দলিল | শিরোনাম | সূত্র | তারিখ | পৃষ্ঠা |
৭৪ | ওরা ডাক্তার মেরেছে | ‘বাংলাদেশের গণহত্যা’ বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা | ১৯৭২ | ৪৭৯-৪৮১ |
ওরা ডাক্তার মেরেছে
“’শুধু শ্লোগান আর মিছিলের সংগ্রাম নয়। যত সত্বর পারো ইমার্জেন্সি মেডিকেল ফার্স্ট এইড স্কোয়াড তৈরী কর্। ব্যপক রক্তক্ষরণের জন্য প্রস্তুত থাক”- ১৯৭১ সালের ২১ শে মার্চ যখন বাংলাদেশের পথে – প্রান্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন সিলেট চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলেছিলেন মানবতার সেবায় আত্মোতস্বর্গকৃত নির্ভীক মহৎপ্রাণ সিলেট চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের প্রধান শল্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: শামসুদ্দিন আহমদ।
বাংলাদেশে গণহত্যার বর্বরোচিত ও নৃশংসতম উদাহরণ বিশ্বে তুলনাহীন. কয়েক মিনিটের ঘটনা কিন্তু কত ব্যাপ্ত , কত বিস্তৃত , কত মর্মান্তিক , কত দুর্ঘটনা , কত মর্মস্পর্শী দৃশ্য , কত পৈশাচিকতা ছিল এ হত্যাকান্ডে। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্বে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে , বাংলাদেশের গণহত্যার কাছে সব ম্লান হয়ে গেছে। এত বড় হত্যাকাণ্ড কোন ভাষায় লিখব , কেমন করে লিখব , কি লিখব , কে লিখতে পারবে? বাংলাদেশের এক কোটি পরিবারের কথা লিপিবদ্ধ করতে হলে এক কোটি ইতিহাস লিখতে হবে। তা না হলে এ নৃশংসতার বহু অধ্যায় বাদ পড়ে যাবে। কিন্তু তা কি সম্ভব? না সম্ভব নয়। সুতরাং এ ইতিহাস অলিখিত থাকবে। এ ইতিহাস লেখা যায় না। এ ইতিহাস লেখা যাবে না। এখানে ঐতিহাসিক ব্যর্থ , এখানে ইতিহাস ব্যর্থ . এ ব্যর্থ ইতিহাসে শহীদ ডা: শামসুদ্দিন আহমদ কে প্রকাশ করাও এক ব্যর্থ প্রয়াস।
কেন তাকে হত্যা করা হল? কেমন করে তাকে হত্যা করা হল? সৌম্য দর্শন দেবতুল্য লোকটিকে পাক বর্বর পশুরা কি করে গুলী করলো? এতো মানুষকে হত্যা করা নয় , মানবতাকে হত্যা করা হয়েছে। মার্চের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হতেই অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদ নতুন এক কার্যক্রম এর অবতারণা করলেন। অসহযোগ এর ফলে অন্যান্য দের কাজ কমে গেলেও তাঁর নতুন আরো কাজ বেড়ে গেল। সামনে কি ঘটতে যাচ্ছে তা তিনি যেন চোখের সামনে স্পস্ট দেখতে পেলেন। ছাত্র ছাত্রী সেবক সেবিকাদের ডেকে ফার্স্ট এইড স্কোয়াড গঠনে প্রবৃত্ত হলেন। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে অনেকগুলো প্যাকেট তৈরী করে বিভিন্ন স্থানে মওজুত করে রাখলেন। তিনি যেন দেখতে পারছিলেন ঐ যে কয়েক গজ দূরে হানাদার বাহিনী তেড়ে আসছে , এতেই আঘাত করবে , এক্ষুনি ফার্স্ট এইডের প্রয়োজন হবে। হ্যাঁ, সত্যি সত্যি নরপশুরা এসে বর্বরোচিত আক্রমণ করেছে , অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে , অগনিত লোককে আহত করেছে আর শল্যবিদ শামসুদ্দিন আহমেদ তড়িৎ গতিতে চিকিৎসা শুরু করেছেন। কিন্তু মানুষ শামসুদ্দিন কে যখন হিংস্র দস্যুরা গুলি করেছে , গুলি করে ধরাশায়ী করেছে , হত্যা করেছে তখন তাকে কেউ ফার্স্ট এইড দিতে আসেনি। কারণ তিনিই ছিলেন শেষ মানুষ , তিনিই ছিলেন শেষ সেবক, তিনিই ছিলেন সে ইতিহাসের শেষ নায়ক।
১ লা এপ্রিল , ১৯৭১ সাল। সূর্য সারা প্রকৃতিতে ছেয়ে রেখেছে। রক্তিম রশ্মী বিচ্ছুরিত হচ্ছে চারিদিকে. সিলেট শহর আবার শত্রু কবলিত। ২৫ শে মার্চের কাল রাতের পর হতেই স্বতস্ফুর্তভাবে বেংগল রেজিমেন্ট , তখনকার ই , পি, আর , আনসার , মোজাহিদ্, ইউওটিসি , ক্যাডেট , জেসিসি , ক্যাডেট, পুলিশ , ছাত্র ও যুবকরা সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনী গঠন করে শত্রুদের উপর মারাত্মক আঘাত হানে। কয়েকদিনের মধ্যেই সিলেট জেলার তিনশত মাইল সীমান্ত এলাকা থেকে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা অথবা বিতাড়িত করে মার্চের মধ্যেই সমস্ত হবিগঞ্জ মহকুমা , মৌলভীবাজার মহকুমা ও সুনামগঞ্জ মহকুমা মুক্তিবাহিনীর পূর্ন কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে।
৩রা এপ্রিল মুক্তিপাগল বাঙ্গালী বীরেরা সিলেট শহর দখল করে নেয়। হানাদার বাহিনী শালুটিকর বিমানবন্দর ও সংলগ্ন জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারপরই শুরু হয় বৃস্টির মত পাক বাহিনীর বিমান হানা। সারা শহরে ঝাকে ঝাকে গুলির ঝড়। শত শত আদম সন্তান রক্তাক্ত আহত হয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ হয়। মানব সেবার প্রতীক প্রখ্যাত শল্যবিদ অধ্যাপক শামসুদ্দিন শানিত ছুরি হাতে ঘড়ির কাটার সাথে তাল মিলিয়ে কাজে রত রয়েছেন। হাসপাতালে আলো নেই , পানি নেই , পথ্য নেই। তাতে কি , শামসুদ্দিন সাহেব আছেন। এক হাতে অস্ত্র চালনা, অন্য হাতে অন্যান্য সব কাজ।
**৮ই মার্চ থেকে আবার শুরু হল তুমুল যুদ্ধ।…
-(এখানে দলিলে একটা ভুল আছে। এটা ৮ই এপ্রিল হবে)
…পাক দস্যুরা স্থল ও বিমানবাহিনি নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মুক্তি বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল। সমস্ত শহর তখন জনশূন্য . প্রানপণ বাঁচার আদিম উগ্রতায় শহরবাসী চলছে গ্রামের আশ্রয়ে – দুর্গত শহরের সাক্ষী ডাঃ শামসুদ্দিন আর তার রোগী। ছাত্রদের প্রতি ডাঃ শামসুদ্দিন – ” আমরা প্রবীন। আহত বাঙ্গালীদের সেবায় আমাদের থাকতে দাও। তোমরা নবীন যুবক , নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ কর্। এখানে থেকে বর্বর পশুদের শিকার হয়ে কোন লাভ নেই”
ডাক্তারদের প্রতি – ” কোথায় যাবেন আপনারা? আমরা ডাক্তার্। রোগী ফেলে আহত মানুষ ফেলে আমরা তো কোথাও যেতে পারি না। ”
সেই রক্তস্নাত ৯ই এপ্রিল। ইতিহাস থমকে গেছে। আন্তর্জাতিক রীতি নীতি ভংগ করে জেনেভা কনভেনশন এর নিয়ম অমান্য করে মারণাস্ত্র সহ কতকগুলো পাক নরঘাতক সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘেরাও করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করল। শল্য প্রকোষ্ঠ. বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন গৌরবর্ণ সুদর্শন অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদ অবিশ্রান্ত কর্মরত। ঝড়ের বেগে প্রকোষ্ঠে ঢুকে সংগীন উচিয়ে ক ‘টি পশু সেনা ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদ কে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। হাসপাতালের পূর্ব -দক্ষিন কোনে অশ্রুসিক্ত সবুজ ঘাসের শীষে দাঁড় করালো তাকে। তারপর্। না , আমি সম্বিত হারিয়ে ফেলছি। কি লিখবো , কেমন করে লিখবো। লিখে কি হবে?লাভ কি? পৃথিবীর মানুষ কি বিশ্বাস করবে আমাকে? অবিশ্বাস্য ঘটনা কি বিশ্বাস করা যায়। না , অন্যের বিশ্বাস অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে আমি লিখবো নাকি? আমি আমাকে তো অবিশ্বাস করতে পারি না। ভগবান যীশুও ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। হ্যা , হাসপাতালের চিরাচরিত মানবিক পবিত্রতা কে বিদীর্ণ করে গুলী করা হল। গুলি করা হল ঋষি শামসুদ্দিন কে , মানুষ শামসুদ্দিন আহমদ কে।
উনসত্ত্বরের গণআন্দোলনে ডাঃ শামসুদ্দিন বলেছিলেন – “হে সভ্য জগত, গনআন্দোলনকে দমন করতে গুলি করো না। তার বদলে ব্যবহার কর রাবার বল বা বেগে চালিত পানি। ” এক – দুই করে তিনটি গুলী করা হল তাঁকে। মৃত্যুহীন প্রাণ ক্ষনিকের ভিতর শেষ হয়ে গেল। প্রানপ্রিয় দরদী শিক্ষককে অনুসরণ করল তরুণ অস্ত্র প্রচারক ডাঃ শ্যামল কান্তি লালা , সহকারী সেবক মাহমাদুর রহমান , এম্ব্যুল্যান্স চালক কোরবান উল্লাহ। ক্লান্ত হল নরপশুদের সামরিক ক্ষুধা।
ডাঃ শামসুদ্দিন ছিলেন মানব সেবার ইতিহাসে এক বিরল আদর্শ। কি সম্মোহনী শক্তি তার ছিল জানি না। ছাত্রবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নম্রভাষী। তাঁর কাজই কথা বলত। বিভাগ – পূর্ব ভারতে তিনি ছিলেন আসাম মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি। কলিকাতা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেনীর ছাত্র নেতাদের অন্যতম ।
সেবাই ছিল অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদের প্রধান ও প্রথম ধর্ম। তাই সেবা করতেই তিনি জীবন বিলিয়ে দিলেন। আজীবন সেবাধর্মী ডা শামসুদ্দিন ছিলেন গঠনমূলক কাজে পারদর্শী ও অভিজ্ঞ। তরুণ ডাক্তার হিসেবেই তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক . অফুরন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন ডাঃ শামসুদ্দিন মেডিকেল সার্ভিস এসোসিয়েশন এর মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠান কে শক্তিশালী করে তোলেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও সংগঠক। তিনি বহু জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তান এম্ব্যুলেন্স কোর্।
১৯৬৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ সমিতি। “অন্ধজনে দেহ আলো” এ মূল মন্ত্র নিয়ে এ সমিতির উদ্যোগে সিলেট , মৌলভীবাজার , শ্রীমঙ্গল , হবিগঞ্জ , কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে এ পর্যন্ত ১৪টি চিকিৎসা শিবিরের মাধ্যমে কয়েক হাজার রোগীকে দৃস্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। দক্ষিন – পূর্ব এশিয়াব্যাপী এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম বিস্তৃত .
ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদের আর একটি কীর্তি হল সিলেট যক্ষা নিবারনী সমিতি। এর মাধ্যমে বহু দূরারোগ্য যক্ষা রোগীকে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। তিনি আরো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ নিরোধ কেন্দ্র। বহু লোকও এর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে।”