৭.৩৮.৮৪-৯২
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩৮।জাতির উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষন | পাকিস্তাব এ্যাফেয়ার্স ওয়াশিংটন দূতাবাসের বিশেষ সংবাদ বুলেটিনঃ ৩০শে জুন | ২৮ জুন, ১৯৭১ |
২৮শে জুন ১৯৭১ তারিখে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের পূর্ণ ভাষ্য
আমরা সকলেই পূর্ব-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে ব্যথিত। ব্যক্তিগতভাবে এই দুঃখজনক ঘটনায় আমি মর্মাহত এবং হতাশ। বিগত আড়াই বছরে আমার লক্ষ ছিলো, দেশে গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চলের জন্য সমতা প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষত পূর্ব-পাকিস্তানের ন্যয়সংগত দাবির প্রতি আমি সচেতন ছিলাম। দাবিপূরনে নানা পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুর্নস্থাপনে গ্রহনকৃত আমার ব্যবস্থাদির প্রতি, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জনগন ও তাদের নেতাদের সমর্থন ছিল। ১৯৭০ এর আইন কাঠামো আদেশের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেতারাসকলেইঅংশগ্রহনকরে। যে কাঠামো সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাষন, ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম পরিচালনের জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি প্রদান করে।
আওয়ামী লীগও নির্বাচনে এই আইন কাঠামো আদেশের ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে, এবং তাই সেসময় ধারনা জন্মে, তারাও এক পাকিস্তান নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের নেতৃত্ব ধীরে ধীরে আইন কাঠামো আদেশ থেকে দূরে সরে যায় এবং পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রতি ঘৃনা, উত্তেজনা বৃদ্ধির চেষ্টা এবং দুই অঞলের ভুল বোঝাবুঝির ভিত্তিতে নির্বাচনী প্রচারনা পরিচালনা করেছে।
ছয়দফা
মুজিবর রহমানের সাথে আলোচনার সময়, আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিশ্চিত করেন, ছয় দফা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তিনি পরিষ্কার করে উল্ল্যেখ করেন, সংবিধানের সকল গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংসদের বাইরে, রাজণৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহনে মাধ্যমে মীমাংসা করা হবে। তিনি নিশ্চিত করেন, এরকম মীমাংসা রাজনীতিবিদের মধ্যে সাধারন বিষয়। নির্বাচনের পরযখন পাকিস্তানের ভবিষ্যত সংবিধান নিয়ে দলগুলোকে ঐক্যমতে আসার আহবান জানানো হয়, তখন বোঝা যায়, মুজিবর রহমান তার অবস্থান পরিবর্তন করবেন নাহ যা ছিলো বিচ্ছিন্নতাবাদেরই সমতুল্য। বারবার অনুরোধ স্বত্বেও তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে এসে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান – যা তার দূরাভিসন্ধির ইংগিত বহন করে। সমগ্র দেশের সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা হিসেবে, দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক আচরন করার কোন ইচ্ছা তার ছিলো না। তিনি ইতিমধ্যে মনস্থির করে ফেলেছিলেন, চাতুর্য বা সহিংস উপায়ে তিনি দেশকে দুইভাগে ভাগ করবেনই।
আমি আমার ২৬শে মার্চের ভাষনে উল্লেখ করেছি, ১৫ই মার্চ পরবর্তী আমার ঢাকা সফরের সময়, মুজিবর রহমান ও তার উপদেষ্টাদের সাথে একাধিক বার আলোচনায় বসি। আমাদের সাথে আলোচনার সময়, সে ও তার অনুসারীরা গোপনে সহিংস উপায়ে চূড়ান্ত ভাঙ্গনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আলোচনার শেষ পর্যায়ে, পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা যায়, এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে মীমাংসায় পৌছানো, মুজিবর রহমান ও তার অনুসারীদের উদ্দেশ্য নয়। বরং তারা আমার কাছ থেকে একটি ঘোষনাচায়, যা প্রকৃতপক্ষে জাতীয় অধিবেশনকে দুইটি প্রাদেশিক অধিবেশনে বিভক্ত করে ফেলবে, কনফেডারেশনের জন্মদিবে এবং জরুরী অবস্থা (মার্শাল ল) অপসারণের মাধ্যমে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করবে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে, পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন তার উদ্দেশ্য ছিলো। যা বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতির পিতার তৈরী পাকিস্তানের শেষ পরিনিতি ডেকে আনবে।
অকার্যকর আওয়ামী লিগের বিবেকবর্জিত ও বিচ্ছিন্নতাবাদি অংশ দেশকে ভাঙনের কিনারায় নিয়ে এসেছে। উপমহাদেশের মুসলিমদের আশা ও ক্লান্তিহীন সংগ্রামের ফসল, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ ভাঙনের আশংকায়। শেখ মুজিবর রহমান ও তার সমর্থক গোষ্ঠীর তিন সপ্তাহের তীব্র (সহিংস) অসহযোগ আন্দোলনের সুযোগে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দল লুটতরাজ, অগ্নি সংযোগ ও হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়েছে।
ভোটের উদ্দেশ্য প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাষন, স্বাধীনতা নয়
পূর্ব-পাকিস্তানের জনগন প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাষনের জন্য ভোট প্রদান করেছে, দেশের ভাঙনের জন্য নয়। বিতর্কিত রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয় জাতীয় স্বার্থে পারস্পারিক আলোচনা ও আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমাধান না করে, অকার্যকর আওয়ামী লিগের কিছু নেতা বিদ্রোহ, অসহযোগ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের পথ বেছে নেয়। আমার সকল প্রচেষ্টা স্বত্তেও, অকার্যকর আওয়ামী লিগের কিছু নেতাদের অসহযোগিতার জন্য গ্রহনযোগ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী সাংবিধানিক কাঠামো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যমতে আসতে ব্যর্থ হয়। একদিকে আপোষহীন ও অনমনীয় অবস্থানের মাধ্যমে তারা আলোচনাকে থমকে দেয়, অন্যদিকে সরকার-বিরোধী দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকান্ড তীব্রতর করে তোলে।আমাদের হাজারো ভাইয়ের জীবন এবং লক্ষ মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগের ফলশ্রুতিতে জন্ম যে রাষ্ট্রের, তার অস্তিত্বই ঝুকির মুখে। এমতাবস্থায় আমি সেনাবাহিনীকে সরকারের কর্তৃত্ব পুনারোদ্ধারের নির্দেশ প্রদান করি। কোন সরকারই দেশকে সশস্ত্র রাষ্ট্রবিরোধি বিদ্রোহিদের কাছে ধ্বংস হতে দেবে না।
সর্বদাই জাতির সেবায় নিবেদিত সাহসী পাকিস্তান সেনাবাহিনী, দুর্বৃত্তদের দমনের দৃঢ় সংকল্পে অভিযান শুরু করে। তাদের কাজ সহজ ছিলো নাহ। দুখজনক, আমাদের প্রতিবেশী, যারা সর্বদাই আমাদের দেশকে দুর্বলতর বা বিকল করায় সচেষ্ট, পরিস্থিতিকে আরো উসকে দিতে, দ্রুত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহয়তায় এগিয়ে আসে– যা ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। আমাদের বাহিনীর অভিযানের ফলে আওয়ামী জংগী, বিদ্রোহী এবং আমাদের বৈরী প্রতিবেশীর ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, বিচ্ছিন্নতাবাদি, দুর্বৃত্ত, বিদ্রোহী ও সীমান্ত পারের অনুপ্রবেশকারীরা দীর্ঘ সময় ধরে সর্তকতার সাথে পরিকল্পনা করেছে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধবংস আর পূর্বাঞ্চলকে বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য।দুর্বৃত্ত, বিদ্রোহী ও সীমান্ত পারের অনুপ্রবেশকারীরা যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, তখন ভারতীয় বেতার ও সংবাদ মাধ্যম পৃথিবীবাসীকে বিভ্রান্ত করতে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়। ভারতীয় সরকার কূটনৈতিক আক্রমন, সশস্ত্র অনুপ্রবেশ, ও আক্রমনের হুমকি সহ প্রতিটি দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে। আমাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে এরকম প্রকাশ্য হস্তক্ষেপের পরিনতি ভয়ংকর হতে পারতো; কিন্তু খোদার ইচ্ছায়, আমাদের সেনাবাহিনী দেশ-বিরোধীদের দমন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে। জাতি সেনাবাহিনীর ভূমিকায় গর্বিত। আমারা সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরন করি, যার জন্য আমাদের দেশ ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেয়েছে।
নতুন নির্বাচন নয়
আমার শেষ ঘোষনায়, আমি আশ্বস্ত করেছিলাম, আমার লক্ষ্য ক্ষমতা হস্তান্তর এবং আমি আরো আশ্বস্ত করেছিলাম, লক্ষপূরণে আমি নতুন পদক্ষেপ নিবো। আমি স্পষ্টভাবে প্রথমেই বলতে চাই, কোন নতুন নির্বাচনের প্রশ্নই উঠে নাহ। কিছু বিপথগামী ব্যাক্তির দুস্কৃতির জন্য বিপুল অর্থ, সময় ও শক্তি ব্যয়ে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম নির্বাচনের ফলাফলকে সম্পূর্নরুপে বাতিল ওঘোষনা করা হবে নাহ। যদিও আওয়ামী লিগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে, আমি নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছি, কিন্তু এই বাতিলকৃত দলের সদস্য যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তাদের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে। যদিও যেসকল নির্বাচিত-সদস্য রাষ্ট্রবিরোধী বা অপরাধমূলক বা সমাজবিরোধী কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন, তাদের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ আমি বাতিল ঘোষনা করবো। এখন পর্যন্ত আমি বাতিল ঘোষনা করা হবে এমন সদস্য সংখ্যা নিরুপন করিনি। আমূল তদন্তের পর, এই রূপ ব্যাক্তিদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
তারপর শূণ্য আসনে, প্রচলিত নিয়মে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ইতিমধ্যে, আমি, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে, বাতিলকৃত আওয়ামী লিগ হতে নির্বাচিত সদস্যদের, যারা দলের নেতৃস্থানীয়দের বিচ্চিন্নতাবাদি নীতির সাথে জড়িত নন এবং যারা উক্ত নীতির সমর্থনে কোন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে দোষী নন বা যারা অন্য পাকিস্তানীদের প্রতি কোন সহিংস আচরন করেন নাই, তাদের আহবান জানাবো যেনো তারা পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামো পূর্নগঠনে অংশগ্রহণ করেন।
নিবিড় ও সতর্করুপে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন, বিশেষত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, সংবিধান প্রনয়নের দায়িত্ব, পরিষদের হাতে ন্যস্ত করা সমীচিন নয়। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশে সংবিধান প্রনয়নের ইতিহাস সুখকর বা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সংবিধান প্রনয়নে দুইটি পরিষদ নয় বছর সময় নিয়েছে (১৯৪৭-১৯৫৬)। পরিষদের সভায় দেশের নেতৃবৃন্দ সংবিধান প্রনয়নে মাত্রারিক্ত সময়ক্ষেপন করেছে, অথচ জরুরী সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা অনালোচিত ও অবহেলিত রয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের সবথেকে দুঃখজনক ঘটনা হল এটি সবরকমের প্রাদেশিক অনুভূতি ও সংকীর্নতাকে বিকশিত করেছে। সব’চে আক্ষেপের বিষয়, সংবিধান প্রনয়ন পাকিস্তানে নোংরা রাজনৈতিক কলহ ও চক্রান্তের জন্ম দিয়েছে যার ফলে দেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে। এবং অবশেষে ১৯৫৬ সালে তারা যে সংবিধান প্রনয়ন করেছে; তা ছিলো নানা ধরনের সাংঘর্ষিক আপোষ ও সুবিধার ফলাফল। ফলশ্রুতিতে, অচিরেই সংবিধান লুপ্ত করে অক্টোবর ১৯৫৮ থেকে জুন ১৯৬২ পর্যন্ত দেশে মার্শাল ল জারি হয়। পরবর্তীতে যে সংবিধানের অধীনে দেশ শাষন করা হয়, তা বোধগম্য কারনেই জনপ্রিয় ছিলো নাহ। ১৯৬৯ এ সংবিধানের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃনা ও রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়। তাই, আমি চেয়েছিলাম, জনগনের প্রতিনিধিরাই সংবিধান প্রনয়ন করুন, কিন্তু পাকিস্তানে সংবিধান প্রনয়নের পূর্ববর্তী ব্যার্থতার পুনরাবৃত্তি রোধে, আমি ১২০ দিনের সময় বেধে দেই। এবং আমি আমার আইনি কাঠামো আদেশে সংবিধানের জন্য কিছু মূলনীতি ও নির্ধারন করে দেই। মুজিবর রহমান সহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষেই, ১২০ দিনের সময়সীমা নির্ধারন করা হয় এবং আশা করা হয়েছিলো, সংবিধান গঠনেই তারা পূর্ণ মনোযোগ দিবে ও সাধারন পরিষদের বাইরেই সংবিধানের প্রধান বিষয়গুলোতে ঐক্যমতে আশা যাবে যাতে নির্ধারিত সময়ে সংবিধান প্রনয়ন শেষ হয়। কিন্তু বাতিলকৃত আওয়ামী লিগের আপোষহীন ও দেশপ্রেমহীন মনোভাবের কারনে আমার আশা ও পরিকল্পনা ধুলিস্যাত হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞবৃন্ধ কর্তৃক খসড়া সংবিধান প্রনয়ন
এই পরিস্থিতে ও বর্তমান অবস্থার নিরিখে, বিশেষজ্ঞদের দ্বারা খসড়া সংবিধান প্রনয়ন ছাড়া আমি অন্যকোন বিকল্প দেখছি না। জাতীয় পরিষদ এই সংবিধানে বর্ণিত সংশোধনবিধি অনুসারে সংবিধানের সংশোধন করতে পারবে। একাধিক সংবিধানের নিবিড় পর্যালোচনা এবং বিগত দুই বছরে আমার দেখা পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে এই সংবিধান প্রনীত হবে। ইতিমধ্যে গঠিত সংবিধান কমিটি তারা খসড়া সংবিধান প্রনয়ন শুরু করছে।খসড়া সংবিধান প্রনয়ন সমাপ্ত হলেই, আমি জাতীয় পরিষদের নেতাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করবো। বিশেষজ্ঞ ও নেতাদের পরামর্শ ও আমার সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সংবিধান চূড়ান্ত করা হবে।
আমি আরো উল্ল্যেখ করতে চাই, ১৯৭০ এর আইন কাঠামোতে ভবিষ্যত সংবিধানের বিষয়ে কিছু নির্দিষ্ট নির্দেশাবলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো, যা জনগনের ও পছন্দ ছিলো। প্রথমত, পাকিস্তানের সংবিধানের ভিত্তি হবে ইসলামী আদর্শ, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠন করা হয়েছিলো এবং যা আজো পাকিস্তানের চালিকাশক্তি। এ সংবিধান হবে প্রকৃত পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধান।
সংবিধান সমাজের সকল শ্রেনীর জন্য পূর্ণ সামাজিক ও আর্থিক ন্যায়বিচার ও নিশ্চিত করবে। সংবিধানের প্রকৃতি হবে কেন্দ্রীয় চরিত্রের। আইন কাঠামোতে যেমন উল্ল্যেখ করা হয়েছিলো, প্রদেশগুলো আইনগত, প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়াদী সহ সর্বোচ্চ স্বায়ত্বশাষন পাবে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের আইনগত, প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাসহ, বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীন দায়িত্ব পালন ও দেশের স্বাধীনতা ও ভূ-তাত্তিক অখন্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা থাকবে।
শূন্য ঘোষিত আসনে উপ-নির্বাচন
আমি কমিটিকে জানিয়েছি, দেশের অখন্ডতার স্বার্থে, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে আবদ্ধ ও বাস্তবঅর্থে জাতীয় নয় এমন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করতে। আবার, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে একই দলের মধ্যে একাধিক উপদলের সৃষ্টি যেনো না হয়। সংক্ষেপে আমার আশা, আমাদের রাজনীতিকে ভংগুর, অস্থির, নিরাপ্ততাহীন ও দেশবিরোধী করে তোলে এমন সবকিছুকে এ সংবিধান উচ্ছেদ করবে এবং রাজনীতিবিদ ও সাধারন মানুষের মধ্যে সঠিক চেতনার উম্মেষ ঘটাবে। সংবিধান কোন বিশেষ ব্যাক্তি বা দলের নয় বরং সমগ্র পাকিস্তানের উদ্দেশ্য সাধন করবে। সংবিধান, কেন্দ্রের শক্তি হ্রাস না করে ও জাতির অখন্ডতা বজায় রেখে, প্রতিটি প্রদেশের সঠিক পন্থায় উন্নয়ন নিশ্চিতকরবে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন থেকেই এই সংবিধান কার্যকর হবে।উপ-নির্বাউন জাতীয় নির্বাচনের ন্যায়, ১৯৭০ এর অধ্যাদেশ অনুসারেই অনুষ্ঠিত হবে।
ভবিষ্যত সংবিধান সম্পর্কে আপাতত এতটুকই, এখন আমি ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসন পূরনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জনগনের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে, আমি নিশ্চিত উপ-নির্বাচনের প্রচারনা, আইন কাঠামো অধ্যাদেশ অনুসারেই হবে। পাকিস্তানে অখন্ডতার প্রতি হুমকিজনক কোন প্রচারনাই কেউ সহ্য করবেনা। আমি মনে করি, প্রচারনা সংক্ষিপ্ত হওয়াই বাঞ্চনীয়। এসকল নির্বাচনের পর, যথাসময়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সভা আহবান করা হবে এবং দেশের সর্বত্র জাতীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হবে। জাতীয় পরিষদকে সংবিধান-গঠনের জন্য কাজ করতে হবেনা বরং শপথ গ্রহনের পর থেকেই তারা কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ হিসেবে কাজ করবে।
জাতির সাম্প্রতিক ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা বিবেচনা করে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিছু সময়ের জন্য জাতীয় ও প্রাদেশিক সরকার, সামরিক শাসনের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। বাস্তবে, বর্তমানের ন্যায় সামরিক শাষণ না থাকলেও, আমরা দেশের কোথা বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে দিতে পারি না। এবং পরিস্থিতি শান্ত হবার আগে সরকারের শক্তি বৃদ্ধির ও প্রয়োজন রয়েছে।
নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে, আইন কাঠামো অধ্যাদেশের যথাযথ সংশোধন করা হবে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়কাল
আমি এখন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়কাল সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। একথা পরিষ্কার যে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা এখনই সম্ভবপর নয় কেননা ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে চিন্তার পূর্বে দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসা জরুরী। কিন্তু অন্যদিকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অযথা কালক্ষেপন ও কাম্য নয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে প্রধান বিবেচ্য, আইনের শাসন পুনরোদ্ধার, বিধস্ত প্রশাসনিক কাঠামোর পুর্নস্থাপন এবং অর্থণৈতিক পুর্নবাসন।
আইনের শাসনের ক্ষেত্রে, আমি আনন্দের সাথে জানাতে চাই, পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে আছে। তারা দুস্কৃতিবাজ, ষড়যন্ত্রকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের ধ্বংস করে দিয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ন স্বাভাবিক হতে আরো সময় লাগবে। জনগন ও দেশপ্রমিক নেতাদের সহায়তায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলমান আছে। দুস্কৃতিবাজ ও অনুপ্রবেশকারীদের দমনে সেনাবাহিনীকে সহায়তার মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগন দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্যের চেতনার প্রকাশ করেছে।
অসহযোগ আন্দোলনের ফলে, পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। অবাধ লুটতরাজ, আওয়ামি লিগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হুমকি, দুস্কৃতিকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের জন্য নির্দোষ মানুষদের অবর্ননীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। তাদের অনেকেই আতঙ্কিত ও নিজেদের সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদের স্বীকার। তাদের জন্য পুরো জাতি ও আমার পূর্ন সমবেদনা। তাদের দ্রুত পুর্নবাসনকে প্রাপ্য অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব না দেয়া হবে অমানবিক।আমি পুর্নব্যক্ত করতে চাই, ধর্ম, বর্ন, জাত নির্বিশেষে যে সকল পাকিস্তানি বিদ্রোহী, দুর্বৃত্ত ও অন্যদের মিথ্যা প্রচারনায় আতংকগ্রস্থ হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়েছেন, তাদের অবশ্যই তাদের ঘরে ফিরে আসতে হবে।পূর্ব-পাকিস্তানের সরকারের তাদের অভ্যর্থনা ও পরিবহনের জন্য সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছেন। আমি ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাবো, যেনো এসকল ভাগ্যহীন লোক যারা নিজেদের ঘরে ফিরে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে ও নিজেদের আত্মীয়স্বজনের সাথে পুনরায় একত্রিত হতে ইচ্ছুক, তাদের কোন বাধা দেয়া না হয়। এসকল গৃহ-হারা মানুষের পাকিস্তান প্রত্যার্পনে জাতিসংঘের যেকোন সহায়তা, আমরা আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহন করবো।
জনগনের অংশগ্রহন
আমি একটি মত শুনেছি, যা প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার পূর্বে জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সমীচিন মনে করে নাহ। আমি এই মত সমর্থন করি নাহ কেননা তা অবাস্তব ও অকার্যকর। প্রশাসনে জনগনের পূর্ণ অংশগ্রহন ছাড়া স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে পারেনা, জাতীয় জীবনের এই গুরুত্বপূর্ন দিকটি এই মতামতে বিবেচিত হয়নি।
চার মাসে ক্ষমতার হস্তান্তর
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আইনের শাসনের মৌলিক কাঠামো এবং প্রশাসনিক কাঠামোর স্তরগুলো শক্তি অর্জন সক্ষম হলেই, আমি আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করতে পারবো। বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন ও নিকট ভবিষ্যতের অনুমানে, আমার আশা ও বিশ্বাস আমি চার মাসের মত সময়ে আমার লক্ষ্য পূরনে সফল হবো। স্বভাবতই প্রকৃত সময়কাল, আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে। আমি সম্পূর্ণরুপে নিশ্চিত, দেশের অখন্ডতা ও মঙ্গল, এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের মধ্যেই নিহিত।
আমি এখন অর্থনীতির সম্পর্কে বলতে চাই। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েছে। নির্বাচনের আগের ও পরের দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতি চাপের মুখে। মার্চে পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনীতি দৃশ্যত স্থবির হয়ে পড়ে।
সেনাবাহিনীর সাফল্যজনক হস্তক্ষেপে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে ও প্রদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনর্জীবিত হয়। আমি নিশ্চিত প্রদেশের দেশপ্রমিক নাগরিকগন পূর্ন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে ও পাকিস্তানে অর্থনীতি গঠনে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনীর পাশে দাড়াবেন।
অর্থনৈতিক পুর্নবাসন ও অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এজন্য আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি যা শীগ্রই আশানুরূপ ফলাফল দিবে।
পূর্ব-পাকিস্তান হতে তীব্রহারে রপ্তানী হ্রাসের ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে গিয়েচে যা ইতিমধ্যে তীব্র চাপের সম্মুখীন।রাজস্ব আদায় ধুকছে, দেশের অখন্ডতা ও অর্থনীতির গতি সঞ্চরনশীল রাখতে, আমাদের সকল সম্পদের প্রয়োজন।
অর্থনীতির কঠিন সময় মোকাবেলা করার জন্য, সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহন করেছে যা সবসময় সুখকর নয়। আমাদেরকে অধিকতর সীমাবদ্ধতার সাথে সম্পদ ব্যবহার করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন কৃচ্ছতা ও ত্যাগ। কিন্তু এছাড়া গত্যন্তর নেই। অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের এই একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায়।
কয়েক সপ্তাহ আগে আমি আমদানি নীতি পুর্নবিবেচনা করতে আদেশ করেছি। সকল অপ্রয়োজনীয় বা বর্তমানে যে সকল পন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়, এমনকি অতিরিক্ত কোটার অধীনেও নিষিদ্ধ করেছি। সংশোধিত আমদানি নীতিতে অতিরিক্ত কোটায় উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কাচামাল ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানি করা হবে।
মিতব্যায় ও কৃচ্ছতা
আভ্যন্তরীণ খরচের ক্ষেত্রে ও সর্বোচ্চ ব্যায়হ্রাসের নীতি গ্রহন করা হয়েচে। আগামী বছরের জন্য মধ্যম মাত্রার উন্নয়ন কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে, যা আমাদের আশু ও অবশ্যম্ভাবী চাহিদার যোগান দিবে। অর্থনীতিরে পুর্নবাসন বিশেষত পূর্ব-পাকিস্তানের উপর জোর দেয়া হবে।
আমি চাই দেশ দ্রুত স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে যাক। আমাদের সম্পদ থেকেই আমাদের চাহিদা মেটাতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই ব্যয়সংকোচন। এ লক্ষে সরকার অর্থনৈতিক নীতিমালাতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করছে, কিন্তু এর সাফল্য জনগনের স্বতস্ফূর্ত সমর্থনের উপরনির্ভরশীল। চলুন জাতি হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই ধাপে আমরা মিতব্যয়ী জীবন যাপন করি এবং সকল ধরনের আড়ম্বরতাকে পরিহার করি।
বহু বছর ধরে আমাদের উন্নয়ন প্রোগ্রামের জন্য সাহায্য-প্রদানকারি দেশগুলো থেকে আর্থিক সহয়তা পেয়ে আসছি, যা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরন করি।কিন্তু দু:খের সাথে বলতে হয়, ইদানীং আর্থিক সহয়তার ক্ষেত্রে রাজনীতির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এবং পাকিস্তানের জনগনের মনে হচ্ছে, এসকল আর্থিক সহয়তা শর্তাধীন।যদি তাই হয়, তাহলে,আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি এমন কোন আর্থিক সাহায্য গ্রহণযোগ্য নয়।আর্থিক সাহায্য ছাড়া চলার জন্য আমাদের সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি,পাকিস্তানের নিজস্ব সম্পদ উন্নয়নেবেসরকারী খাত সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসবে। নিজস্ব সঞ্চয়ের অর্থ থেকে বেসরকারী বিনিয়োগ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে।
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বহিরাক্রমণ বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য পূর্বে নানান সময়ে আমরা যে সংকল্প ও দৃঢ়তা দেখিয়েছি,জাতির এই সঙ্কট কালে,আমাদের সেই একই সংকল্প ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে হবে।
আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব কঠোর পরিশ্রম ও অর্থনীতির পুনর্নির্মানের মাধ্যমে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ উৎপাদন।প্রতিটি শ্রমিক ও চাষী উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে জাতীয় প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে পারেন এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষায় অবদানরাখতে পারেন।
উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি
আসুন আমরা আজ সঙ্কল্প করি, আমারা সমষ্টিগত ও ব্যাক্তিগত পর্্যায়ে অধিক উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য চেষ্টা করবো। আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে ও স্বল্পতম সময়ে পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। এই লক্ষ্যপূরনে দেশপ্রেম ও জাতীয় সংহতির জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।সম্পর্ক ভাল রাখার জন্য আমি, শ্রমিক ও মালিক উভয়কেই অনুরোধ জানাবো।
ঝগড়া ও শত্রুতার বদলে আমরা পাস্পারিক সৌহার্দ্য ও বোঝা-পড়ার উপর জোর দেই। যেকোন মূল্যে হরতাল ও লক-আউট এড়াতে হবে।জাতীয় জীবনে এই ক্রান্তিলগ্নে দেশের উৎপাদনশীল সম্পদের এমন অপচয় সম্পূর্ণই দেশদ্রোহী আচরন। এমন দেশদ্রোহী আচরনকে ছাড় দেয়া হবে না এবং তা দমনে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
আমাদের কৃষিবিদরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অসাধারণ কাজ করেছেন।১৯৬৫ সাল থেকে খাদ্য উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধির মাধ্যমে, খাদ্যে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রান্তে নিয়ে এসেছেন। খাদ্যশস্য উতপাদনে তারা আরো উন্নতি করুক এবং একই সময়ে রপ্তানি ফসল উৎপাদনে মনোযোগ দিক, যেখানে উন্নতির যথেষ্ট সুযোগ আছে। এই উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকার প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা প্রদান করতে প্রস্তুত।
আজ আমি অকপটে আমাদের সমস্যাগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি।কিন্তু আমরা যেনো হতাশ না হই। সমস্যার একটি বড় অংশই অস্থায়ী প্রকৃতির। এটা অর্থনীতির মৌলিক শক্তিকে প্রভাবিত করেনি। কৃষি ও শিল্প উভয়ক্ষেত্রেই উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ আছে। আমাদের আজ প্রগতিশীল কৃষিবিদ, শিল্প উদ্যোক্তা ও মধ্যবিত্তের বিনিয়োগকারীদের বড় গোষ্ঠী রয়েছে।এরাই একটি দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতির মূল ভিত্তি। জাতি তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আগে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে. আমি কোন আছে আমার কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বর্তমান অসুবিধা অতিক্রম করতে সক্ষম এবং একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়পরায়ন সমাজ জন্য নির্মাণ আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখবো।
বৈদেশিক প্রতিক্রিয়া
এখন আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কে বিদেশী প্রতিক্রিয়ার উপর আলোচনা। সন্তুষ্টির বিষয় যে, গত কয়েকমাসের কঠিন পরিস্থিতিতে, বিশালসংখ্যক দেশের প্রতিক্রিয়া ছিলো সহানূভূতির;আমারা যে সমস্যা ভোগ করছি ও সমাধানের চেষ্টা করছি, তা তারা বুঝতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের ঐক্য ও অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি আমাদের বিদেশী বন্ধুদের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।একই সময়ে তারা, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপকারীদের বিরত থাকতে সতর্ক করেছেন।আমি এই সুযোগে, সরকার ও পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে এবং আমার পক্ষ থেকে তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানতে চাই।
আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুকূল প্রতিক্রিয়ায় আপ্লুত বিশেষত জাতিসঙ্ঘ ও এর সংস্থাসমূহ যারা পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ক্ষতি পূরনে আমাদের চাহিদামত যৌথ সহয়তায় সাড়া দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ত্রাণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য বিষয়ে আমরা বন্ধু সরকার এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে বর্তমানে আলোচনা করছি।
আমাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে ভারতের অব্যাহত হস্তক্ষেপের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনীতির পুনর্গঠন ও প্রাথমিকরা জনৈতিক কর্মকান্ডের পুনরারম্ভ হুমকির সম্মুখীন। ভারতের সশস্ত্র অনুপ্রবেশ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রকাশ্য উৎসাহ ও সহায়তার ফলে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এছাড়া ও ভারতের নির্ভরযোগ্য সুত্র হতে একাধিক অবন্ধুসুলভ বক্তব্যে, দাবি না মানলে, পাকিস্তানের প্রতি ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয়েচে। এই মুহূর্তে এসকল বক্তব্য ও কর্মকান্ড হতে বিরত থাকা উচিৎ যাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি না পায়।সংঘাত নয়, সংলাপের মাধ্যমেই কলহের মীমাংসা সম্ভব। রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরন দাবি করে সতর্ক ও সাবধানতা যাতে সমস্যা আরো ঘনীভূত না হয়।
আমরা শান্তিতে থাকতে চাই
আমি আগেই বলেছি, সশস্ত্র সংঘাতের ফলে কিছুর সমাধান হবেনা। আমাদের পক্ষ থেকে, আমরা চাই সব আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি ও সম্প্রীতিতে বসবাস করতে। আমরা কারো আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না এবং অন্য কেউ আমাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলেও সহ্য করবো না। তবে, যদি আমাদের উপর জোর করে পরিস্থিতি চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে আমরা আমাদের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সংহতি বজায় রাখার জন্য আমাদের দৃঢ়সংকল্পের বিষয়ে কোন ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই।
.
আমার প্রিয় দেশবাসী, শেষ পর্যন্ত আমি আবার আপনাদের স্মরন করিয়ে দিতে চাই, জাতির এই ক্রান্তিকালে আমাদের সততা ও নিষ্ঠা সাথে কাজ করে যেতে হবে, যাতে আমাদের প্রিয় দেশ প্রগতির পথে এগিয়ে যায়।কোন আত্মাহুতিই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনোরুদ্ধার ও পাকিস্তানের ঐক্য থেকে বড় হতে পারে না। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়, যে উৎসাহ ও আত্মিক শক্তির বলে আমরা পাকিস্তান প্রতিষ্টা করেছিলাম, তা পুর্নজীবিত করতে হবে এবং সংকল্প ও অটল ইচ্ছায় প্রদর্শণ করতে হবে যার ফলশ্রুতিতে আমরা আগে একাদিকবার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক হুমকি থেকে দেশকে রক্ষা করেছি।
আমাদের শত্রুরা আমাদের জনগনের মধ্যে অনৈক্যের মিথ্যা আশায় আন্দোদিত।তারা আমাদের প্রিয় দেশকে ধ্বংস করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, কিন্তু তারা আছে ভুলে গেছে, তারা এমন জনগোষ্ঠী সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত যারা সর্বশক্তিমানের ঈশ্বরের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। আমার যেনো এই কঠিণ সময়ে আমাদের প্রমাণ করতে পার, আমাদের জাতির জনকের প্রত্যাশা পূরন করতে পারি, এবং আমাদের শত্রুদের প্রমান করে দিতে পারি, আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র, যা তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাত ও অশুভ উদ্দেশ্যকে ধ্বংস করতে করতে সদা-প্রস্তত, এবং আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা, তাদের জন্যই দুর্যোগ ডেকে আনবে।
আমার জনগণের দেশপ্রেম পূর্ণ বিশ্বাস আছে এবং আমি নিশ্চিত যে প্রতিটি পাকিস্তানী আমাদের লক্ষ্যপুরনে যথা – দেশে গণতন্ত্র পুন: প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতিরক্ষা এবং সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে আমাকে সর্বান্তকরণে আমাকে সহযোগিতা করবে। ঈশ্বর আমাদের প্রচেষ্টাকে সাফল্যমন্ডিত করুন। ঈশ্বর আপনাদের সকলের মঙ্গল করুন।