৪১। খুলনায় নরমেধযজ্ঞ (৪৩০-৪৩১)
সূত্র – দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
খুলনায় পাক বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ
।। নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরিত ।।
বর্তমানে হেলিপোর্ট ফরেস্ট ঘাটের কথা বলা যাক। হেলিপোর্ট জজকোর্টের সামনে এবং সার্কিট হাউজ সংলগ্ন। যেসব বাঙ্গালীদের উপর তাদের অত্যাধিক রাগ ছিল জল্লাদরা তাদের প্রকাশ্য দিবালোক হেলিপোর্টর প্রবেশ পথে ছাগল ঝোলা করে পা উপরে মাথা নীচে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতো।
আর ঐ অবস্থায় চলতো অত্যাচার- চড় ঘুষি ও চাবুকের আঘাত। কোন কোন ক্ষেত্রে ঐ অবস্থার উপর বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো হতো। যতক্ষণ না সে মারা যায় ততক্ষণ চলতো এই নির্যাতন। যার কাছ থেকে কোন স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হতো ঐভাবে অত্যাচার করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে নামানো হতো, জ্ঞান ফিরলে আবার ঝোলানো হতো পূর্ববৎ।
একদিন আমার নিজের দেখা একটি মৃত্যুর কথা উল্লেখ করছি। সকাল ১০টা হবে। হেলিপোর্ট লুঙ্গি ও গেঞ্জি পড়া দীর্ঘ সবলদেহী একজন বাঙ্গালীর পায়ে, হাঁটুতে ও অন্যান্য গিরায় কাঠের রোলার দিয়ে দু’জন সেনা পিটাচ্ছে আর দু’জন সেনা তা উপভোগ করছে। যার উপর অত্যাচার চলছে তিনি বার বার বাঁধা দিচ্ছেন আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তারপর তার দু’পায়ে দড়ি বেঁধে পা উপরে মাথা নীচে দিয়ে ঝুলানো হলো।
পরনে থাকলো জাঙ্গিয়া ও গায়ে গেঞ্জি। পরে খালি গা করে গেঞ্জিটিও অপসারন করা হলো। আর চললো চাবুকের বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সাথে সাথে তার দেহটি মুচড়ে উঠতে লাগলো। ঐ ঝুলন্ত অবস্থাতেই তিনি হাত দিয়ে বাধা দিচ্ছেন। কিন্তু পরে আর তার হাতে সে জোর রইল না। কিন্তু চাবুকের বাড়ি চললো অব্যাহত ভাবে। আর এইভাবেই সমাপ্তি হলো একটি বাঙ্গালী জীবন। পরে তার সেই ঠাণ্ডা শীতল দেহটাকে নামিয়ে অবজ্ঞায় তারা দূরে ফেলে দিল আবার অপর একজনকে। আমি সরে পড়লাম।
রাতের বেলায় জজকোর্টের পিছনে ফরেস্ট ঘাটে বাঙ্গালীদের এনে জবাই করে হত্যা করা হতো এবং দেহগুলোর পেট চিরে নদীতে ফেলা হতো। ঘাটটি আবার জজ সাহেবের বাসার ঠিক পেছনেই। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই সব মৃত্যুপথযাত্রী বাঙ্গালীদের করুন আর্তনাদ জজ সাহেবের কানে পৌঁছাতো। দিনে হেলিপোর্টে ও রাতে ফরেস্ট ঘাটের এইসব হত্যাযজ্ঞ সহ্য করতে না পেরে জজ সাহেব তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারকে অনুরোধ করেছিলেন যে বিচারালয়ের সামনে যেন এ ধরণের কাজ না করা হয়। তার উত্তরে তিনি পেয়েছিলেন মৃত্যুর শাসানি। কিন্তু তাদের সাধ মেটেনি। তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে একরাতে মারা গেলেন।
আর একটি বধ্যভূমি চিল গল্লামারি। খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র দেড় মাইল। হেলিপোর্ট ও ফরেস্ট ঘাট, কাস্টমস ঘাট প্রভৃতি জায়গায় প্রথমে বাঙ্গালীদের হত্যার জন্য বেছে নিলেও পরে বর্বর পাক বাহিনীর গল্লামারীকেই তাদের নৃশংসতার উপযুক্ত স্থান বলে বেছে নিয়েছিল।
সারাদিন ধরে শহরে ও গ্রাম থেকে বাঙ্গালীদের ধরে এনে জেলখানা হেলিপোর্ট ও ইউ, এফ, ডি ক্লাবে জমায়েত করা হত। তারপর মধ্য রাত হলে সেই সব হতভাগ্য নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের পেছনে হাত বেঁধে বেতার কেন্দ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা তারা ব্রাস মারতো, রক্তপ্লুত দেখে লুটিয়ে পড়তো হতভাগ্যরা। হত্যার আগে ট্রাক ভরে যখন তাদের নিয়ে যাওয়া হতো তখন সেই সব নিরুপায় মানুষের আর্তনাদ রাস্তার আশপাশের সবাই শুনতো। কিন্তু তাদের তো বাড়ীর বাহিরে যাওয়ার উপায় নেই কারফিউ রয়েছে।
সেই আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে শেরে বাংলা রোডের এক ব্যাক্তি জানালা খুলে মুখ বাড়িয়েছিল মাত্র। ব্যাস, অমনি তাঁকে লক্ষ্য করে হানাদার বাহিনী গুলি ছুড়লো আর বুলেট বিদ্ধ হয়ে সে লুটিয়ে পড়লো। হানাদার বাহিনী প্রতিরাতে কম করেও শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করতো। দিনের বেলায় তাদের লাশ জোয়ারের পানিতে ভেসে আসতো। কিন্তু কারও সাহস হতো না তাদের দাফন করার।
অনেকে তাদের আপনজনের লাশকে সনাক্ত করলেও সেখান থেকে তাকে উঠিয়ে নিতে পারেনি। কেননে বর্বররা জানতে পারলে তাকেও হত্যা করবে।
কিছুদিন জল্লাদরা ঠিক করলো গুলি করে আর হত্যা নয়। অন্য পন্থা। এবার থেকে শুরু হলো জবাই, কিন্তু সংখ্যায় কমলো না-সেই শতাধিক প্রতিরাতে। এরপরের ঘটনা চরম নিষ্ঠুরতার। রাত্রের বদলে হত্যার জন্য দিনের বেলাকে বেছে নিল।
সকলের চোখের সামনে দিনে পিঠ মোড়া দেওয়া ট্রাক ভর্তি বাঙ্গালী নিয়ে যাওয়া হতো আর ঘণ্টাখানেক পর শূন্য ট্রাক ফিরে আসতো- গল্লামারীতে পড়ে রইতো কিছুক্ষণ আগের যাওয়া সেইসব মানুষের শীতল দেহগুলো। খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারী খাল থেকে দুই ট্রাক মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল।
ছবি তুলবার জন্য গল্লামারীর অভ্যন্তরের ধানক্ষেতে ঢুকে দেখলাম এক নৃশংস দৃশ্য। একাধিক লাশ পড়ে আছে, সেদিকে একটি কুকুর খাচ্ছে আর দূর অপর একটি লাশের পাশে আর একটি কুকুর বসে হাঁপাচ্ছে। মনে হয় মানুষ খেয়ে তার উদর অতিমাত্রায় পরিপূর্ণ।
ভাবতেও অবাক লাগে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলে খ্যাত মানুষকে কুকুরে টেনে ছিঁড়ে খাচ্ছে।