জনতার সংগ্রাম

জনতার সংগ্রাম

 

১৪ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমি যতদিন শত্রু কবলিত থাকবে ততদিন আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। চূড়ান্ত জয়ের পূর্বে এই যুদ্ধ আর থামবে না। এবং এই যুদ্ধে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। এই কথাগুলো আজ আর উচ্ছাস বা ভাবাবেগে চালিত নয়, এই কথার সত্যতা আজ প্রতিটি বাঙালীর ধমনীতে প্রবাহিত। বিশ্ববাসীও বিস্ময়ে লক্ষ্য করছে বাঙালীর এই অভূতপূর্ব সংগ্রামের সাফল্যের দিকে।

নানা প্রতিকুল অবস্থায় নিজের জমিতে চাষ করতে করতে কৃষক লাঙলের ফলা হাতে আজ শত্রুনিধনে তৎপর। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে পার্শ্ববর্তী চাষী ভাইয়ের দিকে মুখ তুলে বলে ওঠে, পশ্চিম পাকিস্তানী শত্রু সৈন্যরা যতদিন আমাদের সবুজ মাটিতে আছে ততদিন আর শান্তি নেই। তার রক্ত জল করে উৎপাদিত

পাট-চা-ধান-ধানের মুনাফা লুটবে পশ্চিম পাকিস্তানী ধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা আর কিছুতেই সহ্য করা যাবে না। কারখানার শ্রমিক আজ বুঝতে পেরেছে তারা পশ্চিম পাকিস্তানী মুনাফখোর শিল্পপতিদের শিকার মাত্র, কাজেই সর্বপ্রথমে তাদের সরাতে হবে এবং ঐ ধনিক গোষ্ঠীর অনুচর হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদল। ছাত্ররা আজ দিশেহারা, স্কুল-কলেজে আজ শিক্ষক নেই, ক্লাসগুলো বলতে গেলে প্রায় শূন্য, তারা আজ মিলিটারী জান্তার শিকার মাত্র। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর সৈন্যরা বুঝতে পেরেছে তাদের উন্নতির পথ অবরুদ্ধ। কেননা তাদের উপরে বসে আছে পাঞ্জাবী সামরিক অফিসাররা দিনে দিনে সর্বস্তরে এই পুঞ্জীভূত অসন্তোষ থেকে জন্ম নিয়েছে তাদের প্রতিরোধ আকাংক্ষা। মার খেয়ে বাঙালী অস্ত্র তুলে নিয়েছে, তারা হাতিয়ার তুলে নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে।

তাই স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আজ সর্বস্তরের মানুষ সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, মুক্তিবাহিনীতে আজ কৃষক-মজুর-ছাত্র-পুলিশ-সৈন্য সকলেই যোগ দিয়েছে এবং দিচ্ছে। সামরিক অফিসার থেকে গ্রামের একেবারে সাধারণ একজন কৃষক যুবক প্রত্যেকেই মুক্তিবাহিনীর আজ সক্রিয় সদস্য, অর্থাৎ বীর যোদ্ধা। একজন কারখানার মজুরের পাশে বসে একজন ছাত্র বলছে সে কয়জন শত্রু কে নিহত করেছে। একজন শিক্ষক, যে কোনদিন রাইফেল ধারার কথা চিন্তাও করেনি সে আজ একজন পরিপূর্ণ যোদ্ধা। এই সম্মিলিত শক্তি নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছে, এবং তারা যুদ্ধ করছে মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞায়।

অনেক ত্যাগ এবং অনেক রক্ত দিয়ে বাঙালী আজ আরো রক্ত দিতে ও নিতে শিখেছে। এবার প্রতিটি রক্তবিন্দু ঝরবে শত্রু র রক্তের বদলা নিতে। অনেক রক্ত দেবার পর বাংলাদেশের সবুজ মাটি আজ নির্মম হয়ে উঠেছে। এই রক্তপাত ব্যর্থ হবার নয়। বীরের রক্ত কখনো ব্যর্থ হয় না এই সত্য মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা বুঝতে ফেলেছে।

আমাদের স্বাধীনতার রক্ষার সংগ্রামে প্রথম দিকের অস্ত্রর সংগ্রহের অভিযান এখন শেষ হয়ে গেছে। প্রথম দিকে আমাদের ভয় ছিল আমরা অস্ত্র পাব কোথায়। এখন আমাদের হাতে প্রচুর অস্ত্র এসেছে। আরো আসছে। ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধাদের মত ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্র। এমনকি তাতে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পর্যন্ত উঠেছে। আমাদের টাকায় কেনা অস্ত্র আজ আমাদের হাতে এসেছে শত্রুর হাত হয়ে। বাঙালীদের টাকায় শত্রুরা যে অস্ত্র কিনেছিল দেশরক্ষা করতে, সেই অস্ত্র দিয়ে তারা আমাদের মারছে। আমরা রুখে দাঁড়িয়ে সেই অস্ত্র কেড়ে নিয়েছি এবং নিচ্ছি। প্রতিটি গেরিলা আক্রমণে আমাদের পীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে রাইফেল, মর্টার, মেশিনগান, কামান। সেই অস্ত্র বাঙালীদের ঘরে ঘরে উঠছে। মুক্ত এলাকায় আজ প্রত্যেকেই রাইফেল চালাতে জানে, অস্ত্র আজ তাদের খেলা। বাঙালী আজ বুঝতে শিখেছে যে এই অস্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, এই অস্ত্র আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। এবং অস্ত্র দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবেনিয়মতান্ত্রিক পথে কিছু আদায় করা যাবে না, শত্রুর সঙ্গে কোন আপোস নেই। যুদ্ধ করেই মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, কিউবার মুক্তিসংগ্রাম থেকে আমরা শিখেছি স্বাধীনতাস্পহাই হচ্ছে বড় কথা। এই স্বাধীনতার আকাংক্ষাই সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র। বুকের মধ্যে একবার এই আগুন জ্বলে উঠলে তা আর কোনদিন নেভে না। আমাদের বুকের মধ্যে যে স্বাধীনতার আগুন প্রতিনিয়ত খেলা করছে তাকে পৃথিবীর কোন শক্তি নির্বাপিত করতে পারে না, সেই আগুন দিনে দিনে শুধু বেড়েই থাকে। একবার সেই আগুন জ্বলে উঠলে কোনদিন আর নেভে না। বাংলার বুকে আজ সেই আগুনের অনির্বাণ শিখা। শত্রুকে চিরতরে শেষ করে তাতেই তার শান্তি। এমনকি স্বাধীনতার এই স্পৃহা বা আগুন থেকে কোন মানুষ নিজেকেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। ইচ্ছা করলেও এই আকাংক্ষা থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না। এমনকি এক সময় এই স্বাধীনতাপূহ এমনভাবে মানুষকে সংক্রামিত করে যে ভীতু এবং দুর্বল লোক পর্যন্ত সাহসী যোদ্ধায় পরিণত হয়ে ওঠে । তখন সে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেয় শত্রুর ওপর দুর্বার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কোন বাধা তখন তার কাছে আর বাধা থাকে না। আমাদের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসামানী বলেছেন, “আমাদিগকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে

রাতদিন প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে হবে। সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে যেতে হবে যাতে শত্রু এক মুহুর্তের জন্যেও অবকাশ না পায়।” তিনি আরো বলেছেন, “আপনাদিগকে দলমতনির্বিশেষে সকল পার্থক্য ভুলে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে, পরিকল্পনা প্রস্তুতি নিতে হবে, শত্রুর উপর আঘাত হানতে হবে, এবং শত্রুকে ধ্বংস করতে হবে। শেষ শত্রুটি ধ্বংস না করা পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না।” -এই যুদ্ধ তাই প্রত্যেক বাঙালীর যুদ্ধ, এই মুক্তিযুদ্ধে তাই অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ, সর্বস্তরের মানুষ নিয়ে সংগঠিত হয়েছে মুক্তিবাহিনী। তারা রাতদিন চেষ্টা করছে। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দৃঢ় মনোবল আমাদের সহায়। আমাদের অস্ত্র যোগাবে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পাওয়া শত্রুর হাতের অস্ত্র। এবং মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করছে শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র দিয়েই। এমনিভাবে মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিহত অগ্রগতি চলছে দুর্বার ও দুর্দম গতিতে; তারা আর থামবে না, কোনদিন থামবে না। দেশকে শত্রুমুক্ত করার পূর্বে, চূড়ার বিজয়ের পূর্বে এই যুদ্ধ থামবে না। কারণ প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা জানেন  –

আমি সেই দিন হব শান্ত-

যবে উৎপীড়িতের ক্ৰন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না;

অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।

(বিপ্রদাস বড়ুয়া রচিত)

Scroll to Top