কেউ পাশবিকতা থেকে অব্যাহতি পায়নি

৬১| কেউ পাশবিকতা থেকে অব্যাহতি পায় নি (৪৫৯-৪৬০)

সুত্র – দৈনিক আজাদ, ৮ মার্চ, ১৯৭২

বারো বছরের কচি কিশোরী কিংবা পঞ্চাশের বৃদ্ধা কেউ পাশবিকতা থেকে অব্যাহতি পায়নি

|| আবুল হোসেন মীর ||

উধার আটঠো লাশ হ্যায়। কুত্তাছে খিলানা হ্যায়, খিলাদো। আউর না কিসিকো দেনা হ্যায় দে দো। যাও, যো তোমহারা মর্জি করো”

পাক জল্লাদদের কথাগুলো অবিকল মনে রেখেছেন আমির হোসেন। ঠিক তেমনি মুখ বিকৃত করে শব্দগুলো শোনালেন আমাদের। ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছেড়ে আমরা পশ্চিম দিকের মনোহরপুর গ্রামে গিয়ে উঠতেই দেখা হয়েছিল আমির হোসেনের সাথে। আমির হোসেন মুক্তি বাহিনীকে গোপনে তথ্য সরবরাহের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। পাক বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েন। দীর্ঘ চার মাস হানাদারদের নরকে কাটাবার পর সৌভাগ্যক্রমে ছাড়া পেয়ে যান। ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাঁয়ের বিসু মণ্ডলের বাড়ির কাছে দেখা হয় একদল দস্যের সাথে। সেই দস্যুদের একজন আমির হোসেনকে শোনায় উপরের কথাগুলো। তিনি ক পা এগুতেই সত্যিই দেখতে পান হাত পা বাঁধা উলঙ্গ অবস্থায় আটটি মরদেহ। তাঁদের কারো কারো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা। বিমূঢ় আমির হোসেন দেয়ালটা ভেঙে লাশগুলো মাটিচাপা দিয়ে চলে যান আপন ঘরের দিকে। নীল বেদনার্ত হৃদয়ে।

আমির হোসেনের কাছ থেকে জানা গেল ক্যান্টনমেন্টের অসংখ্য হত্যাযজ্ঞের কাহিনী। তিনি বললেন, সেভেন ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের ও,সি লেঃ কর্নেল আব্দুল হাইয়ের লাশ দুদিন পর আনা হয় সি,এম,এইচ-এ। তাঁর লাশ পাওয়া যায় গ্যারিশন সিনেমা হল সংলগ্ন পশ্চিম দিকের তালতলায়। তাঁর তলপেটে সতেরোটি বুলেটের চিহ্ন ছিলো।

এই কোম্পানির কোয়ার্টার মাষ্টার ক্যাপ্টেন শেখের ভাগ্যেও এই একই পরিণতি ঘটেছিলো। আমির হোসেন তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে আরো জানালেন, সি,এম,এইচের নার্সিং স্টাফ হাবিলদার অব্দুল খালেক ও তাঁর সঙ্গী ফজর আলী ও একজন সুবেদার এম,আই রুমে ঔষধ আনতে যাবার পথে রানওয়ের নিকটবর্তী দরজার কাছে ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের সিপাইরা তাঁদেরকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া সি,এম,এইচ এর মসজিদের ইমামকেও তাঁরা গুলি করে হত্যা করে। হত্যা করার আগে দস্যুরা ইমাম সাহেবকে “কালেমা পড়” বললে তিনি শ্রদ্ধার সাথে পবিত্র কালেমা আবৃত্তি করে শোনান। কিন্তু জনৈক দস্যু মুখ বিকৃতি করে বলে, “শালা গাদ্দার এক মাওলানা, কালেমা ভী পড়নে নেহী স্যাকতা”।

আমির হোসেন জল্লাদদের নরহত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে বললেন, বাঙ্গালী ধরে এনে প্রথমে আই,এস,আই অতঃপর সেখান থেকে ৬১৪ আই,এম,ইউ এবং পরে ৪০৯ জি,এইচ,কিউ-এ পাঠিয়ে দেয়া হতো। ৬১৪ এফ,আই, ইউতেই নাকি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কঠোর নির্যাতন চালানো হতো।

এম,ই,এসের জনৈক কর্মচারী হারেছ উদ্দীন জানান যে, ৩০ মার্চ তিনি গ্রেফতার হন। ১৪ দিন ধরে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর পাক সেনাবাহিনীর জল্লাদেরা তাঁর উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। হারেছ উদ্দীনের কাছ থেকে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত তৎকালীন সামরিক বাহিনীর বাঙালি কর্মচারীদের পরিবারের মহিলাদের একটি বন্দী শিবিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সে জানিয়েছে, ৫৫ নং ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারীর ফ্যামিলী কোয়ার্টারের বারো থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের দু’শ পঁচানব্বই জন মেয়েকে আটক করে রেখে প্রতিদিন রাতে তাঁদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হতো। তিনি আরো জানান যে, তাঁদের সেলটি কিছুটা দূরে হলেও প্রতিদিন রাতেই ভেসে আসতো মেয়েদের করুন আর্তনাদ। সেই সাথে বর্বর পাক সেনাদের পৈশাচিক উল্লাসধ্বনি বাতাসের সঙ্গে মিশে এক মর্মবিদারী দৃশ্যের সৃষ্টি করতো। প্রতিদিন বিকেলে জনৈক সুবেদার এসে এইসব মেয়েরা কে কোথায় যাবে তারই একটি তালিকা প্রস্তুত করে যেতো। অতঃপর সন্ধ্যা হলেই উক্ত লিস্ট মোতাবেক নির্ধারিত মেয়েটিকে পাঠানো হতো নির্ধারিত স্থানে। কখনো কখনো আপন খেয়াল খুশীতে বাইরে নিয়ে এসে পাহারাদার কুকুরের দল উর্যুপরি নারী ধর্ষণে লিপ্ত হতো। একদিন একটি মেয়েকে এইভাবে পরপর চৌদ্দ জন নির্যাতন চালালে মেয়েটি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু তবুও দুর্বৃত্তরা তাঁকে রেহাই দেয়নি। অচৈতন্য অবস্থায়ই নিজেদের লালসা চরিতার্থ করেছে। মেয়েটির পুনরায় জ্ঞান ফিরে আসতে নাকি ৩৬ ঘন্টা সময় লেগেছিলো। জনাব হারেছ বলেন, চৌদ্দ দিন পর তাঁকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর ঐ মহিলা নন্দী শিবিরের বাসিন্দাদের পরিণতি সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেন নি। অপর একটি মহিলা শিবিরের কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

২৫ শে সেপ্টেম্বর জেলখানা থেকে পুনরায় তাঁকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে আসা হলে সেথা এফ,আই,ইউ-এ তাঁর উপর নতুনভাবে নির্যাতন করা হয়। সেখান থেকে ১২ নং এফ আই ইউ ব্যারাকের ১০ নং রুমে বহু মহিলাকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পান, প্রতিরাতে ঐ ঘর থেকে তাঁদের চিৎকার শুনতে পাওয়া যেতো। এবং একই উপায়ে তারা পাশবিক নির্যাতন চালাতো। এইসব মেয়েদের যৌবন সাধারণত অফিসারেরাই ভোগ করতো। এই সম্বন্ধে হারেছ উদ্দীন আরো বলেন, বন্দীশিবিরের মহিলাদের সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করে রাখা হতো। প্রথমভাগে ছিল যুবতী, দ্বিতীয়ভাগে ছিল মধ্যবয়সী এবং তৃতীয়ভাগে কয়েক সন্তানের মাতা। তিনি স্কুল কলেজের সুন্দরী মেয়েদের প্লেনে করে ঢাকা পাঠাতেও দেখেছেন।

হারেছ উদ্দীনের বর্ণনা থেকে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। দখলদাররা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে আন্ডারগ্রাউন্ড সেল তৈরী করেছিল। যশোর পতনের পর ঠিক এমনি একটি সেল থেকে ১১৩ জনকে উদ্ধার করা হয়েছিলো। সবাই জীবিত অবস্থায় থাকলেও তাঁদের মধ্যে প্রাণ ছিলো না বললেই চলে। আলো বাতাস ও খাদ্যের অভাবে মাংসহীন হয়ে তাঁদের শরীর একেবারেই ভেঙে পরেছিলো। হাড্ডি কংকালসার দেহগুলি অসহ্য নির্যাতনের জ্বালা বহন করে এনেছিল।

Scroll to Top