৪৫। জল্লাদেরা আছড়েও মানুষ মেরেছে (৪৩৭-৪৩৮)
সূত্র-দৈনিক বাংলা, ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
জল্লাদেরা আছড়েও মানুষ মেরেছে
।। বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত ।।
বাবা, মা নেই। কাকা খোঁড়া। চলতে পারেন না। জ্যাঠা পাগলা। বোন বিধবা। বাচ্চাও আছে একটা। মোট ১০জনের পরিবার। আমি এদের নিয়ে কি করব বলতে পারেন?
অটো প্রমোশনে প্রদীপ এখন নবম শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু বেতন দেবে কোত্থেকে। না। কোথাও যাইনি। যাদের উপার্জনে সংসারের চাকাটা ঘুরতো খান সেনারা তাদের একদিন ধরে নিয়ে গেল। ধরে নিয়ে গেল, চলতি বাংলা সনের জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৭ তারিখে। নিয়ে গেল আমার ভগ্নিপতি অমল লাল চাকী এবং পরিবারের অপর তিনজন ননী গোপাল দেব, নিরোদ বিহারী দেব, আর নিরঞ্জন দেবকে। ওরা তো ফিরে আসেনি।
হয়ত হেলাল পার্কের বধ্যভূমিতে তাদেরও হত্যা করা হয়েছে। তারপর পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। আজ এ গ্রাম কাল সে গ্রাম এমন করে। বাড়ি লুট হয়েছে। কিছু নেই। স্কুলের বেতন দেবে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। প্রদীপের বোনের বিয়ে হয়েছে মাত্র দু’বছর। এখন বয়স বড়জোর আঠারো উনিশ, সে এখন অর্ধ উন্মাদিনী।
“সরকারের দয়ায় মানুষের সহায়তায় হয়ত একদিন আবার আমরা দাঁড়াতে চলতে পারবো, কিন্তু আমার বোনের স্বামীকে ফিরিয়ে দেবে কে? ছোট ভাগ্নে যখন বড় হয়ে জিজ্ঞেস করবে মামা আমার বাবা কোথায় তখন আমি তাকে কি করে বোঝাবো? কোত্থেকে এনে দেব তার বাবাকে? নাম রাখা সার্থক হয়েছে। প্রদীপ পড়তে চায়। পড়া ছাড়া আর নেই কোন উপায়। যে করেই হোক তাকে পড়তেই হবে। অশিক্ষিত ছেলেকে চাকুরী দেবে না কেউ। সামান্য কিছু জমি আছে তার।
গাইবান্ধা ইমারজেন্সি ফরসে কর্মরত সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক। নীতি খান সেনাদের বিচারের মহড়া দেখেছেন। একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি। রান্নার খড়িয়ে ঘাটতি পড়েছে। মেজর আফজাল ডেকে পাঠাল। জ্বালানী কাঠের ব্যবস্থা করতে হবে।
গেলেন রাজ্জাক সাহেব। তার তখন ৮টা। রাজ্জাক সাহেব বললেন, সুবেদারের নাম এখন মনে নেই। সে মেজর আফজালের ঘর থেকে দুজন লোককে বের করে নিয়ে এল। সুবেদারকে সুধলাম, কেয়া ভাইয়া ইন দোনোকা বিচার হো গিয়া। খান সুবেদার জবাব, তোমহারে সামনে হোগা দেখো। ওদের দুজনকে মাঠে খাড়া করলো। সিপাইকে হুকুম দিল, ইন লোগকো খরচা কর দো।
লোক দুটোকে পিছন ফিরতে ও চোখ বন্ধ করতে বলা হলো। তারপর এক, দুই, তিন, চার। পরপর চারটে গুলি। কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে করতে মারা গেল। তারপর তাদের কফিল শাহর গুদামের মাঠে যেখানে রয়েছে আরো শত শত মানুষের সমাধি সেখানে গর্তে ফেলে মাটি দেয়া হলো। হেলাল পার্কে এবং এখানে যাদের হত্যা করা হয়েছে এই প্রাঙ্গণেই তারা শুয়ে আছে। শুয়ে আছে দশ, বিশ জনে গাদাগাদি হয়ে।
আমার যে বোনের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে পড়ে রয়েছে তাদের পরণের শাড়ির ছিন্ন অংশ। মাথার চুল। চোখে বাঁধা রয়েছে তার রুমাল। গুদামের কক্ষগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইট। তাতে রক্তের দাগ। অনেককে গুলি খরচ না করে ইটের উপর আছড়ে মারা হয়েছে। চিৎকার করতো বলে আর আশপাশের পাড়ার লোকের গুলির শব্দ শুনে শুনে রাখতো তাই পরের দিকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলত।
হেলাল পার্কের সংলগ্ন ওয়াপদা রোড পাড়ার আব্দুল ওয়াদুদ খান শহীদ। কলেজের ছাত্র। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সে গুপ্তচরবৃত্তি করছে বলে তাকে একবার নয় দু-দুবার ধরা হয়েছিল। শেষ বার ৬ই অক্টোবর প্রথমে তার বন্ধু মকসুদার রহমান মুকুল এবং পরে শাহিনকে ধরা হয়। শাহীন আমাকে জানালো, ওরা প্রথমে আমাকে সিকিউরিটি অফিসারের কাছে নিয়ে গেল। আমি মুক্ত এলাকায় যাতায়াত করার কথা স্বীকার করি। স্বীকার করার উপায় ছিল না। ওদের লোকের আমরা যাতায়াতের সঠিক খবর রাখতো। মেজর ছিল না তাই আমাকে এক ঘণ্টার জন্য ছেড়ে দেয় হলো বলা হল, যদি না ফিরে তবে আমার বংশে বাতি দেওয়ার মতও কাউকে রাখা হবে না। অগত্যা এক ঘণ্টা পর ফিরতে হলো। মেজরের জিজ্ঞাসাবাদের পর কফিল শাহর গুদাম ঘরে হাত আর চোখ বেঁধে শুরু হলো নির্যাতন। সেই ঘরে বিমান বাহিনী থেকে অগাত একজন মুক্তি সেনাকে রক্তাপ্লুত ও উলঙ্গ অবস্থায় তিনি দেখতে পেয়েছেন। শাহীন জানাল আমার সামনেই দলে দলে লোক ধরে আনছে আর চালাচ্ছে অকথ্য অত্যাচার।
শাহীন বললো পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর মাহমুদ, বালুচ রেজিমেন্টের মেজর আফজাল, লেফটেন্যান্ট নেওয়াজ রিজভি, ২৯ ক্যাভালরির মেজর তহসিন মির্জা এবং মেজর শের খান ও ক্যাপ্টেন খককর গাইবান্ধার হেলাল পার্কের সকল হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের জন্য দায়ী। মেজর শের আলী তহসিন মীর্জা কত মেয়ের যে সতীত্ব হরণ করেছে তার কোন হিসাব নেই।
ভরতখালিতে পুরাতন ফুলছড়ি ঘাট ও নয়া ঘাটের লাইনের মধ্যবর্তী স্থানে বহু লোককে খান সেনারা হত্যা করেছে। বগুড়া জেলার শরিয়াকান্দি থানার লোকদেরও ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয়েছে। নলডাঙ্গায় আওয়ামী লীগ নেতা একরাম উদ্দিনম,রংপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী শ্রী বিজয়চন্দ্র মৈত্র, তার দু’ছেলে এবং গফুর নামক এক ব্যক্তিক্যা হত্যা করা হয়েছে।
সুন্দরগঞ্জে একদিন সভার কথা বলে ডেকে এনে চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনকে হত্যা করা হয়। সাইমাগঞ্জের একটি বর্ধিঞ্চু পরিবারের তিনজনকে খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে ক্যাম্পে ডেকে এনে হত্যা করা হয়েছে। তারা নাকি মুক্তি সেনাদের সহায়তা করতো।