একটি উর্দু কথিকা

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

প্রচারিত উর্দু অনুষ্ঠান থেকে

শব্দসৈনিক” ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ আগষ্ট, ১৯৭১

একটি উর্দু কথিকা

১৪ আগস্ট, ১৯৭১

আজ ১৪ই আগষ্ট- মৃত পাকিস্তানের জন্মদিন। এই মৃত শব্দটি শুনে চমকে উঠবার কোন কারণ নেই। গত ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতে ইয়াহিয়া, টিক্কা এবং নিয়াজী সমবেতভাবে পাকিস্তানকে হত্যা করেছে। ২৫ বছরের ভরা যৌবনে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটল। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই দেশকে কেন্দ্র করে এই দেশের বিশেষ এক অঞ্চলে কি ধরনের শোষণ-অত্যাচার-চক্রান্ত চালানো হয়েছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা সম্ভব নয়। তবু সংক্ষেপে বলছি।

গত ২৪ বছরের ইতিহাস অত্যাচার এবং বর্বরতার ইতিহাস। ফ্যাসিজমের একটা জীবন্ত চিত্র। এই চব্বিশ বছরে এদেশের শাসক এবং শোষক গোষ্ঠী গণতন্ত্রের সমস্ত শত এবং দাবীকে পায়ের তলায় নিস্পিষ্ট করেছে। মনুষ্যত্ববোধ এবং মানবিকতাকে বিকৃত করবার চেষ্টা করেছে। বাঙ্গালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ- শোষক এই ভয়ে ভীত হয়ে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলে এর সমস্ত সুফল বাঙ্গালীদের জীবনে বিরাট কল্যাণ ডেকে আনবে। তাই গণতন্ত্র যাতে প্রতিষ্ঠিত না হয় তার চক্রান্ত চালিয়ে যেতে লাগল। এবং ধর্ম ও সংহতির নামে গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করা হল। শোষকগোষ্ঠীর ধারণা ছিল বাঙ্গালীরা ধর্মভীরু। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করে নেবে। ইসলামের নামে অর্থনৈতিক শোষণ এমনকি ভাষা ও সংস্কৃতির উপর হস্তক্ষেপ শুরু করল। এই শোষণ থেকে বেলুচিস্তান এমনকি সিন্ধুকেও মুক্তি দেয়া হল না। সিন্ধুর জনগণের কবি শেখ আয়াজকে তারা কারারুদ্ধ করল।

সীমান্ত প্রদেশের জনগণের কবি ফারেগ বোখারীকে জেলে পুরে নির্যাতন চালাল। উপমহাদেশের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা খান আবদুল গফফার খানকে মানবতামুখী কার্যকলাপের দোষে তার মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করলো। এমনকি নির্যাতিত বেলুচিদের মৌখিক দাবীগুলোকে নস্যাৎ করে দেবার জন্য ঈদের জামাতে অমানুষিকভাবে বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল। |

সাম্প্রতিক একটা ভয়ঙ্কর চক্রান্তের কথা উল্লেখ করছি। প্রতিরক্ষা খাতে মোট ব্যয়ের ৬০% ভাগ দিত বাংলাদেশ এবং মাত্র ৪০% ভাগ দিত পশ্চিম পাকিস্তান। বর্তমান শাসকচক্র সুস্পষ্ট ভাবে জানত বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আর তাই বাংলাদেশে যুদ্ধের আগুন আরো প্রচণ্ডভাবে জ্বালিয়ে পাকিস্তানের সৈন্যদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে যাতে ভবিষ্যতে বেঁচে থাকা এইসব সৈন্যের ব্যায়ার তাদের বহন করতে না হয়। একবার ভেবে দেখুন, যে দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ তাদের পরিচিত, যে দেশের জলবায়ুতে তাদের দৈনন্দিন জীবন অভ্যস্ত নয় সে দেশে ১৫শ মাইল দূর থেকে এসে এই নদীমাতৃক সমতল ভূমিতে তারা কি পেতে পারে- একমাত্র অসহায় মৃত্যু ছাড়া?

নাট্যকার খুনি ইয়াহিয়া এই রক্তাক্ত নাটকের পরিকল্পনা অনেক পূর্বেই করেছিল। এই নাটকের সবচেয়ে গত ও ভয়ঙ্কর চরিত্র টিক্কা খাঁকে সে একবার প্রশ্ন করেছিল, “বলো, তুমি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আয়ত্বে আনতে পারবে কি না?”

টিক্কা বিনা দ্বিধায় চট করে উত্তর দিয়েছিল, হুজুর ৭২ ঘণ্টা নয়, বলুন ২৪ ঘণ্টার ভেতরে আমি বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। শুধু দশ-বিশ লাখ বাঙ্গালীর রক্তের প্রয়োজন।

এই উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে নাট্যকার ঘাতক ইয়াহিয়া আহাম্মকের স্বর্গ ইসলামাবাদ চলে যায়। পেছনে পড়ে থাকে সেই রক্তাক্ত নাটকের মঞ্চ বাংলাদেশ।

২৫শে মার্চের সেই ভয়াল রাতে নরঘাতক টিক্কা তার সশস্ত্র বর্বর বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র, নিরীহ বাংলাদেশের মানুষের উপর। কামানের কুটিল গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ‘জয়বাংলা ধ্বনি আরও প্রচণ্ড রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাংলার আকাশে-বাতাসে। টিক্কা খান এতে হতভম্ব হয়ে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, এদেরকে নির্বাচারে হত্যা করার আদেশ দিল। পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর পশুরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সমগ্র বাংলা জুড়ে চালাল হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। গ্রামের পর গ্রাম তারা পুড়িয়ে দিল। বাংলার মাটিতে শুধু রক্ত আর রক্ত। একদিকে এইসব অত্যাচার অন্যদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শক্তি ও মনোবল দিন দিন বেড়েই চলল। বাংলার জনতা এক হয়ে একটা ইস্পাতের দেয়াল হয়ে গেল। রক্তলোলুপ হায়েনারা জানত না এরা বাংলার সন্তান, এরা সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর বাঘের সাথে খেলে, প্রচণ্ড ঝড়ের সাথে পাঞ্জা লড়ে এবং মৃত্যুর চোখের উপর চোখ রেখে হাসে।

গত ২৫শে মার্চের পরে টিক্কা খাঁর ২৪ ঘণ্টা- ঘণ্টা থেকে দিনে, দিন থেকে মাসে অতিক্রম করল। এখন স্বাধীনতা সংগ্রামের ৫ মাস। অর্থাৎ শত্রুকবলিত বেতার থেকে প্রত্যহ তারা প্রচারণা চালাচ্ছে অবস্থা স্বাভাবিক তালা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ, কারখানার চাকা নিস্তব্ধ, মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে বর্বর সৈন্যরা পালাবার পথ খুঁজছে, সত্তরজন সামরিক পদস্থ অফিসার প্রাণভয়ে আকাশ পথে পাড়ি জমিয়েছে। এইসব অফিসাররা তো আকাশপথে পাড়ি জমাবেই, বিপদ আসবে শুধু সাধারণ সৈন্যদের উপর। কেনই বা আসবে না? তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়াই তো শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য। সামরিক পদস্থ কোন অফিসার যুদ্ধে মারা গেলে তাদের মৃতদেহ কাঠের তৈরী কফিনে ভরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সাধারণ সৈন্য মারা গেলে তাদেরকে বাংলাদেশের মাটিতে মাটিচাপা দিয়ে দায়সারা কাজ সারে। এটাই তো ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ।

মিথ্যের সম্রাট ইয়াহিয়া খান ইরানে গিয়ে বলেছে, হিন্দুদের ভোটে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। চমৎকার! মিথ্যার সম্রাট চমৎকার। তোমার ওষ্ঠদ্বয়ই শুধু চওড়া নয়, মিথ্যে বলায় তোমার জিভের দৌরাত্ম্যও অসীম। নিজের ঘৃণিত কার্যকলাপকে ঢেকে ফেলার জন্য আর কত মিথ্যে তুমি বলবে? শোন এহিয়া খাঁ, কান খুলে শোন, বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এটা ধ্রুবতারার মত জীবন্ত সত্য। তোমাদের তথাকথিত পাকিস্তান মৃত। তার গলিত শবদেহকে সতুর কবরস্থ কর, নইলে পচন ধরা দেহের দুর্গন্ধ বাতাস বিষাক্ত করে তুলবে। মারাত্মক বীজাণু ছড়াবে বাতাসে বাতাসে। ইরানের সেই নোংরা বিবৃতিতে তুমি আরও বলেছ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তুমি শাস্তি দেবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের হৃদয় যার স্পন্দনে স্পন্দিত তাকে তুমি শাস্তি দেবে কি করে? শেখ মুজিব শুধু একজন ব্যক্তির নাম নয়, তার ব্যক্তিত্ব সমস্ত বাঙ্গালীর জন্য একটা আলোকস্তম্ভ, যে আলো পথনির্দেশ করবে একটা শোষণহীন জাতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। জেনে রেখো, আমরা যারা বাঙ্গালী তারা তোমাদের মতো শোষকদের এ দেশের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করব। বাংলাদেশে-নব ইতিহাস সূচীত হবে, বাংলার আকাশ-বাতাসকে রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গীত মুখরিত করে তুলবে। বিশ্বের সে নাম তোর। নরঘাতক হায়েনা ইয়াহিয়া, সে নাম তোর।

(উর্দুতে মূল রচনা : জাহিদ সিদ্দিকী। অনুবাদ : আশরাফুল আলম)

Scroll to Top