কামালপুরের অবরোধঃ
১৩ নভেম্বর ২৩ তারিখ দিবাগত রাতে কামালপুরে অবরোধ করা হয় এবং পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুরকে তাদের মূল বাহিনী থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং রসদ বন্ধ করে দেয়া হয়। এই অবস্থায় ১১ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ৪ঠা ডিসেম্বর বিকাল ৩ টার সময় কামালপুর মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।নিয়মিত বাহিনীর ২২০ লোক এবং বিপুল অস্ত্র শস্ত্রসহ পাকসেনারা বন্দী হয়।এই অবরোধ চলাকালে তারা ১১ দিনের মধ্যে ৭ দিন বাইরে আসার চেষ্টা করলে বিপুল বাধার সম্মুখীন হয়ে অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।তিনদিন কামালপুর থেকে মুক্তিবাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে পাকবাহিনী বের হয়ে যাবার চেষ্টা করলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ৪ঠা ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কামালপুরের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের মেঘালয় সীমান্তের সব এলাকাতে মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং দ্রুত পশ্চাদপসারণ করে জামালপুর,ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় মুক্তিবাহিনীর অভিযোগ করার জন্য সমবেত হয়।
১১নং সেক্টরের যুদ্ধের পরিকল্পনাঃ নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখ ভারতীয় ৯৫ তম মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, ভারতীয় এবজা সেক্টরের ব্রিগেডিয়ার সাম সিং এবং ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কম্যুনিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল ভগৎ সিং এবং ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসাবে আমার সমন্বয়ে জামালপুর,ময়মনসিংহ নেত্রকোনা প্রভৃতির সম্ভাব্য হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লার নেতৃত্বে রংপুর জেলার গাইবান্ধা দখল করার পরিকল্পনা করা হয়। সাবসেক্টর মহেন্দ্রগঞ্জ এবং পুরাখাশিয়ায় ভারতীয় মাউন্টেন ব্রিগেডের সহায়তায় জামালপুর দখল করার পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেওয়ানগঞ্জ থানার হাতিবান্ধায় নিয়োজিত প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ শামসুল আলমের নেতৃত্বে দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুর হয়ে জামালপুরের পশ্চিমে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ থেকে জামালপুর জগন্নাথগঞ্জ রেল ট্র্যকে পর্যন্ত অবরোধ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। পুরাখাশিয়া সাবসেক্টরের প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে ভায়াডাঙ্গা,নালিতাবাড়ি, নখলা, নুরুন্দা হয়ে জামালপুরের দক্ষিণে জামালপুর – জগন্নাথগঞ্জ রেলসড়ক থেকে জামালপুর টাঙ্গাইল সড়ক পর্যন্ত অবরোধ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মহেন্দ্রগঞ্জ সাবসেক্টরের অন্য হাজারের একটি দলকে লেঃ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ভারতীয় ৯৫ তম ব্রিগেডের অগ্রভাগে কামালপুর,বক্সিগঞ্জ ও ঝগড়ারচর হয়ে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের উত্তর থেকে জামালপুর শহর অবরোধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমার নেতৃত্বে সেক্টরের মূল বাহিনীকে কামালপুর,বক্সিগঞ্জ, শ্রীবর্দি, শেরপুর প্রভৃতি এলাকার শত্রু অবরোধ প্রতিহত করে নান্দিনা হয়ে জামালপুরের পূর্ব দিকে অবরোধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।এখানে উল্লেখযোগ্য যে জামালপুর থেকে ১২ মাইল পূর্বে লাহিড়ীকান্ধা এবং কানিল নামক স্থানে ঢাকা,ময়মনসিংহ থেকে রেলপথে এবং সড়কপথে শত্রু রিইনফোর্সমেন্ট প্রতিহত করার জন্য সার্জেন্ট ভূইয়ার নেতৃত্বে রেল ও সড়ক পথে জামালপুরের সাথে ঢাকা ও ময়মনসিংহের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা পাঠান হয়। এবং বাকী ১৫০০ মুক্তিযোদ্ধা জামালপুরের দক্ষিণ- পুর্বে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ থেকে টাঙ্গাইল সড়ক পর্যন্ত আমার নেতৃত্বে জামালপুর অবরোধ করেন।
জামালপুরের অবরোধ সমাপ্ত হয় ৬ই ডিসেম্বর। ৬ই ডিসেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেন্ট বহুবার মুক্তিবাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে পালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। ১১ই ডিসেম্বর সকাল ৮ টার সময় পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
এই যুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১০ ই ডিসেম্বর বিকাল ৪ টার সময় পাকিস্তানী বাহিনীর ৩১ তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ককে আত্মসমর্পণ করার আহবান জানিয়ে একটি পত্র মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সীকে দিয়ে একটি সাদা পতাকা হাত নিয়ে পাকিস্তানীদের সদর দপ্তরে পাঠান হয়। উত্তর পাকিস্তানী অধিনায়ক ৭.৬২ চাইনিজ সাবমেশিনগানের একটি বুলেট একটি কাগজ মুড়ে পাঠিয়ে দেয়। তার অর্থ এই যে যুদ্ধই চূড়ান্ত ফয়সালা করবে। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে জামালপুর শহরে প্রবেশ করে এবং অন্যদিকে ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর বোমাবর্ষণ করে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান বাহিনী বীর বিক্রমে ১০ ই এবং ১১ই ডিসেম্বর সারা রাত ব্যাপী যুদ্ধ চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১১ই ডিসেম্বর সকাল ৫টায় মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।জামালপুর যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর ২১২ জন মৃত্যুবরণ করে,প্রায় ২০০ জন আহত হয় এবং ৫২২ জন আত্মসমর্পণ করে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের পরিমান এত ছিল যে,বাইরের কোন সাহায্য ব্যতিরেকেই জামালপুর সীমান্ত এলাকাতে তারা আরও তিন মাস যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতো।
অন্যদিকে ডালু সাব-সেক্টরেও প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ আবু তাহেরের নেতৃত্বে ডালু, হালুয়াঘাট, ময়মনসিংহ রোডে অগ্রসর হয়ে বাঘমারা সেক্টরের আরো প্রায় ২০০০ মুক্তিযোদ্ধা লেঃ কামালের নেতৃত্বে হালুয়াঘাটের পশ্চিমে লেঃ তাহেরের সাথে মিলিত হয়ে ভারতীয় ‘এবজা’ সেক্টরের সহায়তায় উত্তর ও উত্তর – পূর্ব দিক থেকে ময়মনসিংহ অবরোধ এবং আক্রমণ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।অন্যদিকে জামালপুর পতনের পর ঐ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ময়মনসিংহের পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিক থেকে ময়মনসিংহে অবরোধ করে একই সময়ে ময়মনসিংহ আক্রমণ করার পরিকল্পনা ছিল।সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডালু এবং বাঘমারা সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা লেঃ তাহের এবং কামালের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ শহরের দিকে অগ্রসর হয়।অন্যদিকে শিবপুর এবং মহেশখোলা সাব-সেক্টরের প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাদের মেজর মতিউর রহমানের নেতৃত্বে নেত্রকোনা দখল করার পর কিশোরগঞ্জ হয়ে ঢাকার জয়দেবপুরে ১১ নং সেক্টরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল।আর ময়মনসিংহ ও জামালপুরের পতনের পর এই বিরাট মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দীকির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে টাঙ্গাইল দখল করেবিপুল বিক্রমে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়ে টঙ্গি পর্যন্ত অবরোধ করার পরিকল্পনা করা হয়।কিন্তু ১১ নং সেক্টরের হাতে জামালপুর পতনের পর ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পলায়ন করে।মুক্তিবাহিনী তাদের পশ্চাদবন করে এবং ভারতীয় প্যারাসুট বাহিনী টাঙ্গাইল এর নিকটবর্তী পিগনা নামক স্থানে এক ব্যাটালিয়ান ছত্রীসেনা নামায়।একদিকে ছত্রীসেনা ও অন্যদিকে ধাবমান মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত চাপে অসংখ্য গাড়ি সহ প্রায় ৩০০ পাক সৈন্য নিহত হয়।ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল থেকে পলায়নরত পাকিস্তানী বাহিনীর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদেরসহ সমস্ত ব্রিগেড স্টাফ ঢাকার কালিয়াকৈর এর নিকট ধরা পড়ে। এরপর ঢাকা পৌঁছা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী আর উল্লেখযোগ্য কোন বাধার সম্মুখীন হয়নি।
১৬ই ডিসেম্বর বিকাল ৪টার সময় ১১নং সেক্টর বাহিনী বীরবিক্রমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে প্রবেশ করে।
স্বাক্ষরঃ আব্দুল আজিজ
৭-৬-৭৩
* ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে লেঃ কর্নেল পদে উন্নীত হন।