একটি হালকা মেশিনগানের জন্য বত্রিশটি জীবনের পরিসমাপ্তি

৬৪| একটি হালকা মেশিনগানের জন্য বত্রিশটি জীবনের পরিসমাপ্তি (৪৬৩)

সুত্র – পূর্বদেশ, ৮ এপ্রিল ১৯৭২

একটি হালকা মেশিনগানের জন্য বত্রিশটি জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে

|| নজরুল ইসলাম চৌধুরী ||

একটি মাত্র এল, এম, জির জন্য গঙ্গাসাগর সেদিন রক্ত-সাগর হয়েছিল, বলছিলেন ডাঃ মোস্তাক চৌধুরী। গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ের বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনটি গণকবর খুঁড়ে ইয়াহিয়ার বর্বর কর্তৃক নিহত কিছু মানুষের লাশ উঠাবার সময়। ওদের না ছিল হৃদয় না ছিল কাণ্ডজ্ঞান। এ দু’টোর একটা থাকলেও এ মানুষগুলোকে মারতে পারত না। বস্তুত: একটি এল, এম, জির জন্যই বত্রিশ-জন লোক প্রাণ হারিয়েছিল ইয়াহিয়া- ভুট্টোর জল্লাদ বাহিনীর হাতে। সম্প্রতি আখাউড়া রেলওয়ে জংশনের অনধিক পাঁচ মাইল দক্ষিণে গঙ্গাসাগর রেলস্টেশনের পাশে তিনটি গণকবর খুঁড়ে ২৬টি লাশ উঠানো হয়।

ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, গত জুন মাসের মাঝামাঝি এক সময়ে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা রেকি করার উদ্দেশ্য নিয়ে গঙ্গাসাগর  এলাকায় আসেন এবং তানমান্দাইল নামক গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আত্মরক্ষার জন্য তাদের হাতে ছিল একটি মাত্র হালকা মেশিনগান। জানা যায় যে প্রাথমিক রেকির পর  মুক্তাঞ্চলে তাঁদের কেন্দ্রে চলে যাবার পরিবর্তে তাঁরা একটি মাত্র হালকা মেশিনগান নিয়ে শতাধিক পাঞ্জাবী সেনার ছাউনি সরাসরি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই অনুযায়ী রাতের অন্ধকারের সুযোগে তাঁরা ছাউনি এলাকার ভিতরে প্রবেশ করেন। ইত্যবসরে জনৈক স্থানীয় দালাল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্বন্ধে তার সামরিক প্রভুদের সংবাদ দেয়। খান সেনারা তৎক্ষণাৎ আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নেয়। এবং মুক্তিযোদ্ধা দু’জনকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। বেষ্টনীতে পড়ে অস্ত্র নিয়ে পালানো অসুবিধাজনক মনে করে তারা এল, এম, জি-টি গঙ্গাসাগরের জলে ফেলে খান পশুদের চোখে ধুলা দিয়ে বেষ্টনী ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু এলো এম জি টি কোথায় ফেলা হয়েছিল শত্রুরা সে স্থান চিনে রাখতে পেরেছিল। এদিকে সেই রাতেরই শেষের দিকে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা দুজন আবার পাঞ্জাবীদের ছাউনি এলাকায় প্রবেশ করেন এবং সন্তর্পণে তাঁদের এল এম জি-টি উঠিয়ে নিয়ে আসেন। পরদিন পাঞ্জাবী পশুরা পরিত্যক্ত অস্ত্র উঠানোর উদ্দেশ্যে পানিতে নেমে অবাক হল। সে সময় পূর্বোক্ত স্থানীয় দালালটি সংবাদ দিল যে মুক্তিযোদ্ধা দুজনই অস্ত্র উঠিয়ে নিয়ে পার্শ্ববর্তী তানমান্দাইল অথবা ডাঙ্গাইলে কারো ঘরে সেটা রেখে পালিয়ে গেছেন।

এলেমজি উদ্ধারের জন্য শুরু হল পাক জল্লাদদের তানমান্দাইল ও ডাঙ্গাইল গ্রাম-দ্বয় অপারেশন। পাক বর্বররা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা অস্ত্র কিছুরই সন্ধান পেল না বটে, কিন্তু তাদের অমানুষিকতা থেকে রক্ষা পেলনা এই দুই গ্রামের সরল নিরপরাধ মানুষ। শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবাই হল ইয়াহিয়ার জল্লাদদের উন্মত্তার শিকার। অকথ্য নির্যাতনের পর তারা উভয় গ্রামের প্রায় সব পুরুষ মানুষ ধরে নিয়ে আসে এবং মামুলি জিজ্ঞাসাবাদের পর বত্রিশ জনকে রেখে অন্যান্যদের ছেড়ে দেয়। পরে এই বত্রিশ  জনকে তারা হত্যা করে গঙ্গাসাগরের পশ্চিম পাড়ের তিনটি গণকবরে পুঁতে রাখে।

হত্যাকারী জল্লাদ বাহিনী ও তাদের পোষ্য দালালদের বিরুদ্ধে আনিত এক মামলার ব্যাপারে এই লাশগুলো উঠানো হয়। নিহতদের আত্মীয় স্বজনরা যে তেরটি মৃতদেহ সনাক্ত করতে পেরেছেন তারা হলেন:-

(১) আব্দুল গনি

(২) রিয়াজ উদ্দীন

(৩) সাধন মিয়া

(৪) মুসলিম মিয়া

(৫) কমল মিয়া

(৬) আবুল বাসার

(৭) আব্দুল খালেক

(৮) তারা মিয়া

(৯) আবুল ফয়েজ

(১০) আবুল হাসেম

(১১) ওমর আলী

(১২) সালু মিয়া এবং

(১৩) গোলাম কাদের।

Scroll to Top