দুর্জয় বাংলা
১২ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলা চিরদুর্জয়-চির দুঃসাহসী তার দূরন্ত সন্তান। বাংলাদেশের গা বেয়ে ঝরছে রক্ত আর রক্ত, বাংলা মা-বোনের বুকে দুঃসহ কান্না আর কান্না। রক্তের বদলে রক্ত নিয়ে, মার অশ্রুজল মুছিয়ে দিয়ে লাঞ্ছনা ঘুচিয়ে দিতে বাংলার দূরন্ত দুলাল আজ বদ্ধমুষ্টি। কন্টকপথে বিরামহীন যাত্রায় শ্রান্তিহীন ক্লান্তিহীন তার ব্ৰত। শপথের গান উদাত্ত কন্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত-
বাংলা মার দুনিবার আমরা তরুণদল
শ্রান্তিহীন ক্লান্তিহীন সংকটে অটল
সূর্যসেন তিতুমীরের বীর্যগরিমা
রবীঠাকুর নজরুলের ছন্দভঙ্গী
* * * *
সংগীতের মূর্ছনা শেষ হয় না ভাবাবেগের আবেশ গড়িয়ে। কারণ কঠিন বাস্তব রক্তাক্ত সংগ্রামের পথের রক্ত পথিক বাংলাদেশের লৌহদৃঢ় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর দুর্জয় সাহস আর রণকৌশলের সাহায্যে পাক-হানাদার, তার পদলেহী কুকুর রাজাকারের দল ভীতসন্ত্রস্ত। বাংলাদেশের সুদূর উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্তে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের রক্তস্বাক্ষর খোদিত।
কিছুদিন আগেই রাজশাহীর আরানী ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিফৌজ কেবল বীরত্বের পরিচয় দেয়নিদিয়েছে অসম সাহসিকতা ও রণকৌশলের পরিচয়। টহলদার পুলিশ ও রাজাকাররা অগ্রসরমান বীর সেনাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে গেলেও অধিকতর ক্ষিপ্রতার সাথে পুলিশদের কাবু করে ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে গেরিলা যোদ্ধারা সক্ষম হন। তারা কয়েকজন পুলিশকে গ্রেফতারও করেছেন, সেই সাথে কিছু মূল্যবান যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্রও হয়েছে হস্তগত। এ নহে কাহিনী এ নহে স্বপন’। সচিত্র বিবরণই তার প্রমাণ।
পাহাড়পুর-পবিত্র বৌদ্ধ বিহার ভূমি- যেখান থেকে একদিন বৌদ্ধধর্মের অহিংসার মন্ত্রধ্বনি উত্থিত হোত। হাজার হাজার তীর্থযাত্রী, পর্যটনেচ্ছ পথিক, ইতিহাসের তথ্যাভিলাষী শিক্ষক-ছাত্র যেখানে পদচারণা করেছে সবিস্ময়ে, সংগ্রহ করেছে নানান তথ্য- সেই হাজার হাজার বছরের প্রাচীন বৌদ্ধস্তুপ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে হিংসার অনল জ্বালিয়েছে পাক হানাদাররা অহিংসার পাদপীটে। ধর্মদ্বেষী সেই পাক পশুদের দশজন খতম হয়েছে মুক্তিবাহিনীর হাতে।
দিনাজপুরের গোসাইনগঞ্জে, রংপুরের কারনাইতে হানাদার রাজাকাররা গেরিলাদের অব্যর্থ নিশানার লক্ষ্যবস্তু হয়ে করেছে মৃত্যুবরণ। পেয়েছে পাপের চরম শাস্তি। সিলেট, ময়মনসিংহের রণাঙ্গন থেকেও আসছে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবর। কুমিল্লার শান্তধরে গোমতীর তীর মুক্তিসংগ্রামের রণঝনঝনায় ঝংকৃত। ময়নামতীর গুহাবাসী দানবের দল শালদা নদী অধিকার করতে এসে পেয়ে গেছে ইহলোক ত্যাগ করার ছাড়পত্র। পৃথিবীর আলো-বাতাস ভোগের অধিকার তারা চিরদিনের জন্য হারালো। কায়েমপুরের ক’জন পাকসেনার ভাগ্যে ঘটেছে একই পরিণতি।
খবর ! খবর ! নিঃশব্দে শব্দেরা কাগজের পাতায় আর নিরূপদ্রব নির্জীব খবর নয়-তাজা জীবন্ত জ্বলন্ত শব্দের স্ফুলিঙ্গ আজকের খবর। কামানের গোলা, মেশিন-গানের গুলি, মটারের ভয়ংকর শব্দ আর তারই মোকাবেলায় মুক্তিবাহিনীর তরুণ গেরিলার হাতের গ্রেনেডের সশব্দ বিস্ফোরণ, এলএমজি’র ঘন ঘন তরুণ দলের উল্লাসধ্বনি কাঁপাচ্ছে বাংলার দিগদিগন্ত। এই প্রচণ্ড সশব্দ সংবাদ শত্রুবুকে সৃষ্টি করেছে হৃদকম্পন। তাই পাক-সরকার আর সেনাবাহিনীতে লোক পাচ্ছে না নতুন করে। মুহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণে বিস্ফোরিত বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানীরা আর পদার্পণ করতে নারাজ। তারা জানে বাংলার নদী, অরণ্য, পাহাড়, গ্রামে গঞ্জে বন্দরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যুছোবল। হাতে অটোমেটিক রাইফেলই থাক আর মেশিনগান থাক- একা কিংবা দশজনই হোক- প্রতিহিংসায় গজমান ভয়ংকর সৰ্পের বিষমুখে ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সাক্ষাৎ যম বাংলার গেরিলা। তথাকথিত ‘কাফের মারা’র জেহাদী জোশ আজ মারের চোটে অন্তৰ্হিত। তাই আত্মসমালোচনার আত্মস্বরে
পশ্চিম পাকিস্তানীরা ক্ষতবিক্ষত- ২৫শে মার্চের হামলার কী প্রয়োজন ছিল? বেলুচ-পাঠান-সিন্ধীরা গালে হাত দিয়ে ভাবছে বাংলার মানুষের কী দোষ? তারা চেয়েছিল স্বাধিকার। তারা চেয়েছিল দেশের বেশিরভাগ লোকের মঙ্গল। সে মঙ্গলের আলো ছড়াতো সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতিত সিন্ধী-পাঠান-বেলুচদের ঘরে ঘরে। একদিন বেলুচরা মাথা নোয়ায়নি বলে তাদের জীবনেও নেমেছিল টিক্কা খানের পাশর অত্যাচার। ৪৮ সালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ঈদের জামাতে পাক-বাহিনী ফেলেছে বোমা। মুক্তিবাহিনীর সাফল্যই ঘরে-বাইরে পাকহানাদারদের জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে এসেছে। দুর্জয় বাংলার দুর্জয় প্রাণের জয় অবশ্যম্ভাবী।
(বদরুল হাসান রচিত)