শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৬০। একটি বিদেশি সৈন্য বাহিনীর কতৃক আরাপ | নিউইয়র্ক টাইমস | জুলাই ৪, ১৯৭১ |
<১৪, ৬০, ১৩০–১৩২>
নিউইয়র্ক টাইমস, সোমবার, জুলাই ৪, ১৯৭১
একটি বিদেশি সৈন্য বাহিনীর কতৃক আরাপ
সিডনি এইচ. শনবার্গ
ঢাকা – বহুবছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানে আছেন এমন একজন বিদেশি জিজ্ঞেস করলেন “বিশ্ববাসী কি এখনো বুঝতে পারছেনা যে তারা (পশ্চিম পাকিস্তানিরা) কসাই ছাড়া কিছু নয়? তারা বাঙালিদের হত্যা করেছে এবং করেই চলেছে শুধুমাত্র ভয় দেখিয়ে তাদের দাস বানিয়ে রাখার জন্য? সূর্য উদয় থেকে শুরু করে ক্লান্ত না হওয়া অব্দি তারা গুলি চালিয়েই যাচ্ছে, পুরো গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে”?
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের কতৃক বাঙালী স্বাধীনতা আন্দোলনকে বরবাদ করতে পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট রক্তগঙ্গার বিষয়ে যে বিদেশি বলছিলেন তিনি আদতে একজন শান্ত স্বভাবের মানুষ।
এই লোকটির মত বেশিরভাগ বিদেশি কূটনীতিক, ধর্মপ্রচারক ও ব্যবসায়ীরাও ঠিক একই কথা বলছে। তারা গত তিন মাসের চাপা রাগ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। এবং তারা এসব ব্যাপারে সেইসব বিদেশি সাংবাদিকদের জানাতে খুব আগ্রহী যারা ২৫শে মার্চের আগের রাত থেকে (অর্থাৎ যখন পাকবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে নিপীড়ন অভিযান চালায়) পাকিস্তানে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছিল এবং প্রথমবারের মত একাকি চারিদিক ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিল।
পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কাছে বিদেশি সংবাদমাধ্যম অপ্রতিরোধ্য ও প্রতিকূল হয়ে উঠছে, কিন্তু তারা বিশ্বের কাছে তাদের দাবি প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে যে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে আছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে।
ভারতের সাহায্য পেয়ে বোনিয়ারের কাছাকাছি কিছু অঞ্চলে মুক্তিফৌজ বা স্বাধীনতা বাহিনীরা বেশ সক্রিয় এবং ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে, এই অঞ্চলগুলো বাদে বাকি সব পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলে। তা সত্ত্বেও, পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছুই স্বাভাবিক। সহজ ও নিশ্চিতভাবেই এটি একটি বহিঃ সেনাবাহিনীর কতৃক সামরিক দখলদারিত্ব।
বাঙালি পুলিশদের বদলে ১০০০ মাইল দুরের (ভারতকে মাঝে রেখে) পশ্চিম পাকিস্তানের পুলিশদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানিরা সরকারি কর্মকর্তাদেরও বদলাতে চেয়েছিলো- এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাইপিস্ট পর্যন্ত।
নিহত ও গ্রামে পলাতক বাঙালিদের ঘর-বাড়ি এবং দোকানপাটগুলো পূর্বপাকিস্তানের মুসলিম অবাঙালিরা দখল করেছে, এরা পাকবাহিনীদের সহযোগীতা করছে। সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্য সংখ্যালঘু হিন্দুদের মন্দির, যেগুলো বিনাকারনে ধ্বংস করা হচ্ছে শুধু এটা বোঝানোর জন্য যে সেনাবাহিনীর নকশা অনুযায়ী যারা ‘বিশুদ্ধ ইসলামের’ অংশ নয় তারা প্রকৃত পাকিস্তানি নয় এবং তাদেরকে সহ্য করা হবেনা।
বাঙালি যুবকদের মধ্যে কিছুদিন আগেও যারা প্রকাশ্যে উল্লাস করে কুচকাওয়াজ করে পাকিস্তানিদের প্রতি প্রকাশ্য অবাধ্যতার স্লোগান দিত, এখন তারা ফিসফিস করে কথা বলছে, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে গনহত্যা, স্বজন হত্যা বা গ্রাম ধ্বংস করার কথা অস্ফুট স্বরে বলতেও ব্যর্থ হচ্ছে। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে অবস্থানরত সাংবাদিকদের ডাকবাক্সে প্রতিদিন বিস্তারিত বিবরণসহ বেনামী চিঠি আসছে।
ভয়ের বহিঃপ্রকাশ এখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে কিন্তু একটা নতুন উদ্দীপনাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরল এবং আবেগপ্রবন অনেক বাঙালিও এখন বুঝতে পারছে যে অন্য কোন দেশ তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না, যা করার নিজেদেরকেই করতে হবে এবং এর জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন।
তরুনদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা বের হয়ে পড়েছে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের জন্য, যা সীমান্ত এলাকা এবং অভয়াশ্রম থেকে শুধু ভারত সীমান্ত জুড়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। বাঙালি গেরিলা আক্রমন বাড়ছে। ঢাকায় প্রচুর ককটেল বিস্ফোরিত হচ্ছে এবং বেশকিছু সেনাবাহিনী সহচরদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। প্রতিরোধ এখনো সীমান্তবর্তী, বিক্ষিপ্ত এবং বিশৃঙ্খল, কিন্তু এটা বাড়ছে।
প্রতিটি আক্রমনের প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনীরা নিকটবর্তী বাঙালি নাগরিকদের উপর অত্যাচার করছে। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, নোয়াখালী জেলায় মুক্তিফৌজরা সেনাবাহিনী সৃষ্ট “শান্তি কমিটির” একজন সদস্য, তার স্ত্রী এবং সন্তানকে মেরে ফেলার পরপরই সেনাবাহিনীরা কয়েকশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করে এবং কুপিয়ে মেরে ফেলে।
একসময় একটা তত্ত্ব ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে ভোগদখলের খরচ পাকিস্তানকে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করবে কিন্তু এই তত্ত্ব খুব দ্রুতই বাতিল হয়ে গেল। নিপীড়নের তিরষ্কারে বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগীরা বাৎসরিক অনুদান বন্ধ করলেও, ইসলামাবাদ সরকার পূর্ব পাকিস্তানে তাদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ধারনা করা হয়েছিল, গত সোমবারে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষনে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে তার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বেসামরিক শাসনের পরিকল্পনা ব্যক্ত করবেন। দেখা গেলো সম্পুর্ন বিপরীত ঘোষনা দিলেন যাতে বলা হয় সামরিক একনায়কতন্ত্র অব্যাহত থাকবে; চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য একটি বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়।
রাষ্ট্রপতি, যিনি সেনাবাহিনী প্রধানও, তার বক্তৃতায় আল্লাহর রহমতে দেশকে বিভেদের কিনারা থেকে উদ্ধার করছে দাবি করে সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন যেটাকে পশ্চিমা কূটনীতিকরা একটি “বিপর্যয়” হিসাবে বর্ণনা করেন। পাশাপাশি তিনি ৬০ লক্ষ বাঙালির (যাদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু হিন্দু) প্রতি ‘গভীর সমবেদনা’ জ্ঞাপন করেন, যারা বিদ্রোহীদের মিথ্যা প্রচারনার কারনে ভারতে পলায়ন করেছে। “দ্রুত পুনর্বাসন” এর লক্ষ্যে তিনি তাদের নিজের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার ভাষণের আগেরদিন, এক পল্টন সেনা ঢাকা থেকে ৩০ মাইল দুরবর্তী কিছু হিন্দু প্রধান গ্রামে হামলা চালিয়ে পুরুষদের হত্যা করে, ঘরবাড়ি লুট করে এবং জ্বালিয়ে দেয়। একই ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রিপোর্ট আসে এই প্রদেশের (পুর্ব পাকিস্তান) অন্যান্য অংশ থেকেও। কেউ জানেনা ঠিক কতজন বাঙালিকে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে, কিন্তু বিদেশি কিছু নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে এর সংখ্যা এক লক্ষাধিক এবং সম্ভবত তার থেকেও বেশি।
পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি, জাতীয় কোষাগারকে শুধু অর্ধেক রপ্তানি মুল্য এবং বৈদেশিক মুদ্রাই প্রদান করেনি বরং পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পজাত পণ্যের জন্য বড় বাজার তৈরি করেছিল, এই ধ্বংসযজ্ঞে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জনগন যতই বিরূপ বা অপ্রতিরোধ্য হোক না কেনো, চরম অর্থনৈতিক মুল্য দিয়ে হলেও পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উপনিবেশ হিসাবে রাখতে সামরিক শাসকদের যথেষ্ট আগ্রহী মনে হচ্ছে, অন্ততপক্ষে বর্তমানের জন্য।
একজন পশ্চিমা বলেন, “এটা যেন ভূমিদাসদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক মধ্যযুগীয় সেনা। এরা যেকোন উপায়ে পূর্ব পাকিস্তান দখল নিতে এবং শোষণ করতে চায়। এমনকি, বাঙালিরা প্রতিরোধের ব্যাপারে গুরুত্ব দিলেও তাদেরকে ঘায়েল করতে ৫ থেকে ১০ বছর লেগে যাবে”।
—– সিডনি এইচ. শনবার্গ