশ’- আন্তর্জাতিকভাবে অধ্যয়নের জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার বহুবিধ বিদ্যালয়ে এখন তা পড়ানো হচ্ছে।

এটা ছিল সুব্রত চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর থেকে যুদ্ধ সমাপ্ত পর্যন্ত তিনি আমাকে বড় ভাই-এর মত সময়ে অসময়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। আমার জন্য তার দুয়ার সর্বদাই ছিল খোলা।

এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানির সামরিক পোষাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোষাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোষাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোন পোষাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তাঁর জন্য পোষাক তৈরি করা হলো।

শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর। ১৬ই এপ্রিল আমরা দু’জনে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দু’জন প্রতিনিধি বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাই নেই। সার্চ লাইটের মত অসংখ্য চোখ আমাদের দিকে নিবদ্ধ। ক্লাবের সেক্রেটারী উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদেরকে প্রথম অনুরোধ জানাই আমাদের উপস্থিতির কথা গোপন রাখতে হবে। এরপর বললাম, আমরা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বার্তা নিয়ে এসেছি।

সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ই এপ্রিল কাক ডাকা ভোরে প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরোধ জানাই। বললাম, তখন তাদেরকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেয়া হবে। তাদের কেউ কেউ আরো প্রশ্ন করতে চাইলেন। আমরা কোন উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করি। এতে তারা কেউ কেউ হতাশও হন। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম।

আওয়ামী লীগের এমপি, এমএনএ এবং নেতাদের খবর পাঠিয়ে দেই রাত বারোটার মধ্যে লর্ড সিনহা রোডে সমবেত হওয়ার জন্য।

বিএসএফ-এর চট্টপাধ্যায়কে বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট ৫০টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছানো হবে।

রাত ১২টা থেকে নেতাদের আমি গাড়িতে তুলে দেই। বলে দেয়া হলো, কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। সকাল বেলা আমরা একত্র হবো। গাড়ীর চালক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবেন। সাইক্লোস্টাইল করা স্বাধীনতা সনদের কপিগুলো গুছিয়ে নিলাম। হাতে লেখা কিছু সংশোধনী রয়েছে। কয়েকজনকে এগুলো সংশোধন করার জন্য দেই।

১৭ই এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন। সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়িতে রওয়ানা হয়ে যান।

আমি ও আব্দুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচী অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। ভোরেও ক্লাবে লোক ধরে নি। ক্লাবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল।

আমি সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করবেন। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি, আমি আপনাদের সাথে রয়েছি, পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়ীগুলো তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়ীতে ওঠেন। তাদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০/৬০ টা গাড়ীযোগে রওয়ানা হলাম গন্তব্যস্থানের দিকে। আমি ও আব্দুল মান্নান দু’জন দুই গাড়ীতে। আমার গাড়ীতে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাদের সাথে অনেক কথা হলো।

শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌছতে ১১ টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তওফিক এলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন।

এদিকে পাক হানাদার বাহিনীর চাপের মুখে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হঠতে হয়েছে। সম্মুখ সমরে হানাদের বাহিনীর মোকাবিলা করা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব নয়। নির্দেশ সত্ত্বেও দেশ মাতৃকার মুক্তি পাগল যোদ্ধারা বাংকার ছেড়ে আসতে রাজি হচ্ছিল না। মাহবুব ও তওফিক তাদের সৈন্যসহ পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়েছিলেন। তারা সুকৌশলে পিছু হটে আসেন। মনোবল ঠিক রেখে পশ্চাদপসরণ করা একটা কঠিন কাজ। ক্লান্ত শ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার থেকে উঠে আসে। ওদের চোখে মুখে বিশ্বাসের দীপ্তি বিদ্যমান ছিল।

কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট্ট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এই স্থানের নাম মুজিবনগর করেন। ১৬ই ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী।

সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তাঁর সাথে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দী। কিন্তু আমরা তা বলতে চাই নি। পাক বাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি অস্বীকার করে তাহলে সমূহ বিপদের আশংকা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিনি দেশের ভেতরে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন হানাদাররা বলে বসবে তিনি বন্দী।

আম বাগানের অনুষ্ঠানে ভর দুপুরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কন্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, ইত্যাদি শ্লোগান।

আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানো। দুপুরের মধ্য অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলো। সাংবাদিকদের গাড়ীযোগে ফেরত পাঠানো হল। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফিরেন সন্ধ্যায়। অনুষ্ঠানের পর কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংবাদ পরিবেশন করেন।

কলকাতার বাসায় ফিরে তাজউদ্দিন ভাইকে জিজ্ঞাসা করি কলকাতায় পাকিস্তান মিশনের হোসেন আলীকে আমাদের পক্ষে আনা যায় কিন। ফরিদপুরের আত্মীয় শহিদুল ইসলামের মাধ্যমে হোসেন আলীর সাথে যোগাযোগ করা হল। হোসেন আলী প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে রাজী হলেন।

গঙ্গার ধারে একটি হোটেলে দু’জনের সাক্ষাৎ হল। হোসেন আলী আমাদের পক্ষে আসতে রাজী হলেন।

ইতিমধ্যে বিশ্বে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য লণ্ডনে ফোন করি। লণ্ডনের গেনজেজ হোটেলের মালিক তসদ্দুক আহমদ আমার পুরাতন বন্ধু। এক কালে তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার সাথে যোগাযোগ করে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর ফোন নম্বর পেলাম। বিচারপতি চৌধুরী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই লণ্ডনে ছিলেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

বিচারপতি চৌধুরীর মাধ্যমে লণ্ডনের তৎকালীন কাউন্টি কাউন্সিলের সদস্য এলভারস্যান, শ্রমিক নেতা ডোনাল্ড চেসয়ার্থ-এর সাথে যোগাযোগ করি। ডোনাল্ড আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। লণ্ডনে ব্যারিষ্টারী পড়ার সময় তার সাথে আমার পরিচয়। পরিচয় সূত্রেই বন্ধুত্ব। ডোনাল্ড ও অন্যান্যদের আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা করার আবেদন জানাই।

লণ্ডনে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ডোনাল্ডের যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিলাম। তার সাথে টেলিফোনে কথা হল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সার্বিক সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। সে সময় রকিব সাহেব সিলেট থেকে কলকাতা আসেন। তিনি লণ্ডনে যাবেন। তার কাছে আবু সাঈদ চৌধুরীকে একটা চিঠি দিলাম। চিঠিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে মত গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে আহবান জানাই। চৌধুরীর সাথে আমার ফোনেও যোগাযোগ হল।

১৮/১৯ তারিখের দিকে ওয়াশিংটন থেকে হারুনুর রশীদ এলেন। তিনি বিশ্ব ব্যাংকে চাকুরী করেন। তার কাছে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের মনোভাব জানতে পারলাম। ওয়াশিংটনে এ এম মুহিত ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় তারা একটি গ্রুপ গঠন করেছেন। তিনি তাদের পক্ষে তাদের সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। দিল্লী থেকে কলকাতা ফিরে আমরা খবর পেয়েছিলাম প্রফেসর নুরুল ইসলাম কোলকাতায় আছেন।

মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহনের পরদিন (১৮ই এপ্রিল) স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আরো একটি স্মরণীয় দিন। এই দিন সকালবেলা কলকাতা পাক মিশনের হোসেন আলীসহ প্রায় সকল কর্মকর্তা বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। সার্কাস এভিনিউতে অবস্থিত পাক দূতাবাসে এত দিন ধরে যেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়তো, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হল। এই ঘটনায় দেশে বিদেশে এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দূতাবাসে সেদিন জনতার ঢল নামে। বিভিন্ন সংগঠন মিছিল করে সার্কাস এভিনিউতে এসে হোসেন আলীকে স্বাগত সম্ভাষন জানায়। ফুলের মালায় মিশনের প্রাঙ্গন ভরে যায়।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী আমাকে প্রেরণ করেন হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে। হোসেন আলীর স্ত্রী, দুই কন্যা এবং এক ছেলের সাথে পরিচয় হল। তারা সকলেই স্বাধীনতা যুদ্ধে শরিক হলেন। হোসেন আলীর স্ত্রী খুবই সাহসী মহিলা। এ ব্যাপারে স্বামীকে তিনি প্রচণ্ড সাহস যুগিয়েছেন।

বিদেশী বেতারের সাথে বাংলাদেশের পাক দস্যুদের অত্যাচারের করুণ কাহিনী তিনি বর্ণনা করেন। কান্নাজড়িত তার এই বক্তব্য কলকাতা বেতারে প্রচারিত হয়। এই মহিলার হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য যারা শুনেছেন তারাই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন।

১৮ই এপ্রিলের পূর্ব রাতে বেগম হোসেন আলী ও তার একমাত্র মেয়ে মিলে স্বাধীণ বাংলার পতাকা তৈরি করেন। আমি থাকতে থাকতে বহু লোক এলো হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে। বেশীক্ষণ সেখানে আমি অবস্থান করি নি। বহু গণ্যমান্য লোককেও আসতে দেখলাম।

বাংলাদেশের বহু লোক পাক বাহিনীর অত্যাচারে কলকাতায় শরণার্থী হয়েছে। তাদের জন্য সাহায্য প্রয়োজন। ১৯শে এপ্রিল থেকে মিশনে কাপড়, অর্থ ইত্যাদি সাহায্য আসতে থাকে। হোসেন আলী আগেই পাক মিশনের অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে রেখেছিলেন। এই অর্থ দিয়ে মিশন পরিচালনা করা হবে।

পাক মিশনের একজন মাত্র কর্মচারী বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেননি। তিনি তার বাসায় রয়ে গেলেন। মিশনে আসেন না। এই ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে তার বাসায় গেলাম। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। ১৯৬৪ সাল, তখন মোনায়েম খানের রাজত্ব। এই ভদ্রলোক সে সময় পাবনার পুলিশ সুপার ছিলেন। তার নাম আর আই চৌধুরী। সরকার বিরোধী এক মিছিল করায় পাবনায় সে সময় বহু লোককে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের দলের নেতা মনসুর আলী তখন জেলে। আমি ও নাইমুদ্দিন পাবনা গিয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করি এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পত্রিকায় একটা রিপোর্ট প্রকাশ করি। জেলে আমাদের নেতাদের সাথে দেখা করার পর আদালতে তাদের জামিনের আবেদন করি।

পুলিশ সুপার আর আই চৌধুরীর প্রচণ্ড দাপটের কথা তখন আমার মনে পড়ছিল। তবে ‘৬৪ সালের চেহারার সাথে আজকের চেহারার কোন মিল নেই। তার স্ত্রী তখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। কিছুদিন পর তার স্ত্রীর কলকাতা আসার পর আর আই চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর ডালিম তার মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়ের পিতা রাজী হননি। পরে ছেলে মেয়ে নিজেদের উদ্যোগে বিয়ে করে। তাজউদ্দিন ভাই তাদের মিলিয়ে দেন।

ক্রমশঃ আমাদের লোকজন বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থান সংকুলান হচ্ছে না। বিএসএফ বালিগঞ্জে একটি বাড়ী ভাড়া করে। আমরা সেই বাড়ীতে উঠি। তাজউদ্দিন ভাই ও আমি একটি ঘরে। অন্য একটি ঘরে সৈয়দ নজরুল ও মনসুর ভাই এবং পৃথক একটি ঘরে খন্দকার মোশতাককে। কামরুজ্জামান ভাই থাকতেন তার এক বন্ধুর বাড়ীতে।

১৯শে এপ্রিল বাংলাদেশ মিশনের একটি ভবনে তিন তলায় আমি অফিস করছি। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে আবেদন করা। কয়েকজন টাইপিস্ট আমার সাথে রাত দিন কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর ১০ই এপ্রিল ও ১৭ই এপ্রিলের বক্তৃতা বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতে হবে। স্বীকৃতির আবেদনপত্রসহ বক্তৃতার বহু কপি তৈরী করা হলো। স্বীকৃতির আবেদনে দস্তখত নিয়ে একটুর ঘাপলার সৃষ্টি হল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক এগুলোতে নানা অজুহাতে সই দিতে দেরী করলেন। এদিকে আমি অস্থির হয়ে গেছি। কয়েকদিন গড়িমসি করে পরে তিনি সই করেন।

স্বীকৃতির এই আবেদনপত্রগুলো কিছু ডাকযোগে আবার কিছু লোক মারফত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করা হয়। আবদুস সামাদ আজাদ কিছু চিঠিসহ বিদেশের পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আমাদের এই স্বীকৃতির আবেদনের খবর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

মোশতাক সাহেবের পরিবার আনার জন্য ডঃ টি হোসেন আগরতলা থেকে আবার ঢাকা ফিরে গেছেন। আমার পরিবারের খবর সম্ভব হলে নেয়ার জন্য ডঃ টি হোসেনকে অনুরোধ করেছি। কিন্ত তিনি ঢাকায় সন্ধান করেও আমার পরিবারের কোন খোঁজ পাননি। তার আগেই আমার পরিবারকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছে। ডঃ হোসেন আমার প্রতিবেশী ডঃ নাইমুর রহমানের বাসায় আমার পরিবারের খোঁজ করেছিলেন। তারা ভাল আছেন বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু কোথায় তারা ছিলেন এই খবর পাই আরো পরে। কিছুদিন পর ডঃ টি হোসেন কলকাতা ফিরে আসেন।

ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভায় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আমি সন্ধ্যায় মিশন থেকে বাসায় ফিরে জানলাম, আমাকে প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রিন্সিপাল এইড’ করা হয়েছে। আমার সহকারী হুইপ আবদুল মান্নানকে প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়।

আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম, আমাকে কেন এই পদে নিয়োগ করা হলো। তিনি বলেন, এটা মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত এবং আমারও ইচ্ছা। পুনরায় জিজ্ঞাসা করি, আমার করণীয় কি হবে? তাজউদ্দিন ভাই জানান, “প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি যা কিছু করবো তার সবকিছুই আপনার কাজের অংশ হবে।”

এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কিছু বেসামরিক অফিসার এসে গেছেন। পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের, রাজশাহীর জেলা প্রশাসক হান্নানসহ আরো অনেকে। এদের কাজ দেয়া হলো। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক কয়েকদিন কাজ করে ফিরে চলে যান।

সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে শত শত লোক প্রতিদিন আসছে। এদের মধ্যে সরকারী কর্মচারী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, উকিল, ছাত্র-যুবক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বিভিন্ন স্তরের লোক রয়েছে। সকলেই চলে আসে বাংলাদেশ মিশনে। এদের পেশা উল্লেখ করে নাম ঠিকানা রেকর্ড হতে লাগলো। পেশা জানার উদ্দেশ্য হল প্রয়োজনে কাজে লাগানো। মিলিটারী, পুলিশ, বিডিআর, মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হলে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার কথা ছিল। এখান থেকে আমি তাদের প্রয়োজনীয় কাজে লাগাবার চেষ্টা করতাম।

এ সময়টা আমাদের জন্য চরম সংকটের সময় ছিল। পাক হানাদার বাহিনী প্রচণ্ড হামলা করে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রায় সকল ফ্রন্ট থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করছে। এ সময়ে তাদের মনোবল ঠিক রেখে যুদ্ধ পরিচালনা ছিল খুব কঠিন কাজ।

বনগাঁ সীমান্তে একটা তাঁবুতে মেজর ওসমান, তওফিক এলাহী ও মাহবুব তাদের দল বল নিয়ে অবস্থান করছেন। তখনো তারা ভারতে ভেতরে প্রবেশ করেন নি। কাষ্টম চেক পোষ্টের ওপারে তাদের ছাউনী।

সারাদিন অফিসে খুবই ব্যস্ত থাকতাম। কিন্তু শত ব্যস্ততার মধ্যেও সীমান্তে যোদ্ধাদের খোঁজ খবর প্রতি সন্ধ্যায় নিতে চেষ্টা করতাম। এ সময় আমার জুনিয়র পার্টনার ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ কলকাতা পৌঁছেন। সহযোগিতা করার জন্য তাকে আমার সাথেই রাখলাম। আমার অফিসের পাশে একটা ঘরে তার বসার ব্যবস্থা হলো। প্রথম দিকে তিনি বিদেশী প্রেসের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এ কাজ তিনি খুবই দক্ষতার সাথে করেন। পরে তাকে বহিঃপ্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়।

এরপর বাংলাদেশ সরকার ডাকঘর স্থাপন করেন। মওদুদ আহমদ পোষ্ট মাষ্টার জেনারেল হন। বিমান মল্লিকের নকশা করা স্ট্যাম্প বাজারে ছাড়া হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মারক হিসেবে এই স্ট্যাম্প ছাড়া হয়।

দৈনিক প্রচুর লোক আসতো। এসেই জিজ্ঞাসা করতো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কোথায়? সোজা জবাব দিতাম, ‘এই প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারবে না। আপনাকে ম্যানেজ করে নিতে হবে। অর্থাৎ আপনি আমাদের ম্যানেজ কমিটির সদস্য হলেন। যেখানে রাত হবে, সেখানেই ঘুমাবার চেষ্টা করবেন। কেউ খেতে বললে কোন আপত্তি করবেন না।’

কলকাতায় অনেকের বন্ধু বান্ধব রয়েছে। অনেকে আবার বাংলাদেশে থেকে গেছেন। কিছু কিছু বাংলাদেশী সেই সূত্রে আশ্রয় লাভ করেছেন। মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে থাকতেন কেউ কেউ। পরে মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ীর পাশে একটি স্কুলে ক্যাম্প তৈরী করা হয়। এমনিভাবে কলকাতা শহরে বিভিন্নভাবে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। আগরতলাতেও এমনি ধরনের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আসাম ও মেঘালয়ের জীবন ছিল আরো শক্ত। শেষোক্ত দু’টি রাজ্যের মানুষ তত প্রাণখোলা ছিল না।

এ সময় বৃটেনের শ্রমিক দলীয় সংসদ সদস্য ডগলাস ম্যান কলকাতা আসেন। আমার বন্ধু ডোনাল্ডের চেষ্টায় তিনি আমাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য আসেন। ডোনাল্ড আমাকে ফোন করে বলেন, ডগলাস ম্যান-এর সাথে যেন বাংলাদেশ সরকারের কারো সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেই। ডগলাস ম্যান বৃটিশ হাই কমিশনারের বাড়ীতে উঠেছেন। সেখানে গিয়ে তার সাথে দেখা করি। মিঃ ম্যান ও আমি বাংলাদেশের ভেতরে যাব। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সাথে তার দেখা হবে।

তাজউদ্দিন ভাই ভোরে চলে গেছেন। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম সাক্ষাতের প্রয়োজন। তাই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাষ্টম চেক পোষ্টের কাছে প্রধানমন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আমি ডগলাস ম্যানকে নিয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করি। সেখানে মেজর ওসমানকে পাওয়া গেল। বৃটিশ এমপিকে নিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গেলাম। এই বিদেশীকে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা খুবই খুশী হলো। তারা ডগলাস ম্যান-এর কাছে মুক্তিযুদ্ধ, পাক সেনা হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ইত্যাদি বর্ণনা করেন। আমরা তাকে অনুরোধ করি তিনি যেন আমাদের দূত হয়ে সারা বিশ্বে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর মিঃ ম্যান আমার হাত ধরে বলেন, আমাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করো। তিনি আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। মানবিক গুণে গুণান্বিত খাঁটি পুরুষ ডগলাস তার কথা রেখেছিলেন।

ডগলাস ম্যান-এর এই সফর এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ-এর সাক্ষাৎ-এর খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সাড়া জাগে। ডগলাস ম্যান ফিরে গিয়ে খবরের কাগজ, বৃটিশ পার্লামেন্ট, শ্রমিক দলের বৈঠকসহ বিভিন্ন কমিটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে রিপোর্ট দেন।

ডগলাস ম্যানকে বিদায় করে দিয়ে কলকাতা ফেরার পথে তাজউদ্দিন ভাই ও আমি যশোর অঞ্চল থেকে আগত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক করি। তারা খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে। সেখানেও শরণার্থী সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পথে আসতে আসতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে শরণার্থীসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি।
বাংলাদেশ থেকে খবর আসছে যে, সেখানে সর্বত্র হানাদার বাহিনীর আক্রমনের প্রচণ্ডতা বৃদ্ধি পেয়ছে। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হানাদার বাহিনীর অত্যাচার যত বৃদ্ধি পাচ্ছে শরণার্থীদের সংখ্যাও সেই হারে বেড়ে চলেছে। ২৫শে মার্চের পর ঢাকা থেকে যে হারে মানুষ গ্রামে চলে গিয়েছিল আজো সেই হারে বাংলাদেশ থেকে মানুষ সীমান্ত পার হয়ে আসছে।

কলকাতা ফিরে আইনজীবী সুব্রত রায় চৌধুরীর সাথে শরণার্থী নিয়ে আলোচনা করি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতির কর্মকর্তাদের সাথে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেন। সমিতির সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি বলেন, পরদিন তিনি সীমান্তের দিকে যাবেন। কৃষ্ণনগর ও নদীয়া জেলা সীমান্তে। আমি গেলে তিনি নিয়ে যেতে পারেন। আমি রাজী হলাম। কথা হলো, তিনি আমাকে বাংলাদেশ মিশন থেকে তুলে নেবেন।

সীমান্তে যাওয়ার জন্য আমি হাতের কাজ গুছিয়ে নেই। আমার সেখানে যাওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারণ, সীমান্তের এই অঞ্চলে নিজের জেলা কুষ্টিয়ার অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হবে। কৃষ্ণনগরে গিয়ে দেখি, স্থানীয় সমাজকর্মীরা এক বাড়ীতে অফিস করেছে। সেদিন সেখানে শরণার্থী সমস্যার সমাধান ও মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সর্বদলীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বৈঠক আহবান করা হয়েছে। প্রফেসর দিলীপ চক্রবর্তী বৈঠকে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমাকে পেয়ে তারা খুশী হন।

আমি সমাবেশে আমাদের সংগ্রাম, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে আলোচনা করি। বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিম বঙ্গের সচেতন অধিবাসীদের কাছ থেকে কি আশা করি তাও জানালাম। ছোটবেলায় দাদুর মুখে শোনা কৃষ্ণনগর, ‘পুতুল খেলার কৃষ্ণনগর’ আজ স্বচক্ষে দেখলাম। বাংলাদেশের ভিটে মাটি হারা মানুষ আসছে। কিন্তু এপারের জনগণ আঁতকে ওঠে নি। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় বলেই এপারের মানুষ ওপারের ভাগ্যহত মানুষদের আশ্রয় দিচ্ছে। বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসলে চুয়াডাঙ্গার সকল কর্মী ভাইয়েরা আমার সাথে কোলাকুলি করেন। এদের মধ্যে মিছকিন মিয়া, ফকীল মোহাম্মদ, ডাঃ নজির আহমদসহ আরো অনেকে ছিলেন। তাদের মুখে অনেক কথা শুনলাম। আমি তাদেরকে বললাম, এদেশে আমরা যেন বাস্তুহারা হয়ে না যাই। এই যুদ্ধে সকলকে অংশ নিতে হবে। যিনি অস্ত্র হাতে নিতে পারবেন, তিনি প্রশিক্ষণ নেবেন। আর যিনি তা পারবেন না, তাকে সহকারী হিসেবে যুদ্ধের সামগ্রী বহন করতে হবে। সকলকে একত্র থাকতে হবে। যা পাই তা ভাগ করে খেতে হবে। আমি তখন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব ছাড়াও জেলার প্রতি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।

এর পর আমি কয়েকদিন ধরে কুষ্টিয়া জেলার দলীয় কর্মীদের খুজে বের করি। চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রচার সম্পাদক (বর্তমানে জাসদ নেতা) মীর্জা সুলতান রাজা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কুষ্টিয়া আওয়ামী লীগ সংগঠনের সাংগঠনিক ব্যাপারে তিনি আমাকে সক্রিয়া সহায়তা করেছেন। সমাজতান্ত্রিক ও বিপ্লবী কর্মী গড়ে তোলার ব্যাপারে তার প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। তাকে খুজে বের করি। মীর্জা সুলতান, আবুল হাশেম, ডাঃ নাজিরসহ আরো অনেকে মিলে একটি বাড়ীতে একটি ক্যাম্প গড়ে তুলেছেন। বিভিন্নভাবে তাঁবু, খাবার ও রান্নার জিনিসপত্র যোগাড় করা হলো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি বিশেষ করে দিলীপ চক্রবর্তী এ ব্যাপারে বিশেষ সহযোগিতা করেন।

এমনিভাবে বয়রা, মামাভাগ্নে, কৃষ্ণনগর, শিকারপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের দলীয় কর্মীদের উদ্যোগে ছোট ছোট ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এগুলোর মধ্যে শিকারপুরের অবস্থা অতি করুণ। কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী, রাজাবাড়ী ইত্যাদি অঞ্চলের লোকজন এখানে জমা হয়েছে। একটি ছোট গুদাম ঘর স্থানীয় লোকেরা ছেড়ে দিয়েছে। সেখানে সকল রাজনৈতিক কর্মী স্থান নিয়েছেন। কুষ্টিয়ার আব্দুল হামিদ, আজিজ মিয়া, আবুল কালাম, জলিল সবাই এখানে স্থান নিয়েছেন। এক হাঁটু পানি দিয়ে এই গুদাম ঘরে যেতে হয়। কোন রকমে ছাউনি দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাটিতে বিছানা পেতে থাকতে দেয়া হয়েছে। এত কষ্টের মধ্যে থেকেও এদের মনোবল ও উদ্দীপনা কমে নি। কিভাবে দেশ স্বাধীন হবে, এই যেন তাদের সবসময়ের চিন্তা। মেহেরপুরের এমপিএ মহিউদ্দিন, এমপিএ নুরুল হক, জলিল এদেরকেও খুঁজে পেলাম। তারা একটি পাটের গুদামে আশ্রয় নিয়েছে।

আমাদের সকলের চিন্তায় এক অদ্ভুত মিল রয়েছে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যে এক পরিবারভুক্ত তা বিপদের দিনে বুঝা যায়। কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। যা পাবে, তা সকলে মিলে ভাগ করে খাবে এমনি মনোভাব গড়ে উঠেছে। সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা ঘুরতে ঘুরতে অনেক রাত হয়ে যেতো। কোন কোন দিন রাত ১২ টার দিলে কলকাতা ফিরতাম। দিনের বেলা অফিসে আর রাতের বেলা সীমান্তে এই ছিল নিত্যদিনের কাজ। প্রধানমন্ত্রীকে প্রায়ই মনঃক্ষুণ্ণ মনে হতো। নকশালীদের তখন চরম দাপট। কৃষ্ণনগর, রানাঘাট অঞ্চলে তাদের তৎপরতা চলছে। তেমনি কলকাতায়ও। ২/১ ঘন্টা ঘুমিয়ে, উঠে পড়তাম। সকালে নাশতার টেবিলেও তাজউদ্দিন ভাই-এর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো। ১২/১ টার মধ্যে মিশনে গিয়ে কাজ শেষ করতাম। এরপর হোসেন আলীর সাথে দুপুরের খাবার সেরে নিতাম। হোসেন আলীর স্ত্রী ডালভাত পাক করতেন। বিদেশ থেকে পাওয়া চিঠিপত্রের সংক্ষিপ্ত সার ও প্রেস ক্লিপস প্রধানমন্ত্রীকে দিতাম। দুপুরের খাওয়া শেষ করে সীমান্তের দিকে রওয়ানা হতাম।

ইতিমধ্যে শরণার্থী সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করলো। সীমান্তের কাছাকাছি ভারতের কয়েকটি রাজ্যের স্কুল কলেজগুলো বন্ধ করে দিতে হলো। বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীরা এগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় উদ্যোগে শরণার্থীদের সাহায্য করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা এতো ব্যাপক যে কেন্দ্রীয় উদ্যোগ ছাড়া এর সমাধান সম্ভব ছিল না। ভারত সরকার চাল, ডাল ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেন কিন্তু রান্নার হাঁড়ি, পাতিল, বাসন কোসনের অভাব রয়েছে। পায়খানা প্রস্রাব করার স্থানেরও অভাব। পানির ব্যবস্থা নিতান্ততই অপ্রতুল। এই অবস্থার জন্য আশ্রয়দাতা ও আশ্রিত কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় বিভিন্ন শিবিরে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা এসব সমস্যার আশু সমাধানের চেষ্টা করছে। কোন কোন শিবিরে কলেরা, রক্ত আমাশয় ইত্যাদি রোগ দেখা দিয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দীর্ঘ সীমান্ত পথ পাড়ি দিয়ে শিবিরে এসে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অনাহার ও রোগের বেশী শিকার হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে মা মৃত শিশুকে সৎকার না করে পথিমধ্যে ফেলে এসেছে। অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের আহার, বিশ্রাম প্রয়োজন। শরণার্থী শিবিরের করুণ অবস্থার দেখে চোখের জল বাধ মানে না। কিন্তু দুরবস্থার মধ্যে থেকেও মানুষের মনোবল কমে নি। কলকাতার বন্ধুদের আমাদের এই দুরবস্থার কথা জানাই। বিভিন্ন ত্রাণ সমিতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসে।

মৈত্রেয়ী দেবী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা কমিটির আহ্বায়িকা। তিনি ছোট এক ত্রাণ তহবিল গঠন করেছেন। রবি ঠাকুরের স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী দেবী বাংলার মানুষের দুঃখের দিনে এগিয়ে এলেন। তাকে নিয়ে আমি বিভিন্ন শিবিরে গিয়েছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, বিশেষ করে শরণার্থী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

একটি লিফলেট ছাপা হলো। লিফলেটে শরণার্থী শিবিরে থাকার নিয়ম কানুন, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি লিখা ছিল। এটা শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। প্রথম দিকে বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার সাহায্যে শিবিরগুলো পরিচালিত হয়। পরে অবশ্য এগুলোর ভরণ-পোষণের দায়িত্বভার কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহন করে। চব্বিশ পরগণা অঞ্চলে বরিশাল ও স্থানীয় সমাজ কল্যাণ সংস্থাগুলোর সহায়তায় শরণার্থী শিবিরগুলো পরিচালিত হতে থাকে।

বিভিন্ন সেক্টরে সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজ চলছে। আগরতলাতে খালেদ মোশারফ ও শফিউল্লাহ নিজ নিজ ছাউনীতে নিয়মিত বাহিনীর সাথে অনিয়মিত মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছেন। নতুন নতুন যোদ্ধা তৈরী হচ্ছে। পাক বাহিনীর সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লড়াইয়ে নবাগতরা অংশগ্রহণ করে।

আমাদের সাথে ভারত সরকারের কথা হয়েছিল তারা ১ লাখ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেবে। এছাড়া একটি বেতার ষ্টেশন চালুর ব্যাপারেও ভারত সরকার প্রতিশ্রুতি দেন। এদিকে ভারত সরকারের বিভিন্ন এজেন্সীর লোক আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে। কখনো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কখনো সামরিক লিয়াজো আমাদের কাছে আসছে। এসব বিষয়ে সমন্বয় সাধনের জন্য বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নেয়।

মিসেস গান্ধীর সাথে দেখা করার জন্য সকল মন্ত্রী দিল্লী যান। দেখা করে তারা কলকাতা ফিরে আসেন। এ সময় ওসমানী রাজনৈতিক সচেতন ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাব করেন। রাজ্জাক, তোফায়েল প্রস্তাব নিয়ে আসেন তাদের দায়িত্ব দিলে তারা ভাল ছেলে রিক্রুট করে দিতে পারে। ওসমানী তাদের প্রস্তাবে উৎসাহ প্রকাশ করেন। তিনি আমার পাশের ঘরে থাকতেন। বালিগঞ্জে তার অফিস ছিল। তার অফিস তখনো ভালোভাবে গড়ে ওঠে নি। তিনি আমাকে একটা অথোরাইজেশন লেটার লিখে দেয়ার অনুরোধ করেন। আমি তা লিখে টাইপ করে দিয়ে দিলাম। ওসমানী তার পক্ষে রাজ্জাক, তোফায়েলকে রিক্রুট করার অধিকার দিয়ে দিলেন। এই চিঠির সুযোগ গ্রহণ করেই শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আ, স, ম, আবদুর রব ‘মুজিব বাহিনী’ নামে আলাদা বাহিনী গড়ে তোলেন।

ভারতের ২টি স্থানে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জেনারেল ওভান এই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। আজ পর্যন্ত আমি বুঝে উঠতে পারছি না মুজিব বাহিনী নামে এই আলাদা বাহিনীর কোন প্রয়োজন ছিল কি না। তবে যদ্দুর জেনেছি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র”-এর সাথে শেখ মনির লবি ছিল। তাকে বুঝানো হয় যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সে সময় নেতৃত্ব দিতে অসমর্থ হবে। অথবা এই নেতৃত্ব কোন প্রকার আপোষ করতে পারে। তাকে আরো বুঝানো হয়, যে যুব শক্তি স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটিয়েছে, তারাই কেবলমাত্র সঠিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। প্রয়োজনে এই নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারবে। তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হলে নব্যশক্তি চীন বা নকশাল পন্থীদের স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে। পরে আরো জেনেছি, ভারত সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয় যার অর্থ হলোঃ “এক বাক্সে সকল ডিম না রাখা”।

বিএসএফ-এর রুস্তমজী মুজিব বাহিনী গঠনের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তার প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য করা হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ভারত সরকার মুজিব বাহিনী গঠন সংক্রান্ত এই সিদ্ধান্ত মুজিব নগর সরকারের কাছে গোপন রাখে। তবে মুজিব বাহিনী গঠনের বিষয়টি আমাদের কাছে আর গোপন থাকেনি। তাজউদ্দিন ভাই-সহ আমাদের অনেককে এই সিদ্ধান্ত পীড়া দেয়। জাতি যখন সম্পূর্ণভাবে একটি নেতৃত্বের পেছনে ঐক্যবদ্ধ ও আস্থাবান তখন যুব শক্তিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের যেমন সহায়ক হয় নি, তেমনি পরে দেশ পুনর্গঠনের কাজেও অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর চেয়ে বড় বিপর্যয় (সেট ব্যাক) আর কিছু হতে পারে না। আমাদের এমপি, এম এন এ ও নেতাদের মনোনীত ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওসমানীর প্রত্যাশিত ‘সোনার ছেলে’ পাওয়া গেল না। মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ তাকে এই সুযোগ দেয় নি। ওসমানীর প্রাথমিক ধারণা ছিল তারা হয়তো তাদের দায়িত্ব পালন করেন নি। কিন্তু পরে তিনি জানেন, এই দায়িত্বের ভার নিয়ে তারা অন্য দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলেন।

স্বাধীন বাংলা বেতার প্রতিষ্ঠার জন্যে সবাই তাগিদ দিচ্ছে। এটা আমাদের পরিকল্পনার শুরুতেই প্রধান কর্মসূচী ছিল। আমার জানামতে আমাদের নিজস্ব বেতার ষ্টেশন স্থাপনের ব্যাপারে ভারতে প্রধানমন্ত্রী খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। এ ব্যাপারে একটা নির্দেশ আসার কথা ছিল। কিন্তু কোন কারণে এতে জটিলতা দেখা দেয়। ভারতীয় আমলাতন্ত্রের জট খুলতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়।

ইতিমধ্যে ভারতীয় বৈদেশিক অফিসের মিঃ রয়, মিঃ নাথ, কংগ্রেসের বহু নেতা উপনেতা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। ত্রিগুণা সেনের সাথে বাংলাদেশ মিশনে পরিচয় হয়। তিনিও সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণও আমাদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জানান।

কিছুদিনের মধ্যে ব্যবস্থা এমন হলো যে আমাদের কর্মসূচী রেকর্ড করে তা স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচার করতে পারবো। আমরা বালিগঞ্জের যে বাড়ীতে থাকতাম সেখানে একটা ঘরে রেকর্ড করা শুরু হয়। একটা টেপ রেকর্ডার-এর ব্যবস্থা করে তা করা হয়। কিছুদিন পর থিয়েটার রোডের একটি বাড়ীতে রেকর্ডের কাজ করা হয়। বেতার কেন্দ্রও ঐ বাড়ীতে চলে যায়। আবদুল মান্নান বেতার পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় বৃটেন থেকে ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ আসেন। তার সাথে আসেন “ওয়ার অন ওয়ান্ট”- এর পক্ষ থেকে একটি ছোট্ট প্রতিনিধি দল। সাথে ছিলেন ফাদার হার্ডেলসন ও মাইকের বার্নস এমপি। তিনি আসার আগেই আমাকে খবর দেয়া হয়। প্রতিনিধিদল সরেজমিনে শরণার্থীদের ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে দেখেন।

আমি তাদের থাকার জন্য সুব্রত রায় চৌধুরীর বাড়ীর তিন তলায় ব্যবস্থা করি। কিন্তু তারা সেখানে উঠেন নি; তারা উঠেন গ্র্যাণ্ড হোটেলে। সেখানে উঠেই টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। ফাদার হার্ডেলসন ছিলেন কলকাতায় নিযুক্ত বৃটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার। এই প্রতিনিধিদলের সাথে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তারা জানতে চান কিভাবে আমাদের সাহায্য করবেন। আমি প্রস্তাব করি, “ওয়ার অন ওয়ান্ট” নিজেরা প্রত্যেক ক্যাম্পে সাহায্য করতে পারবে না। কারণ, সমস্যা অতি ব্যাপক। তাই তারা যদি বাংলাদেশী কোন সাহায্য প্রতিষ্ঠান বা বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করেন, তাহলে আমরা তা ক্যাম্পে পৌছাতে পারবো।

ডোনাল্ড পূর্ব থেকেই আমাদের সাহায্যের ব্যাপারে উৎসাহী। তিনি অন্যান্য ট্রাষ্টিদের সাথে আলোচনা করে যথাসাধ্য সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আমার কাছে পরিকল্পনা ও বাজেট চান। আমি তা দিই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথেও এ নিয়ে আলোচনা হয়। শরণার্থী শিবিরের সাধারণ মানুষকে সাহায্য করা ছাড়াও রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী যারা কোন কাজ করতে পারছেন না, তাদের কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমি বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও এর একটা বাজেট পেশ করি। প্রধানমন্ত্রী এই সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন। তিনি এই সংগঠন করার অনুমতি দেন।

বরিশাল থেকে নূরুল ইসলাম মনজুর ও মহিউদ্দিন এম পি অস্ত্রের জন্য আসেন। সে জেলায় তখন প্রচণ্ড প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। বরিশাল শহর ও তার আশপাশ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। তারা জানান, অস্ত্র পেলে সেখানে তারা পাক বাহিনীর মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। আমি বুঝলাম, বরিশালে যে শক্তি আছে, তাদের এদিকে নিয়ে এসে নতুন সাংগঠনিক রূপরেখায় গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু তারা তাদের সংকল্পে অটল। তাদের দু’জনেরই বিশ্বাস অস্ত্র পেলে তারা বরিশাল মুক্ত করতে পারবেন। মেজর জলিল এই সেক্টরের কমান্ডার। বরিশালে তিনি বীরের মত যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাদের অনুরোধ রক্ষার্থে দু’ নৌকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়।

দুর্ভাগ্যবশত পাক চরেরা আগে ভাগে এই খবর পেয়ে যায়। পশ্চিম বাংলার মুসলমানরা সাধারণতঃ আমাদের আন্দোলন সহানুভূতির চোখে দেখতো না। এদের কেউ কেউ হানাদারদের মদদ দিত। নৌকা ভর্তি অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার সময় চব্বিশ পরগনার কোন এক স্থানে পাক বাহিনী এই ছোট্ট নৌকাকে এমবুশ করে। পাক বাহিনীর হামলার হাত থেকে মনজুর রক্ষা পেলেও মহিউদ্দিন ও অপর একজন শত্রুর হাতে বন্দী হন। তাদের অকথ্য নির্যাতন করা হয়। কিছুদিন পর মেজর জলিল ও নূরুল ইসলাম মনজুর দলবল নিয়ে টাকিতে এসে ক্যাম্প স্থাপন করেন।

টাকি থেকে নৌপথে খুলনা সাতক্ষীরা ইত্যাদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমরা যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর ও সংগঠনের অবস্থা এমনিভাবে জানা সম্ভব হতো। হাজার হাজার শরণার্থী এই অঞ্চলে বসবাস করছে। এরা খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীর শরণার্থী। এরা নৌকায় সংসার সাজিয়ে নিয়েছে। দেশ থেকে চাল, ডাল, হাঁড়ি পাতিল সব এনেছে। হাজার হাজার নৌকায় এভাবে লোকজন বসবাস করেছে। ছিন্নমূল মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে কিভাবে ঢেউ-এর সাথে লড়াই করছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। দুঃখী মানুষের এই দুঃসাহসী মনোবল দেখে আমার মন গর্বে ভরে উঠেছে। চব্বিশ পরগনার কয়েকটি অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীসহ আমি বহুবার গিয়েছি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বেশ কিছু বিদেশী সাংবাদিক অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। এরা বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব গাঁথা বিশ্বের জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। এসব বরেণ্য সাংবাদিকদের মধ্যে পিটার হেজেল হার্ষ্ট, নিউইয়র্ক টাইমস-এর সিডনী সেন বার্গ, লা মদের একজন সাংবাদিক ও লণ্ডনের গ্রনেডা টেলিভিশনের প্রতিনিধি শিলার নাম উল্লেখযোগ্য।

শিলা খুব সাহসী মহিলা ছিলেন। তিনি বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের চিত্র সারা পৃথিবীতে প্রচার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলার মুক্তিযুদ্ধ কাল্পনিক কিছু নয়। এক সময় শীলাকে আমি খালেদ মোশারফের যুদ্ধ ক্যাম্পে পাঠাই। খালেদ পূর্বাঞ্চলে এক দুঃসাহসী প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলেছে। খালেদ আমার পুরাতন বন্ধু। আমরা দু’জনেই ঢাকা কলেজের ছাত্র। আমি তখন ছাত্র রাজনীতি করি। সামরিক বাহিনীতে যাওয়ার পরেও তার সাথে আমার দুই-একবার দেখা হয়েছে। খালেদের দুঃসাহসিক বীরত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। খালেদ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে শফিউল্লাহ, এম, এ, জলিল, রফিকুল ইসলাম, ওসমান চৌধুরী, নূরুজ্জামান, নজমুল হুদা, তওফিক, মাহবুবসহ আরো অনেকের ভূমিকা ছিল অনন্য।

শিলা খালেদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় এক সপ্তাহ বাংকারে বসে ছবি তুলেছেন। তিনি ফিরে এসে আমাকে বলেন, আমি যা দেখেছি, এতে জোর দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। পৃথিবীর কোন শক্তি এই অদম্য স্পৃহা দমাতে পারবে না। শিলা খালেদের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমনিভাবে টেলিভিশন ক্রুসহ বিদেশী প্রতিনিধি নিয়ে বহুবার রণাঙ্গনে গেছি। একদিন বয়রার কাছে একটি ক্যাম্পে যাই। ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা ঐ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন।

একটি পানি ভেঙ্গে শিবিরে যেতে হয়। কয়েকদিন পূর্ব থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিলো। ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি কোথাও কোন শুকনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। ছেলেদের গায়ের কাপড় ভিজে গেছে। আমরা সবাই শীতে থর থর করে কাঁপছি। বিকেল ৩/৪টা বেজে গেল, তবুও তাদের খাওয়া হয়নি। ভেজা কাঠে রান্না করতে হলো। তবুও হুদা কোন অভিযোগ করলেন না। ফেরার সময় হুদা শুধু বললেন, কিছু মশারী দিতে পারলে ভাল হয়। মশার খুবই উৎপাত। পরদিন দিলিপ চক্রবর্তীর কাছে মশারী চাইলাম। তিনি কয়েক’শ মশারীর ব্যবস্থা করে দিলেন। দুই দিন পর এই মশারী সহ ক্যাম্পে যাই। সেদিন লুঙ্গি ছিল। তাই ক্যাম্পে পৌছাতে কোন অসুবিধা হলো না। হুদার সাথে অনেক আলোচনা হলো। মুকিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণের পর দেশে পাঠানো এবং দেশে এদের পরিচালনার ব্যাপারে নেতৃত্বের অভাব ইত্যাদি বিশয় নিয়ে আলোচনা করলাম। আমি এসব বিষয় নিয়ে পরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করি। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানাই।

বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় বহু অধ্যাপক, শিক্ষক এসেছেন। এদের মধ্যে ডঃ সারওয়ার মোর্শেদ, বেগম নূরজাহান মোর্শেদ, ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ মোশাররফ হোসেন, ডঃ স্বদেশ বোস-এর সাথে কথা হল। আমরা কিছু কাজ তাদের কারো কারো মধ্যে ভাগ করে দিলাম। এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা বিবৃতি তৈরী করার দায়িত্ব ডঃ সারওয়ার মোর্শেদ ও ডঃ আনিসুজ্জামানকে দিলাম। তারা খসড়া তৈরী করতেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে এগুলোর চূড়ান্ত রুপ দিতাম। ডঃ মল্লিককে বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হলো। তার প্রচেষ্টায় সেখানে শিক্ষক সমিতি গড়ে ওঠে।

(স্কুল) শিক্ষক সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামান এই শিক্ষক সমিতির ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেন। বন্ধু মঈদুল হাসানও কলকাতা আসলেন। তাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কয়েক দফা বৈঠক হলো। তিনি দিল্লী চলে গেলেন। সেখানে নেপথ্যে থেকে তিনি আমাদের লবি সৃষ্টি করেন।

এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক কোন কাজেই হাত দিচ্ছেন না। মাহবুব আলম চাষী ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে আগরতলা থেকে কলকাতা আসার জন্য মোশতাক চাপ দিচ্ছেন। মোশতাক-এর দাবী অনুযায়ী তাদের দু’জনকে কলকাতা আনা হলো। চাষীকে মোশতাক আহমদ পররাষ্ট্র সচিব এর পদের নিয়োগ করেন। আমি বুঝলাম আমার মাধ্যমে বিদেশের সাথে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে যোগাযোগ হচ্ছিল তাতে মোশতাক খুশী হতে পারেন নি। চাষী কাজ শুরু করেছেন। মোশতাক এরপর দাবী করলেন, বাংলাদেশ মিশনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য কোন বিভাগ থাকতে পারবে না। এতদিন আমি বাংলাদেশ মিশনে কাজ করেছি। মোশতাকের এই নতুন দাবীর অর্থ বুঝতেও আমার অসুবিধা হলো না। অর্থাৎ আমাকে সার্কাস এভিনিউস্থ পররাষ্ট্র মিশন থেকে তাড়াতে হবে।

থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আমার বসার ব্যবস্থা হলো। আমার পরিবার না আসা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও আমি একটি ঘরের দুইটি চৌকিতে থাকতাম। থিয়েটার রোডের বাড়ীটি বেশ বড়। সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার না আসা পর্যন্ত তিনিও এখানে থাকতেন। এরপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক ও কামরুজ্জামান পৃথক পৃথক ফ্ল্যাটে ওঠেন। কিন্তু পরিবার আসার পরেও প্রধানমন্ত্রী থিয়েটার রোড ত্যাগ করেন নি। তাজউদ্দিন ভাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে, ততদিন তিনি পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না। তিনি বলতেন, যুদ্ধরত অবস্থায় যোদ্ধারা যদি পরিবার বিহীন অবস্থায় থাকতে পারে, আমি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তা করতে পারবো না কেন? তিনি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন।

আমার পরিবার আসতে অনেক দেরী হয়ে যায়। ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আমার ছোট্ট পরিবার ৩ ভাগে বিভক্ত ছিল। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে, ছেলে প্যাবলু স্ত্রীর সাথে, আর মেয়ে শম্পা তার নানীর সাথে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জে। ২৫শে মার্চের পর পাক বাহিনী নারায়ণগঞ্জ আমার শ্বশুরের বাড়ী এবং স্ত্রীর ভাই মুস্তফা সারোয়ারের বাড়ীতে আগুন দেয়। মেয়েটি তার নানীর সাথে মানুষের মিছিলে শামিল হয়। এরপর বহু কষ্টে শ্বশুরের পৈতৃক বাড়ী দাউদকান্দির জামালকান্দিতে উপস্থিত হয়।

আমার স্ত্রী লীলা আমার কোন খোঁজ খবর পাননি। বাড়ীওয়ালী বেগম হাবিবউদ্দিন ওপর তলায় থাকতেন। আমাদের সাথে তার খুবই সদ্ভাব ছিল। আমি তাকে খালাম্মা ডাকতাম। তিনিও পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। কিন্তু ২৫শে মার্চের পর আমার স্ত্রীকে ৪ বছরের ছেলেসহ বাড়ী ছাড়তে বাধ্য করেন। স্ত্রী পাশের বাড়ীর নাইমুর রহমানের সাথে আমার খোঁজে মুসা সাহেবের বাড়ীতে যান। আমি মুসা সাহেবের বাড়ীর ছাদের যে ঘরে থাকতাম, সেখানের একটি চৌকিতে একটি রক্তাক্ত চাদর ছিল। আমার স্ত্রী এই চাদর দেখে ফেলেন। ২৫শে মার্চে রাতে সে চৌকিতে একজন গাড়ী চালক ঘুমিয়েছিলেন। হানাদারদের গুলিতে সে নিহত হয়। এরপর লীলা আমার খোঁজে শ্বশুরবাড়ী নারায়ণগঞ্জে রওয়ানা হন। কিন্তু তিনি সেখানে যেতে পারেন নি। ফতুল্লায় পাকবাহিনী ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখে। ফিরে এসে তিনি দু’একজন আত্মীয় স্বজনের বাসায়ও যান। কিন্তু অনেকেই সেদিন তাকে ভাল চোখে দেখেন নি। তবে কোন এক সাহসী সহৃদয় আত্মীয়ের বাড়ীতে আমার স্ত্রী প্রায় দু’সপ্তাহ অবস্থান করেন। সেখান থেকে ডঃ নাইমুর রহমানের স্ত্রীর সহযোগিতায় গাড়ীযোগে তিনি নারায়ণগঞ্জ যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে শ্বশুরবাড়ীর কাউকে না পেয়ে নৌকাযোগে জামালকান্দি চলে যান। তখনো আমার মেয়ে সেখানে পৌছে নি। নদীর প্রায় কাছাকাছি আমার শ্বশুরের গ্রামের বাড়ী। মিলিটারী হামলার আশংকায় আমার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে গ্রামান্তরে দৌড়াতে হয়েছে। তা’ছাড়া তিনি তখনো জানতে পারেননি আমি কোথায়, কী অবস্থায় রয়েছি। আওয়ামী লীগের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী রহমত আলীর কাছে খবর পেলাম আমার স্ত্রী জামালকান্দিতে রয়েছেন। রহমত আলীর কাছে তাজউদ্দিন ভাই-এর পরিবারের খবর পাওয়া গেল। রহমত আলী জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে নিয়ে আসবেন। আমি রহমত আলীর কাছে চিঠি দিলাম। রহমত আলী প্রথমে বেগম তাজউদ্দিন ও জুন মাসের শেষ দিকে আমার পরিবারের লোকজনকে কলকাতায় নিয়ে আসেন।

মে-জুন মাসের দিকে আগরতলা গিয়েছিলাম। সেখানে আমার স্ত্রীর বড় ভাই আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম শামজ্জোহা তার পরিবার পরিজন নিয়ে আসেন। তাঁদের কাছে আমার পরিবারের খোজ খবর পাই। আমার পরিবার যখন কলকাতায় পৌঁছেন, আমি তখন উপস্থিত থাকতে পারি নি। বিএসএফ-এর মিঃ চট্টপাধ্যায় একটি কার্গো বিমানে করে তাদেরকে আগরতলা থেকে কলকাতা নিয়ে যান। বিএসএফ-এর ভাড়া করা বাড়ী কোহিনূর ম্যানসনে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এসময় আমি খুব ব্যস্ত। আমাদের অভ্যন্তরীন রাজনীতির একটি প্রচণ্ড সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছিলো।

প্রথম থেকে মন্ত্রিসভার প্রতি আমাদের যুব সমাজের একটা অংশের বিরূপ মনোভাব ছিল। তারা মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্ব মেনে নিতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। যুবকদের এই অংশের কাজ ছিল বিভিন্নভাবে সরকারকে অপদস্থ ও হয়রানি করা। তারা ভারতে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পর্যন্ত মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্ব সম্পর্কে কুৎসা ও ভুল তথ্য পরিবেশন করে। অপপ্রচারের অংশ হিসেবে তারা প্রচার করে যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের প্রতি অধিকাংশেরই সমর্থন নেই।

এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য ও নেতাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কারণ এমন একটি বৈঠকই প্রমাণ করতে পারে যে তাজউদ্দিন সরকারের প্রতি সংশ্লিষ্ট সকলের শুধু সমর্থনই নেই, এ পর্যন্ত তার সকল কার্যক্রমের প্রতিও তাদের অনুমোদন রয়েছে।

এই উদ্দেশ্যে শিলিগুড়ির জঙ্গলে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। নদীর পাশে পাহাড়িয়া এলাকার এই জঙ্গলে বৈঠকের জন্য অনেকগুলো তাঁবু টানানো হয়। নির্বাচিত সদস্য ও দলীয় নেতাদেরকে বৈঠকে একত্রিত করার ব্যাপারে বিএসএফ-এর চট্টপাধ্যায়ের বিরাট অবদান রয়েছে।

বৈঠকে খোলাখুলিভাবে সরকারের কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আস্থা ও সমর্থন প্রকাশ করা হয়। এতদিন যারা তাজউদ্দিন সরকারের অপপ্রচার করেছিল, বৈঠকের ফলে তাদের মুখে ছাই কালি পড়ে। শিলিগুড়ির বৈঠকের পর কলকাতা বিমান বন্দরে জানলাম, আমার পরিবারবর্গ এসেছে।

কোহিনূর ম্যানসনের ফ্ল্যাটে স্ত্রী, মেয়ে ও পুত্রের সাথে মিলিত হলাম দীর্ঘ দিন পর। ফ্ল্যাটে কোন আসবাবপত্র নেই। মেঝেতে বিছানা পাতা রয়েছে। একই ফ্ল্যাটে আমরা ছাড়াও শামসুজ্জোহা ও মুস্তফা সরওয়ারের পরিবারবর্গ রয়েছে। জায়গার তুলনায় আমরা লোক ছিলাম বেশী।

এ সময় হানাদার বাহিনীর সমর্থকরা আমার গ্রামের বাড়ী জ্বালিয়ে দিলে তারা গৃহহারা হন। অসুবিধা হলে দেশ ছাড়ার জন্যে আমি আব্বাকে ইতিপূর্বে খবর দিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, দেশের মাটিতে থেকেই আমাদের জন্য তিনি দোয়া করছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় চাকরি সূত্রে তিনি কলকাতায় কাটিয়েছেন। তার কলকাতা আসার কোন ইচ্ছা ছিল না। বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পরে আত্মীয়স্বজনরা এক প্রকার জোর করে আব্বাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন।

হানাদাররা আমার বাড়ীর সকল সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায়। তাদের গুলিতে আমার চাচী আহত হন। বাড়ীর মেয়েরা অন্যত্র আত্মীয়দের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। আব্বাসহ যুবক ও অন্যান্য পুরুষ মানুষ কলকাতা চলে আসেন। ২৫শে মার্চের রাত থেকেই এ পর্যন্ত তাজউদ্দিন ভাই ও আমি একত্রে থেকেছি। পরিবার আসার পর তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম। তাকে ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাছাড়া রাতের বেলায় এই বিচ্ছিন্নতায় কাজেরও বিরাট ক্ষতি হলো। কেননা, এতদিন দিনের শেষে রাতের বেলা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতাম। আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। তাছাড়া সকল প্রতিকূলতার ভেতর সংগ্রাম করে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে জীবন যাপন করে খুবই দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। স্ত্রীর এই শারীরিক অসুস্থতার সময় আমার কাছে থাকা খুবই প্রয়োজন। অসুস্থ স্ত্রীকে ডঃ অমীয় ঘোষের কাছে নিয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গেছে। প্রথম থেকেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ করে আসছেন। আমার স্ত্রীর অবস্থা দেখে ডাক্তার চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ অপুষ্টি ও অনিয়মের কারণে গর্ভজাত সন্তান বিপদমুক্তভাবে প্রসব নাও হতে পারে। অন্যান্য সংসদ সদস্যদের হারে মাসিক যে টাকা পেতাম, তা দিয়ে কোন রকমে বাজার খরচ চলতো।

আমার জন্য একটি সরকারী জীপ বরাদ্দ ছিল। এর জন্য প্রয়োজনীয় পেট্রোল দিতেন বলাইদা। বলাইদা ছিলেন একজন নামকরা সলিসিটর। তার এক মক্কেলের এক্সপেন্স একাউন্টে একটি নির্দিষ্ট পেট্রোল পাম্প থেকে স্লীপ দিয়ে গাড়ীর জন্যে পেট্রোল নিতাম। ৯ মাস যুদ্ধের সময় এই দানের পেট্রোল ছিল চলাফেরার একমাত্র সহায়।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস (বি ভি এস) গঠন করা হয়েছে। এই সংস্থা গঠনের উদ্দেশ্য, কার্যকরী কমিটি, উপদেষ্টা ঠিক করা হয়েছে। আমি নিজে বিভিএস-এর চেয়ারম্যান। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক করিমুদ্দিন আহমদ উপদেষ্টা এবং শাহীন স্কুলের অধ্যক্ষ মামুনুর রশীদ নির্বাহী পরিচালক।

‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ আমাদের প্রাথমিক কাজের জন্য টাকা দেয়। প্রত্যেক শরণার্থী শিবিরে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ বিভিএসকে একটি জীপও দেয়। সদর স্ট্রীটে গাজা সংলগ্ন বাড়ীতে মিশনের বদান্যতায় বিভিএস-এর অফিসের জন্য দুইটা ঘর পাওয়া গেল।

কৃষ্ণনগরে সেচ্ছাসেবকদের একটি সম্মেলন হয় জুলাই-এর কোন এক সময়ে। শরণার্থী শিবিরে করণীয় কার্যক্রমের বিশদ বিবরণসহ পুস্তিকা ছাপানো হয়। সকাল বেলা সম্মেলনে যাত্রার পূর্বে দেখলাম, আমার স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতর। বেগম শামসুজ্জোহার সাহায্যে পাশের ক্লিনিকে তাকে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই অবস্থায়ও আমার স্ত্রী অত্যন্ত সাহসের সাথে আমাকে সম্মেলনে যেতে বললেন।

এমনি এক অবস্থায় আমাকে সাহস দিয়ে সম্মেলনে প্রেরণের কথা কোনদিন ভূলে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্মেলনে ডঃ মোশাররফ হোসেন, শিল্পী কামরুল হাসান, মামুনুর রশীদ প্রমুখ আমার সাথী হলেন। আমার বন্ধু ও রাজনৈতিক সাথী কুষ্টিয়ার কুমারখালি কলেজের অধ্যক্ষ দেওয়ান আহমদকে কৃষ্ণনগরে এই সম্মেলনের প্রস্তুতির ভার দিয়েছিলেন।

বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে স্বেচ্ছাসেবক আসেন। এদের সকলেই রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী। তবে তাদের যুদ্ধের যাওয়ার বয়স নেই। আর্তমানবতার সেবা করাই সম্মেলনে আগত সকলের উদ্দেশ্য। ডঃ মোশাররফ হোসেন সম্মেলনে বক্তৃতা ছাড়াও কিছু ছাপানো পুস্তিকা বিতরণ করা হয়। এসব পুস্তিকায় বিভিএস-এর কর্মসূচী, শরণার্থী শিবিরে করণীয় কর্তব্য, স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় এবং স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে এদের ভূমিকা লিপিবদ্ধ করা ছিল। সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে ডঃ স্বদেশ বোস এবং শিল্পী কামরুল হাসানও বক্তব্য রাখেন।

কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার পথে জানলাম, কুষ্টিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মীরা এখানে আশেপাশে রয়েছে। খবর পেলাম, কুষ্টিয়ার খোকসা থানার ৭টি গ্রাম পাক বাহিনী জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে। একতারপুর গ্রামের কাপালিকরাও গ্রাম ছেড়ে এখানে এসেছেন। এসব গ্রামের আবাল বৃদ্ধ-বনিতা আমাকে তাদের অত্যন্ত আপনজন জানতেন। কলকাতায় ফিরে প্রথমেই ক্লিনিকে যাই। বুকের ভেতর ছিল চাপা উত্তেজনা। ক্লিনিকে গিয়ে জানলাম আমার পুত্র সন্তান হয়েছে। মা ও সন্তান সুস্থ আছে বলেও জানলাম। আমরা শখ করে সন্তানের নাম রাখি জয়; কিন্তু আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। জন্মের পর জয় আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয় এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই জয় আমাদের ছেড়ে চলে যায়। অর্থাভাবে জয়-এর চিকিৎসা করাও সম্ভব হয় নি। ক্লিনিকে মৃত্যপথযাত্রী জয়কে নেয়া হয়। সেলাইন-এর বিল আমরা পরিশোধ করতে পারবো কি না, এই নিয়ে ক্লিনিকে কর্তৃপক্ষ চিন্তিত ছিল। কিন্তু সেলাইন দেয়ার আর প্রয়োজন হয় নি। তার আগেই জয় চলে যায়।

পুত্রশোকের অভিজ্ঞতা যেন কোন পিতা মাতার না হয়। আমি জয়কে নিজে হাতে মাটিতে নামিয়ে দেয়ার সময় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি আল্লাহ আমার জয়-এর পরিবর্তে স্বাধীনতা দিও। এই শোক সামলে নিতে আমার প্রায় সপ্তাহখানেক সময় লাগে। কিন্তু আমার স্ত্রীর সেই স্মৃতি আজো মুছে যায় নি। তা ছাড়া কোন মায়ের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। ডঃ স্বদেশ বোস পরে বলেছিলেন, সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় পথে পথে ঘুরে এবং খাদ্য ও বিশ্রামের অভাবে মা ও সন্তানের অপুষ্টি হয়। এই সন্তান বেচে থাকলেও সংশয় মুক্ত ছিল না। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি প্রতিদিন শরণার্থী শিবিরে বহু শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। এরপর থেকে স্ত্রীও আমার সাথে সীমান্ত শিবির দেখতে যেতেন। এমনিভাবে স্ত্রী আমার কাজের সহযোগী হয়ে ওঠেন। আমরা এ সময়ে বিভিন্ন শিবিরে অর্থকরী কাজে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কর্মসূচী গ্রহন করি। তাছাড়া প্রতি ক্যাম্পে শিশু কিশোরদের জন্য কয়েকটি নির্ধারিত কর্মসূচী ছিল। প্রতি ক্যাম্পে ভোর বেলা পতাকা উত্তোলন, মুক্তিযুদ্ধের গান, পিটি, শরীরচর্চা ও খেলাধুলা এই কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এগুলো ক্যাম্পে ক্যাম্পে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করে। ক্যাম্পগুলোতে ময়লা নিষ্কাশন ও স্বাস্থের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ড্রেন কাটা, নালা সাফ, আবর্জনা পরিষ্কার ও ব্লিচিং পাউডার ছিটানোর ব্যবস্থা করা হয়। আমাশয় রোগে বিভিন্ন শিবিরে বহু লোক মারা যায়। তন্মধ্যে শিশু মৃত্যুর হারই বেশী। ডাক্তার ও ওষুধের প্রচণ্ড অভাব। প্রত্যেক ক্যাম্পে মেডিক্যাল সেন্টার খোলার সঙ্গতি আমাদের নেই।

এসময় আমি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারদের খুঁজে বের করে প্রত্যেক ক্যাম্পে নিয়োগ করি। তাদের ওষুধের বাক্স দেয়া হল। এতে বেশ কাজ হলো। সীমান্তের নিকটে আমরা হাসপাতাল ক্যাম্প গড়ে তুলি। একজন কর্মঠ ডাক্তার এবং তাকে সাহায্যকারী কয়েকজন নার্স পেলেই হাসপাতাল শুরু করা যায়। কোন ছোট গুদাম জাতীয় স্থান নামমাত্র অর্থে ভাড়া নিয়ে সেখানে ছোট ছোট চৌকি ফেলে ১০/১২ বেডের হাসপাতাল তৈরী করা হতো। বিভিন্ন সংস্থার সাহায্য সহযোগিতায় হাসপাতাল পরিচালনা করা হয়।

এসব হাসপাতাল আমাদের খুবই উপকারে আসে। এতদিন পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে আহত যেসব মুক্তিযোদ্ধা সামান্য চিকিৎসার অভাবে মারা যেত, হাসপাতালগুলো চালু হওয়ার পর তারা চিকিৎসা পেতে থাকে। ডাক্তারী পড়া ছাত্ররা এসব হাসপাতালে চমৎকার সাফল্য দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার এমপিদের প্রতি মাসে ২০০ টাকা মাসহারা দিত। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের এ ধরনের কোন আর্থিক সুবিধা ছিল না। বিভিএস ( বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস)-এর পক্ষ থেকে এসব রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীদের মাসিক ৫০ টাকা মাসহারা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দুঃসময়ে এ টাকা তাদের খুবই কাজে আসে।

প্রধানমন্ত্রী আমাকে দু’বার দিল্লী পাঠান। প্রথমবার দিল্লী যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার বিভিন্ন এজেন্সীর লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করা। সেখানে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সাথে আমার দেখায় হয়। এদের কাছে বিভিন্ন ধরনের খবর পাওয়া গেল। বিশিষ্ট সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার-এর সাথেও আলোচনা করি। তাছাড়া দিল্লীতে অবস্থিত বিদেশী মিশনের কর্মকর্তাদের সাথেও পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হই।

এদের সাথে সাক্ষাতের সময় শুনতাম বেশী, বলতাম কম। দেশ-বিদেশে আমাদের সংগ্রামের প্রতিক্রিয়াসহ পরাশক্তিসমূহের মনোভাবও জানার সুযোগ হয়। ভারত সরকার সম্পর্কেও অনেক খবর জানা সম্ভব হলো। হিন্দুস্তান টাইমস-এর সম্পাদক উইলিয়াম ভারগিস ও তার মত আরো অনেকে বুঝাতে চান, ভারতের সকলে যে বাংলাদেশের পক্ষে আছে বা থাকবে এ ধারণা করার কোন কারণ নেই। তারা বলেন, আজো অনেকে ভাবেন যে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানই ভারতের জন্য মঙ্গল হবে। কারণ পাকিস্তানকে এতদিনে চেনা-জানা হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। কারো কারো ধারণা, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ভারতের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যহত হবে।

এ সময় দিল্লীতে শেখ আবদুল্লার সাথেও আমার দেখা হয়। একটি বাড়ীতে আধা নজরবন্দী অবস্থায় তিনি থাকতেন। তার চলাফেরার উপর বিভিন্ন সংস্থার কড়া নজর ছিল। তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন। তবুও পুরো একটা দিন তিনি আমার জন্য ব্যয় করেন।

বহুদিন পূর্ব থেকেই তার নাম শুনেছি। কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আমার চোখে তিনি বীর। ভারতের উত্থান পতনের ইতিহাসে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি স্পষ্টবাদী। তিনি তার মনোভাব গোপন করলেন না। তিনি বললেন, তিনি পাকিস্তান চান নি। কিন্তু বাঙালিরা চেয়েছিল। তারা আবার আজকে বাংলাদেশ চায়। আগামীতে তারা আবার কি চাইবে, তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি? শেখ আব্দুল্লাহর কথাগুলো তখন আমার খুব ভালো লাগে নি। কিন্তু তার কথার ভেতরে যে ইঙ্গিত ছিল, পরে তার মর্ম বেশী করে উপলব্ধি করেছি।

আমি শেখকে বুঝাবার চেষ্টা করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি আজ সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ। আমাদের সংগ্রাম ৮ কোটি বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কথা বলতেই তিনি আবার ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলেন, তোমরা জিন্নাহর পিছনেও ছিলে। নাচাটাই তোমাদের স্বভাব। আজ তোমরা বঙ্গবন্ধুর পেছনে আছো। আবার কালকে তাঁর বিরোধিতা করতেও তোমাদের সময় লাগবে না। কাজেই তোমাদের প্রতি অন্ততঃ আমার কোন সমর্থন নেই।

সে সময় পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে এমন কিছু ব্যক্তির সাথেও আমি সাক্ষাত করি। তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় সংসদে একটি প্রতিনিধি দলও প্রেরণ করা হয়। মিঃ ফনীভূষণ মজুমদারের নেতৃত্বাধীন এই প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্য ছিলেন মিসেস নূরজাহান মোর্শেদ এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।

আমি দিল্লী আসার আগেই বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ভারতীয় সংসদে বক্তৃতা করেন। আমি দিল্লী এসেছি জেনে তারা আমার সাথেও যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল আহূত সাংবাদিক সম্মেলনে থাকার জন্য আমাকে অনুরোধ করা হলো। সম্মেলনে পেশ করার জন্য বক্তব্য তৈরী করে নিয়ে গেলাম। ফনীদা জানতেন বিদেশী প্রেসের সাথে আমি যোগাযোগ রক্ষা করছি। দিল্লী প্রেসক্লাবে তিনি আমাকে সামনে ঠেলে দিলেন। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলাম। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন আহবান করি। শাহ মোয়াজ্জেম আমার নাম বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিন্তু তখনো আমি ছদ্মনাম ‘রহমত আলী’ হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় আমার বক্তব্য প্রচারিত হলো। পরিবার পরিজনের সাথে তখনো আমার দেখা হয় নি।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের মূল বক্তব্য ছিল পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায় অনভিজ্ঞ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে সফল হবেন এবং যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থাই বা কী? উত্তরে বললাম, দেশ মাতৃকার জন্য রক্তদানে প্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারা ভাড়াটে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাভূত করবেই। আমাদের ধারণা ছিল বর্ষাকালে পাক বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। প্লাবন ও বন্যায় অনভ্যস্ত পশ্চিমা বাহিনী এ সময় মূলতঃ শহরে আটকে থাকবে। আমাদের যুদ্ধ পরিকল্পনাও তেমনি ছিল। সাংবাদিক সম্মেলনে এরূপ ইঙ্গিত দেই। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা অন্যরূপ। পাক হানাদার বাহিনী গান বোটের সাহায্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনীর উপর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে।

দিল্লী থাকাকালে অন্য একটি কাজ করি। সিপিআই-এর একজন এমপি’র মাধ্যমে দিল্লীস্থ সোভিয়েত দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ হয়। সংসদীয় দলের ৩ জন প্রতিনিধিসহ আমরা ৪ জন সোভিয়েত দূতাবাসে যাই।

এটি পাক দূতাবাসের সামনে অবস্থিত ছিল। রাষ্ট্রদূতের পরবর্তী কর্মকর্তা আমাদের সাথে দেখা করেন। অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে তিনি আমাদের বক্তব্য শোনেন। তিনি বলেন দূতাবাসের পক্ষ থেকে আমাদের বক্তব্য তিনি মস্কোতে পাঠাবেন। এর বেশী কিছু তিনি করতে পারবেন না বলে জানান। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগে আগ্রহী ছিলেন না। আব্দুস সামাদ আজাদ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শান্তি সম্মেলনে মস্কো যান। তখনো তিনি সোভিয়েতের কোন নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তির সাক্ষাৎ লাভে সমর্থ হন নি।

শান্তি সম্মেলনের সময় খাবার টেবিলে বিভিন্ন প্রতিনিধিদের পতাকা থাকতো। আব্দুস সামাদ আজাদ সেখানে বাংলাদেশের পতাকা রাখার দাবী জানালে স্বাগতিক দেশ অসম্মতি প্রকাশ করে। এমনকি বাংলাদেশ প্রতিনিধি ব্যক্তিগতভাবে একটি পতাকা রাখতে চাইলে মস্কোর তা পছন্দ হয় নি। এরপর আব্দুস সামাদ আজাদ নিজের ঘরে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

তাজউদ্দিন ভাই সাংবাদিক মঈদুল হাসানের মাধ্যমে মস্কোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। আমাদের সংগ্রামের প্রতি সরাসরি সমর্থন করতে মস্কোর যে অসুবিধা ছিল, সেটা আমরা বুঝতাম। তবে আমাদের সংগ্রামের প্রতি যে মস্কোর সমর্থন রয়েছে, সেটা বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের পর পাক সরকারের কাছে প্রেরিত প্রেসিডেন্টর চিঠিতে তার আভাস পাওয়া গেছে। ২৫ শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর হামলার প্রতিবাদ করে পদগোর্ণি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যই সে সময়ে মস্কোর পক্ষে আমাদের সংগ্রামের প্রতি সরাসরি সমর্থন দেয়া সম্ভব হয় নি।

তবে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্যে ভারতের সাথে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করে। আমাদের সংগ্রাম চলার সময় মিঃ হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর করেন। আর চীন-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির ব্যাপারে পাকিস্তান দূতিয়ালী করে। এই ঘটনা ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের প্রেক্ষিত রচনা করে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থা ও বৃহৎ শক্তির ভারসাম্যের আলোকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবস্থান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যৎবাণী কার্যে পরিণত হয়েছিল।

এসব আলোচনাকালে আমরা দু’জনেই মোটামুটি একইরকম মতামত পেশ করতাম। কিসিঞ্জার চীন সফরের খবরের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সফর আমাদের সংগ্রামে প্রভাব বিস্তার করবে। পরে এটা সত্যে প্রমাণিত হয়। মস্কো উপলব্ধি করে যে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান এই অঞ্চলে রাশিয়াবিরোধী জোট গঠনে ব্যস্ত রয়েছে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করতে চীন-মার্কিন তখন বিশেষভাবে ব্যস্ত।

চীন-মার্কিন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর রুশ-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই ঘনিষ্ঠতর হয়। এখন রাশিয়ার পক্ষ থেকে ভারতের একটি আশ্বাস প্রয়োজন। সেই আশ্বাসটি হলো, কোন কারণে চীন ভারতে হামলা করলে রাশিয়া যেন পাল্টা চাপ সৃষ্টির ব্যবস্থা করে, যাতে চীন নির্বিঘ্নে ভারতে ঢুকে পড়তে না পারে।

হিমালয়ের তুষার ও সোভিয়েতের বন্ধুত্ব এই দু’টি ছিল চীনের বিরুদ্ধে ভারতের রক্ষা কবচ। তাই সময় ও সুযোগে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে ভারত তখন অপেক্ষা করছিল, সে সময় বাংলাদেশের বীর সন্তানেরা গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পাক বাহিনীর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

দিল্লীতে আমি ভারতের বৈদেশিক দফতরে টি এন কাউলের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদেরকে বিদেশে প্রচার কাজের ওপর জোর দেয়ার কথা বলেন। তিনি বিদেশের বিভিন্ন রাজধানী, সেখানকার সরকার, সংবাদপত্র ও জনমত সম্পর্কে আমাদের একটি ধারণা দেন। আমি এসব দিল্লী সফরের রিপোর্ট হিসেবে একটা নকশার মত প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্বের সরকারগুলো কে কি ভাবছে, তা বুঝতে আমাদের কোন অসুবিধা হয় নি। এ ব্যাপারে তাজউদ্দিন ভাই-এর একটি মোটামুটি হিসেব ছিল। তিনি জোর দিয়েই বলতেন যে আগামী শীতেই একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কেননা এছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহনের জন্যে প্রতিদিন সীমান্ত পার হয়ে শত শত তরুণ যুবক আসছে। তাদের মুখে এক কথা-ট্রেনিং চাই, অস্ত্র চাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহনে ইচ্ছুক যুবক ছাড়াও প্রতিদিন বহু লোক আমার অফিসে সাক্ষাৎ করতে আসতেন তাদের প্রত্যেকের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ভিড় করা শুরু করলেন। তাদের সবার বক্তব্য, স্ব স্ব স্থানের ছেলেদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা বুঝতে পারলাম, যে সংখ্যায় মুক্তযোদ্ধা ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা আমরা করেছি, এর চেয়ে বহু বেশি সংখ্যায় যুবকরা আসছে প্রশিক্ষণের জন্যে। এ সময় আমরা ‘ইয়ুথ ক্যাম্প’ খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই ক্যাম্পগুলো এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা পরিচালনা করেন।

এর পরের ধাপ ছিল অভ্যর্থনা শিবির। অভ্যর্থনা শিবিরের কাজ ভারতীয়রা ও আমরা যৌথভাবে পরিচালনা করতাম। মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনা ক্যাম্প থেকে ছয় সপ্তাহের ট্রেনিং-এ পাঠানো হতো।

প্রথমে আমাদের ২৫ হাজার গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। পরে এই সংখ্যাকে এক লক্ষে উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে ট্রেনিং শেষ করে ৯০ হাজার স্বদেশে আসতে সক্ষম হয়। তাছাড়াও ছিল নিয়মিত বাহিনী। সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী ও বিডিআর-এর সৈনিকদের দ্বারা এই বাহিনী গঠন করা হয়। পুলিশের সংখ্যাও ছিল পর্যাপ্ত।

সীমান্তে ছাউনী তৈরী করে নিয়মিত বাহিনী অবস্থান করতো। সেখান থেকেই তারা পাক বাহিনীর ওপর হামলা করেছে। তাছাড়া ছিল সহায়তাকারী একটি গোষ্ঠী। একটু বয়ষ্ক, যাদের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সম্ভব ছিল না, তারা ‘ইয়ুথ ক্যাম্প’ ও ‘অভ্যর্থনা ক্যম্পে’ নিয়মিত বাহিনীর সাথে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতো।

ইয়ুথ ক্যাম্প করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পাওয়া গেল। বাংলার হাজার হাজার দামাল ছেলের দ্বারা ক্যাম্পগুলো ছিল পরিপূর্ণ। তাদের শুধু একটাই কথা-ট্রেনিং চাই, অস্ত্র চাই। খান সেনাদের যে কোন মূল্যে খতম করতে হবে।

এসময় আমি নিয়মিত ইয়ুথ ক্যাম্পে যেতাম। প্রিনসেপ স্ট্রীটে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি অফিস খোলা হল। এই মন্ত্রণালয় ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কাজের মাধ্যমে ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানের সাথে আমার সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে ওঠে। সপ্তাহে কয়েকবার আমাদের বৈঠক হতো। এতে কাজের সমন্বয় বৃদ্ধি পায়। কামরুজ্জামান (হেনা ভাই) ও আমি সড়কপথে বাংলাদেশের পুরো সীমান্ত দেখার জন্য ২৫ দিনের এক কর্মসূচী গ্রহণ করি। স্বরাষ্ট্র সচিব আব্দুল খালেক আমাদের সাথে ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে খালেক রাজশাহীতে ছিলেন, পরে সীমান্ত পার হয়ে আসেন। আব্দুল খালেক পুলিশ বাহিনীর লোকদের সংঘবদ্ধ করেছেন। তিনি অত্যন্ত অমায়িক লোক। তাঁর উদ্যম ও কর্মোৎসাহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি ছিলেন একটি ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের অধিকারী। আমরা রওয়ানা হই কলকাতা থেকে। মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম দিনাজপুরের শিলিগুড়ি পার হয়ে মেঘালয়ের তোরা পাহাড় অঞ্চলের পাদদেশে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি। ফিরে আসার সময় পথে পথে সকল ক্যাম্প পরিদর্শন করি।

আমাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা হতো ইয়ুথ ক্যাম্পে। ইয়ুথ ক্যাম্প ছাড়াও পথিমধ্যে নিয়মিত যোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে গেছি। আমাদের এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সরেজমিনে দেখা এবং স্থানীয় ও ভারতীয় প্রশাসন যন্ত্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। তোরাতে মেঘালয়ের মূখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা হলো।

মূখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানান হয়। মেঘালয়ের জনগনের অধিকাংশ খৃস্টান। তারা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত। মিশনারীদের পুরাতন প্রভাব বিদ্যমান। এখানে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মতো সহায়তায় এত ব্যাপক নয়। আমাদের লোকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়।

মেঘালয় সরকারের সাথে সরাসরি আলোচনা হলো। হেনা ভাই-এর সাথে মূখ্যমন্ত্রীর ছাত্রজীবনের সম্পর্ক ছিল। আলোচনায় এ সম্পর্ক আরো গভীর হলো।

এখানেই মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। খবর পেয়ে তিনি ডাকবাংলোতে আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর থেকে প্রতিশ্রুতিপূর্ণ অফিসারের একটা গ্রুপ তৈরীর ভার ছিল জিয়ার ওপরে। কয়েকদিন পূর্বে জিয়া সৃষ্ট আমাদের শিক্ষানবিশ গ্রুপটিকে পাক বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করাও আমার দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিল। আমরা ঘটনাস্থলে গেলাম। সেই পরিত্যক্ত ক্যাম্প সার্ভে করি। সবকিছু শুনে মনে হলো শত্রুর মুখে শিক্ষানবিশ অফিসাররা নিতান্তই নিরাপত্তাহীন ছিল। এত বড় আঘাতের রেশ তখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় নি। মেঘালয়ের কাজ শেষে আমরা শিলং-এর পথে রওয়ানা হই। পাহাড়ি পথ বেয়ে আমাদের গাড়ি চলতে থাকে। পাহাড়ি অঞ্চলে রাতের বেলা শীত বাড়ে।

জঙ্গলে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ক্যাম্পে শত্রুহানার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। রাতের বেলায় এমন একটি ক্যাম্পে গিয়ে আমরা উপস্থিত হই। পরিত্যক্ত বাড়িতে ক্যাম্প করা হয়েছে। চালা দেয়া ঘর এবং কয়েকটি তাঁবু রয়েছে। ছেলেরা তখন আগুন পোহাচ্ছিল। শীতের মধ্যে তাদের প্রয়োজনীয় কাপড় নেই। পাহাড়ী জঙ্গলে খাওয়া দাওয়ার এমনিতেই অসুবিধা। যোগাযোগের অবস্থাও ভালো নয়। এই অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে অম্লান হাসি। তাদের সাথে অনেকক্ষণ খোলাখুলি কথা হয়। কারো কারো প্রশ্ন, স্বাধীনতার পর দেশকে কিভাবে পূনর্গঠিত করতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হবে ইত্যাদি। তাদের প্রয়োজনীয়তার কথা জিজ্ঞাসা করি। তারা জানান, তাদের প্রয়োজন শুধু অস্ত্রের। তাদের অভাবের তালিকায় শীতবস্ত্র, জুতা, কম্বল ও খাবারসহ অনেক কিছু ছিল। কিন্তু তারা এসবের কিছুই উল্লেখ করেন নি। তাদের সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ দাবী হলো অস্ত্র চাই। শত্রুকে হত্যা করে দেশকে মুক্ত করতে হবে।

সারারাত গাড়ী চালিয়ে আমরা পথ অতিক্রম করে পরদিন সিলেট সীমান্তে আসি। পথে পথে বহু শিবির আমরা পরিদর্শন করেছি। সিলেটের কিছু অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে রয়েছে। হেনা ভাইয়ের খুব ইচ্ছা বাংলার মাটিতে রাত কাটাবেন। বর্ষার পানিতে সিলেটের হাওড় তখনো পরিপূর্ণ। আমাদের আসার খবর চারদিকের গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। ছোট ছোট নৌকায় আমাদের দলীয় নেতা-কর্মীরা দেখা করতে এলেন। নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় বিএসএফ কর্মকর্তার সাথে আলোচনা শেষে শিলং-এর পথে যাত্রা করি।

এখানে মুক্তাঞ্চলে বহু শরণার্থী শিবির রয়েছে। রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা শিবির। এখান থেকে গিয়ে তারা হানাদারদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। একটি গ্রামে পৌঁছলাম। সেখানে বিরাট জনতার সমাগম হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও আমরা বক্তৃতা করি। স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রকাশ্যে জনসভা করতে পেরে অফুরন্ত আনন্দ পেলাম। জনসভা শেষে রাতেই শিলং পৌছার কথা রয়েছে। এই অঞ্চলে সিলেটের একজন এম.পি আব্দুল হক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি এক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন।

সেখান থেকে আমরা শিলং ডাকবাংলাতেই যাই। সিলেটের একজন এম.পি এই অঞ্চলে প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন। এই এম.পি’র নাম ব্যারিষ্টার মোনতাকিম চৌধুরী পরে তাকে জাপানে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। এখানে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে কয়েকটি বৈঠক করি। পরদিন আমরা সিলেট ও আসামের সীমান্তে অবস্থিত ‘বালাট’-এর পথে রওয়ানা হই। কিছুদিন পূর্বে বালাটের কাছে পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আমাদের কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে। সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের মাটিতে এই বীরদের কবর দেয়া হয়েছে। বালাটেও স্থানীয় নেতাদের সাথে আমাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়।

আমাদের ফেরত যাত্রা শুরু হল। শিলং-এ পৌছে দিনের কর্মব্যস্ততা শেষ করে পশ্চিম বাংলার একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকের বাসায় যাই। তার কাছ থেকে স্থানীয় রাজনীতি, আসাম ও মেঘালয় সরকারের মনোভাব সম্পর্কে অবহিত হই। এর পূর্বে আমি কয়েকবার গৌহাটি, আগরতলা ঘুরে গেছি। আসাম সরকার মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে খুব বেশী উৎসাহী ছিলেন না। শরনার্থী শিবিরগুলোতে খুবই কড়াকড়ি। তাই তাদের জীবন এখানে খুব সুখকর ছিল না।

এর আগে ডোনাল্ড চেসওয়ার্থকে নিয়ে আমি আগরতলা গেছি। তাকে নিয়ে আমি সাবরুমে গেছি, এখানে ওপারে বাংলাদেশ সীমান্তে একটি রেষ্ট হাউজ রয়েছে। সেখানে হানাদার বাহিনী ক্যাম্প তৈরী করেছে। পাক হানাদার বাহিনী এখানে নারী নির্যাতন করেছে। দস্যুরা নারীদের উলঙ্গ করে পর্যন্ত রাখে। ওপারের লোকের মুখে এসব নির্যাতনের কথা আমরা শুনি। সাবরুমের ডাকবাংলোতে বিশ্রামের সময় ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী মাহফুজুল বারীর সাথে আমাদের দেখা হয়। বারী একজন সাধারণ শরনার্থীর মতো ডোনাল্ডের কাছে বাংলাদেশে পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেন। ডোনাল্ড এসব কথা বৃটিশ সংসদে বলবেন বলে আমাদের জানান। এবং তিনি পরে তা করেছিলেন।

হ্যনসার্ড-এর রিপোর্টে বাংলাদেশের করুণ এই আলেখ্য প্রকাশিত হয়। আমি জন স্টোন হাউজ, ডগলাস ম্যান, পিটার বার্নস এমপিসহ অনেক সাংবাদিককে নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে পৌছি। এমন একটি দল নিয়ে পাটগ্রামের মুক্তাঞ্চলে যাই। যুদ্ধ চলার সময়ও আমি বহুবার পাটগ্রামে গেছি। পাটগ্রামে একবার আমরা একটি ডাকঘর উদ্বোধন করি। এ সময় প্রখ্যাত ডিজাইনার বিমান বোস অংকিত স্বাধীনতা যুদ্ধের কোমেমোরেটিভ স্ট্যাম্প লণ্ডন ও কলকাতায় বিক্রি করা হয়।

পাটগ্রামে ডাকঘর উদ্বোধন করার সময় টেলিভিশনসহ বেদেশী সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং মোস্তফা সারওয়ার অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। পাটগ্রাম থেকে আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যাই। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আমরা ১ রাত ১ দিন কাটাই। সামরিক ছাউনীতে আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়।

আমরা দিনাজপুরের পঁচাগড় পর্যন্ত মুক্তাঞ্চলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবর নিই। আমাদের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কামান বিপুল উৎসাহে গর্জে ওঠে। আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে তখন কামান এসে গেছে। এই কামানের গোলায় দূরের পাকিস্তানি বাংকারগুলো ভেঙ্গে পড়েছে। দূরবীন দিয়ে পলায়নপর পাক বাহিনী দেখে উল্লাসিত হই।

দিনাজপুর জেলার এই অঞ্চলের একটি গ্রামের সমস্ত অধিবাসী মুক্তিবাহিনীর জন্যে গ্রামটি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। গ্রামটির নাম মনে নেই। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ি-ঘরে টিনের বা খড়ের চালা। ঘরের ভিটিগুলো বেশ উঁচু। ঘরের ভিতরে বাংকার তৈরী করা হয়েছে। মেঝেতে গর্ত করে মাটির ভেতরে কামান বসানো হয়েছে। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর সেই উদাত্ত আহ্বান ‘ঘরে ঘরে দুর্গ ঘড়ে তোল’ এ কথা মনে হত। গোরস্থানে কবরের ভেতরেও অনেক স্থানে বাংকার হয়েছে। গ্রামবাসীরা মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ করেছে। ছোট ছোট রাখাল ছেলেরা দূরে গরু চরাতে গিয়ে পত্র বাহকের কাজ করেছে ও দূরে শত্রুদের অবস্থান জানাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ভিয়েতনামের জনগন পরম পরাক্রমশালী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করেছে। প্রতিদিন বাংলাদেশের মাটিতে একাধিক বীরত্ব গাঁথা জন্ম নিচ্ছে। এই বীরত্ব গাঁথার সবগুলো হয়ত কোন দিনই লেখকের কলামে, কবির কবিতায় বা শিল্পীর কণ্ঠে শোনা যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হয়তো কোন দিনই লেখা হবে না। তবে ৯ মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও সাহস দেখে মন ভরে উঠতো। প্রথম প্রথম বেশ ভয় করতাম। পরে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাই। একদিন ভারতীয় একজন জেনারেলের কথা শুনে আমার ভয় অনেকটা কমে গেল। তিনি বলেন, ‘যে গুলিতে তুমি মারা যাবে, সে গুলির আওয়াজ তোমার কানে আসবে না। আর যে গুলির শব্দ তুমি শুনছ, তা তোমার গায়ে লাগবে না।’ এরপর বলতে গেলে গুলির শব্দে আর ভয় পাই নি।

ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও আমি যুদ্ধের নিয়ম কানুন কিছুটা রপ্ত করে ফেলেছি। তাছারা কোন ক্যাম্পে গেলে আমাদের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো। আর বিশেষ কথা হলো আমাদের তখন মরার ভয় ছিল না, ভয় ছিল শত্রুর হাতে যেন না পড়ি। শত্রুর হাতে না পড়ার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হতো। কারন, যুদ্ধাবস্থায় বন্দিত্ব মৃত্যুর চেয়ে খারাপ হতে পারে। সে সময় পঁচাগড়ের একটা সেতু মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দেয়। সেতুর স্থান থেকে ঢাকার মেইল স্টোন দেখা যায়। ভাবতাম, এই পথে কখন ঢাকা যাব। বাংলাদেশের এই অঞ্চলের মুক্তাঞ্চলগুলো ছিল আমাদের আগামি দিনের মাইল পোস্ট।

প্রধানমন্ত্রী ও আমি পাটগ্রাম সফর করে শিলিগুড়িতে ফিরে আসি। শিলিগুড়ির মিলিটারী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে গেলাম। আহতদের মুখে মুক্তিযুদ্ধে তাদের বীরত্বের কাহিনী শুনলাম। তাদের চোখে মুখে দেশে ফেরার স্বপ্ন। শিলিগুড়ির এক কাকর বিছানো পথ দিয়ে আমরা পাটগ্রাম যেতাম। পাটগ্রামের পরিত্যক্ত রেল স্টেশনে বসে বাংলাদেশ যুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধু ডোনাল্ড ও স্টোনহাউস কে বাংলাদেশে প্রবেশের ভিসা প্রদান করি। শিলিগুড়িতে বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক কর্মচারীদের একটি প্রশাসন কাঠামো ছিল। গণসংযোগের জন্য আমি একবার শিলিগুড়ি বারে যাই।

প্রধানমন্ত্রীর সাথেও একবার শিলিগুড়ি যাই। সারদিন কর্মসূচি ছিল। এবার চিত্তদের বাসায় যেতে পারি নি। সন্ধাবেলায় শিলিগুড়ির ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মিলিটারি ক্লাবে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিলো। এই অঞ্চলে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান, তার সঙ্গী সাথী কর্মকর্তারা সকলে উপস্থিত। তাদের ব্যবহার খুবই ভাল। তাদের আলোচনায় একতি বিষয় বিশেষ ভাবে পরিষ্ফুট হয়ে উঠে। তা হলো ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা। গনপ্রতিনিধিদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাভাব দেখে আমার খুব ভাল লাগলো। বুঝলাম সে দেশে কেন গণতন্ত্র টিকে আছে।

পরদিন সকালে আমরা আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পরিদর্শনে গেলাম। এগুলো ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি তত্বাবধানে। আমরা ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি শিক্ষানবিশ মুক্তিযোদ্ধারা টার্গেট শুটিং-এ ব্যস্ত। মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ শেষে লাইন করে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী কে অভিনন্দন জানায়। জয় বাংলা শ্লোগানে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত ক্যাম্প কেঁপে ওঠে। আমাদের সবার কন্ঠে ভেসে আসল ‘আমাদের সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’।

ক্যাম্পের সীমার শেষ প্রান্তে এসে ছেলেরা আমদের বিদায় দিয়ে গেল। এখান থেকে আমরা রংপুরের ভূরুঙ্গামারীর দিকে রওয়ানা হই। আমাদের সাথে ভারতীয় একজন বিখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী রয়েছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি তুলেছেন। পেছনে একটি জীপে সেই ক্যামেরা ম্যান। আমাদের সাথে অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন সংস্থাপন সচিব নূরুল কাদের খান, আলোকচিত্র শিল্পী আলমসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক। ভূরুঙ্গামারী পৌঁছে জানলাম, এই অঞ্চলে একজন জজ ( নাম সম্ভবতঃ আনোয়ার) যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

পরদিন আবার আমরা মুক্তাঞ্চলে যাই। এ সময় আমাদের মাঝে মধ্যে খাল, বিল, খরস্রোতা নদী ও মুক্তি যোদ্ধাদের উড়িয়ে দেইয়া সেতু পার হতে হত। একদিন প্রধানমন্ত্রী ও আমি কলা গাছের ভেলায় করে একটি খাল পার হই। এই ভেলাসহ আমাদের সেই ছবি আন্তর্জাতিক ভাবে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য বই-এ এই ছবি প্রকাশিত হয়।

এই সফর সূচিতে আমরা বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত ছুঁইয়ে আগরতলা পৌঁছি । কঠিন দূর্গম ও পাহাড়ী পথ। আগরতলা, সাবরুম, হরিনা, বালাট, তোরা, ভূরুঙ্গামারী, পাটগ্রাম, পঞ্চগড়, রাজশাহী, বেতায়, শিকারপুর, মুজিবনগর, বেনাপল, মামা ভাগ্নে, টাকি, দেবহাটা এগুলো ছিলো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাইল পোস্ট। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের মানচিত্রকে মালা দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে।

সীমান্তের ওপারে এক কোটি মানুষের ভিড়। এরা ঘরে ফিরতে আগ্রহী। শৃংখল মুক্তির উদ্দাম আবেগ তাদের মনে। মুক্তিযোদ্ধারা প্লাবনের মত সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এরা বাংলার নিভৃত গ্রামে, অরণ্যে মাঠে, নদী খাল বিল, হাটে ঘাটে,বাজার ও শহরের পাড়াতে ছড়িয়ে রয়েছে।

দেশের জনগন মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ভরসা করে রয়েছে। এরা ঢাকার ইন্টারকন থকে মতিঝিল আবাসিক এলাকা, ফার্মগেট, মফস্বল শহরের রাজপথ, গঞ্জে বাজারে, ধানক্ষেতে রাজাকারের ক্যাম্প, দালালের গৃহ, হানাদার বাহিনীর ছাউনিতে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। আগরতলা এসে আমরা মেজর শফিউল্লার সাথে মিলিত হলাম। শফিউল্লাহ হরিণাতে ক্যাম্প স্থাপন করে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছেন।

আমরা মেজর খালেদ মোশারফের ক্যাম্পেও গেলাম। ক্যাপ্টেন রফিক খুব শীর্ণ হয়ে পড়েছেন। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অনেক দিন পরে তার সাথে দেখা। ইয়াহিয়ার শাসনামলে আমলে কুষ্টিয়া ছিলেন। দু’সপ্তাহ পূর্বে তিনি ফ্রন্ট থেকে ফিরেছেন। কয়েক দিন পূর্বে তার জ্বর হয়েছিল। জ্বর থেকে সেরে উঠেছেন। যুদ্ধে ফিরে যাওয়ার জন্য তিনি উদগ্রীব। এই ক্যাম্পে সবাই মাটিতে বসে আমরা দুপুরের খাওয়া খেলাম।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দিত। পাক সেনাবাহিনী তখন আগরতলা সীমান্তে দারুন চাপ সৃষ্টি করছে। তাদের গোলা সীমান্ত পার হয়ে শরনার্থী শিবির পযুর্ন্ত আসছে। হানাদার হটাবার জন্য আমাদের মুক্তিবাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এ সময় চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এম.এ হান্নানের সাথে দেখা হলো। আমরা বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করি। আগরতলাতে জনসংখ্যার চেয়ে শরনার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। ফেরার পথে মালেক উকিলের সাথে দেখা হলো। এখানে ছোট পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যেখানেই যান সেখানেই বিপুল লোকের সমাগম হয়। তাদের দুজনের আগমনে এখানে প্রাণচাঞ্চল্য বয়ে গেল।

পরদিন সকালে আমরা খালেদ মোশারফের ক্যাম্পে গেলাম। খালেদ আমাদের জানান, এই মুহূর্তে তিনি আমাদের কুমিল্লা অঞ্চলে নিয়ে যেতে পারছেন না। কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়ক তিনি অবরোধ করে রেখেছেন বলে তিনি আমাদের জানান। তার লোকজন অনেক গভীরে যোগাযোগ স্থাপন করে রেখেছে। আমাদের নিয়ে তিনি জঙ্গলের পথে বের হলেন। পাহাড়ের গা ঘেঁষে কয়েকটি পরিছন্ন গ্রাম। ভারতীয় সীমান্তের সাথে লাগানো। এই গ্রামের মানুষের সাথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সখ্যতা স্থাপিত হয়ে গেছে। পুকুর থেকে গ্রামের মেয়েরা পানি নিচ্ছে, তারই পাশ দিয়ে চলাচল করছে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা। গ্রাম থেকে একটু দূরে আম বাগানের ভিতরে বৃহৎ কামান বসিয়ে গোলা ছুড়ছে আমাদের আমাদের গোলান্দাজ বাহিনী। এই কামান গুলো খুব পুরানো বলে মনে হলো। এগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। খালেদ আমাদের কামানের সামনে নিয়ে গেল। আমাদের মাথার উপর দিয়ে কামানের গোলা উড়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক উত্তেজনা শিহরণ। এরপর খালেদ পাহাড়ে উঠার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানান। তিনি আমাদের শত্রুর শিবির দেখানোর কথা বলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে না নিয়ে যেতে পারলেও সড়কটি আমাদের দেখাতে চাইলেন। কন্টকাকীর্ণ পথ। খালেদের চাল-চলন দেখে মনে হলো, তিনি যেন এখানে মানুষ হয়েছেন। তার কাঁধে একটি দূরবীণ, পায়ে বুট এবং হাতে একটি ছোট ছড়ি। আমাদের হাতেও এমনি করে লাঠি দিয়েছেন পথ চলার সুবিধার জন্য। আমাদের উঠতে কোন অসুবিধা হচ্ছিলো না। নজরুল ভাইকে কে নিয়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। পাহাড়ে উঠে দূরবীণ দিয়ে খালেদ কি যেন দেখলেন। এক সময় খালেদ পাক-ছাউনি দেখালেন। আমি দেখলাম। ঢাকা চট্টগ্রাম সড়ক ও দেখলাম। রাস্তাটি একেবারে জনমানবহীন।

আমাদের গোলান্দাজ বাহিনী তখনও গোলাবর্ষণ করেছে। শত্রু বাহিনী ছাউনীর কাছে সেই গোলা গিয়ে পড়েছে। শত্রুছাউনীর পাশে একটি রেস্ট হাউজ দেখা যাচ্ছে। খালেদ যোগযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন।

কতক্ষণ পর ফিরে গেলাম। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জোয়ানদের সাথে। ইতিমধ্যে গাফফার (অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) একটি ছোট বাহিনী নিয়ে আসে। গাফফার অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা। বাড়ি খুলনা। অসম সাহসী, ধীর, স্থির। একটা ভালো লাগার মত ব্যক্তিত্ব। তার কাছে যুদ্ধের বহু কাহিনী এবং মুক্তিযুদ্ধাদের বীরত্বের কথা শুনলাম। সন্ধ্যা হতেই আমরা আগরতলা ফিরে আসি। পরদিন আমাদের কলকাতা যাবার কথা। বি.এস.এফ এর মালবাহী বিমানে আমদের যাবার ব্যবস্থা হয়েছে। খালেদ সকালবেলা আমাদের বিদায় জানাতে এলেন। তিনি সুবিধা-অসুবিধা এবং আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতৃস্থানীয় লোকের সাথে যোগাযোগের অভাবের কথা জানান। কিছুদিন পূর্বে মুজিব বাহিনীর কার্যক্রর্মের সাথে যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, আমরা তা’ দূর করতে সক্ষম হই। দুই দিন পর কলকাতায় এসে আওয়ামী লীগ কাযর্করী কমিটির বৈঠকে আমরা সবর্শেষ পরিস্থিতি আলোচনা করি। এই সময় খবর আসে যে খালেদ মোশারফ আহত হয়েছেন। তাকে লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।

আওয়ামী লীগের এই বৈঠক ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তখন বুঝতে পারি যে উপমহাদেশের পরিস্থিতি ও যুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি সব কিছু মিলে আমাদের সংগ্রামের চূড়ান্ত পযার্য় চলে এসেছে। এ সময় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব আসে। বাংলাদেশের শরনার্থীদের নিয়ে আমরা দেশের ভেতরে যেতে পারি কিনা। ভূ-খণ্ড দখলের ব্যাপারে ভারত সরকার সাহায্যের আশ্বাস দেয়। আমরা এ প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করি। আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রায় সকল মানুষেই আমাদের সংগ্রামের পক্ষে। হানাদার বাহিনীর বন্দুক কামানের বাইরে সারা দেশেই বলতে গেলে স্বাধীন। আমাদের তাই নতুন করে ভূ-খণ্ড দখলের প্রয়োজন নাই।

ইতিমধ্যে আমরা আমাদের কথার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে সক্ষম হই। জুলাই মাস পর মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। শত্রুদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভয়ভীতি। বিশ্বব্যাংকের একটি দল আগস্ট মাসে ঢাকা আসে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে পাক সরকার সাহায্য পাবে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা তখন ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ১২ আগস্ট তারিখে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে বলে পাক সরকার যে প্রচার চালাচ্ছিল এই গ্রেনেড নিক্ষেপের ফলে তা অনেকটা ব্যর্থতায় পযর্বসিত হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সবর্ত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গেরিলারা অতি অল্প সময়ে কলা কৌশল রপ্ত করে। প্রথম দিকে পাক বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল পরিবতর্ন করে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

জুন মাসের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ্য করছি। কুষ্টিয়া কলেজের বীর যোদ্ধা তারেক। এক সম্মুখ সমরে তারেক শহীদ হয়। কৃষ্ণনগর ক্যাম্প পরিদর্শনে গেছি। শুনলাম, তারেক দলবল নিয়ে যুদ্ধে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসলো, কিন্তু তারেক ফিরে আসল না। জরুরী কাজে আমার কলকাতা ফিরে আসা দরকার। ক্যাম্পের বাইরে ৪ টি ছেলেকে দেখতে পাই। তাদের মুখে শুনলাম কিভাবে তারেক বীরের মত শহীদ হয়েছে। আমি তাদের বললাম, “যুদ্ধে বিজয় বড় কথা নয়, সবচেয়ে বড় কথা হলো বীরত্বের কথা। আমরা তারেকের গর্বে বেঁচে থাকবো। তারেক শহীদ হলেও তার একটা জিনিস পাওনা আছে। তা’হলো তার বন্ধুদের কাছ থেকে সম্মান। তাঁকে সেই সম্মান দেখাতে হবে। তোমরা তার লাশ আনতে পার নি। তার আত্মা কে তোমরা নিয়ে এসেছো। এসো, আমরা তাকে সম্মান করি।”

সকলকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করান হলো। পতাকা অর্ধনমিত রাখা হলো। আমরা শ্রদ্ধার সাথে তারেক কে সম্মান করলাম। সবার চোখে নেমে আসলো অশ্রুধারা। ধরা গলায় আবার গাইলাম “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।”

অন্য একদিনের ঘটনা। শিকারপুর ক্যাম্পে। তওফিক এলাহী এই ক্যাম্পের অধিনায়ক। যুদ্ধে একজন আনসার মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাশ নিয়ে আসে। বুট পায়ে সামরিক পোশাক পরে ছাউনির সবুজ ঘাসে শুয়ে আছে শহীদ ভাই। বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো শরীর। তাকে সামরিক কায়দায় দাফন করে ক্যাম্পে ফিরে আসি। এসে দেখি, শহীদের স্ত্রী। কোলে অবুঝ পুত্র। সাথে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। জানি না আজ তারা কে কোথায় কেমন আছে। যুদ্ধকালে এই পরিবারের ভরণ পোষণের ভার নিয়েছিলো বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস। এমনি শত শত মুক্তিযোদ্ধা শুয়ে আছে সিলেটের বালাট সীমান্তে। তাদের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের বাংলার মাটিতে কবর দেওয়া হয়। শুধু বালাট নয়, ২৪ পরগনার টাকি পযর্ন্ত পুরো সীমান্তে শহীদের অসংখ্য কবর রয়েছে।

পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করার সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও আমি সেখানে একটা সংযোগ রাখার চেষ্টা করতাম। সেখানে আমার তদারকি মোশতাক আহমদ কিছুতেই পছন্দ করতেন না। খন্দকার মোশতাক মাহবুব আলম চাষীকে পররাষ্ট্র সচিব করেছেন। হোসেন আলী কলকাতা মিশনের প্রধান হিসেবে কাজ চালাচ্ছেন। হোসেন আলী থেকে শুরু করে কলকাতা মিশন ও পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা যেভাবে আমাকে সহযোগিতা দিয়েছেন, তা ভুলবার নয়।

পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি প্রচার সেল খোলা হয়। আমার বন্ধু ও সহকারী মওদুদ আহমেদ এ সেলে কাজ করতেন। এ সময় তার একটি পুস্তক বিদেশ অফিসের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। মান্নান সাহেব জয়বাংলা পত্রিকা ও বেতার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ডাঃ টি হোসেন থাকেন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগের দায়িত্বে। তিনি যুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন শিবিরে আহতদের শুশ্রুষা চালু করেন।

পররাষ্ট্র দপ্তরের “প্রকাশনা সেল” কে একটি নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিদেশী প্রতিনিধি দল আসলে তাদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব এরা পালন করতে থাকে। মিঃ বটমলির নেতৃত্বে একটি বৃটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে। এদের কলকাতা আসার কথা ছিলো। তাদের সাথে কথাবার্তা বলার জন্য আমরা একটি ছোট দল গঠন করি। এই দলে সৈয়দ আবদুস সুলতান, ডাঃ টি হোসেন, ডাঃ স্বদেশ বোস সহ আর অনেকে ছিলেন।

বেনাপোলের ডাক বাংলোতে বৃটিশ প্রতিনিধি দলের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের লোকদের বিভিন্ন শিবিরে পোস্টার ও ফেস্টুন সহ পাঠাই। প্রতিনিধি দল আসেন বেশ বিলম্বে। বটমলি বলেন, তারা সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলবেন। আমাদের ন্যায় বুদ্ধিমান মানুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমি বললাম যে, আমরা বুদ্ধি বিবেকহীন মানুষের অত্যাচারে আজ দেশ ছাড়া, গৃহহারা। বুদ্ধি বিবেক সম্পুর্ণ মানুষের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষায় আছি। তাই তার এই পালার্মেন্টারী ডেলিগেশনের সাথে আমাদের আলোচনা বিশেষ প্রয়োজন। আমাদের সমস্যা নিয়ে তাদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয়। তারা আমাদের পক্ষে সম্ভাব্য সব কিছু করার আশ্বাস দেন।

টেড কেনেডী আসেন একবার। তাঁর সাথে আমাদের প্রতিনিধিদলের দেখা হয়। আমি ছাড়াও প্রতিনিধি দলে ছিলেন ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ স্বদেশ বোস ও মুস্তফা সারয়ার। কেনেডী প্রথমেই জানতে চান, আমাদের জন্যে তারা কী করতে পারেন। আমি বললাম, মার্কিন জনগন, সেদেশের পত্র-পত্রিকা ও কেনেডী আমাদের জন্যে যা করেছেন,এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমি আরো বলি, যুক্তরাষ্ট্র সরকার যদি কিছুই না করেন, তাহলেই আমরা খুশি। সফরের পর কেনেডীর রিপোর্ট আমাদের পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিলো।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস চরমভাবে দেখা দেয়। এই উচ্চাভিলাস যুবক, ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে বন্দুকধারী মুক্তিযোদ্ধা, সিপাই, চাকরিজীবি সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। রাজনীতিকদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল তবে উচ্চভিলাষীদের সংখ্যা তত বেশী ছিল না।

মিলিটারীদের প্রতি যুবকদের একটা চরম অবিশ্বাস ছিল। তাদের অভিযোগ, এককালে এরা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে থাকায় তাদের ভাবধারা প্রভাবাম্বিত। তাই তাদেরকে ক্ষমতায় আসতে দিলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আত্মবিকাশের চরম বিপর্‍্যয় ঘটাবে।

অপরদিকে সামরিক বাহিনীর মধ্যে আওয়ামী লীগের যুবকদের প্রতি তেমন অবিশ্বাস। এর মধ্যে মুজিব বাহিনী সৃষ্টির ফলে এই অবিশ্বাস আর বৃদ্ধি পায়। একজন সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বহু সামরিক অফিসারের মধ্যে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে । তাদের বক্তব্য ছিল সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির অধিনায়ক হওয়া উচিত নয়।

জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশারফ প্রমুখ ওসমানী সম্পর্কে এ ধরনের উদাসীন উক্তি করেছেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা তখন থেকেই শুরু হয়। শফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ এই তিন জনের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বলে আমার ধারনা। শফিউল্লাহ ও খালেদ দু’ জনেই যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন। এরা চিরকাল বীর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জিয়ার তেমন কোন বীরত্বের নজীর নেই। তবে তার মধ্যে ক্ষমতার অস্পষ্ট প্রস্ততি তখন থেকেই লক্ষ্য করা গেছে। নূরুল ইসলাম শিশু প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারী সেক্রেটারী হিসেবে কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলতেন, ‘‘সামরিক বাহিনীর সকল অফিসারের সহযোগিতা ও সম্মান আমাদের অজর্ন করতে হবে। তবে আমাদের প্রতি তাদের আস্থার অভাব স্পষ্টতঃই দেখা যায়। শিশু তাদের পক্ষ হয়ে আমাদের কাছে আছেন ও থাকবেন। আমাদের কতটুকু কাজে লাগবে জানি না। তবে তার মাধ্যমে সামরিক অফিসারদের আস্থা ও সম্মান অজর্ন করার চেষ্টা করা উচিত। ওদের এটাও বুঝানো দরকার যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধ অচল এবং নতুন দেশ গড়াও অসম্ভব। তাই দেশপ্রেমের তাগিদে যারা অস্ত্র ধরেছেন, এই কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পেছনে ওদের কাতারবন্দী হওয়াও উচিত।”

সামরিক বাহিনীর সাথে মুজিব বাহিনীর, মুজিব বাহিনীর সাথে অনিয়িমিত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কমীর্দের খুটিনাটি বিরোধ দেখা দেয়। এসব বিষয় আওয়ামী লীগ কাযর্করী কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়। তাজউদ্দিন ভাই এই বিষয় সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিক মুল্যায়নের নির্দেশ দেন। তার বক্তব্য ছিল কে বা কারা পাকিস্তানি ভাব ধারায় অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী গণবিরোধী মনোভাব প্রভাবাম্বিত বা কে তা নন, এর বিচার শুধু ভবিষ্যতেই সম্ভব।

নয় মাসের সংক্ষিপ্ত সময়ে তাজউদ্দিন ভাই-এর সেই আবেদন কতটুকু সফল হয়েছিল তা ভবিষ্যত ইতিহাসই বলবে। প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য একজন করে লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগ করা হয়। বেশির ভাগ লিয়াজোঁ অফিসার ছিলেন সংসদ সদস্য। সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার লক্ষ এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

পাকিস্তান সিভিল সাভির্স থেকে যে সব অফিসার যোগ দেন, এদের মধ্যে উচ্চভিলাষী লোকের অভাব ছিল না। আবার এদের মধ্যে বেশিরভাগ অফিসারই অসীম সাহসিকতা, ত্যাগ ও কমর্স্পৃহার পরিচয় দেন।

মাগুরা ও মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক কামালউদ্দিন ও তওফিক এলাহীর অবদান স্বণার্ক্ষরে লেখা থাকবে। একজন ছেলেদের সাথে বন্দুক কাঁধে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন, যিনি পরে ঢাকা জেলার জজ হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি ব্যাপক ও সম্মানিত আন্দোলন ছিল । এখানে অনেক লোকই তাদের পোশাকী, পদবী ও মনোভাব বজর্ন করতে পেরেছিলেন। পাক সিভিল সাভির্সের অনেকের মধ্যে পদবী মেজাজের রেশ ছিল। ফলে রাজনৈতিক মহলে এই কিছুটা ক্ষোভ দেখা দেয়। এই পদবীজনিত মনোভাবের কারনে পরবতীর্কালে বাংলাদেশে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এদের সংখ্যা খুব বেশী ছিল না।

এসব পদবী মনোভাবাপন্ন অফিসারদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব, ফাইলের খেলা, কলম দিয়ে পিষে নোট লিখা, লাল ফিতাতে বাঁধা এমন এক পর্যায়ে এলো যে পুরো ৪/৫ তলা বাড়ি প্রবাসী সরকারের অফিস পরিণত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যাপকতায় এদের মিশিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় নি। ফলে এরা একটি ভিন্ন মনোভাব ও ভিন্ন স্রোত হয়ে দেশে ফিরে আসে।

কেবিনেটে তাজউদ্দিন ভাই-এর বিরুদ্ধে প্রথম থেকে চরম অসন্তোষের বারুদ নিয়ে বসে ছিলেন খন্দকার মোশতাক। ব্যক্তিগত আক্রোশ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি ভিন্ন মনোভাব, যে কোন কারণেই হউক না কেন, মোশতাক অনেক কাজেই বাঁধা সৃষ্টি করেছেন।

মোশতাক কখনো শেখ মনিসহ যুব নেতাদের উস্কিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। মোশতাকের ভাবশিষ্য তাহের ঠাকুর একবার স্বাধীন বাংলা বেতারে শিল্পীদের দিয়ে ধর্মঘট করার ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করেন। অবশ্য এসব সফল হয় নি। সাধারণ কর্মীদের সংগ্রামের প্রতি ছিল সমর্থন আর প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের দলগত দিক থেকে তাজউদ্দিন ভাই-এর প্রতি মিজান চৌধুরীর একটি ক্ষোভ ছিল। প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দিন ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়েন নি।

আর অনান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভাসানী ন্যাপ, মোজাফফর ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি ইত্যাদি দল গুলোর দাবী ছিল একটি সবর্দলীয় সরকার গঠন করার। আওয়ামী লীগের বক্তব্য ছিল নিবার্চিত প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকার গঠন যুক্তিযুক্ত হবে না। সবর্দলীয় সরকার গঠনের দাবীদারদের কেউ কেউ ভারতবর্ষের বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে লবি সৃষ্টি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন নি।

ভারতে সিপিআই ও সিপিআই (এম)-এর কংগ্রেসের ওপর প্রভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক। তাদের কাজ থেকেও সবর্দলীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে আনাগোনা শোনা যেতে লাগলো।

এ সবের অবসান ঘটাবার জন্যে প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের সাথে পরামর্শ করে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। এতে ভাসানী, মনি সিং ও মোজাফফর আহমদ সদস্য হলেন। উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।

উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের কাযর্করী কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্থাব উত্থাপন করা হয়। সেরেনিয়াবাত এই প্রস্তাবের নেত্তৃত্ব দেন। শেখ আজিজ, শাহ মোয়াজ্জেমসহ আর কেউ কেউ নেপথ্য থেকে এই প্রস্তাব চাঙ্গা করেন। অবশ্য আলোচনার পর এই প্রস্তাব নাকচ করা যায়।

যুদ্ধকালে তাজউদ্দিন ভাইকে ঘায়েল করার জন্যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল কম চেষ্টা করে নি। এইসব প্রচেষ্টা অনেক সময় সামগ্রিক সংগ্রামকে ব্যাহত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখন কিছু বলা সম্ভব হতো না, তখন তাকে উচ্চভিলাষী রাজনীতিবিদ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলেছে। সে সময় কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু কে ধরিয়ে দিয়ে ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়ে ভারতে এসে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষণা করেছেন।

তাজউদ্দিন ভাই বহুদিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি বঙ্গবন্ধুকেই তার জীবনের একমাত্র নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এসব ভাবতে হচ্ছে বলে তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন। সহকমীর্দের মাঝে কাউকে খুঁজতেন তার এই ভার বইতে। মন ও মানসিকতার দিক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি এই সংকীর্ণ মনোবৃত্তিতে কখনোই অভ্যস্থ ছিলেন না। তাই তাকে অনেক কষ্ট ও বেগ পেতে হয়েছে। কর্তব্যে অটল, নীতিতে দৃঢ়, কঠিন প্রত্যয় নিয়ে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার চারিত্রিক গুনাবলিকে তার সংস্পর্শের লোকেরা মুগ্ধ হয়েছেন। ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্ব, মিসেস গান্ধী, সরকারি কর্মচারী, সামরিক কর্মচারী, বিএসএফ থেকে বিভিন্ন এজেন্সী, সবাই মুগ্ধ ছিলেন। এদের সকলের সম্মান অজর্ন করতে তিনি সক্ষম হন। গান্ধী ভাবধারায় প্রভাবিত ভারতীয় নেতৃত্ব তাজউদ্দিন ভাই-এর মত চরিত্রের লোকের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন। দলের অভ্যন্তরীন ষড়যন্ত্র সত্বেও আমাদের সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের বিপুল অংশ তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করেন। তিনি একজন বড় নেতা ছিলেন। তাঁর চিন্তাকর্ম ও ভাবধারার সাথে দলের ও ক্যাবিনেটের খুব কম লোকেরই মিল ছিল। ক্যাবিনেটের মধ্যে মনসুর ভাই ও হেনা ভাই একাগ্র মন নিয়ে পরিশ্রম করেছেন। তবে, তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাথে প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবী কম-বেশী যাই হোক না কেন, সমান থাকার কারণেই এরা একাত্ম হতে পারে নি।

ইয়াহিয়ার কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন চলছে। এই বিচারের বিরুদ্ধে আমরা বিদেশে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এ ব্যাপারে আমরা বন্ধু ও হিতাকাঙ্ক্ষীদের কাছে আমাদের চিঠি পাঠিয়েছি। লণ্ডনে ডোনাল্ড চেসওয়ার্থকে চিঠি লিখে তাকে জানাই সেখানে বাংলাদেশ কমিটির সাথে যোগাযোগ করে জেনেভা কনভেনশনের চার নং ধারা মতে একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় কিনা। কোন যুদ্ধকালীন অবস্থায় সম্মুখ সমরে যারা লিপ্ত, তাদের গ্রেফতার ও বিচারে জেনেভা কনভেনশনে বিধি-নিষেধ রয়েছে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর বিচার আইনসিদ্ধ ছিল না। পাকিস্তান জেনেভা কনভেনশন মানতে বাধ্য থাকায় এই মর্মে কোন ব্রিটিশ নামী কৌসুলির একটি মতামত গ্রহণ করা আবশ্যক।

তাছাড়া নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইডের যুক্তিপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ লিখিত মতানুযায়ী জেনেভাতে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে এই ব্যাপারে আমরা আবেদন করতে পারি। ডোনাল্ড ও আবু সাঈদ চৌধুরী পৃথক পৃথক ভাবে লিখে জানান, এ ব্যাপারে আমাদের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাজউদ্দিন ভাইকে এসব অবহিত করার পর তিনি আনন্দিত হন। পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী হিসেবে এ ব্যাপারে খন্দকার মোশতাকের মত নেয়া প্রয়োজন। তাজউদ্দীন ভাই আমাকে খন্দকার মোশতাকের সাথে দেখা করতে পাঠান। মোশতাক সাহেব তাঁর পরিবার নিয়ে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। দেখা করতে গিয়ে আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। সেখানে আরও কিছু লোক তাঁর সাথে গল্প-গুজবে ব্যস্ত ছিলেন। সবাই চলে যাবার পর আমার ডাক পড়লো। মোশতাক ম্যাকব্রাইডের লেখা মতামত না পড়েই একটা মন্তব্য করেন। তাঁর এ বক্তব্য আমি কোন দিন ভুলতে পারবো না। তিনি বলেন, “You must decide, whether you want Sheikh Mujib or Independence, you can’t have both.”

-(অনুবাদঃ তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তোমরা কী চাও, স্বাধীনতা না শেখ মুজিব? দু’টা একসাথে পাবে না)

আমি এ কথা শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। সাথে সাথে উত্তর দিলাম, “We want both, Sheikh without Independence or Independence without Sheikh, both are incomplete.”

-(অনুবাদঃ আমরা দু’টোই চাই। শেখ মুজিব ছাড়া স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীনতা ছাড়া শেখ মুজিব, দু’টোই অপূর্ণ)

আমি বুঝলাম, তাঁর মন্তব্য আকস্মিক নয়। এর পিছনে একটা যোগ-সূত্র কাজ করছে। শেখ মুজিবকে আনতে আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ প্রয়োজন। এটাও এক ধরণের ব্ল্যাক মেইল বলে আমার মনে হলো। আমি যে উদ্দেশ্যে গিয়েছি, মোশতাক সুকৌশলে যে তা এড়িয়ে গেলেন, তা বুঝতে আর বাকি রইলো না। খুব বিরক্ত হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে সেখান থেকে ফিরে তাজউদ্দীন ভাইকে সব জানালাম।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমি এ ব্যাপারে ডোনাল্ড ও আবু সাঈদ চৌধুরীকে চিঠি লিখি। ম্যাকব্রাইড ও মিঃ চৌধুরী আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে পাক সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। জেনেভা কনভেনশনের চার নং আর্টিকেলে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা উল্লেখ না থাকায় আমাদের কোন পদক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে সফল না হলেও আন্তর্জাতিক বিশ্বে এর একটি বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ইয়াহিয়া সরকার এর গুরুত্ব উপলদ্ধি করেন। ম্যাকব্রাইড পরে ইসলাবাদ গিয়ে আমাদের পক্ষে বলেন যে, শেখ মুজিবের বিচার আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী মোশতাক প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্যদের অগোচরে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেন। একই সাথে তিনি দলীয় নেতা, কর্মী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেন।

বিভিন্ন সময় বিদেশ থেকে নানা ধরণের লোক প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে আসতেন। অনেকের সাথেই তিনি দেখা করতেন। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিজে সাক্ষাতের পূর্বে তিনি আমাকে পাঠাতেন।

এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গুস্তাভ পাপানেক কলকাতায় এসে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর সাথে প্রাথমিক আলোচনার জন্য তাজউদ্দীন ভাই আমাকে প্রেরণ করেন। একটি হোটেলে তাঁর সাথে আমি দেখা করতে যাই। তাঁর সাথে আমার কোন পূর্ব পরিচয় নেই। পাপানেক বলেন, “সি.আই.এ. বাংলাদেশের আন্দোলনের পক্ষে নয়। হোয়াইট হাউজের মত পাল্টাতে হলে আগে সি.আই.এ. এর মত পাল্টাতে হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর প্রয়োজন। মার্কিন প্রশাসন, বিশেষ করে সি.আই.এ.-এর মত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। উত্তরে আমি জানাই, একজন রাজনৈতিক নেতার পক্ষে গোয়েন্দা সংস্থার সাথে কোন আলোচনা হতে পারে না, তেমনি এর প্রয়োজনীয়তাও আমি বুঝতে পারি না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন খোলা-মেলা ব্যাপার। এর মধ্যে কোন আঁতাত বাঁ ষড়যন্ত্রের চিহ্ন নেই। তাছাড়া, সি.আই.এ.-এর মত একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা এই আন্দোলনের সকল বিষয় সম্পর্কে অবহিত। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের বন্ধুরা আমাদের পক্ষে কাজ করছেন। তাদের কোন বক্তব্য থাকলে, বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে খোলাখুলি উত্তর পেতে পারেন।

পাপানেকের প্রস্তাব নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। তবুও প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে তাঁকে চূড়ান্ত কথা জানাবার প্রতিশ্রুতি দেই। তাঁর প্রস্তাব শুনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সফর কিংবা সি.আই.এ.-এর সাথে সাক্ষাৎ কোনটাতেই তিনি রাজী নন। আমি প্রধানমন্ত্রীর জবাব পাপানেককে জানাই। আমার জানা মতে একমাত্র বিদেশী ব্যক্তিদের মধ্যে পাপানেকের সাথেই প্রধানমন্ত্রী দেখা করেননি। প্রফেসর রেহমান সোবহান যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পক্ষে কাজ করেন।

ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শোর কলকাতায় এসে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। ব্রিটিশ জনমত গড়তে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। শোরের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠককালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত, মানবিক দিক, বাস্তুহারা সমস্যা ইত্যাদি আলোচনা করা হয়। এই সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ও আমি উপস্থিত ছিলাম। শোর ও ডোনাল্ড উভয়েই প্রধানমন্ত্রীকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। পরে শোর সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন। তাঁর মতামত ব্রিটেন ও ভারতে বিশেষভাবে প্রচারিত হয়।

ব্রিটিশ এম.পি. মাইকেল বার্নসের সাথে দেখা হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। স্থানটা ছিল চব্বিশ পরগণা পার হয়ে বাংলার মাটিতে। তিনটি টুল ছিল। এগুলো অনায়াসে হাতে বহন করা যায়। পাশে যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য সামরিক টেলিফোন সেট। কিছু দূরে নদীর ওপার থেকে গোলা-গুলির আওয়াজ আসছে। এমনি করে টাইমস পত্রিকার নামী সাংবাদিক হেজেল হার্টসের সাথেও সাক্ষাৎ হয়।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষা-শেষি আমাদের সুখবর আসতে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবর আসতে থাকে। আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের সমর্থন বৃদ্ধি পায়। আঁদ্রে মালরো থেকে শুরু করে তরুণ বিটলস এবং ইহুদি মেনহুইন থেকে পন্ডিত রবি শঙ্কর, কৃশকায় পপসিঙ্গার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেন।

এছাড়াও বাংলাদেশের উপর গান রচনা ও রেকর্ড হয়ে আসছে। বিদেশী বন্ধুরা টাই পরে এসেছেন, তাতে বাংলাদেশের ছবি। বাংলাদেশ সারা পৃথিবীর অন্তরে।

ইতিমধ্যে নানা রকম পরিকল্পনা এসেছে। ভারত বিরাট ও ব্যাপক দেশ। নানা ধর্ম ও বর্ণের লোক এখানে বাস করে। ভারত সরকারও একটি বৈচিত্র্যময় সরকার। মিসেস গান্ধী তাঁর নিজস্ব পরকল্পনা মোতাবেক কাজ করে যাচ্ছেন। অটল বিশ্বাস নিয়ে তিনি কাজ করছেন। বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে মিসেস গান্ধীর কাছে বহু প্রস্তাব এসেছে। সেগুলো তিনি কিভাবে দেখছেন, তা তিনিই জানেন। কিন্তু, আমরা দূর থেকে দেখে যা বুঝেছি, দিল্লী থেকে বিভিন্ন এজেন্সী কাজ করতো। ভারতীয় বিশেষ মন্ত্রণালয় কলকাতায় অফিস খোলে। মিঃ রায় ও মিস অরুন্ধতী এই অফিসের কর্মকর্তা ছিলেন। অপর একটি এজেন্সী ছিল ‘র’। এর পক্ষ থেকে লিয়াজোঁ করতেন মিঃ নাথ।

পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালে হৃদরোগে তিনি মারা যান। মিঃ নাথ ছিলেন বাঙালি সুপুরুষ, ধীর-স্থির ব্যক্তিত্ব। সচরাচর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীদের থেকে তিনি পৃথক ছিলেন। এছাড়া তিনি বি.এস.এফ.-এর কর্মকর্তা। ইস্টার্ন সেক্টর কমান্ডার গোলক মজুমদার প্রথম থেকেই সর্ব বিষয়ে আমাদের দেখা-শুনা করতেন। ভারতের সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি জেনারেল সরকার আমাদের কম্যান্ডের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। দিল্লী থেকে লিয়াজোঁ করার জন্য কেউ কেউ কলকাতায় থাকতেন।

পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস নেতা সাত্তার সাহেব আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। দিল্লী থেকেও অনেকে আসতেন। প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য আমাকে ন্যস্ত করেন। কিন্তু, রাজনৈতিক যোগাযোগ কখনোই সফল রূপ নিতে পারে নি। তবে স্থানীয় সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এটা খুবই কার্যকরী হয়। কিন্তু নীতিগতভাবে এই লিয়াজোঁর খুব একটা প্রয়োজন ছিল না। এমনি বিভিন্ন মহল ও এজেন্সীর সাথে সমন্বয় করতে একটি মূল সূত্রের অভাব সর্বদা লক্ষ্য করেছি। ফলে অনেক সময় যোগাযোগের অভাব বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তিতে পরিণত হয়। মিঃ ডি.পি. ধরের দিল্লীতে আসা পর্যন্ত এই বিভ্রান্তি বিরাজ করছিলো। ডি.পি. ধর ছিলেন একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। এই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপক প্রেক্ষিত সম্পর্কে একটি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী অর্জন করেন। মিঃ ধর যদি মিসেস গান্ধীর পক্ষে থেকে কাজ করতেন, তাহলে হয়তঃ বহু ভুল বুঝা-বুঝি ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। দিল্লী সরকারের বিভিন্ন এজেন্সী, তাদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। তাদের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতার মনোভাব। ফলে, সামগ্রিক উদ্দেশ্য অনেকবার বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। ডি.পি. ধরের সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। মুজিব বাহিনী গঠনের ব্যাপারেও ডি.পি. ধরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।

শামসুল হককে দিল্লীতে আমাদের পক্ষে কাজ করতে বলা হয়। শাহাবুদ্দিন প্রথম থেকেই পাক দূতাবাসের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে আমাদের সাথে চলে আসেন। একই সাথে দূতাবাসের প্রেস এটাচীও আসেন। এদের সাথে প্রথম থেকেই আমাদের যোগাযোগ হয়। প্রথমবার দিল্লী গিয়েই তাদের সাক্ষাৎ পাই। সেখানে অফিস করার ব্যাপারে তাদের সাথে আলোচনা করি। পরবর্তীকালে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে আসার পর দিল্লীতে অফিস স্থাপনে সক্ষম হই। অক্টোবরের শেষ দিকে মিসেস গান্ধীর সাথেও বাংলাদেশ মন্ত্রীসভার একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকের আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আগামী শীতেই বাংলাদেশ প্রশ্নে একটি অবশ্যম্ভাবী ফয়সালা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বলতে গেলে, অক্টোবর থেকেই আমরা ভারতের স্বীকৃতির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকি।

১৫ই অক্টোবর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে স্বীকৃতির জন্য পুনঃরায় অনুরোধ করেন। সেই চিঠিতে এটাও দাবী করা হয় যে, বাংলাদেশের অর্ধেক ভূ-খণ্ড মুক্তিবাহিনীর দখলে ও বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা সেখানে চালু আছে। এই চিঠির সূত্র ধরেই ১৫ই নভেম্বর অন্য একটি চিঠি লেখা হয়। সেই চিঠিতে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, স্বীকৃতির অনুরোধ, তৎকালীন অবস্থা ইত্যাদি ছিল। এই চিঠি লেখা হয় মিসেস গান্ধীর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রাক্কালে। ২৩শে নভেম্বর অপর একটি চিঠি লেখা হয় তাঁর সফর শেষে ।

এই চিঠিতে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ও বিশ্ব জনমতের প্রতি ইয়াহিয়ার চরম উপেক্ষার কথা বলা হয়। এই চিঠিতে আরও ছিল শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরার ব্যবস্থার কথা। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুরা শীতের আগে দেশে ফিরে যেতে না পারলে বিপজ্জনক অবস্থার সম্মুখীন হবে। অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী এক চিঠিতে জানান, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকলেও পাক হানাদাররা ক্যান্টনমেন্ট থেকে হামলা করে সম্পদ ধ্বংস করছে। জবাবে ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সহযোগিতার প্রস্তাব করে। বাংলাদেশ সরকার ভারতের বন্ধুসুলভ সশস্ত্র বাহিনীকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও বেসামরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়।

পাক-ভারত যুদ্ধের ডামা-ডোল বেজে উঠলো । স্বভাবতই বোঝা গেলো পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে চাচ্ছে ।

এসময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতীয় সমর শক্তির সরাসরি যুদ্ধে অবতরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সরকারের কাছে এক জরুরী আবেদনে বলেন, বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার আগে ভারতীয় সেনাবাহিনী যেন বাংলাদেশে প্রবেশ না করে। আবেদনে আরও বলা হয়, একটি যৌথ বাহিনী গঠন করতে হবে এবং এই বাহিনী দু’দেশের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবে। তাছাড়া বাংলাদেশ মুক্ত হবার পর, বাংলাদেশ যখন ইচ্ছা প্রকাশ করবে তখনই ভারতীয় বাহিনীকে দেশ ত্যাগ করতে হবে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে দিল্লী থেকে ডি.পি. ধর কলকাতায় আসেন। থিয়েটার রোড থেকে অন্য একটি বাড়িতে গিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে ডি.পি. ধরের দু’দিনব্যাপী আলোচনা হয়। রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনায় পারস্পারিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে ভারত সরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি দেয়ার এটা ছিল যথোপযুক্ত সময়। হানাদার বাহিনী তখন সেনানিবাসের ভেতরে আবদ্ধ। দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের শাসন ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। হানাদার বাহিনীকে তাড়াতে পারলেই দেশে যাওয়া সম্ভব।

সীমান্তের ভেতরে-বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের তখন উল্লাস দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। বিদেশী সাংবাদিকরা এসেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে। প্রধানমন্ত্রী কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, তোমরা জানতে চাচ্ছো আমি কেমন আছি? সন্তানের জন্মের কথা জনক না জানলে তাঁর মর্মব্যাথা তোমরা বোঝ? আমি একটি ধাত্রির কাজ করেছি মাত্র। বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হয়েছে। আর তাঁর জনক রয়েছেন হানাদারদের কারাগারে। জাতির জনক হয়তঃ কিছুই জানেন না। দুঃখে, ক্ষোভে, বেদনায় তাজউদ্দীন ভাই কেঁদে ফেলেন। তিনি অবিলম্বে জাতির জনককে মুক্তি দেয়ার দাবী করেন।

৭ই ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাসের পতন হয়। এরপর আমি বেশীরভাগ দিন কাটিয়েছি অগ্রগামী দলের সাথে।

আমি যশোরে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য রওয়ানা হই। পরদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যাবেন। অগ্রগামী দলে আমি ও মুস্তফা সারওয়ার ছিলাম। পথে পথে মানুষের বিপুল উল্লাস। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে চলছে। চারদিকে এই অস্ত্র দেখে সারওয়ার উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে তো?

যশোর সার্কিট হাউজে ক্যাপ্টেন হুদার কাছে অস্ত্র জমা দেয়া হলো। পথে দেখলাম, ট্রাক ভর্তি করে হানাদার বাহিনীর সদস্যদের নেয়া হচ্ছে। জনগণ এদের মেরে ফেলতে চায়। বহু সাবধানে ও কড়া পাহারায় এদের ভারতে নেয়া হয়।

ভারতীয় বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোর অতি দ্রুত পুল-কালভার্ট মেরামত করে দেয়। কোথাও বেইলী ব্রিজ তৈরী করে দেয়া হয়।

বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ছিলে মুস্তফা সারওয়ার। রওশন আলীসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এসে আমাদের সাথে দেখা করেন। আমরা বেনাপোল সীমান্তে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধামন্ত্রীকে স্বাগত জানাই। আমি ও মুস্তফা সারওয়ার সার্কিট হাউজের কক্ষে সামরিক অফিসারের ব্যবহৃত পিস্তল ও কাপড়-চোপড় পাই।

সীমান্তের ওপার থেকে মানুষ আসা শুরু করেছে। সর্বস্তরের মানুষ আসছে কে কার আগে স্বাধীন বাংলাদেশ দেখবে। শিল্পী মুস্তফা আজিজ বলেন, তিনি আমার একটি স্কেচ করবেন। তাঁর ভাই মুস্তফা মনোয়ার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ছিলেন।

স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি আসলো। হাজার হাজার মানুষ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নতুন উদ্দীপনা নিয়ে দেশ গড়ার আহবান জানান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। রাতে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে কলকাতা ফিরে আসি।

-ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম
জুন,১৯৮৩

 

Scroll to Top