পাকিস্তানি দলিলপত্র: সরকারি ও বেসরকারি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র সংকলনে পাকিস্তান পক্ষের দলিল নিয়ে এই খন্ড প্রকাশ করা হল। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশপ্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের যেমন সংগ্রাম ছিল, তেমনি এই সংগ্রাম নস্যাত করার জন্যপাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীও ছিল তৎপর। স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষের দলিলাদি অন্যান্য খন্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধকে প্রতিহত করবার এবং স্বাধীনবাংলাদেশের পরিবর্তে পুরানো পাকিস্তান রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা অটুট রাখবার জন্যেপাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও তাদের সহযোগীরা ন’মাস ধরে যে কার্যকলাপ চালায় সে সম্পর্কিত দলিলপত্র এই খন্ডেঅন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই সব দলিল দুটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে; যথাসরকারী ও বেসরকারী। প্রথম অধ্যায়‘কেন্দ্রীয়’ও‘প্রাদেশিক’দুটি অংশে বিভক্ত।‘সরকারী দলিলপত্রঃ কেন্দ্রীয়’অংশে জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণসমূহ, সামরিক আদেশ জারিসহ বিভিন্নকার্যক্রম গ্রহণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার-প্রহসন, বাংলাদেশের প্রতিঅনুগত সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের প্রতি দন্ডাজ্ঞা ঘোষণা, তথাকথিতবিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রণীত শাসনতন্ত্র প্রদান, বাংলাদেশে পাক সামরিক জান্তার অধীনবে-সামরিক পুতুল সরকার গঠন, প্রহসনমূলক উপনির্বাচন অনুষ্ঠান; এবং যুদ্ধ ঘোষণা, পরিচালনা ও আত্মসমর্পণ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বহির্বিশ্ব ও জাতিসংঘেপাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা, বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যসরকারী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে প্রতিনিধিদল প্রেরণ, কূটনৈতিক তৎপরতা এবংশরনার্থীদের প্রত্যাবর্তনের আহবান সম্পর্কিত দলিলপত্রও এখানে স্থান পেয়েছে। এইঅংশের শেষে একটি পরিশিষ্টে, বিশেষ করে বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য, প্রচারিত‘শ্বেতপত্র’সহ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত কয়েকটি প্রচার-পুস্তিকাও মুদ্রিত হয়েছে।
‘সরকারিদলিলপত্রঃ প্রাদেশিক’অংশেসামরিক গভর্নর লেঃ জেনারেল টিক্কা খান ও পূর্বাঞ্চলের জিওসি আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়েজীরনেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক কার্যক্রমগ্রহণ ও আইন জারি, বিভিন্ন দণ্ড ও শাস্তি বিধান, জনজীবনে ‘ স্বাভাবিক অবস্থা ও বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠার ’ চেষ্টা, শরনার্থীদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা, কুইসলিং সরকারের গভর্নর ওমন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি-তৎপরতা, প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচন অনুষ্ঠান এবংশেষে পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পনের পূর্বমুহুর্তে কুইসলিং সরকারের একযোগে পদত্যাগবিষয়ক উপাত্তসমূহ বিন্যস্ত হয়েছে।
এই খন্ডের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘ বেসরকারি দলিলপত্র ’। এটিও দুটি অংশে বিভক্তঃ‘রাজনৈতিক বিবৃতি’এবং ‘ বেসামরিক সহযোগিতা ’ । পাকিস্তানেরযে সমস্তরাজনৈতিক দল বা নেতা জেনারেল ইয়াহিয়ারসামরিক কার্যক্রম সমর্থন করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে, সংগঠন ও জোটবদ্ধ হয়েবিভিন্নভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেছে তাদের সেসব কর্মকান্ড এইঅধ্যায়ের প্রথমাংশে বিধৃত হয়েছে।
সামরিক জান্তার অভিপ্রায় অনুযায়ী স্বাধীনতাসংগ্রামের তৎপরতা নির্মুল করে‘অখন্ড পাকিস্তান’রক্ষায় নিবেদিতপ্রান সংগঠন- শান্তি কমিটি এবং রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসপ্রভৃতি বাহিনীর গঠন ও ততপরতার দলিলাদি‘বেসামরিক সহযোগিতা’অংশে সন্নিবেশিত হয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের একটি খণ্ড হিশেবেএটি পাঠের সময় অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাপাকিস্তানী পক্ষ কখনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বীকার করে নি। তাই তারা‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ও‘স্বাধীনতারসংগ্রাম’কে‘রাষ্ট্রদ্রোহীতা’, ‘সমাজবিরোধীও নাশকতামূলক তৎপরতা’মুক্তিযোদ্ধাদেরকে‘দুস্কৃতিকারী’, ‘ভারতেরচর’ও‘অনুপ্রবেশকারী’; নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ সদস্যদেরকে‘ভারতের দালাল’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, শরনার্থীদেরকে ‘উদ্বাস্তু’; স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি বিদেশী রাষ্ট্র ও সংগঠনের সমর্থনকে‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ রূপে আখ্যায়িত করেছে।
আরো উল্লেখ্য যে,সামরিক জান্তা ও তাদেরসহযোগীরা বাংলাদেশের ঘটনাবলীর দিক থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ফেরানোর জন্যে সরকারিবিবৃতি, লিপি, পুস্তিকা, প্রতিনিধিদল ইত্যাদির মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচারকরেছে যে, বাংলাদেশে পাকবাহিনী গণহত্যা চালায় নি। তারা বিদেশী সাংবাদিকদের দেখাতেচেষ্টা করেছে সেখানে‘পূর্ণস্বাভাবিক অবস্থা’বিরাজকরছে। আপাতদৃষ্টিতে এই খণ্ডে উল্লেখিত এ ধরণের পদবাচ্য ও তথ্যসমূহ বিভ্রান্তিরসৃষ্টি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রকাশিত দলিলসমগ্রের অন্যান্য খণ্ড, বিশেষকরে অষ্টম ও চতুর্দশ খণ্ড (‘গণহত্যা’ও‘বিশ্বজনমত’) এ সময়ের ঘটনাবলির স্বরূপ যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সহায়ক হবে।