দর্পণ
১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সম্প্রতি প্রখ্যাত ফরাসী সাহিত্যক ও কূটনীতিকে মঁসিয়ে আঁদ্রে মালর বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে সংগ্রামী ভিয়েৎনামী জনগণের মত জবাব দিতে বলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে তিনি আমরণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আবেদন করেছেন।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্যে যুদ্ধ করছেন না- তাঁরা আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করছেন।
মঁসিয়ে মালর দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তাতে জয় তাদের অনিবার্য।
দ্য গল মন্ত্রীপরিষদের সংস্কৃতি দফতরের বিদগ্ধ মন্ত্রী এই প্রখ্যাত সাহিত্যিক দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসী বর্বরতা নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি জানেন যুদ্ধ কি। তিনি জানেন, অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে কিভাবে গড়ে ওঠে এবং তিনি জানেন মুক্তিযুদ্ধ কি। এই কুটনীতিক ও সংবেদনশীল মানুষটির অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। ফ্রান্সকে নাৎসী জার্মানীর কবল থেকে মুক্ত করার জন্যে একদিন জেনারেল দ্য গলকেও ইংলিশ চ্যনেল পার হয়ে ইংল্যাণ্ডে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। জেনারেল দ্য গল তখন মুক্তিযোদ্ধা-স্বদেশকে মুক্ত করার জন্যে তিনি সংগ্রাম করছেন।
আলজেরিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরাসী বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকের ভূমিকাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্যের জন্যে অনেক প্রখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিক কারাগার বরণ করেন। এ সম্পর্কে এ কালের বিবেকের অন্যতম মুখপাত্র জাঁ পল সাত্রের নাম উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সার্ত্র নাৎসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। শুধু সার্ত্র নন, ফরাসী দেশের অন্যতম প্রখ্যাত সাহিত্যিক আলবেয়র কামুও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ছাড়াও বহু প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী যুদ্ধে সৈনিক হিসাবে যুদ্ধ করেছেন কিংবা পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছেন। ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন Anglo-Spanish যুদ্ধে নিহত হন। স্পেনের কবি গার্সিয়া লোরকাও স্পেনের গৃহযুদ্ধে শহীদ হন। প্রখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন এবং প্রথম মহাযুদ্ধেরও তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সৈনিক ছিলেন মহান সোভিয়েট ঔপন্যাসিক ঋষি টলষ্টয়।
এ যুগের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আর একটি উজ্জ্বল তারকা গ্রীসের মিকিস থিওডোরাকিস। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। কিন্তু এই বিপ্লবী শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ মিকিস থিওডোরাকিস গ্রীক সামরিক জান্তার উৎপীড়নকে না মেনে নিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। গ্রীক সামরিক জান্তা তাকে বন্দী করে রেখেছে কারাগারে।…
মুক্তিযুদ্ধে শত্রুকবলিত দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক এক-একজন মুক্তিযোদ্ধা। সকলেই হয়তো রণাঙ্গনে শত্রুর সাথে প্রত্যক্ষ মোকাবেলা করেন না- কিন্তু সকলেই যুদ্ধ করছেন। কেউ নিস্ক্রিয় নয়, সকলেই সক্রিয়। চাষী, শ্রমিক, মজুর, চাকুরে, ব্যবসায়ী সকলেই যুদ্ধ করেছেন।
এই মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পীদের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকে- তারা সংগ্রামীদের মনোবল অক্ষুন্ন রাখেন, তাঁদের গান, কবিতা ও রচনার মাধ্যমে।
রণাঙ্গনে গিয়ে যুদ্ধ করার দরকার নেই কবির। কবি তখন যুদ্ধক্লান্ত যোদ্ধাদের গেয়ে শোনান দেশপ্রেমের উদাত্ত সঙ্গীত, বিজয়গাথা। রণক্লান্ত সৈন্যরা আবার নতুন বলে বলীয়ান হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে যান। কবি তখন চারণের ভূমিকা গ্রহণ করেন।
মসি ও অসির প্রাধান্য নিয়ে পুরোনো বিতর্ক সৃষ্টি করার সময় নয় এটা। মসি এখন ঝলসে উঠুক অসির মত প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতিতে।
বাংলাদেশের বেশীরভাগ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী আজ গৃহহারা। ঘাতক ইয়াহিয়া ২৫শে মার্চ রাতেই তাদেরকে খতম করতে চেয়েছিল। শিক্ষা-সংস্কৃতি বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে নরপশু ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের কোয়ার্টারগুলোতে আক্রমণ চালায়। বেশীরভাগই নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো পালিয়ে বেঁচেছেন।
কিন্তু এখনও যাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি কিংবা অসুবিধার জন্য যারা দেশের শত্ৰু-অধিকৃত অঞ্চলে রয়ে গেছেন, তারা কি করছেন- এটাই জানতে ইচ্ছে হয়। বলাবাহুল্য তারাও চুপ করে নেই। কি করে চুপ করে
থাকা যায়? চোখের সামনে মা, বোন, ভাই, বাপ, বন্ধু-বান্ধব সকলকে ঘাতকেরা হত্যা করছে। এই জল্লাদদের অকথ্য অত্যাচারে সোনার বাংলা আজ শ্মশান।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্ধন হচ্ছে ভাষার বন্ধন। বাংলা-বাংলা ভাষাভাষীর দেশ। কি করে সহ্য করা যায় বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে হানাদারদের আনাগোনা? তবু সহ্য করতে হয়। সারাদিন রাত-কাটে এক ত্রাসের মধ্যে, এক দুঃস্বপ্নের জগতে। বেয়নেটের মুখে বিপন্ন অস্তিত্ব!
শামসুর রাহমান এখন পত্রিকা অফিসের তেতলায় বসে কবিতা লিখছেন কি? তাঁর বিষগ্ন চোখ দুটোতে নিশ্চয় দশ লাখ মৃত মানুষের পুঞ্জীভূত নিম্পলক দৃষ্টি লেগে রয়েছে। দুঃখ, মহা দুঃখ! আর এই দুঃখ অহরহই নাম লিখেছে- বাংলার প্রতিটি পর্ণ কুটিরে-ভাবনার আদিগন্ত জুড়ে। …
শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন নিশ্চয় বেয়নেটের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সৃষ্টির উন্মাদনায় একের পর এক একে চলেছেন ধর্ষিতা বাংলার ছবি। আরব গেরিলা শিবিরে থাকাকালে তার তুলিতে জ্বলে উঠেছিল আগুন- আর সেই অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা পেয়েছিল আরব মুক্তিযোদ্ধারা। আমরাও সে মন্ত্রে দীক্ষা নেবার জন্যে প্রতীক্ষায় রয়েছি।
জিন্না এভেন্যুর রেস্তোরাঁতে নববিবাহিত শহীদ কাদরী কি এখনও সন্ধ্যা কাটান? রক্ত, রক্ত চায়ের কাপে, ফ্রিজের জলে। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে বৃষ্টির শব্দকেও কি তার দশ লাখ মানুষের আত্মার হাহাকার মনে হয়?..
আবুল হাসান কি এখনও হাসপাতালে পড়ে আছে? অসুখে নয়, জল্লাদের গুলীতে আহত হয়ে। নাকি সে পড়ে পড়ে ধুঁকছে কোন মেসের আলোহীন কক্ষে-আলোর প্রতীক্ষায়। … সে কি এক মিলিয়ন শবের দুঃস্বপ্নে ঘুমের মধ্যে ঘেমে ওঠে?
রফিক আজাদের অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাস নিশ্চয়ই এখন বারুদের আগুন হয়ে শত্রুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে? ….
তোমাদের মৃত্যু নেই। তোমাদের স্থান সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মনের মণিকোঠায়। বিশ্ববিবেক তোমাদের দিকে। তোমাদের ভয় কি?
জয় আমাদের হবেই। তোমাদের মসিকে করে তোল জিঘাংসু ধারালো হাতিয়ার। পড়ে পড়ে মার খাবার দিন চলে গেছে। তোমার প্রাণের ভাষা তোমার পবিত্র জন্মভূমি জননী বাংলাকে ওরা ধর্ষণ করছে। তোমরা দেখিয়ে দাও রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ কত ভয়ঙ্কর হতে পারে।
আমরা তোমাদের পাশেই রয়েছি। পশ্চিম বাংলার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে চাই –
‘মরো কিন্তু মেরে মরো এবং উদ্ধার করো ঘর
নিশ্চিত রয়েছি পাশে আমি তোর জন্ম সহোদর।”…
(রণজিৎ পাল চৌধুরী রচিত)