বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ১৩৩ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ১৫ নং দলিল থেকে বলছি…
কণিকা বিশ্বাস
২৫ শে মার্চ আমি গোপালগঞ্জ মহকুমার কাশীয়ানী থানার ওড়াকান্দি গ্রামে ছিলাম এবং সেখান থেকেই পাক বর্বরদের অমানুষিক নির্যাতনের সংবাদ জানতে পারি। জুলাই মাসের শেষ ভাগে ভারত আগমনের পূর্ব পর্যন্ত গোপালগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করি এবং আওয়ামী লীগ কর্মী ও যুবকদের সংগঠনের চেষ্টা করি। মে মাসের মধ্যে আমরা বেশ শক্তিশালী হই এবং ৫ই মে গোপালগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আমরা গোপালগঞ্জ থানা আক্রমণ করি। গোপালগঞ্জ থানা ইনচার্জ নিহত হয় এবং থানা থেকে ৮২ টি রাইফেলসহ বহু গোলাবারুদ উদ্ধার করি। প্রথমদিকে গেরিলা যুদ্ধে আমরা সুবিধা করতে সক্ষম হলেও মে-র মাঝামাঝি প্রায় হাজারখানেক পাকসেনা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমাদের এলাকায় প্রবেশ করলে আমাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। ১৬ ই মে রবিবার পাক সৈন্যরা গোপালগঞ্জ থানার সাতপাড়া গ্রামে একাধারে পাঁচ ঘন্টা গুলি চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। এখানে ১০৩ জন নিরীহ গ্রামবাসী পাকসেনা কর্তৃক নিহত হয়। ঠাকুরবাড়ীতে গর্তে একই পরিবারের ৮ জনকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে।
১৮ ই মে মকসুদপুর থানার ভেন্নাবাড়ী পাকসেনা কর্তৃক আক্রান্ত হয়। সমগ্র গ্রামে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। ছাত্রলীগ কর্মী অমলকে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে হত্যা করা হয়। ভেন্নাবাড়ী ও রথবাড়ী এই দুই গ্রামের মধ্যের বিলই ছিল হত্যাকান্ডের কেন্দ্র। এখানে প্রায় ১৩২ জনকে পাক বর্বররা হত্যা করে। এছাড়া কদমবাড়ী, আনন্দপুর, বেদভিটা, মাদুকান্দি, আড়ুয়াকান্দি, তৈলীভিটা,বৌলতলী, রঘুনাথপুর, গোলাবাড়িয়া এলাকায় পাক সেনারা গণহত্যা চালায়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে কেবল সাতপাড়া গ্রামে ১০৩ জন, ভেন্নাবাড়ী গ্রামে ১৩২ জন লোককে হত্যা করা হয়। তাছাড়া কদমবাড়ীতে ৮ জন, আনন্দপুরে ৫ জন, বেদভিটায় ১২ জন, মাদুকান্দিতে ৪৫ জন, আড়ুয়াকান্দিতে ২ জন, তেলীভিটায় ৭ জন, বৌলতলীতে ১০ জন, রঘুনাথপুর ১৪৪ জন এবং গোলাবাড়িতে ১৫০ জনকে পাকসেনারা হত্যা করে। এদের অধিকাংশকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাচ্চাদের তারা আছাড় মেরে বা বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে।
দিন দিন আমাদের বাহিনীর অবস্থার অবনতি ঘটাতে থাকলে আমরা বেশ কয়েকজন উন্নত অস্ত্র এবং ভারতের সাহায্যের আশায় জুলাই মাসের ২য় সপ্তাহে ভারতাভিমুখে যাত্রা শুরু করি। সাতদিন পথ চলার পর অষ্টম দিন ভারতে পৌঁছি। ভারতের বালেশ্বপুর, ব্যারাকপুর পলতাতে অবস্থান করি। কয়েকদিন পর মুজিবনগরে যাই এবং মুজিবনগরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এরপর ঠাকুর নগর সলট লেক,হাসপুর, গয়া, হেলেঞ্চা, খড়েরমাঠ প্রভৃতি স্থানের শরণার্থী শিবিরে সেবাকার্যে আত্ননিয়োগ করি। ৭২-এর মার্চের দিকে আমি দেশে ফিরে আসি।
-শ্রীমতি কণিকা বিশ্বাস
জাতীয় সংসদ সদস্য
(ফরিদপুর, সংরক্ষিত আসন)
৬ জুন, ১৯৭৩