<১০, ৬.৬, ২২৫-২৩৪>
মেজর এস, এ, ভূঁইয়ার প্রতিবেদন*
॥একটি এ্যামবুশ ও সুবেদার চান মিয়ার বীরত্ব॥
প্রায় সাড়ে তিন মাসের মত আমি বি-কোম্পানীর সাথে মনতলায় ছিলাম। ঐ সময়ের মধ্যে আমরা অনেক ছোট বড় অপারেশন করেছি। সবগুলোর বিবরণ লেখা সম্ভব নয় বলে আমি মাত্র কয়েকটার কথা নিচে লিখলাম।
২৭শে জুন রাত্রে আমি বি-কোম্পানীকে নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে যাই। দিনের বেলায় গিয়ে শত্রু সৈন্যরা কোথায় আছে, কিভাবে আছে, কেমনভাবে অবস্থান করছে তাই দেখবার জন্য ভিতরে যাই। দেখতে পাই সিদাইই থানার সামনে শত্রুর দুটো ছোট ঘাঁটি আছে এবং তারা সেখানে বিনা দ্বিধায় চলাফেরা করছে। তাদের সংখ্যা ৬০/৭০ জন।
সিদাই থানার পুলিশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী থেকে আমরা তাদের অবাধ চলাফেরা সম্বন্ধে নিশ্চিত হলাম। সেদিন রাত্রে সেনাদলকে দুটিভাগে ভাগ করলাম। সুবেদার চান মিয়াকে আমি আমার একটি গ্রুপের ভার দিলাম এবং তাঁর সহকারী হুসেবে দিলাম সুবেদার তৈয়বকে। আমি নিজে অন্য দলটা সঙ্গে নিলাম। আমাদের সাথে ছিলেন সুবেদার শফিউল্লাহ। রাত ৩ টায় আমরা বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকলাম। দুশমনের অগ্রবর্তী ঘাঁটি দূরে ছিলনা। সুবেদার চান মিয়া গেলেন বাম দিকের অবস্থানে, আমি গেলাম ডান দিকের অবস্থানে। ভোর ৪টার দিকে শত্রুর খুব কাছে গিয়ে আমরা লুকিয়ে ওঁত পেতে থাকলাম। যেই রাস্তা দিয়ে শত্রু সৈন্য দল বেঁধে টহল দিচ্ছিল সেই রাস্তার পাশেই আমরা ওঁত পেতে অপেক্ষা করতে লাগলাম। চান মিয়ার দল বাড়ির আনাচে কানাচে এবংপাট ক্ষেতের ভিতরে পজিশন নিলেন। এলাকাটা ছিল সমতল এবং তার অধিকাংশ জায়গা জুড়ে ছিল ধান ক্ষেত। আর সে ধান ক্ষেতের উচ্চতা ছিল এক ফুটের মতো। অতএব লক্ষ্যবস্তু একেবারে সুস্পষ্টভাবে আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছিল।
আমরা যার যার স্থানে তো অস্ত্রশস্ত্রসহ পজিশন নিয়ে ছিলামই, উপরন্তু সিদাই থানার বামদিক থেকে শত্রুর প্রতি তাক করে রেখেছিলাম একটি রিকয়েললেস রাইফেল। রাতের অন্ধকারেই আমরা এই কাজ শেষ করি।
সকাল ৭টার দিকে শত্রুরা প্রায় ৩০/৪০ জন সৈন্য নিয়ে আগের মতো সুবেদার চান মিয়ার অবস্থানের দিকে টহল দিতে বেরুল। আমরা আরো দেখতে পেলাম শত্রু বাহিনীর আর একটি দল শান্তি বাহিনীর কিছু সংখ্যক লোক নিয়ে সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শত্রুরা কাছাকাছি পৌঁছামাত্র চান মিয়ার পুরো দলটাই তাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করলো। তাঁর দলের হাঁতে ছিল দুই ইঞ্চি মর্টার আর ১৮ টি বোমা। সবগুলোই তারা কাজে লাগালো। প্রায় ৩০ মনিট ধরে সংঘর্ষ হলো এবং চান মিয়াদের তীব্র গুলিবর্ষণে ভয়ার্ত হয়ে অনেকগুলো মৃত সৈনিককে পিছনে ফেলে পাক সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হলো। শত্রু পক্ষের অন্য দলটি প্রতিশোধের স্পৃহায় সুবেদার চান মিয়ার দলকে আক্রমণ করতে চাইলো। তারা কামান দিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু করলো। শত্রুর ইচ্ছা ছিল উত্তর দিক থেকে এসে লেফট(বাম) ফ্ল্যাঙ্ক করে চান মিয়ার দলকে পিছন থেকে আক্রমণ করা। শত্রুর অগ্রগমনের পথে আমি আমার দল নিয়ে বিপুল আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। যেই মাত্র তারা আমাদের কাছে এলো অমনি আমরা হালকা মেশিনগান ও রাইফেলের সাহায্যে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলাম। আমাদের সঙ্গেও একটা দুই ইঞ্চি মর্টার ছিল। সেটারও আমরা পুরোদস্তুর সদ্ব্যবহার করলাম। ঐ দিকে রিকয়েললেস রাইফেলের অবস্থান থেকে ৪টি রিকয়েললেস রাইফেলের গোলা বর্ষিত হলো শত্রুর বাঙ্কারের উপর। শত্রুর দুটি বাঙ্কার সেই গোলার আঘাতে চুরমার হয়ে গেলো। এবারও শত্রুরা আমাদের ওঁৎ পেতে আক্রমণ করার ফাঁদে পড়ল। দিশেহারা হয়ে তারা আমাদের অবস্থানের উপর কামানের গোলাবর্ষন শুরু করল। এখানেও তাদেরকে নিহত সঙ্গীদের লাশ ফেলে পিছনে হটতে বাধ্য করা হলো। আমরা শত্রু সৈন্যের কামানের গোলাবর্ষণকে অত্যন্ত ভয় করতাম। কারন তাদের নিশানা ছিল অদ্ভুত রকমের নির্ভুল। এখানেও সেই নির্ভুল নিশানার পরিচয় পেয়ে আমাদের ঐ অবস্থানে থাকা আর নিরাপদ মনে করলাম না। সুতরাং মর্টার থেকে শত্রুদের দিকে গোলা বর্ষণ করতে করতে তারই আড়ালে আমরা পিছনে সরে এলাম। কামানের গোলা তখন এমন অবিশ্রাম ধারায় এসে পড়ছিল যে, পিছনে হটে আসা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর ছিল না। ঐ সময় আমাদের কোন পরিখা ছিলনা। আমার কোম্পানীতে এই প্রথমবারের মতো সেদিন রিকয়েললেস রাইফেল ব্যবহার করি। তাতে চমৎকার ফল হয়। আমরা দুটো বাঙ্কার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হই।
ঐ দিন আমার দলের একটি মাত্র ছেলের শরীরে গোলার টুকরো এসে আঘাত করে। অন্যান্যরা খোদার একান্ত রহমতে সক্ষম অবস্থায় ফিরে আসে। আমার রানার ও আমি এক স্থানেই ছিলাম। কামানের গোলাগুলো যখন ভীষণ শব্দ করে আমাদের আশেপাশে পড়ছিল তখন মনে হচ্ছিল মৃত্যু বুঝি আমাদের ঘাড়ের উপর খঞ্জর ধরে বসে আছে। আমার কাছ থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে একটি কামানের গোলা সশব্দে ফেটে পড়লো। লক্ষ্য করে দেখলাম আমাদের কারো মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। আমরা তখন মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। আর মুখে উচ্চারণ করতে থাকলামঃ লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজজোয়ালেমিন।
পাকিস্তান রেডিও থেকে সেদিন প্রচার করা হয়েছিল যে, আমাদের মৃতের সংখ্যা ২০ জন। কিন্তু প্রকৃত খবর পাই ঘটনার ৫ দিন পরে। শত্রুপক্ষে নিহত হয় ১৭ জন আর আহত হয় ১৯ জন। গোপন অবস্থান থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করলে দিশেহারা শত্রু সৈন্যদের আত্নরক্ষার প্রায় উপায় থাকে না এবং তখন তাদের এমনি সীমাহীন ক্ষতি মেনে নিতে হয়। এর সাধারণ কারণ এক পক্ষের সতর্কতামূলক পূর্বপ্রস্তুতি, অন্য পক্ষের অজানা বিপদ সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং অপ্রস্তুতি। আর শত্রুপক্ষ সমরশক্তিতে যতই উন্নত পর্যায়ের হোক না কেন আকস্মিকভাবে এমনি ওঁৎ পাতা ফাঁদে পড়লে তারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় এবং সাধারণ মনোবল হারিয়ে ফেলে। সে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় সেই মুহুর্তে অংশ নিতে আর সাহস পায় না। ফলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোটাই তার কাছে বড় হয়ে উঠে।
যাহোক, অপূর্ব সাহস দেখিয়েছিলেন সেদিন সুবেদার চান মিয়া। ঐ দিনের যুদ্ধের পর চান মিয়ার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মেছিল। পরে কর্তৃপক্ষ কোন এক কারণে আমার দল থেকে তাকে বদলী করতে চাইলেও আমি তাতে রাজি হইনি।