৭৯। একাত্তরে রংপুরের আলমনগর (৪৯২-৪৯৪)
একাত্তরে রংপুরের আলমনগর
সুত্র -‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা।
“তিনটে গুলি, তিনটে শব্দ, তিনটে দাগ দাসু মিঞার। একটি চোখে, একটি মুখে,একটি বুকে। বাসু মিঞার আর এক নাম মোহম্মদ ইসমাইল মিঞা। তিনি রংপুর শহরের আলমনগর নিবাসী একজন জনগনমান্য দেশবরেণ্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। তার অপরাধ তিনি ধনী এবং আওয়ামীলীগার।
তাকে যেদিন মারা হয় আমি সেদিন রংপুরে,একাত্তরের এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে সপরিবারে নিজস্ব মোটরে করে শহর থেকে পালালেন দূর মফস্বল পদ্মগঞ্জে। বাসু মিঞা পালানোর কয়েকদিন আগেই তার বাড়ির পাশের পাড়ার (মোড়ল) আজিজ মিঞা আর ঘরে আসেননি। আমি তখন স্বয়ং প্লাটফরমে দাঁড়ানো। বাসু মিঞা পালালেন জানাজানি হয়ে গেল অবাঙ্গালিদের মধ্যে। শুরু হলো তার তল্লাশি, এদিকে শহরে ধরাপাকড় করে পথে ঘাটে সমানে গুলি করে মারছে খান সেনারা বুনো শুয়োরের মত। একদিন শহরের গণ্যমান্য সর্বপরিচিত এগারজন বাঙ্গালীকে হাত পা বেঁধে মাহিগঞ্জ শ্মশানে রাত বারটায় গুলি করে মারে।
তার মধ্যে একজন ভদ্রলোক ডাঃ মন্টু। তিনি প্রথম গুলির আওয়াজের মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে পরে যান ঘাতকের অগোচরে, এগারজন এর উপরে প্রায় ৩০/৪০ টি বুলেট চালিয়ে চলে যায়। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা ডাঃ মন্টু মরেনি। শেষ রাতের দিকে তিনি আহত অবস্থায় জ্ঞান ফিরে পেয়ে শ্মশান ও বাঁধন মুক্ত হয়ে ভারতের কোনো এক হাসপাতালে যেয়ে ভর্তি হন। মৃত দশজনের মধ্যে জরজেট মিঞার জন্য আজও রংপুরের লোক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
এদিকে বাসু মিঞার তল্লাশি চলছে, “বাসু মিঞা গাদ্দার হ্যায়,ও জয় বাংলাকা আদমি”। অবাঙালি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে ও শুনেছি। বাসু মিঞার জনৈক দালাল বন্ধু খোঁজ পেয়ে বাসু মিঞার কাছে যেয়ে টাকা খাওয়া শুরু করলো। এবং তাকে শহরের বাড়িতে ফিরে আসতে অনুরোধ জানালেন, সে দালাল বন্ধুটি অভয় দিলে মেজর, কর্ণেল সবই তার বন্ধু লোক। তাদের সঙ্গেই তিনি উঠাবসা করেন। অতএব তার কোন ভয় নেই, চিন্তা নেই, আশঙ্কা নেই। তাকে তো মারবেই না বরঞ্চ মেজর , কর্ণেল তাকে তাদের নিজের গাড়িতে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন,সে দালালের এখন যথেষ্ট আধিপত্য রংপুর শহরে, (দালালটি সম্ভবত খৃস্টান ধর্মীয় বাঙ্গালি) বন্ধুর আধিপত্য দেখে বিশ্বাস করে দীর্ঘ দেড় মাস পরে ফিরে এলেন শহরে নিজগৃহে, দালাল বন্ধুটি মিথ্যা বলেন নি, সত্যিই মেজর, কর্ণেল, নায়েক সবাই দলে দলে যাতায়াত শুরু করেন বাসু মিঞার বাড়িতে, বাসু মিঞাকে তারা দোস্ত বানল,বাসু মিঞার মাকে মা স্ত্রীকে ভাবী এবং অন্যান্যদের বেটা,মেয়ে,দোস্ত, চাচা, বন্ধু ইত্যাদি পাতিয়ে নিলো খান সেনারা। বাসু মিঞা ওদের বন্ধুত্ব পেয়ে নিশ্চিত হলেন মৃত্যুর হাত থেকে, এদিকে রোজ বাসু মিঞাকে সকাল, বিকাল ক্যান্টনমেন্টে গাড়ি করে নিয়ে যায়,আবার রেখে যায়, যখন বাড়িতে থাকে তখন অগোচরে দু’টি মিলিটারি যে তাঁকে চোখে চোখে রাখতো, তা আমি নিজে চোখে দেখছি। ক্যান্টনমেন্টে রোজ বাসু মিঞাকে নিয়ে নাচ, গান, বাজনা আর পানীয় চলতো। এতে প্রায় দৈনিক ১/২ হাজার টাকা খরচ হতো। এর সবই বাসু মিঞাকে বহন করতে হত। তাছাড়া যখন বাড়িতে আসে তখন তো গোশত, পোলাও, চা,মিষ্টি, কফি, কলা রয়েছেই। শুধু বন্ধুত্বের জন্যই এসব করেননি, প্রাণের ভয়েও করেছেন। কেননা বাঙ্গালি যাদের কাছে গাদ্দার, শত্রু বাসু মিঞা তখন বাঙ্গালি হয়ে তাদেরই অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাই এমন খাতির করার চেয়ে না করাটাই অস্বাভাবিক।
এরই মধ্যে একদিন আমি নিজেও ধরা পড়ে গেলাম খান সেনাদের হাতে। রাত তখন নয়টা,আমার অপরাধ যুবক বাঙ্গালি এবং মুক্তিফৌজ সন্দেহে,আমাকে নিয়ে গেল। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে অনেক এলোমেলো ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিবকে গালি দিয়ে পাকিস্তানের সুনাম কীর্তন গেয়ে ছাড়া পেলাম ঠিকই কিন্তু আমার শরীর থেকে রক্ত বের করে নিল যথেস্ট পরিমানে। এছাড়াও রংপুর মডার্ন হলের পিছনে যে বীভৎস দৃশ্য দেখেছি তা বলতেও শিহরন জাগে। বেশ বড় একটা আগাছার বন তারই মধ্যে লেপ,বালিশ, কাঁথা, তোষক পাটে পাটে সাজানো, এগুলো ধর্ষণ বা নারী সঙ্গমের শয্যা। পাশেই বেশ বড় একটা অত্যধিক ধর্ষনের গর্ত পড়ে। যেসব মেয়েরা, মা বোনেরা সঙ্গমে অপারগ হয়ে পড়তো, অক্ষমতা প্রকাশ করতো, তাদেরকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে এই গর্তের মধ্যে ফেলা হত। এদেরকে কুকুরে খেত,পোকামাকড়ে খেত। দেশী ও বিদেশী সাংবাদিকগন মেপেজুকে হিসেব বলেছিলেন এই গর্তে প্রায় চার,পাঁচশো মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। উক্ত গর্তের মধ্যে তাদের এলোমেলো চুল,লম্বা বাণী গাঁথা চুল, ছায়া, শাড়ি, সেলোয়ার কামিজ, মাথা, খুলি, আধাপচা গোস্তসহ পোকা ঘিন ঘিন করা মাথা, এসব নিজে দেখেছি নেড়েচেড়ে দেখেছি। মডার্ন হল ছিল উচ্চপদস্থ খানদের ক্যাম্প।
শুনেছি সেখানে নাকি কয়েক ঝুড়ি শুধু ভাঙ্গা কাঁচের চুড়ি পাওয়া গেছে।তবে নিজে দেখেছি মডার্ন হলের দেওয়াল ঘেঁষা ইন্দারার পাশে যে কুল গাছটি আজও হত্যার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে , আছে তার ডালে লটকানো ফাঁসির দড়ি, আশেপাশে ছেঁড়া রক্তমাখা কিছু কিছু ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার, শাড়ির পাড় এবং টুকরো টুকরো ব্যান্ডেজ আকারের অনেক সাদা কাপড়, কুল গাছটি যদি আজ কথা বলতে পারতো তবে নিশ্চয় জানা যেত কতটা অসহায় নারী কে ধর্ষন শেষে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তার ডালে।
সেদিন একাত্তরের তিরিশে মে-র দিনগত একত্রিশে মের রাত। রংপুর ক্যান্টনমেন্টে নাচ গানের বড় আয়োজন। খানসেনারা এসে রোজকার মত গাড়ি করে নিয়ে গেল বাসু মিঞা কে। সঙ্গে গেল তার শালা হাবিবুর রহমান, ওরফে চাঁদু। এই চাঁদুকে মিলিটারিরা দোস্ত বলে ডাকতো, এসেই হাত মেলাতো, কেলি করতো, কিন্তু সেদিন রোজকার মত ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতে না দেখে স্ত্রী, কন্যা, মা, ভাইবোন সবাই চিন্তা আর শঙ্কার মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। রাত তখন ঠিক সাড়ে এগারোটা। সারা রংপুর শহরে সান্ধ্য আইন থমথম করছে। ঠিক এই সময় সম্ভবতঃ ষড়যন্ত্রমাফিক দুখানা জীপগাড়ি ভর্তি পাকসেনা এসে ঘিরে ফেলল বাসু মিঞার বাড়ি। ব্যাপারটা সম্যক অনুভব করে বাসু মিঞার কনিষ্ঠ ভগ্নিপতি মিঃ নুরুল ইসলাম আকন্দ যুবতী বাসু কন্যা, জোৎস্না এবং অন্যান্য যুবতী বৌদের পাশের বাড়িতে সরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীর টপকিয়ে আর গেট ভেঙ্গে ছয়, সাত জন সৈন্য ঢুকে পড়লো। ঢুকেই পেল বাসু মিঞার ছোট ভাই গেদু আর ভাগ্নে জুল্লুকে। বেঁধে ফেলল ওদের হাত আর চোখ। মুখে শালা, বাহেনচোত, খিঞ্জিরাকা বাচ্চা তুম জয় বাংলাকা আদমি হ্যায়, বাতাও বাসু মিঞা কিধার হ্যায়। ধড়াম করে মারল রাইফেলের বাট দিয়ে গেদুর ঘাড়ে। গেদু চোখ বাঁধা অবস্থায় মা বলে ডেকে উল্টে পড়ে গেল। ঠিক এমন সময় আর একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়ির গেটে। বাসু মিঞা আর চাঁদুকে নামিয়ে দিয়েই মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটি হুঙ্কার দিয়ে বেরিয়ে গেল। রোজ তারা বাড়ির মধ্যে যেয়ে চা পানি পানের পর যেতো কিন্তু আজ গেল না। এটা যে এভাবেই ধরি মাছ না ছুঁই পানি ষড়যন্ত্র এর মধ্যে দিয়ে কাজ হাসিল করা হচ্ছে, তা নিশ্চয় দূর্বোধ্য নয়। বাড়ির মধ্যে চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে চাঁদু ছুটে এসে প্রবেশ করে অন্দরে। ঢুকে দেখে রোজ যারা এসে গোশত পোলাও কলা খেয়ে যেত সেইসব দোস্ত বন্ধুদেরই দল।
গেদুকে, জুল্লুকে তখনও খেয়াল করে নি।তাদের সঙ্গে করমর্দনের উদ্দেশ্য হাত বাড়াতেই দোস্তজি খপ করে হাত ধরে বলে বাহেনচোত শালা, তারপর হাত বেঁধে ফেলে। ততক্ষণে বাসু মিঞাও ঢুকে পড়েছেন এসব অবাঞ্চিত ব্যাপার দেখে সাধারণ জ্ঞান লোপ পেয়ে যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। বাসু মিঞা ধরা পড়লেন। হাত বাঁধলো, চোখ বাঁধলো নিয়ে গেল ছয় সাত মাইল দূরে দমদমা নদীর ধারে। এখানে পা রাখার জায়গা নেই। আধ হাত মাটির নীচে নীচে সোনার বাংলার মানুষ বাস করছে। নদীর পটভূমি ছোট্ট একটি কুলগাছ। সেখানে তাদের বাঁধলো এবং ওদের দিয়ে ওদের কবর খুঁড়ালো। চাঁদু, জুল্লু, আর গেদুকে সে কুল গাছের সাথে বেঁধে রেখে, কয়েকজন সেনা বাসু মিঞাকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো, উদ্দেশ্য মোটা মালপানি কিছু নিবে, নিল সামান্য কিছু মাত্র ১৯০০.০০ টাকাই ঘরে ছিল। উদ্দেশ্য সিদ্ধি হলো। আবার হাত বাঁধলো, চোখ বাঁধতে যাবে, বাসু মিঞা কাকুতি জানালেন, এক মিনিট আমাকে সময় দিন,কথাটা রাখলো পাষণ্ডরা। মা জহুরা তখন মিলিটারির পায়ের তলায় কেঁদে কেঁদে কাকুতি মিনতি করে ছেলের প্রাণভিক্ষা চেয়ে লুটোপুটি খাচ্ছেন। মাকে বললেন, মা লিটনকে ( ছোট ছেলে) একবার নিয়ে এসো। মা কাঁদতে কাঁদতে লিটনকে নিয়ে এলেন। কিন্তু হাত তো বাঁধা। মাকে বললেন, আমার বুকের সঙ্গে একটু ঠেকাও। মা লিটনকে তার বুকের সাথে চেপে ধরলেন। চোখের সমস্ত পানি যেন শেষবারের মত বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এল বাসু মিঞার। চোখ বেঁধে ফেলল পাষণ্ডরা। শেষ বার মাকে ডেকে বললেন, মা এই শেষ দেখা, দমদমার গর্তের কাছে ওদের বেঁধে রেখেছে, আমার গর্তও হয়ে গেছে। তোমরা সবাই মিলেমিশে থেকো। আমার মৃতদেহকে নিয়ে এসে ভালোকরে দাফন করো। কিন্তু তা আর হয়নি। পাষণ্ডরা তার মৃতদেহ আনতে দেয়নি। দমদমার ছোট কুল গাছটির তলায় যেখানে রংপুর সরকারি কারমাইকেল কলেজের তরুণ দম্পতিকে এক সঙ্গে একই গর্তে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছে, ঠিক তারই পাশে আজ তিনটে গুলি, তিনটে শব্দ, তিনটে দাগ চিহ্নিত বাসু মিঞার দেহকে মাটিচাপা দিয়ে গেল এরা কিন্তু চাঁদু, জুল্লু, গেদুর লাশ কোথায় এই প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি।“
-আজাদ এম,কবির