৪৬। খুলনায় পাক বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ (৪৩৯-৪৪০)
সুত্র – দৈনিক বাংলা, ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
খুলনায় পাক বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ
।। নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরিত ।।
খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থলে রেল ষ্টেশন ও রেল লাইনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল বাঙ্গালী নিধনের আর একটি ঘাঁটি। এপ্রিল মে মাসে জল্লাদ সৈন্যরা খুলনা রেলষ্টেশন এলাকাতে বহু বাঙ্গালীকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে ছিল প্রদেশের অন্যত্র থেকে আসা ট্রেনের যাত্রীরা। প্রথমে তাদের সর্বস্ব লুট করা হতো। তারপর হত্যা করা হতো এবং সেই সব মৃত দেহগুলির পেট চিরে নদীতে ফেলে দেয়া হতো যাতে করে লাশ নদীর গভীরে তলিয়ে যায়।
রেলষ্টেশন ও ষ্টীমার ঘাটগুলির শক্ত সবল মুটে শ্রমিকেরাই তাদের হাতে মারা গিয়েছে সর্বাধিক। রেল কলোনী এলাকাতে প্রাধান্য ছিল পাকসেনাদের সহযোগী একডল আবাঙ্গালিদের। ঐ সময়ে রেল কলোনী এলাকাতে দিনে বা রাতে যখনই কোন বাঙ্গালী গিয়েছে, সে আর ফেরেনি কোন দিনও। তাকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হতো। বহিরাগত লঞ্চ ষ্টীমারের যাত্রীরাই হয়েছে তাদের প্রধান শিকার।
ঐ সব কলোনীতে বসবাসকারী অনেক বাঙ্গালী রেলকর্মচারীও হয়েছে তাদের শিকার। লুণ্ঠিত হয়েছে তাদের গৃহসামগ্রী। এই এলাকা থেকে অন্যান্য গলিত দেহের সঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছিল খুলনা থানার দারোগা জনাব কাশেমের মৃতদেহটি। ডিউটি করে বাড়ি ফেরার পথে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন। এই এলাকায় আশিয়ানি হোটেলের সামনে বিরাট একটা ডোবা আছে। এই ডোবার ভেতরেও নিক্ষিপ্ত হয়েছে বহু বাঙ্গালীর মৃতদেহ।
গত ডিসেম্বরের কথা। যুদ্ধ চলছে একদিকে আর বাঙ্গালীকে হত্যা করে ভর্তি করা হচ্ছে রেল রোডের একটি গুদাম। খুলনায় বিমান হামলা চলাকালীন পথের লোকজন রেল রোডে বা রেল কলোনিতে আশ্রয় নিলেই সেখান থেকে তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করে ঐ গুদামে ফেলে দেয়া হত। ঐ সময়ে খুলনায় কেউ ভাবতে পারতো না যে রেল রোডের মত ব্যস্ত সড়কে এই ধরণের একটি গুদাম রয়েছে যেখানে বাঙ্গালীদের লাশ রোজই বেড়ে উঠেছে।
ষ্টেশনরোডে ঐ সময়ে কেরোসিন বিক্রি হতো। কেরোসিন তখন ছিল আক্রা। তাই সুদুর গ্রামাঞ্চল থেকে ক্রেতারা এসে ভোর থেকে লাইন দিত। কিন্তু বিমান হামলার সাইরেন বাজলেই তারা আত্মরক্ষার্থে আশপাশে আশ্রয় নিত। তারা জানতো না যে যেখানে তারা আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে রয়েছে বাঙ্গালীদের মরণফাঁদ। তাদের পাহারাদারদের সহায়তার বর্বর সেনারা বাঙ্গালীদের অর্থ লুণ্ঠন ও হত্যা করতো।
পাহারাদার খানরা পথেঘাটে, বাজারে ব্যাংকে সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। ঐ সব জায়গায় কোন বাঙ্গালীর কাছে বেশী টাকা দেখলেই তাকে মুক্তিবাহিনী বলে ধরে আনতো হেলিপোর্টে অবস্থানরত জল্লাদ সেনাদের কাছে। সেখানে তার সর্বস্ব লুট করে তারপর তাকে মেরে ফেলা হত। এ ধরণের হত্যা অনেক ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ম্যাটারনিটি রোডের ননী, স্যার ইকবাল রোডের সিমেন্ট ব্যবসায়ী কাঞ্চন মিয়া, আরও অনেকে।
এখানে শুধু ননীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটনার কথা বলছি। ননীদের কন্ট্রাক্টরী ও নৌপরিবহন ব্যবসা আছে খুলনাতে। ঘটনার দিন সে ব্যাংকে গিয়েছিল ব্যবসার জন্য কয়েক হাজার টাকা তুলতে। ননী টাকাটা তুলে তার সাথীকে নিয়ে ঢুকল পিকচার প্যালেসের কাছে এক রেস্টুরেন্টে চা খেতে। তখন সে বুঝতেও পারেনী এটাই হল তার জীবনের শেষ চায়ের কাপ। বাইরে অপেক্ষা করছিল দুজন খান। যেই মুহূর্তে ননী রেবিয়েছে অমিন তাকে পাকড়াও করে তুলল রিক্সাতে। রিকশা ছুটল বধ্যঘাঁটি হেলিপোর্ট, যেখানে অপেক্ষা করছিল বর্বর পাকসেনার।
১৭/১৮ বছর বয়সের ননী ছিল নির্ভীক ও তেজোদীপ্ত। মৃত্যু অবধারিত জেনেও বাঙ্গালী তরুন ননী খানসেনাদেরকে রেখে কথা বলেনি। কঠিন ভাষায় সে প্রতিবাদ করেছিল- যার প্রতিশোধ তাকে তারা হত্যা করেছিল নির্মমভাবে। বর্বররা তার পায়ে দড়ি বেঁধে হেলিপোর্টের সিলিং-এ পা উপরে মাথা নীচে দিয়ে ঝুলিয়েছিল।
তারপর চালালো তার দেহে চাবুক। চাবুকের প্রতিটি বাড়ি তার দেহে কেটে বসে যাচ্ছিল। আর সে আর্তনাদ করছিল। সময়টা ছিল দুপুর। তার সাথীরা ছিল নির্বাক পথযাত্রী বাঙ্গালী। চাবুকের বাড়িতে যন্ত্রনায় তার মুখমণ্ডল থেক চোখ দুটো বেরিয়ে গিয়েছিল।