তথাকথিত পাকিস্তান বেতার ঢাকা

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্ৰ থেকে প্রচারিত বাংলা অনুষ্ঠানমালার আরও কয়েকটি কথিকা। ‘বেতার বাংলা’।

মার্চ ও এপ্রিল,

——

১৯৭১

১৯৭২

তথাকথিত পাকিস্তান বেতার ঢাকা

        ঢাকা বেতার কেন্দ্র এখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। না, গ্যাস চেম্বার কিম্বা সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বেতার কর্মচারীদের হত্যা করা হচ্ছে না। মিথ্যে প্রচারকে জিইয়ে রাখবার জন্য তাদের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। এবং এই প্রয়োজনটুকু না থাকলে বেতারের সঙ্গে জড়িত সবাইকে মানবতার বর্বরতম শত্রু ইয়াহিয়া সরকার এতদিনে নিশ্চয়ই হত্যা করতো। তবু বলছি ঢাকর বেতার কেন্দ্র এখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। সেখানে বিবেককে, সত্যকে, সাড়ে সাত কোটি বাংলার মানুষের বক্তব্যকে বেয়নেটের পাশবিক আক্রমণে প্রতিদিন হত্যা করা হচ্ছে। এর চেয়ে জঘন্যতম কনসেন্ট্রেশন আর কি হতে পারে?

        ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ-এর পর যদি কারো কারো বেতার কেন্দ্রে যাওয়ার দুর্ভাগ্য হ’ত তা হলে দেখতে পেতেন সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক সামী কোরায়শীর সেক্রেটারীয়েট টেবিলের উপর দ্বিতীয় আর একটি টেলিফোন শোভা পাচ্ছে। সাধারণ টেলিফোনের থেকে এর গড়ন সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। এই টেলিফোন থেকে একটি মাত্র জায়গায় যোগাযোগ করা যায় এবং সে জায়গাটা হচ্ছে কসাইদের সুরক্ষিত ক্যান্টনমেন্ট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন? কেন এই ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক টেলিফোন লিঙ্ক-এর এই আলাদা ব্যবস্থা? ঢাকার বেতারে আরও ৬ জন সিনিয়র সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আছেন। কিন্তু কেনই বা বেছে সামী কোরায়শীর কক্ষে এই টেলিফোনের ব্যবস্থা করা হল? যদিও তিনি অনেক জুনিয়র- এর একমাত্র উত্তর সামী কোরায়শী পশ্চিম পাকিস্তানী। অতএব, তিনি কসাই সরকারের একনিষ্ঠ পদলেহী। অবশ্য সামী কোরায়শী ছাড়াও ঢাকা বেতারে আরও এমন কয়েকজন দালাল রয়েছে যারা সামরিক স্বার্থের লালসায় বর্বরতার গ্যাংরিনে আক্রান্ত শত্রুদের পদলেহন করছে। বাংলার মানুষের ন্যায়দণ্ড তাদেরকে কোনদিনই ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করতে পারে না।

        এ থেকে আর একটি সত্য আগুনের মতো জ্বল জ্বল করে ওঠে। আর সেটা হচ্ছে কসাই সরকার বাঙালীদের কোনক্রমেই বিশ্বাস করতে পারছে না, বাংলার মুক্তিকামী মানুষদের নিয়ে তারা সর্বদাই সন্ত্রস্ত। অবশ্য এটা অত্যন্ত পুরোনো সত্য। কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে- এত অবিশ্বাস, এত সন্ত্রস্ততা, এত আতঙ্ক সত্ত্বেও বর্বর সরকার মিথ্যে প্রচারের প্রলেপ বুলিয়ে তাদের কুৎসিৎ মানসিকতাকে চাপা দেয়ার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। তাই রেডিও পাকিস্তানের খবরে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, অমুক জায়গায় জনসাধারণ কসাইদের ভাষায় দুষ্কৃতকারীদের ধরিয়ে দিয়েছে। একদিকে তারা প্রচার করছে শান্তি কমিটির কথা, অন্যদিকে প্রচার করছে দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তাই যদি হবে তাহলে শান্তি কমিটির প্রয়োজন পড়ল কেন? কেন নানা ধরনের মিথ্যে প্রচারণার বেসাতি? কেনই বা বার বার প্রচার করা হচ্ছে আপনারা সবাই কাজে যোগ দিন? এর উত্তর বাংলার মানুষ জানে। নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই।


[১৯৭১-এর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বেতারের কয়েকজন কর্মীসহ আশরাফুল আলম শত্রুকবলিত ঢাকা বেতার কেন্দ্র ছেড়ে মুজিবনগরের স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেন। এই কথিকাটি ১৯৭১-এর ৯ই জুন স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়েছিল- বেতার বাংলা, ১৯৭২]

বলছিলাম ঢাকা বেতারের কথা। কিভাবে সেখানে ন্যায়কে, সত্যকে হত্যা করা হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে আসছি। দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় মতামত- শক্র কবলিত ঢাকা বেতারের একটি নিত্যকার অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে কি সত্যি কথা প্রচার করা হয়? এর উত্তর জানতে হলে পত্রিকা অফিসের কথা জানা প্রয়োজন। বর্বর জঙ্গীশাহী বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকীয় বিষয় টেলিফোনে জানিয়ে দেন। এবং সেইসব বিষয়ের উপর সম্পাদকীয় লেখা হয়ে থাকে। এরপর লিখিত বক্তব্য ছাপাবার আগে সামরিক কর্তৃপক্ষ পুনরায় সেটা অনুমোদন করেন।

        পত্রিকার সমস্ত সংবাদ ঠিক একই নিয়মে ছাপা হয়-শুধুমাত্র তারিখ, পত্রিকার নাম এবং সম্পাদকের নাম ছাড়া। বিবেকহীন নির্মম বেয়নেট সত্যকে লংঘন করে যে পত্রিকার জন্ম দেয় তাদের আর যা-ই থাক বিন্দুমাত্র সত্যের প্রয়াস থাকে না। তাই দৈনিক পত্রিকার মতামত একটি জাল অনুষ্ঠান। ঢাকা বেতারে এ ধরনের অনেক জালিয়াতি চলছে। ২৫শে মার্চের পরও আমি ঢাকা বেতারে কিছুদিন কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে ছিলাম পরে ও-বি সেকশনে লোক না থাকায় সেই সেকশনে আমাকে দেয়া হ’ল। ও-বি অর্থাৎ আউটসাইড ব্রডকাষ্ট সম্পর্কে বলার আগে পত্রবিতান’ অনুষ্ঠানটির কথা না বলে পারছি না। ২৫শে মার্চের পর প্রথম যেদিন পত্রবিতান প্রচার করা হ’ল তার দুদিন আগে এই অনুষ্ঠানটির স্ক্রীপ্ট লেখা এবং পড়বার জন্য একটা নির্দেশ পেলাম। সেই সঙ্গে আমাকে কয়েকটা চিঠি দেয়া হ’ল। পত্রবিতান অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের চিঠিপত্রের জবাব দেয়া হয়। সেই চিঠিগুলোর তারিখ দেখে অবাক হয়ে গেলাম, চিঠিগুলো ১৯৭০ সালের। আরও অবাক হলাম চিঠিগুলোর উপরে লেখা রিপ্লাই’ অর্থাৎ ৭০-এর কোন এক সন্ধ্যায় এই চিঠিগুলোর জবাব দেয়া হয়েছে। এর পরের ঘটনা আরও মারাত্মক। দ্বিতীয় সপ্তাহে আবার পত্রবিতান অনুষ্ঠান-এর পালা এলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষও একটু চিন্তায় পড়লেন, শেষ চেষ্টা হিসেবে আমাকে পুরোনো কিছু চিঠি খোঁজ করতে বললেন। দোতলার একটা অফিসরুমে গিয়ে দেখলাম আলমারির পাশে মেঝেতে অসংখ্য চিঠি পড়ে আছে। এত চিঠি? একটু অবাক হবারই কথা। চিঠিগুলো ১৯৭১ সালেরই, কিন্তু ২৫শে মার্চের আগের কথা। একটার পর একটা চিঠি পড়তে লাগলাম। প্রত্যেকটা চিঠির বক্তব্য প্রায় একই ধরনের। এক সময় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামকে পূর্ণভাবে সমর্থন করে যেসব অনুষ্ঠান, সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল তারই প্রশংসায় ভরপুর। একটা চিঠির এক জায়গায় পড়লাম বাংলার মানুষের বক্তব্যকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার করার জন্য ধন্যবাদ- অনুষ্ঠানগুলি শুনিলে এত আনন্দ লাগে যে, আমার মায়ের মৃত্যুশোকও আমি ভুলিয়া যাইতে পারিব।”

        প্রতিটি চিঠিই অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বক্তব্য ছাড়াও কুটিল ভুট্টো ও প্রধান কসাই ইয়াহিয়ার কঠোর সমালোচনায় ভরা ছিল।

        দোতলার সেই কক্ষে যখন চিঠিগুলো পড়ছিলাম পাশের কোন রুম-এর স্পীকার থেকে পাকিস্তানী খবরএর বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারী, দেশের প্রধান শত্রু শেখ মুজিব এইসব শব্দ ভেসে আসছিল, আমি তখন যে চিঠিখানা পড়ছিলাম তাতে অল্প বয়সের একটি ছেলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা অক্ষরে লিখছে-

“এয়ারপোর্ট-এ ইয়াহিয়া খান আসলে তাকে তো বাচ্চা ছেলের দ্বারা মালা দিয়ে স্বাগত জানান হয়, তাই না? জানেন আমাকে যদি তাকে মালা দেয়ার জন্য নেয়া হত তাহলে লুকিয়ে একটা পিস্তল নিয়ে যেতাম আর মালার বদলে তাকে গুলি করে মারতাম।”

        এইসব চিঠি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে দেখালাম। কিন্তু এ দিয়ে তো আর পত্রবিতান’ অনুষ্ঠান চলে না। জনৈক কর্তব্যক্তি নির্দেশ দিলেন কিছু মিথ্যে ঠিকানা দিয়ে সমস্ত স্ক্রীপ্ট লিখতে। ক্ষমা করবেন, আমি লজ্জিত। সেই নির্দেশ মত স্ক্রীপ্ট লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম এবং তা যথারীতি সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় প্রচার করেছিলাম। তারিখটা আমার স্মরণ নাই। ২৫শে মার্চের পর মে মাসে দ্বিতীয় যেদিন পত্রবিতান অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় সেই দিনের কথা বলছি। ঐ দিনের চিঠির সত্যতা সম্পর্কে যে কোন শ্রোতা শত্রুকবলিত ঢাকা বেতার কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। সেই দিনের পত্রবিতান অনুষ্ঠানে যেসব শ্রোতার চিঠির উত্তর দেয়া হয়েছে তাদের সেই ঠিকানায়

বেতার কর্তৃপক্ষ কোনদিনই তাদেরকে খুঁজে বের করতে পারবে না। কারণ, নাম-ঠিকানা সবই কাল্পনিক ছিল।  সেই দিনের পত্রবিতানে এমন অনেক কাপ্পনিক শ্রোতার চিঠির উত্তর দেয়া হয়েছিল যারা নাকি কষ্টিপাথর, প্লেইন ট্রথ, ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে প্রভৃতি অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেছেন। কি ভয়ঙ্কর জালিয়াতি।

ঢাকার আউট ব্রডকাষ্ট সেকশনকে ‘ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে’ এই শীর্ষক অনুষ্ঠানটি প্রযোজনা করতে হ’ত।  ঢাকা এবং তার আশেপাশে যে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে তারই উপর শত্রু দের ভাষায় প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচার করা হত। যেমন ট্রেন কেমন চলছে কিংবা ফ্যাক্টরী কেমন চলছে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার। আর ওই সাক্ষাৎকারগুলো নিতে আমাকেই যেতে হত। গেল মাসের প্রথম দিকের কথা। পোরটেবল রেকর্ডিং মেশিন নিয়ে কমলাপুর ষ্টেশনে গেলাম। সমস্ত ষ্টেশন খাঁ খাঁ করছে। ডিকেড অব রিফর্মস-এর ভাষায় এশিয়ার বৃহত্তম ষ্টেশনের এ কি পরিণতি! জনহীন নিস্তব্ধতায় চারদিক থম থম করছিল। মনে হচ্ছিল নির্জনতার দ্বারা সমস্ত ষ্টেশনটা লাঞ্ছিত। টিকেট কাউন্টারের পাশের বিরাট চত্বরটার উপর দিয়ে একমাত্র আমিই প্ল্যাটফর্মের ভেতর প্রবেশ করলাম। দু’একজন উর্দুভাষী টিকেট কালেক্টর ও দু’একজন অন্যান্য কর্মচারী প্ল্যাটফর্মে অকারণ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দূরে দেখতে পেলাম লাইনে দাঁড়ানো নিস্তব্ধ কতগুলো কম্পার্টমেন্ট। জানালাগুলো বন্ধ। দেখলেই বোঝা যায়, বহুদিন চাক্কা ঘোরেনি। প্রথমে স্টেশনের জনৈক পদস্থ কর্মচারীর সাক্ষাৎকার নিলাম। বুঝতে পারলাম তিনি নিরূপায় হয়েই ইন্টারভিউ দিলেন। প্যাসেঞ্জারদেরও সাক্ষাৎকার নিতে হবে। কিন্তু প্যাসেঞ্জার পাব কোথায়? ষ্টেশনের কয়েকজন কর্মচারীকে প্যাসেঞ্জারের ভূমিকায় অভিনয় করালাম। তারা সবাই উর্দুভাষী। বাংলাও মোটামুটি বলতে পারেন। ষ্টেশনের সেই পদস্থ কর্মচারীই ব্যবস্থা করে দিলেন। সাইডিং-এ একটা ইঞ্জিন দাঁড় করানো ছিল। সেখান থেকে সাউণ্ড এফেক্ট সংগ্রহ করলাম। যথারীতি ট্রেন চলাচলের উপর প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচার করা হল। অথচ যবনিকার দুয়ারে যে অভিনয়টুকু করান হ’ল, যে সাজান মিথ্যে কথাগুলো বলান হ’ল তার হিসেব কে রাখে? এরি নাম প্রামাণ্য অনুষ্ঠান! বেয়নেটের আগায় অনেকেই বাধ্য হয়ে সাজানো সাজানো কথা তোতাপাখির মত আউড়ে গেছে। এবং সেই সব সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান ফলাও করে “ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে” শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। বর্বর ইয়াহিয়া সরকার এর মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাইছেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। প্রসঙ্গতঃ একটা কথা বলে রাখি, ঢাকা শহরে একটা মাত্র কারখানা পুরোদমে চলেছে। আর তা হচ্ছে ঢাকা বেতার। যেখান থেকে প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে মিথ্যে” ম্যানুফ্যাকচার করা হয়।

মে মাসের ৮ তারিখে স্কুলগুলো খোলার জন্য বর্বর সরকার নির্দেশ দিয়েছিল। তিন-চারটে স্কুলে সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু কোন স্কুলে ছাত্র দেখতে পাইনি। ঢাকার কোন এক নামকরা স্কুলের গেটে দেখলাম জনা ৫/৬ ছেলে জটলা করছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম তারা ক্লাশ করতে আসেনি। এবং তারা ক্লাশ করবেও না। এমন কি স্কুলবাড়ির ভিতরে ঢুকতেও তারা ভয় পাচ্ছিল। কারণ যে কোন মুহুর্তে দু’পেয়ে পশুরা এসে তাদেরকে হত্যা করতে পারে। তবুও স্কুলের উপর প্রামাণ্য অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। দু’একজন শিক্ষক যাদেরকে বেয়নেটের ডগায় স্কুল খুলতে বাধ্য করান হয়েছিল তারাই সেই বেয়নেটের ভয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ক্লাশে কোন ছাত্রী নেই অথচ একজন শিক্ষয়িত্রী ক্লাশে পড়াচ্ছেন। এমনি একজন শিক্ষয়িত্রীর কণ্ঠস্বরও সেদিনের সেই প্রামাণ্য অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়েছিল অথচ ছাত্ৰীবিহীন একটি ক্লাশকক্ষে সেই শিক্ষয়িত্রী শুধু পড়ানোর অভিনয় করে যাচ্ছিলেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁকে এ ধরনের অভিনয় করতে বাধ্য করেছিল।

এরই নাম স্বাভাবিকতা, এরই নাম প্রামাণ্য অনুষ্ঠান। এবং এরই নামই জালিয়াতি৷ ডকুমেন্টারী’ নামে তারা জাল অনুষ্ঠান প্রচার করছেন। পত্রবিতান অনুষ্ঠানে তারা কাল্পনিক শ্রোতাদের চিঠিত উত্তর দিচ্ছেন, সংবাদ সেখনে ‘ম্যানুফ্যাকচার’ করা হয়, যে কোন স্ক্রীপ্ট প্রচারের পূর্বে ইংরেজীতে অনুবাদ করে সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়; কোরানের কোন কোন আয়াত এমন কি ছুরা, হাদিসের কোন কোন অংশ বা পুরো হাদিস তারা প্রচার করতে দিচ্ছেন না। বেতারের ‘প্রোগ্রাম ফাইল ঘাঁটলে এমন

অসংখ্য স্ত্রীপ্ট পাওয়া যাবে না থেকে কোরানের উদ্ধৃতি কেটে দেয়া হয়েছে। বেতার কেন্দ্রের ডিউটি রুমের আলমারিতে রাখা হাদিসের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, এমন কি কোন কোন হাদিস সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে-“আল্লাহতালা সে জাতির অবস্থা কখনই পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের অবস্থা নিজে পরিবর্তন না করে।” আল-কোরানের এই বিখ্যাত বাণীটি শত্রুর দ্বারা পরিচালিত ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে আর শোনা যায় না। মোটের উপর মিথ্যার বারুদ পুড়িয়ে ঢাকা বেতার আতসবাজির খেলায় মেতে উঠেছে। সেখান থেকে এক ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে- যাকে সহজ কথায় ছ্যাবলামো ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। ঢাকা বেতার একটা অনুষ্ঠানের নাম সোহাগ করে রেখেছে ’প্লেইন ট্রথ’। অনুষ্ঠানের বক্তব্যগুলো অনুধাবন করলে দেখা যাবে তারা কতগুলো জটিল মিথ্যের জাল বুনছেন অনুষ্ঠানটির নাম কমপ্লেক্স লাই দিলেই ভাল হত। তাই বলছিলাম- ঢাকা বেতার কেন্দ্র এখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। সেখানে বিবেককে, সত্যকে, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বক্তব্যকে বেয়নেটের পাশবিক আক্রমণে প্রতিদিন হত্যা করা হচ্ছে। এর চেয়ে জঘন্যতম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আর কি হতে পারে।(আশরাফুল আলম রচিত)

Scroll to Top