দৃষ্টিপাত

দৃষ্টিপাত

১৪ জুন, ১৯৭১

আমাদের চোখের সামনেই যেন একটি মর্মান্তিক ইতিহাস তার পৃষ্ঠাগুলো দিনের পর দিন উন্মোচন করে দিল। আর আমরা সবাই হয়ে থাকলাম ইতিহাসের এক-একজন উজ্জ্বল সাক্ষী। সর্বযুগের, সর্বকালের এবং সর্বদেশের একটি নিষ্ঠুরতম ঘটনা, একটি অমানুষিক পৈশাচিকতা, একটি হৃদয়বিদারক, বিশ্বাসঘাতকতা

আমাদের চোখের সামনেই ঘটে গেল। আমরা চোখ দিয়ে দেখলাম, আমাদের সমগ্র অনুভূতি দিয়ে অনুভব করলাম এবং আমরা সবাই বহু ত্যাগের মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করে আবার নতুন সূর্যের অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম। নতুন দিনের আশায় আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আজ উজ্জীবিত নতুন সংগ্রামে আমরা সমগ্র বাঙালী আজ শপথ গ্রহণ করেছি। এ সংগ্রাম আমাদের সুনিশ্চিত মুক্তি নিয়ে আসবে, এ সংগ্রাম আমাদের বিজয়ের তোরণদ্বারে উপস্থাপন করবেই।…

বন্ধু, আমরা তো কোন অন্যায় করি নাই। বৃটিশ বেনিয়াদের উৎখাত করে এদেশে স্বাধীনতা গোখলে তাই একদিন বাঙালীকে লক্ষ্য করে এ যুগের একটি পরম সত্যবানী উচ্চারণ করেছিলেন What Bengal thinks today, Indian thinks tomorrow -অর্থাৎ বাঙালী আজ যা ভাবে, সারা ভারত তা চিন্তা করে আগামীকাল। রামমোহন, চিত্তরঞ্জন, রবীন্দ্রনাথ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, নেতাজী সুভাষ বসু, নজরুল ইসলাম এবং এই জাতীয় আরো বহু নাম উচ্চারণ করা যায় যাঁরা সারা ভারতীয় উপমহাদেশকে মানবতার শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এবং স্বাধীনতার দীক্ষায় দীক্ষিত করেছেন। পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তিও ছিল বাংলাদেশ। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের ঢাকায়। ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব যিনি সারা বিশ্বের কাছে পেশ করেছিলেন তিনিও ছিলেন একজন বাঙালী-বাংলার নয়নমণি, বাংলার বাঘ ফজলুল হক। পাকিস্তান অর্জনের প্রাক্কালে পাঞ্জাবে এবং সিন্ধুতে মুসলিম লীগের বিরোধী মন্ত্রিসভা ছিলসীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তান চায় কিনা তা নির্ধারণ করতে হয় গণভোট নিয়ে। সারা পাকিস্তানে একমাত্র বাংলাদেশেই মুসলিম লীগ সরকার কায়েম ছিল। সুতরাং পাঞ্জাব ও সিন্ধু এবং সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি বহুলাংশে নিস্পৃহ ছিল-এ আন্দোলনে বলিষ্ঠ এবং অগ্রণী নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ। বাঙালীর আন্দোলনেই পাকিস্তান এসেছে পাঞ্জাবীম সিন্ধী, বেলুচি বা পাঠানদের আন্দোলনে নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার সাথে সাথেই মাতব্বর হয়ে এলো পাঞ্জাবী, কি চাই? না লুটের মাল চাইএলো সিন্ধী, এলো পাঠান। কোথায় লুট করা যায়। আর কোথায়! সোনার বাংলায় সোনা ফলে। সুতরাং সবাই মিলে লুটের জন্য হাত বাড়ালো। কিন্তু লুট করতে গিয়ে দেখা গেল বাঙালীর সাধনা, বাঙালীর ঐতিহ্য, বাঙালীর সংস্কৃতি সব কিছু অত্যন্ত প্রদীপ্ত। সুতরাং শুরু হলো ষড়যন্ত্র। ধ্বংস, করতে হবে বাঙালীর আসল চেহারাকে। ইসলামকে সামনে রেখে পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সামনে রেখে তাদের এই লুণ্ঠনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এরপর দিনের পর দিন ষড়যন্ত্রেও জাল বিস্তারিত হতে থাকলো। প্রথম আঘাত এলো ভাষার ওপর তারপর অর্থনীতির ক্ষেত্রে, রাজনীতি ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। শুরু হলো শোষণের এক সুপরিকল্পিত আয়োজন, আরম্ভ হোল শাসনের এক নিদারুণ প্রয়াস। আমরা পাকিস্তান অর্জন করেছিলাম এবং প্রত্যেকটি বাঙালী পাকিস্তানের নিষ্ঠাবান নাগরিক হিসেবে পাকিস্তানের আদর্শকে বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করতে একান্ত নাগরিরে পরিণত করলো। কথায় কথায় আমরা যে পাকিস্তানের সত্যিকার নাগরিক সে ব্যাপারে তারা সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করলো-আমাদের আন্তরিকতা, আমাদের বিশ্বস্ত চেতনা সবকিছু পদদলিত করে আমাদের সবাইকে পর্দার সামনে থেকে পর্দার অন্তরালে নিয়ে যাবার সুপরিকল্পিত কাজ শুরু হোল। আর এই হোল পাকিস্তানের বিগত তেইশ বছরের ইতিহাস। বর্তমান শতাব্দীর নিমর্ম একটি ইতিকথা।

(‘চেনাকণ্ঠ” ছদ্মনামে ডঃ মযহারুল ইসলাম রচিত)

১৬ জুন ১৯৭১

বাংলার প্রাণের নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হককে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থবাদীচক্রের মুখপাত্ররা of an foot of ST-T fossil of Mr. Fazlul Hoq is self-confessed traitor ১৯৫৪ সালের

নির্বাচনে কুচক্রী মুসলিম সরকারের অনুসারীগণ বাংলার মাটিতে সাংঘাতিক পরাজয়বরণ করে আবার পর্দার অন্তরালে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার সপক্ষে সমগ্র বাঙালী অকুণ্ঠ রায় দিয়েছিলেন। বাঙালীর এই একতা ও নবজাগ্রত চেতনা পশ্চিমাদের ভয়ের ও আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাকে যেমন নির্বিচারে শোষণ করা চলছিল এবার সে পথে এক বিরাট বিঘ্ন সৃষ্টি হয়ে পড়ে। এই জাগ্রত জনতার পুরোভাগে দাঁড়িয়ে যখন শেরে বাংলা ফজলুল হক ব্ৰজকণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকেন যে বাংলাকে আর শোষণ করতে দেয়া হবে না তখন পশ্চিমা আমলাগণ এবং স্বার্থবাদী রাজনীতিবিদরা বিপদ গুনতে শুরু করে। তাই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হতে থাকে-আর বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ফজলুল হককে বলা হয় বিশ্বাসঘাতক। এই ষড়যন্ত্রের নেতা সেদিন ছিল ইস্কান্দার মির্জা, গোলাম মোহাম্মদ প্রমুখ। এদের সাথে হাত মিলিয়েছিল চুয়ান্নোর নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগের কতিপয় বাঙালী মীরজাফর। ১৯৫৫ সালের ২৯ শে মে বাংলার দরদী নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক যখন করাচী থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে ফিরে এলেন তখন বিপুল জনতা তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাসনিজের দেশে ফিরে এসে, যে বাংলার মাটিকে ফজলুল হক প্রাণের মত ভালবাসতেন সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে একটি কথা পর্যন্ত বলবার অধিকার তাঁর রইল না। সামরিক বাহিনীর কড়া পাহারায় তাঁকে বিমানবন্দর থেকে গৃহে নিয়ে যাওয়া হোল এবং নিজের ঘরে তাঁকে অন্তরীণাবদ্ধ করে রাখা হোল ছয় মাস তাঁকে বাইরের কোন লোকের সাথে মিশতে দেয়া হোত না। এমনকি পবিত্র ঈদের দিনে মুসলিম জামাতের সাথে একত্রে বসে নামাজ পড়তে পর্যন্ত তাঁকে দেয়া হোত না। বাংলাকে ভালবাসার এই হোল শাস্তি-বাংলার দুঃস্থ, নিঃস্ব, নিপীড়িত এবং বঞ্চিত মানুষের জন্য কথা বলার এই হোল সত্যিকার পুরস্কার। ঋণ সালিসী বোর্ড স্থাপন করে একদিন যে ফজলুল হক বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষা করতেন, বাংলার গ্রামে, বন্দরে, শহরে অসংখ্য স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার পথ যিনি সুগম করেন এবং সর্বোপরি লাহোর বৈঠকে যিনি সারা বিশ্বের সামনে পাকিস্তান প্রস্তাব তুলে ধরেন সেই ফজলুল হক, সেই শেরে বাংলা ফজলুল হক সেদিন প্রবীণ ও বৃদ্ধ বয়সে নিজের ঘরে বন্দী হয়ে রইলেন। যেদিন জীবনের সমস্ত বিশ্বাস ও আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য ফজলুল হক ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেদিন কোথায় ছিল ইস্কান্দার মির্জা, গোলাম মোহাম্মদ? বৃটিশের তাঁবেদার ও গোলাম সেজে তারা তখন চাকরি করতো ও নিজেদের সমস্ত বিপদ থেকে নিরাপদ দূরত্বে বাঁচিয়ে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করতো এই দুই পরাশ্রিত বশংবদ জানোয়ার। আর পাকিস্তান বলতে এদের এতটুকু বাধলো না।…

উনিশ শ’ সত্তরের নির্বাচনের পর এসেছে অভিশপ্ত একাত্তর সাল। এবারেও সেই একই খেলার ভয়াবহ পরিণাম আমাদের চোখের সামনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। চুয়ান্নোর নির্বাচনের পর শিকার ছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক, প্রবীণ গণনেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও অসংখ্য দেশপ্রেমিক। শিকার ছিলেন শহীদ সোহরাওয়াদী এবং সেদিনের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আর আজকের নির্বাচনের পর শিকার হয়েছেন বাংলার অবিসংবাদিত প্রাণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর অনুসারীবৃন্দ এবং বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। যে ইয়াহিয়া, টিক্কা এবং এম, এম, আহমেদ একদিন ছিল বৃটিশের পদলেহী চাকর, যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ছিল এক-একটি অখ্যাত-কুখ্যাত সাধারণ গোলাম, আজ তারাই হয়েছে দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা। আর ফজুলল হকের ভাগ্যে যেমন জুটেছিল বিশ্বাসঘাতকতার গ্রানি, তেমনি বাংলার প্রাণের নেতার সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের একমাত্র গণনেতা আজ হলেন দেশদ্রোহী। ভাগ্যের এ এক নির্মম পরিহাস বটে-রবীন্দ্রনাথের উপেনের ভাষায় “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আর আমি চোর বটে।”

কিন্তু দিন আর বেশী দূরে নয় যখন এই ষড়যন্ত্রের জাল আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করবোই এবং বাং এই দানবদের নির্যাতন থেকে উদ্ধার করবোই। আসুন আপনি কৃষক-মজুর, আসুন আপনি চাকরিজীবী-বুদ্ধিজীবী, সবার ওপর এসো তোমরা ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-তরুণের দল এবার আমরা দানব হত্যায় ও দানব বিতাড়নের

কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন। জয় বাংলা। (চেনাকণ্ঠ” ছদ্মনামে ডঃ মযহারুল ইসলাম রচিত)

২৩ জুলাই, ১৯৭১

পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকবর্গ তাদের বেতার ও অন্যান্য প্রচারকেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্বের নিকট দিন-রাত প্রচার করে চলেছে যে তাদের দখলীকৃত বাংলাদেশের অঞ্চলসমূহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। বিগত তিন মাসে জঙ্গী শাসকদের অমানুষিক কার্যকলাপ এবং সমগ্র প্রচারণা যে কিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যাকে অবলম্বন করে অগ্রসর হয়েছে আমরা তা জানি এবং বিশ্বের নিকটও তা বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থা সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের চীৎকার এবং ক্ৰন্দন এই বিশ্বাসঘাতকতা এবং মিথ্যা প্রচারণাই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

মাসক্যারেনহাস নামক সানডে টাইমস’-এর একজন বিখ্যাত সাংবাদিক এই মাসের ১৩ তারিখে করাচী থেকে সপরিবারে লণ্ডনে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে বাঙালী জাতিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করবার সুপরিকল্পিত কার্যকলাপের একটি লোমহর্ষক এবং প্রামাণ্য বর্ণনা দিয়েছেন। সানডে টাইমস-এর জেনোসাইড বা একটি জাতিকে নির্মুল করা সম্পর্কে এই প্রামাণ্য তথ্য আজ ইউরোপ, আমেরিকা এবং প্রাচ্যজগতে একটি আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন কিভাবে শক্তসমর্থ যুবকদের ধরে নিয়ে গিয়ে শরীর থেকে ধরছে এবং খেয়ালখুশিমত গুলি করে মারছে। তিনি দেখেছেন এই বর্বর পশুগুলো কিভাবে যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করছে। এবং এই জাতীয় আরো বহু চোখে দেখা ঘটনার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। আর এই ঘটনাগুলো সবই বেশী দিন আগের নয়। মে মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহের দিকে ঘটেছে। সুতরাং একদিকে মৃত্যুর নিষ্ঠুর লীলা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার সেনাবাহিনী, অন্যদিকে জঙ্গী সরকার প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে যে অবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে পি-টি-আই পরিবেশিত আর একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার উল্লেখ করবো। কোন একটি শহরে শতাধিক নিরীহ লোককে বলা হয় যে, রেশনের দোকানে এলে তাদেরকে সাপ্তাহিক রেশন দেয়া হবে। লোকজন সরল বিশ্বাসে রেশনের দোকানে উপস্থিত হয়। তখন সেনাবাহিনী রেশনের দোকান খুলে দিয়ে সেই শতাধিক লোককে দ্রব্য নিয়ে দোকান থেকে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল তখন সৈন্যরা পেছন থেকে গুলি করে এবং শতাধিক লোককে সেখানেই হত্যা করে।

এগুলো সবই বর্বরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার এক-একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর এই দৃষ্টান্তগুলো এখন সবই ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য বিদেশী পত্রিকাগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে মিথ্যা প্রচারণার তো অন্ত নেই। দেশবাসী সবাই জানেন যে এখনো ট্রেন পুরো চালু করা সম্ভব হয়নি- যে সব জায়গায় দিনে একটি কি দুটো মাত্র ট্রেন চালু হয়েছে সেখানেও বাঙালীদের উঠবার বিশেষ সুযোগ নেই। সড়কপথেও অনুরূপ অবস্থা। মফস্বল শহরগুলোতে লোকজন ফিরে আসতে ভরসা পাচ্ছে না, কেননা বহু ঘটনায় দেখা গেছে যে লোকজন ফিরে এলেই তাদের ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং সড়কপথে গাড়ি দু’এক স্থানে চালু হলেও লোকজন নেই। জলপথের অবস্থাও একই রকম। স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে কিন্তু দু’একজন শিক্ষক কাজে যোগ দিলেও ছাত্র নেই- এবং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে হানাদার সৈন্যদের বিতাড়িত না করা পর্যন্ত কোন ছাত্র পড়াশুনা করতে যাবে না।

অফিস-আদালতের অবস্থাও অন্যরূপ নয়। ঢাকার বেশকিছু পরিমাণ অফিস খোলা হয়েছে। কিন্তু ঢাকার অফিসগুলো মফস্বল শহরগুলোর অফিসের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু মফস্বল শহরে শতকরা আট-দশটির বেশী

অফিস চালু হয়নি, সেহেতু ঢাকায় লোকজন অফিসে গিয়ে বসে বসে স্ময় কাটানো ছাড়া করবার কিছু পাচ্ছেন না।

সুতরাং পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক চীৎকার করে যতই বলুক যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে কিন্তু আসলে যে তা সত্য নয় একথা আমরা সবাই জানি। আর আমরা বাঙালী একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশকে যতদিন পর্যন্ত না হানাদার পশ্চিম পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে, ততদিন দেশে স্বাভাবিক অভস্থা ফিরে আসতে পারে না। সত্যিকারভাবে বাংলায় বিগত তিনমাসে যা ঘটেছে তারপর আর কোন অবস্থায়ই এই হানাদার পশুশক্তির সাথে সহযোগিতা করতে একটি বাঙালীও অগ্রসর হতে পারেন না। জোর করে কিছুসংখ্যক লোককে অফিসে, আদালতে, ট্রেনে, বাসে বা শহরে-নগরে নিয়ে এলেও বাংলার মানুষের মন জয় করবার সাধ্য এই পশুশক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে। আর তাদের বর্বরতা, তাদের ইতিহাসে নজীরবিহীন হত্যালীলা, পাশবিকতা ইত্যাদি কার্যকলাপের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক দেশটি মৃত্যুবরণ করেছে-আর সেখানে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় জন্মভূতি বাংলাদেশ। জয় বাংলা।

(চেনাকণ্ঠ” ছদ্মনামে ডঃ মযহারুল ইসলাম রচিত)

২৬ জুন, ১৯৭১

বাংলাদেশ ও নাম কানের ভিতর দিয়া মরমে পশে এ নামের লাবণী অবনি বহিয়া যায়। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। শেখ মুজিবের বড় প্রিয় গান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রাণের গান। এ গানে বাংলাদেশের মর্মকথাটি আছে। আমার কাছে এ গানের কিন্তু একটা ভিন্ন অর্থ আছে। মনে পড়ছে গাঁ থেকে ফিরছি। অদূরে রাজশাহী শহর দেখতে পাচ্ছি। তেসরা এপ্রিল। সকাল দশটা। মাথার ওপরে উড়ে এলো ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বিমান স্যাবর জেট। তারপর শুরু হলো নির্মম বোমা বর্ষণ। আমি তাড়াতাড়ি একটা খালে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু খালটার দশহাত দূরেই একটি ছেলে হাল চাষ করছে। তাকেও শুয়ে পড়তে দেখলাম। কিন্তু সে নির্বিকার হাল চাষ করতে লাগলো। কোন কিছুই হয়নি। বিমানগুলি চলে গেলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়-চোপড় ঝাড়তে লাগলাম। কিন্তু ছেলেটি তখন গাইছে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। আমাকে দেখে ও বলদ দুটি থামালো-বললো, আপনি বুঝি খুব ভয় পেয়েছিলেন? তার কথায় একটু বিদ্রুপের সুরও ছিল। বললাম, হ্যাঁ ভয় একটু পেয়েছিলাম বৈকি। বললাম, তোমার বুঝি ভয় করেনি। বললো, না। বললো, মরতে তো হবেই স্যার। জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার নামটি কি ভাই? উত্তর এলো, অমল। ঘটনাটা ছোট্ট কিন্তু অসামান্য। অমল, বিমল, রহিম, করিম হাল-চাষ করছে আর গান গাইছে, আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালবাসি।

হাঁটতে হাঁটতে আবার গাঁয়ের দিকে যাচ্ছি। আম বাগানের নীচে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বীর সেনানী ভাইরা বন্দুক নিয়ে শত্রুর মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। রাজশাহী শহরের চারিদিকে অতন্দ্র প্রহরী এই ই-পি-আর বাহিনীর জোয়ানেরা। ওদের কাছে বসলাম। পাশেই বাজছে রেডিও। আবার গানঃ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। ই-পি-আর এর কয়েকজন জোয়ান গানের সঙ্গে পায়ের তাল ঠুকছে। ওরই মধ্যে একজন, নাম রশিদ। ঢাকায় বাড়ি, বললো, কি জানেন সাহেব, এ গানটা শুনলেই পরানটা এক্কেবারে ফাইট্যা যাবার চায়। বললো ঐ যে ছেলেটাকে দেখছেন, ঐ যে হাল চাষ করছে। ওর নাম অমল। কাল সারা রাত ট্রেঞ্চ কেটেছে আমাদের জন্য। আর এই যে দেখছেন বুড়ো মিয়াকে, ইনি মসজিদের ইমাম। সারাদিন আমাদের জন্য খাবার দিয়ে যাচ্ছে। পানি আনছেন। বিড়ি-সিগারেট জোগাড় করছেন। বুকটা আমার গর্বে ফুলে উঠলো। বাংলাদেশের মানুষ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শেখ মুজিবের আহবানে সাড়া দিয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এমন প্রমাণ আর কখনও দেখিনি…

(অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ রচিত)

২৭ জুন, ১৯৭১

একজন মায়ের কথা বলছি। হ্যাঁ, একজন বাঙালী মায়ের কথাই বলতে চাইছি। মার্চ মাসে ইয়াহিয়ার সরকার বন্দুক-রাইফেল জমা দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ কেউ জমাও দিয়েছিল। কিন্তু যে মায়ের কথা হাতে বন্দুক দেয়ার অর্থ মৃত্যুকে ডেকে আনা। মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করবি না তোরা? বললেন তিনি। আমার মনে আছে, তিনি তাঁর তিন ছেলেকেই বললেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করো। হয় ইয়াহিয়ার সেনাদেরকে খতম করবে আর না হয় মরবে। ছেলেরা কথা রেখেছে। তাঁর এক ছেলে শহীদ হয়েছে। আর বাকী দুজন এখনও লড়ছে। গেরিলা আক্রমণে তারা দুজনেই সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছে। এই কিছুদিন আগে এদের দু’ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হলো। বললাম- তোমার মায়ের কথা বলো। বললে মা আছেন গাঁয়ে। তিনি তাঁর কাজ করছেন। সবাইকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন, প্রেরণা যোগাচ্ছেন। বললে- মা কি বলেন জানেন আপনি? বলেন, মাকে আর দেশকে এক করে দেখবি। তোমরা আমার ছেলে নও, তোমরা বাংলাদেশের সন্তান- এই কথাটা মনে রেখো, ইয়াহিয়ার রক্তপিপাসু সেনারা আমার মতো বহু রত্নপ্ৰসবিনী মাতাকে হত্যা করেছে। আর এখন রতুগর্ভা বাংলাদেশকে হত্যা করছে। কিন্তু ওরা জানে না, একজন মাকে হত্যা করা যায় কিন্তু দেশকে হত্যা করা যায় না। বাংলাদেশকে হত্যা করা যায় না। যাবেও না। মাতা আর পুত্রের রক্ত থেকে জন্মনেবে রক্তবীজের ঝাড় ।

 এমনি মা আমরা পেয়েছি লক্ষ লক্ষ, আর এমনি পুত্ৰও পেয়েছি লক্ষ লক্ষ। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আজ মরণ-পণ লড়াইয়ে ব্যস্ত। সমস্ত শোষিত নিপীড়িত জনগণ আজ জেগে উঠেছে, হাতে তুলে নিয়েছে তারা ওপর। আর ভয় নেই। মুক্তিফৌজের বীর ভাইয়েরা প্রতিনিয়ত কঠিন আঘাত হানছে ইয়াহিয়ার সেনাদলের ওপর। আর ভয় নেই।  মুক্তিফৌজির সামনে তিনটি প্রধান কর্তব্যঃ

(এক) শত্রু কে চূড়ান্ত আক্রমণ করতে হবে

(দুই) শত্রুর দালালদের খতম করতে হবে

(তিন) কে শত্রু আর কে মিত্র তা চিনতে হবে।

…আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করছি, আমরা জানি পৃথিবীর যে সমস্ত স্থানে মুক্তিযুদ্ধ চললছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সর্বাপেক্ষা গৌরবময়। কারণগুলো কি? প্রথম কারণঃ পৃথিবীর কোনও মুক্তিযুদ্ধ এমন অভূতপূর্ব গণঐক্য দেখে নি। দ্বিতীয় কারণঃ পৃথিবীর কোনও মুক্তিযুদ্ধই যুদ্ধের শুরুতেই সশস্ত্র বাহিনীর এমন সমর্থন লাভ করেনি। স্মরণ করুন কিভাবে আমরা ই-পি-আর, ই-বি-আর পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদ ভাইদের সহযোগিতা পেয়েছি এবং এ মুহুর্তেও তারা কিভাবে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। এমন কি ভিয়েতনামের যুদ্ধেও প্রথম দিকে এ ধরনের সশস্ত্র সমর্থন পাওয়া যায়নি, কাজেই সবদিক থেকে বিচার বিবেচনা করে বলা যায় আমরা সবাই একটি গৌরবময় মহান যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছি। মনে রাখতে হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কারণসমূহ যথার্থ। আমরা লড়াই করছি ন্যায়ের জন্য এবং আমাদের লড়াইও যথার্থ পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে। কাজেই বিশ্বের সকল দেশ থেকে আমরা সমর্থন, সাহায্য ও সহানুভূতি পাবোই এবং পাচ্ছিও….

(অধ্যাপক আবদুল হাফিজ রচিত)

৯ জুলাই, ১৯৭১

মাঠে মারা গিয়েছে ইয়াহিয়া খানের লম্বা-চওড়া রেডিও গলাবাজি। শাহী কায়দায় ফরমান জারির ভঙ্গিতে কাকাতুয়া ইংরেজীতে আওড়ানো প্রায় একঘন্টার নরম গরম চরম বিলাপ আর প্রলাপ কি করে দাগ রাখবে

দুনিয়ার মানুষের মনে? তবু, যাদের মাথায় দুবুদ্ধি ভর করেছে, যাদের মাধ্যমণি হিসেবে ইয়াহিয়া খান ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে, তারা এই রেডিও গলাবাজির আগে একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বাজনা তো কম দেশদেশান্তরে মিষ্টি কথা তো কম পরিবেশন করেনি। পাকিস্তানী শাসকচক্রের ঝানু ঝানু উপদেষ্টারা ইতিমধ্যে তদ্বির-তদারকের বাকি কিছু রাখেনি। কিন্তু কোন ফল হলো না। ইয়াহিয়া খানের ২৮ শে জুনের রেডিও ভাষণ একটা জঘন্য অপভাষণ হিসেবেই বরং চিহ্নিত হয়ে গেল। উলঙ্গ হয়ে ধরা পড়ে গেলে রাওয়ালপিণ্ডি সামরিকচক্রের সেই মুনাফালোভী দুবুদ্ধিতা, যা এই চক্রকে বাংলাদেশ দমনে প্রবৃত্ত করেছে। ইয়াহিয়া খান তার প্রলাপে বলেছে যে, রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক চক্র নিজেরাই শাসনতন্ত্র রচনা করবে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও শাসনতন্ত্র রচনার এখতিয়ার নাকচ করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে তো তারা ধ্বংস করতেই চেয়েছে। এটা ইয়াহিয়ার কারণে দুনিয়ার কাছে জাহির হয়ে গিয়েছে।

২৮শে জুনের আগে দুনিয়ার যেসব রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চিন্তা করছিলেন যে, দাবনীয় অপকর্ম করে ফেলে হাতেনাতে ধরা পরে ইয়াহিয়া খানেরা হয়তো তওবা করে পশ্চিম পাকিস্তানে বহাল থাকার জন্যেও দুনিয়ার কাছে একটা সম্মানজনক মীমাংসাসূত্র রাখতে পারবে, তারাও খুঁজে পেতে কিছু পায়নি ইয়াহিয়া খানের বাচনে।

বস্তুতপক্ষে ২৮শে জুনের পরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুখপাত্র এবং প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে যেসব বক্তব্য বলেছেন, তাদের প্রত্যেকটি থেকেই একথা বুঝতে পারা যায় যে, এইসব মুখপাত্র এবং প্রতিনিধি ইয়াহিয়া খানের বাচনকে আমলেই আনেননি। নিউজিল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিম জার্মানীর পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী বাংলাদেশ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক মীমাংসাসূত্রের জন্যেই তাগিদ দিয়েছেন। এটা ধরে নেওয়া যায়, তাঁরা কূটনৈতিক সূত্রে ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক সমাধান সূত্রগুলিকে প্রত্যাখান করেছেন।

 কানাডা আর আয়ারল্যান্ডের আইন পরিষদের যেসব সদস্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসেছেন, তাদেরও একই কথা। তাঁরা স্বচক্ষে দেখে যাচ্ছেন, বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের রাওয়ালপিণ্ডি চক্রের জল্লাদেরা একটা গোটা জাতিকে সাড়ে সাত কোটি নরনারী শিশুকে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্য কি ধরনের হত্যাকাণ্ড করেছে। বাংলাদেশের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধানের যে তাগিদ তাঁরা দিয়েছেন তাতে বুঝতে পারা যায়, ইয়াহিয়ার বাচনকে তাঁরা ঝাড়া অগ্রাহ্য করেছে। গোটা বাঙালী জাতিকে নিধন করার জন্য পাকিস্তানী শাসকচক্র যে ষড়যন্ত্র চালিয়ে এসেছে এতদিন, ইয়াহিয়ার বক্তব্য তারই একটা বেতালা পদক্ষেপের মহড়া ছাড়া যে আর কিছু নয় সে কথা আজ বিশ্বের মানুষ বুঝে নিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী দেশ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে তাঁদের সমর্থন জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ সংবাদে দেখা গেল, চেকোশ্লোভাকিয়ার কর্মকর্তারা সরকারীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁরা বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্যে তাগিদ দিয়েছেন। এর সোজা অর্থ এই যে, ইয়াহিয়া খানের রেডিও বাচনকে তাঁরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব, এটাই বর্তমান, এটাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিজের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরী করবে। দুনিয়ার দেশ-দেশান্তরের কাছে এই ঘটনা অনিবার্য অপ্রতিরোধ্য ঘটনা হিসেবে উন্মোচিত হয়ে চলেছে। ইয়াহিয়া খানেরা মিথ্যা। স্বাধীন বাংলাদেশ সত্য। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নরনারী-শিশু বুকের রক্ত ঢেলে এই সত্যের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের মুক্তির দিনকে এগিয়ে নিয়ে আসছেন।

(“জামিল শারাফি’ ছদ্মনামে রণেশ দাশগুপ্ত রচিত)

১০ জুলাই, ১৯৭১

রাওয়ালপিণ্ডি থেকে দুটো পত্র পৌঁছেছে লণ্ডনে। সরকারীভাবে সরকারী চিঠি। এগুলো নাকি প্রতিবাদলিপি। কিন্তু কিসের প্রতিবাদ? দুনিয়া তাজব হয়ে গিয়েছে খবরটা শুনে। পাকিস্তানী জল্লাদ সরকার বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে বৃটেনের সংবাদপত্রে পাকিস্তানবিরোধী প্রচার চলছে- এ প্রচার বন্ধ করার ব্যবস্থা হোক।

বিশ্ববাসীর মনে স্বভাবতই দুটো প্রশ্ন জেগেছে। বাংলাদেশ নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করার পরেও যে পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসকচক্র অতীতের রেশ ধরে বাংলাদেশের ঘটনাকে এখনও আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বোঝাতে চেষ্টা করছে। আর শুধুমাত্র অস্ত্রপাতির জোরে বলে বেড়াচ্ছে যে বাংলাদেশ তাদের দখলে রয়েছে- তারা বৃটেনের খবরের কাগজগুলি কি লিখছে না লিখছে তার ওপর খবরদারি করতে চাইছে কোন লজ্জায়? এটা হতে পারে প্রথম প্রশ্ন।

দ্বিতীয় প্রশ্নটা ভিন্ন ব্যাপার থেকে এসেছে। পাকিস্তানী জল্লাদেরা নিজেদের হাতে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম নগরীতে রাজমিস্ত্রী দিয়ে দুটো-চারটে দালানকোঠা মেরামত করিয়ে আর রং ফিরিয়ে, নিজেদের হাতে খুন করা হাজার হাজার নরনারী-শিশুর গলিত লাশ গুম করে সাফাই-সাক্ষীর মারফত প্রমাণ করার চেষ্টায় ছিল যে, পাকিস্তানী ফৌজের লোকেরা বেকসুর, মাসুম; তারা দুষ্টের দমন আর ক্যান্টনমেন্টে বসে আছে জনসংযোগ দফতর হাট করে খুলে। ফল এতে উল্টোই হয়েছে। সাংবাদিকরা অবরুদ্ধ নগরীগুলিতে ঢুকবার সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন এবং ফাঁস করে দিয়েছেন পাকিস্তানী জল্লাদদের সমস্ত গোমর। শেষ রক্ষা করার জন্যে, সত্যের বিশ্বপরিব্যাপ্ত অগ্নিশিখাগুলিকে ঢাকা দেবার জন্যে পাকিস্তানী জল্লাদেরা এখন চেষ্টা করছে বিভিন্ন দেশের সরকারকে দিয়ে কিছু একটা করাতে। কিন্তু এদের মাথায় কি এ কথাটা ঢুকছে না যে, যে হাত দিয়ে এরা সত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্র লিখছে, তা বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরীহ নরনারী-শিশুর রক্তে রঞ্জিত সে রক্তের দাগ লেগে যাচ্ছে এদের চিঠিপত্রেও? তবে দুনিয়ার সামনে উপরোক্ত দুটো প্রশ্নের একটাই জবাব রয়েছে। দু’কান কাটা রাস্তার মাঝ দিয়েই চলে। আসামীর কাঠগড়ায় উঠে আবোল-তাবোল বকে পাগলের ভান করে। সত্যকে চাপা দেবার জন্যে পাকিস্তানী জল্লাদেরা কম চেষ্টা করেনি এরা ২৫শে মার্চে নৈশ হামলা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা নগরীতে সমাগত সমস্ত বিদিশী সাংবাদিকদের হোটেলের কামরায় আটকে রেখেছিল। তা সত্ত্বেও সেই অবরোধ ভেদ করে সাংবাদিকরা পাকিস্তানী জল্লাদদের নারকীয় কাণ্ডের যে তথ্য আর ছবি নিয়েছিল, সেই সব তথ্য আর ছবি কেড়ে নেয়া হয়েছিল করাচী বিমানবন্দরে। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীকে এরা ঢুকতে দেয়নি, পাছে পাপ প্রকাশ পেয়ে যায় এই চিন্তায়। এরা বাংলাদেশের যেসব খবরের কাগজের অফিসকে দালান সমেত পুড়িয়ে ছাই করেনি, তাদের ওপর জঙ্গী আইনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কোন ফাঁকে যাতে বাংলাদেশ থেকে খবর বাইরে না যেতে পারে সে জন্যে এরা বিদেশীদের জন্যে নির্ধারিত কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে বুটের তলায় মাড়াতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু সত্যকে চাপা দেওয়া যায়নি। পাকিস্তানী জল্লাদেরা ভেবেছিল, দিন চলে যাবে একরকম করে এবং দুনিয়ার মানুষ আস্তে আস্তে ভুলে যাবে।

(“জামিল শারাফী’ ছদ্মনামে রণেশ দাশগুপ্ত রচিত)

১৬ জুলাই, ১৯৭১

বাংলাদেশের মত এমন শান্তির দেশ, এমন সুখের দেশ আর কোথায় আছে। এমন জন্মভূমি ক’জনে ভাগ্যে পায়। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বঙ্গজননী। বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা চিরকাল ঘরকুনো। বুঝিবা একটু আডডাবাজ। কিন্তু বাংলার ছেলেমেয়েরা কোনোদিন গোলমালে নিজেদেরকে জড়াতে চায়নি। মায়ের স্নেহ, দাদা-

দাদী আর নানা-নানীর আদর কেড়ে বাংলার ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়। অথচ আজ! ভাবলে অবাক লাগে। এই তো সেদিন ঘুরছি আর ঘুরছি। হঠাৎ গিয়ে হাজির হলাম মুক্তিবাহিনীর শিবিরে। শান্ত নিরীহ বাঙালীর ছেলেরা দীপ্ত অগ্নিশিখার মত জ্বলছে। এক একটি ছেলে যেন জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভূত্য করে নিয়েছে। মায়ের আচল ছেড়ে, ঘরের নিশ্চিন্ত কোণ ছেড়ে, সামান্য সুখ আর আনন্দের পথ ত্যাগ করে বাংলাদেশের ছেলেরা এই প্রথম অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে। পার্থক্যটা অনুভব না করে উপায় নেই। আমিও না করে পারিনি। বাংলাদেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ। কিন্তু বন্ধ নেই মুক্তিবাহিনীর স্কুল-কলেজ। তা সব সময়ই খোলা।

এমনি একটি মুক্তিবাহিনীর শিবিরে গেলাম সেদিন। সোনার টুকরো হীরের টুকরো সব ছেলেরা লড়াইয়ে যাবে তাই তৈরী হচ্ছে। বললাম, কেমন আছো ভাইরা আমার? কেমন আছো? সবাই বললে ভালো আছি। বললেঃ আমাদের বিপ্লবী সেলাম নিন। ওদের সঙ্গে কথা বললাম। পেয়ালা পেয়ালা চা খেলাম। একজন বললেঃ আমরা এখন লড়াই করতে যাচ্ছি। বললাম- সে কি? এক্ষুনি? হ্যাঁ এক্ষুনি। প্রথমে অবশ্য বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছিলাম। অস্ত্রে ওরা দীক্ষিত হচ্ছে- অস্ত্রে ওরা শাণ দিচ্ছে। ওদের সমস্ত মাংসপেশীগুলো ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে, ওরা পায়ের তালে তালে মার্চ করছে- ওরা তৈরি হচ্ছে, লড়াই করতে যাচ্ছে। বাংলার সন্তান মুক্তিযুদ্ধে লড়ছে, শক্র নিকেশ করছে। পার্থক্যটা সত্যিই ভুলবার মত নয়। মায়ের আদূরে বেগ। ওদের একজন বললে-দেখবেন লড়াইটা। বলার অপেক্ষা মাত্র। সঙ্গে সঙ্গে ওরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল মুক্তিবাহিনী আর একদল পাক-সেনা শুরু হল লড়াই। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী হেরে গেল। আমি হাততালি দিয়ে ওদের অভ্যর্থনা জানালাম। এরপর ওরা গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল দেখালো। আর একবার হাততালি দিয়ে ওদেরকে অভিনন্দন জানালাম। ওদের অবসর ওরা এমনি করে কাটায়। আনন্দের মধ্যে শিক্ষা আর শিক্ষার মধ্যে আনন্দ। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এভাবে তৈরী হচ্ছে। ইয়াহিয়ার খুনী সেনাবাহিনীর কবর রচিত হবে অচিরে।

(অধ্যাপক আবদুল হাফিজ রচিত)

১৯ জুলাই, ১৯৭১

কবি শহীদ সাবের আজ আর নেই- কিন্তু তার কবিতা আছে। সেই কবিতাটিই পড়ছিলাম। গত মহাযুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্ট জার্মান বাহিনী যেভাবে গেরিলাদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল- সেসব কথা মনে পড়েছিলো শহীদ সাবেরের। সাবেরের মনে তৈরি হচ্ছিল বিদ্যুতের-জন্ম হচ্ছিল একটি কবিতার- আর সে কবিতা মুহুর্তে মনকে আক্রান্ত করে।

কবিতাটি পড়ছিলাম। শহীদ সাবের আজ আর নেই। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী হত্যা করেছে শহীদ সাবেরকে হত্যা বলবো, না অন্য কিছু? শহীদ থাকতেন ঢাকার দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ’-এর কার্যালয়ে আগুনে-বোমা ফেলে পুড়িয়ে দেওয়া হল সংবাদ কার্যালয়। তাঁরই সঙ্গে পুড়ে গেলেন শহীদ সাবেরযে শহীদ সাবের ছিলেন ফ্যাসি-বিরোধী, যে শহীদ ছিলেন মুক্ত মানবতার প্রতীক। ইয়াহিয়ার খুনী সেনাবাহিনী শুধু অধ্যাপক হত্যাই করেনি। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী কেউ বাদ যায়নি।

শহীদ সাবের নেই- কিন্তু আছে তাঁর কবিতা। কবিতাটির একটি ভূমিকা লিখেছিলেন সরদার ফজলুল করিম। লিখেছিলেনঃ

‘কিশোর শহীদ সাবের আমারই ন্যায় জেল থেকে জেলান্তরিত হতে হতে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে এসে আমার সঙ্গে দৈবক্রমে মিলিত হয়েছিলেন। রাজশাহীর সাঁওতাল কৃষকদের আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন পূর্ববাংলার

আন্দোলনের মধ্যমণি ছিল। আর সে আন্দোলনের সঙ্গে ইলা মিত্রের নামও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।”… সরদার ফজলুল করিম আরও লিখেছেনঃ “ইলা মিত্রের গ্রেফতার এবং তার উপর অনুষ্ঠিত নির্যাতন তখনকার সংগ্রামের উপকথায় পরিণত হয়েছিল। সে কাহিনীর ভিত্তিতে শহীদ সাবের তাঁর ‘শোকার্ত মায়ের প্রতি কবিতাটি রচনা করেন।” সংক্ষেপে এই হল শহীদ সাবেরের সেই বিখ্যাত কবিতার পটভূমি। তাঁর মনে পড়েছিল হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনীর অত্যাচারের কথা। কিন্তু যে কারণে আমি বিস্ময় বোধকরি, তা হল শহীদ সাবেরের সেই কবিতায় ইয়াহিয়ার খুনী জল্লাদ সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নারী নির্যাতন ধর্ষণ, অপহরণ, খুন সবই প্রতিফলিত হয়েছে বিস্ময়কর ভাষায়। কবিরা নাকি ভবিষ্যৎ দেখতে পান। দেখতে পেয়েছিলেন শহীদ সাবেরও। সবচাইতে বড় কথা সেই ফ্যাসিস্ট নির্যাতনের শিকার হলেন কবি নিজেই। এমন করে নিজের ভবিষ্যৎ আর কোনও কবি দেখেছেন কি? আছে কি বিশ্বে কোনও উদাহরণ? না নেই- শুধু আছে এই বাংলাদেশে। শহীদের সেই কবিতার ভাষা তাই কান্নায় সিক্ত, ঘৃণায় ঘৃণায় উচ্চকিত, ছন্দে ছন্দে উচ্ছসিত, পাশব শক্তির ঘৃণ্যতম অত্যাচারের কথা এমন কোরে কেউ কখনও প্রকাশ করেনি।…

 কবিতাটির প্রথম অংশে দেখা যাচ্ছে একজন জার্মান ফ্যাসিস্ট ক্যাপ্টেন ভের্নের গর্ভবতী একজন রুশ মহিলাকে উলঙ্গ করছে। কারণ, সেই রুশ মা ছিলেন গেরিলা দলের সদস্যা। তাই এই নির্মম অত্যাচার। শহীদ সাবের লিখেছেনঃ

মাগো, মা আমার কাঁদছো তুমি?

আমাকে একবার দেখো,

দেখো, আমি স্থির, আটল, চোখের পাতাটি নড়ছে না।

চেয়ে দেখো, আমার হাতে লাল মলাটের বই,

কারা-প্রাচীরের অন্তরালে, লুকিয়ে আনা বইটি।

এখন আমার চোখে ভেসে উঠেছে

সেতো তোমারি ছবি মাগো।

কি সেই ছবি? ছবিটা দেখুন।

চারদিকে রক্ত-জমানো হিমেল মৃত্যু

আর তুমি দাঁড়িয়ে আছ জার্মান কমান্ডারের সামনে

মাগো ক্যাপ্টেন ভের্নের কি বুঝবে বলো?

কেন তুমি যোগ দিয়েছ গেরিলা দলে?

স্বদেশ প্রেমের আগুন কত জ্বলে

পররাষ্ট্র লোভী নাৎসীরা কি বুঝবে তা।

না, শুধু হিটলারের ফ্যাসিষ্ট বাহিনী নয়। বোঝেনি ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ট জল্লাদ সেনারাও। শহীদ সাবের তারপর লিখেছেন দ্বিতীয় দৃশ্য। ফ্যাসিস্টরা ধরে নিয়ে গেছে গর্ভবতী মাতাকে। পথেই তার সন্তান হল। মায়ের কোল থেকে দস্যরা কেড়ে নিলে নবজাতককে।

তারপর আমি দেখছি পরিষ্কার

সেই হাড় কাঁপানো শীতের রাতে, সেই দুঃসহ শীতে

তুমি উলঙ্গ, মাগো তুমি উলঙ্গ

সেই বরফের আস্তরণের উপর দিয়ে ধীর পদক্ষেপে তুমি

হেঁটে চলেছ মাগো, পেছনে বেয়োনেটের ডগা

ছুঁয়ে আছে পিঠেতে তোমার,

দস্যুরা হাসছে মাগো, মাতৃমূর্তির নগ্নতায়,

তোমার সন্তান ভরা পেট ঝুলে পড়েছে মাগো

*      *      *      *      *

তুমি এখন জন্ম দিচ্ছ একটি সন্তানের

কি দারণ যন্ত্রণা বলোঃ

একটি ক্ষুদ্র লাল মাংসপিণ্ডঃ আগামী দিনের

এক সর্বহারা সেনা বেরিয়ে আসে ধীরে।

শিশুটি ছিনিয়ে নিলে তোমার কোল থেকে

*      *      *      *      *

শয়তান তোমার ছেলের জাম কবজের দিক হুমকি

মাগো, তুমি, মা- তোমার একটি কথার পরে

করছে নির্ভর অসংখ্য তরুণ গেরিলার প্রাণ

তুমি তো জননী, বলবে না একটি কথাও।

না জননী একটি কথাও বলেননি। তাঁর চোখের সামনে তার সাদ্যোজাত শিশুকে হত্যা করা হলো। পরে তিনি নিজেও প্রাণ দিলেন। বাংলাদেশের মা-বোনদের ওপরে এমনি নির্যাতন চালিয়েছে ইয়াহিয়ার বর্বর সেনারা।…

শহীদ সাবের লিখেছিলেনঃ

আর দেখ আমি কারাগারে

মাগো তুমি কেঁদো না, কেঁদো না

আমার জন্যে কেঁদো না, দেখ দেখ

আমি স্থির, আটল…

না, শহীদ সাবেরের জন্য আমরা কাঁদবো না। বাংলাদেশের তিনিই প্রথম কবি যিনি ইয়াহিয়ার বর্বর ফ্যাসিষ্ট সেনাদের হাতে প্রাণ দিলেন।…

(অধ্যাপক আবদুল হাফিজ রচিত)

২০ জুলাই, ১৯৭১

…পাকিস্তান সরকার শিক্ষিত সেনাবাহিনীর নিয়মিত মৃত্যু রোধ করতে আরও কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে? যেমন- রাজাকার বাহিনী তৈরী করেছে বিভিন্ন অঞ্চলে। আকাশ থেকে নিক্ষেপ করেছে রাশি রাশি প্রচারপত্র। তাতে বলা হয়েছেঃ হে দেশপ্রেমিক জনগণ দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীরা বড্ড খারাপ কাজ করছে। আপনারা তাদেরকে ধরিয়ে দিয়ে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখান। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খাঁ সাহেবদের জন্য এখনও দেশপ্রেমিক আছে, এ কথা ভাবলে হাসি পায়। তবে একটা কথা বলতেই হয়, বাংলাদেশের মানুষ দেশপ্রেমের বাস্তব পরাকাষ্ঠার প্রমাণ দিয়েছেন হাতে হাতে।

একজন কৃষক ভাইয়ের সাথে আলাপ করছি। তিনি জমিতে রোয়া লাগাচ্ছিলেন। বললাম- কেমন আছেন? বললে-ভাল আছি, খুব ভাল আছি। বলেই মাথার টোপরের ভেতর থেকে একখানা কাগজ বের করে দিলে। বললে, এই এক্ষুণি ফেলেছে বিমান থেকে। ওখানেই বসে বসে পড়লাম। সেই প্রচারপত্র যাতে দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আবেদন জানানো হয়েছে। কৃষক ভাইটি জানালেন, মুক্তিবাহিনীকে বলবেনতাদের জন্য আমরা ধান-চাল আটা-গম সব মজুদ করে রেখেছি। এমন জায়গায় রেখেছি, খান সেনাদের চোঁদ্দপুরুষও খুঁজে পাবে না।

অবাক লাগলো। একজন সাধারণ চাষী মুক্তিবাহিনীর জন্য সর্বস্ব পণ করেছেন। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার দস্যু সেনাবাহিনী যা করছে, তা সমস্ত অত্যাচারের ইতিহাসকে স্নান করে দিয়েছে। প্রতিটি কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী প্রতিদিন অনুভব করছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী ধনিকদের দালাল পাকিস্তানী হানাদার সেনার হাত থেকে মুক্ত করতেই হবে স্বদেশকে তাই দেশের সমস্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করছেন। দেশের সাধারণ মানুষ। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে জনগণের আন্তরিক সহযোগিতাই মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কারণ। রাজাকার বাহিনী কিংবা শান্তি কমিটি করেও কূল পাওয়া যাচ্ছে না। জনগণের ব্যাপক অংশে বিরাজ করছে অসন্তোষের তীব্র দাবদাহ।…

আজ পাকিস্তান বলতে যা বোঝায়- তা হল পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আমাদের মতই শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকচক্র পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে মিথ্যে ভাঁওতায় ভুলিয়ে, কাশ্মীরে নিয়ে যাওয়ার নাম করে বাঙালীকে হত্যা করবার কাজে লাগাতে চেয়েছে। সিন্ধু থেকে কৌশলে এভাবে স্বল্পমেয়াদী ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোক আনা হয়েছে সীমান্ত অঞ্চল রক্ষার জন্যে মুক্তিবাহিনীর হাতে এরাও প্রচণ্ড মার খাচ্ছে।

 গোড়াতে সেই যে চাষী ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। তিনিই বলছিলেন- একটা মজার ব্যাপার দেখেছেন? মজার ব্যাপার? আমি অবাক হলাম- চারিদিকে হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ এবং অত্যাচারের মধ্যে মজার ব্যাপারটা কি? তিনি বলছিলেন, সিন্ধু থেকে আনা একদল সেনা রাস্তার ধারে বসে নিজেদের ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করছে। তারা এ হত্যাকাণ্ডে নিজেদের হাত রক্তাক্ত করতে চায় না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরে যেতে চায়। আর কেউ বা বসে বসে কাঁদে। এরা যুদ্ধ করতে চায় না, মরতে চায় না। পাকিস্তানী শাসকচক্র সিন্ধুর শোষিত জনগণকে লেলিয়ে দিয়েছে শোষিত বাঙালীদের বিরুদ্ধে। মানুষ যুদ্ধ নয়- মানুষ ভাবে, মানুষ চিন্তা করে, মানুষেরই শুধু বিবেক রয়েছে। তাই সিন্ধী, বেলুচী এবং সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা লড়তে চায় না। একজন কম্যাণ্ডিং অফিসার তার অধীনস্থ সেনাদেরকে বাঙালীদের বাড়ি ঘর লুট করতে বললে তারা রাজী হয়নি। উল্টো তারা কম্যাণ্ডিং অফিসারকেই হত্যা করে।…

(অধ্যাপক আবদুল হফিজ রচিত)

২ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা আজ শত্রুমুক্ত। এইসব জায়গায় মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় গ্রামবাসী প্রতিটি গ্রমকে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো করে গড়ে তুলেছে। যে হাত কেবল লাঙল ধরতো, কিংবা কলম ধরতো, কিংবা যে হাতে একতারা শোভা পেতো-সেই হাত, সেই একই হাত আজ তুলে নিয়েছে রাইফেল।

এই সব এলাকা কয়েকদিন আগে ঘোরার সময় খান সেনাদের অত্যাচারের চিহ্ন দেখেছি, শুনেছি তাদের বর্বরতার কথা, জেনেছি মুক্তিবাহিনী ও গ্রামবাসীর সম্মিলিত ক্রমাগত যুদ্ধের কথা, জয়ের কথা। তরুণ যোদ্ধাদের সঙ্গে ভাব-বিনিময় করেছি এবং বার বার অনুভব করেছি কি গভীর আমাদের দেশের মানুষের দেশপ্রেম; কি প্রচণ্ড সংগ্রামের, যুদ্ধের ইচ্ছা তাদের। এবং কি কঠিন পণ নিয়েছে তারা সবকিছু উৎসর্গ করে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার।

এসব জায়গায় যে কদিন খান সেনারা ছিল, সে কদিন তারা গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে অত্যাচারের ঝড় বইয়ে দিয়েছে। বহু মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়েছে, ফসলের ক্ষতি করেছে, বাজার-দোকানপাট জ্বালিয়েছে, মানুষকে, অত্যাচার করেছে মেয়েদের উপর। এইসব অন্যায়-অত্যাচারের মধ্য দিয়ে মানুষ-পদদলিত, শোষিত মানুষ জেগে উঠেছে। তাদের চোখে এখন শত্রু হননের আকাঙ্খা। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ এখন যুদ্ধ করে যেতে চায়। একজন গ্রামবাসী আমায় বললেনঃ যুদ্ধ তো সবে শুরু, এখনই কি জয়ের কথা বলেন। খান সেনাদের বিষদাঁত ভেঙে না দেয়া পর্যন্ত জয় কিসের। আমাদের হাতে অস্ত্র ছিলো না তাই খান সেনারা ফাঁকা মাঠে কারদানি দেখিয়েছে, এখন তো আমরা সবে অস্ত্র ধরেছি, তারা শোধ তুলবো না?

গ্রামের একজন যুবক বললেন, ‘অস্ত্র যখন ধরেছি তখন বেঁচে থাকতে খান সেনারা এই গ্রামে আর ঢুকতে পারবে না। চেষ্টাও তারা কম করেনি, ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও চেষ্টা করেছে, কিন্তু এখন মজাটা টের পেয়েছে তারা। এখন তারা মাইল সাতেক দূরে থানা গেড়েছে।’

সবখানেই এক মানসিকতা। খরচাপাতি কমিয়ে দিয়েছে সবাই। খাদ্যসামগ্রী জমিয়ে রাখছে ভবিষ্যতের জন্য। গ্রামের এখানে-ওখানে জঙ্গল হয়ে গেছে- আমাদের যোদ্ধাদের জন্য খুবই অনুকূল। গ্রামবাংলা যুদ্ধ ও জীবন সব এখন একাকার হয়ে গেছে।

মুক্তিযোদ্ধারা এমন চতুরতার সঙ্গে খানসেনাদের ঘায়েল করে চলেছে যে আমাদের কোন প্রাণহানি হয় না বল্লেই চলে। তার কারণ নিজেদের পরিচিত দেশে যুদ্ধ করে চলেছে মুক্তিসেনারা সহজে তারা দেশের মাটির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মানুষের শত্রুখান সেনারা তা পারে না। কাউকেই তারা বিশ্বাস করতে পারে না, দেশের মাটি ও পরিবেশ তাদের অনুকূল নয়। কারণ এদেশ তাদের নয়, এদেশকে তারা জানে না, এ দেশের মানুষকে চেনে না, জানে না। তারা কেউ এদেশের নয়। তারা যে জোর করে এদেশে থাকতে চাইছে সেটি নিতান্তই অস্বাভাবিক ব্যাপার তাই তারা এদেশে থাকতে পারবে না, এদেশ থেকে তাদের চলে যেতে হবে, এদেশের মানুষই তাদের তাড়িয়ে দেবে। মাটির সঙ্গে ও মানুষের সঙ্গে যারা শত্রুতার করে তাদের এরকমই পরিণত হয়ে থাকে।

যুদ্ধ কিভাবে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তা দু-পাঁচজন মুক্তিসেনার সঙ্গে আলাপ করলেই জানা যায়। যারা আহত হয় তাদের কারুর হাতে বা পায়ে, কিংবা কাঁদে বা শরীরের অন্য কোথাও হয়তো গুলি লাগে। এগুলো যেন কাউকে বলার মতো কোন ব্যাপার নয়। নিতান্ত জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যায়ঃ গুলি তা লেগেছিল

গোটা দুই-হাত কিংবা পায়ে বা অন্য কোথাও বেশ কিছু ছেলে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের কাছে তা বিশেষ কোন ব্যাপার নয়, জীবনে আর পাঁচটা ঘটনা প্রত্যেকদিন ঘটে, ঘটেছে; এও তেমনি। সে জন্যে এসব ব্যাপারে কোন মুক্তিসেনার ভ্রক্ষেপও নেই। তাদের সবার সামনে একটি মাত্র লক্ষ্য-শত্রু ধ্বংস করা।

দুটি তরুণের কথা শুনলাম। কয়েকবার যুদ্ধ করেছে এমন একটি ছেলের নাম খোকন। স্কুলের ছাত্র। হালকা গড়ন। লাজুক লাজুক ভাব। সবার সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতো। যুদ্ধ করতে করতে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, কোন সুযোগ এলেই সে লাফিয়ে উঠতো। তার সঙ্গে শেষবারের মতো যখন আমার দেখা হয় তখন সে বারবার আমাকে বলেছিল, “আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য শুক্র খতম করে এদেশের শোষিত মানুষকে সত্যিকার স্বাধীনতা দেয়া। কেউ যেন আর কোন দিন আমাদের বঞ্চিত পদদলিত করতে না পারে সে জন্যই আমরা জীবন দিচ্ছি। পাক-সেনাদের দ্বিমুখী আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিল খোকন। একটি সজিনা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গুলি চালাচ্ছিল সে। তার শেষ চেষ্টা ছিল সঙ্গীদের বাঁচানো। কয়েকজন খানসেনাকে খতম করার পর একটি গুলি সজিনা গাছ ভেদে করে তার শরীর বিদ্ধ করে। মৃত্যুর শেষ মুহুর্তে তার উত্তর ছিল একজন খান সেনার উদ্দেশে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে দেয়া। তাতেই খানরা তাদের বহু সঙ্গীকে হারিয়ে পালিয়ে যায়।

কাছাকাছি এক শিবিরে দেখা হয় হাবলুর সঙ্গে। তার বুকে পাশ থেকে এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে। বাঁ হাতেও লাগে কয়েকটি গুলি, বা পা-ও রেহাই পায়নি। ডান হাত ছাড়া হাবলুর কোন অঙ্গই আর চালু ছিল না। বুক পেটের সামনের মাংস সমেত উড়ে চলে যায়, হাত-পা আচল তবু হাবলু যুদ্ধ চালিয়ে গেছে এক হাতে, ছুড়েছে গ্রেনেড। যে খানসেনাটি তাকে গুলি করেছিল তাকে হাবলু শেষ করেছে এক গ্রেনেডেই। সামনে যে কয়টি পড়েছিল তাদের কাউকেই ছাড়েনি সে। তারপর বুকে হেঁটে জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সে নিরাপদ জায়গায় চলে। হাবলুর বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো অচল হয়ে গেছে।

হাবলু বললো, “আমরা এখন খানদের একেবারে কাছে না পেলে আর গুলি ছুড়ি না। ওরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে, আমরা হিসেব করে গুলি খরচ করি। ওরা বেহিসাবীর মতো মরে, মরে অন্যায়ের ধ্বজাধারী হয়ে। আমরা মরি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, প্রতিটি প্রাণ আমাদের অমূল্য, একটি একটি মৃত্যু একটি অবদান।”

এরকম বহু খোকন ও হাবলুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তারা সবাই প্রাণ দিচ্ছে, দেবে। তারা বারবার বলেছে, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা শোষণের শেষ ঘাঁটিটি পর্যন্ত ধ্বংস করতে চাই। কড়াই থেকে আগুনে পড়তে চাই না আমরা। দশ লক্ষ নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। মরছে প্রতিদিন হাজার হাজার। রক্ত দিচ্ছে মুক্তিসেনারা, দেশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এর বিরাম নেই। কিন্তু তার মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ যেন মুছে যায়, শোষক যেন ধ্বংস হয়। শোষক যেন না গজায়, গরম কড়াই থেকে আমরা যেন আগুনে না পড়ি। তাহলেই, কেবল তাহলেই আমাদের জীবন বিসর্জন, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের যুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ সার্থক হবে।

(“জাফর সাদেক’ ছদ্মনামে মোহাম্মদ আবু জাফর রচিত)

৩ নভেম্বর, ১৯৭১

‘মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল প্রবাদটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য পিণ্ডি অধিকর্তাদের বেলায়। কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, ৯০ লক্ষ লোককে দেশত্যাগী, আরো অসংখ্য গৃহ ভস্মীভূত এবং লুণ্ঠন করে হঠাৎ টনক নড়েছে। আজ ইয়াহিয়ার বাদশাহী সিংহাসন টলোমলো, জল্লাদবাহিনীর আর্তনাদে মুখর সমস্ত পাকিস্তানের আকাশ বাতাস। যারা এসেছিল এদেশকে পদানত করতে, শৃংখল পরাতে, ধনসম্পদ লুট করতে আজ মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে হত্যাকারী হয়ে উঠেছে হতোদম, গতপ্রাণ। জল্লাদ বাহিনীর মনেও আজ ভয়, সন্ত্রাস দানা বেদে উঠেছে। মুক্তিবাহিনীর নাম শুনলে তিনবার ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করে।

এখন উপায়? উপায় খুঁজে বের করেছে বিশ্ব ইতিহাসের ঘৃণিত নায়ক, বুদ্ধিবিবেক বর্জিত সেনাপতি ইয়াহিয়া খান। খবরের কাগজে প্রকাশিত হলো বিবৃতি, সর্ব অসত্যের ভাণ্ডার রেডিও পাকিস্তান থেকে ক্ষণে গৃহহীন আশ্রয়হীন সংসারকে টিকিয়ে রাখার জন্য, একটু আশ্রয়, একটু নিরাপত্তার অভিপ্ৰায়ে। দরদবিগলিত কণ্ঠে পরম বন্ধুর মতো আহবান এলো- ‘আয়, ওরে আয় ঘর ছেড়ে যারা গেছিস তারা আয়। তোদের সব আছে, তোদের সব দেবো। কিন্তু বাংলার মানুষ দুর্জনের আশ্বাসে ভুলল না। কেননা তারা জানে, ‘খলের ছলের অভাব হয় না। একবার তারা আঘাত পেয়েছে, বহু কষ্টে বুকের পাথর চাপা দিয়ে ভুলে আছে মা বোন ভাই আত্মীয়স্বজনের হত্যার কাহিনী। তারা চায় নায় আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক।

ইয়াহিয়ার তাঁবেদাররা বলল, ‘সংবর্ধনা শিবিরগুলি ফেরত-উদ্বাস্তুদের দ্বারা ভেঙ্গে গেছে।” সংগে সংগে ইংল্যাণ্ডের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো, ‘সংবর্ধনা সভায় একটি লোকও দেখলাম না। দুর্জনদের মিথ্যা উক্তির প্রমাণটি লক্ষ্য করুন।

যারা মানুষকে ঘরছাড়া করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে, বাঙালীকে হত্যা করে সংখ্যাসমতা আনতে চাইছে- তাদের কোন আশ্বাস কি সংগ্রামী মানুষ সুস্থ মানুষের উক্তি বলে গ্রহণ করতে পারে?…

শুধু এই নয়, আরো আছে। ইয়াহিয়া নির্বাচনের দিন ও তারিখ ঘোষণা করেছে। ভাবখানা এই, নিজের মুরগী যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে কাটব’। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার, ভাগ্য, ধ্যান-ধারণা তো সস্তা বা মূল্যহীন নয়। ইয়াহিয়া খান অনুভব করেছে এতদিনে।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো, জনপ্রিয় অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগের সদস্যদের দেশদ্রোহী বলে ফরমান জারি করা হলো। আবার সেই ব্যক্তি যে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো, সে দলেরই নির্বাচিত কতিপয় সদস্যদের আবার বৈধ বলে মেনে নিলো। প্রবঞ্চক প্রবঞ্চনার পথ বেছে নিলো। বাতিলকৃত সদস্যপদ আবার নির্বাচন হবে। এ যেন ছেলের হাতের মোয়া। সামরিক শক্তির বলে গণমানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা যেন ছেলেখেলা ব্যাপার।

শুধু তাই না, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিনিধি নির্বাচিতও হয়ে যাচ্ছে। আর আশ্চর্য, আওয়ামী লীগের সংগে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, খেলা আর বলে কাকে? মনগড়া হিসেবে বিশ্বকে ভাঁওতা দেয়ার যে পথ বেছে নিয়েছিল ইয়াহিয়া খান, আজ তা নিদারুণভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত। বাংলার মানুষ আজ তার জবাব দিচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং বারবার।…

(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)

৭ নভেম্বর, ১৯৭১

জল্লাদ বাহিনীর মৃত অফিসারদের জন্য কাটের বাক্স তৈরী করা হচ্ছে এবং সেটা হচ্ছে ব্যাপকহারে। বেচারা কাঠমিস্ত্রীর শান্তি বা স্বস্তি নেই। দিন-রাত তার কাজ-বাক্স বানাও। মরা লাশগুলোকে জলদি পাঠাও নিজের দেশের মাটিতে। কারণ? কারণ অনেকগুলো। প্রথমত, বাংলার মানুষ যেন বুঝতে না পারে যে বর্বরবাহিনীর অফিসাগুলোর একে একে লোপাট হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়, বাংলার মাটিতে ওদের ঠাঁই নাই। কেননা ওরা বাংলার নয়। বাংলার মাটির এতোটুকু দরদ নেই ওদের জন্য। বাংলা শুধু বাংলাদেশের জনগনের। এখানের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কৃষ্টি সব এদেশেরই। এসবই বেড়ে উঠেছে সবুজ কোমল লতার মতো বাংলার মাটি থেকে। তাই এ মাটিতে কি ঠাই পেতে পারে যারা বাঙালী বিদ্বেষী, যারা বাংলার পয়লা নম্বরের দুশমন? কখনোই না।

হিংস্র পশুদের খাঁচা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল বাংলার শ্যামল প্রান্তর আর জনপদে। লোভী, বিবেকহীন পশুর দল দিকদিশাহীনভাবে চালিয়েছে অত্যাচার, হনন আর সন্ত্রাসের রাজত্ব।

        কিন্তু তারপর? কুল আর রক্ষা হয় না। চারিদিক থেকে আঘাত হানছে বাংলার মানুষ। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, শহরে-বন্দরে, জলে-স্থলে, যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাদের খতম করছে। এখন শয়তানদের পথ চলতে ভয়, ঘরের মধ্যেও নেই স্বস্তির আশ্রয়।

        এজন্যেই নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে এবং মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য রাইফেল দেখিয়ে টেনে নিয়ে আসছে খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষকে। তাদের আড়ালে এগিয়ে আসছে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখে। কিন্তু এতেও কুল রক্ষা হচ্ছে না। তীক্ষ্ণধী, সদজাগ্রত বাংলার প্রহরী মুক্তিবাহিনী তাদের কৌশল ধরে ফেলেছে। পাল্টা এমন আঘাত হানছে যে দস্যুর দল পরি কি মরি করে পালাতে দিশা পাচ্ছে না।

        ভীত সন্ত্রস্ত জল্লাদবাহিনী শহরের চারপাশে নদীর ধারে গড়েছে বাঙ্কার, বসিয়েছে মেশিনগান। কিন্তু রাতের অন্ধকারে গা মিশিয়ে এসে মুক্তিবাহিনী আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের উপর, তাই কোন কিছুতেই বিশ্বাস নেই। নদী দিয়ে পানা ভেসে যাবে ওদের সামনে দিয়ে? যাদি মুক্তিবাহিনী হয়? মেশিনগানের গুলি চলে পানার ওপর।

        রাতের অন্ধকারে শিয়াল-কুকুরেরও ওদের সীমানা দিয়ে যাওয়ার উপায় নাই। হত্যাকারীদের ধারণা, মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা যেকোন রূপ ধারণ করতে পারে-অতএব দৃশ্যগোচর কোন কিছুকেই ক্ষমা নেই।

        রাতের বেলায় মুক্তিবাহিনীর গুলির শব্দ পেলে সে পথে তারা হাঁটে না। প্রথমে তাদের পরম ভৃত্য রাজাকারদের পাঠিয়ে খোজ খবর নেয়, পরে বিশ্বাসযোগ্য হলে সেখানে যায়।

        একবার রাতের বেলায় গেরিলারা একজন পাক দালালের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে হত্যা করে। দালালের এক শুভানুধ্যায়ী উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় পার্শ্ববর্তী জল্লাদবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে। খবর দেয়, ‘হুজুর, অমুককে মুক্তিবাহিনী এসে মেরে ফেলল। এখনো ওরা আছে, রাজাকারদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। কাপুরুষ পশুপ্রবর, খেকিয়ে উঠে বলল, ‘হাম কিয়া করেগা। মুক্তিফৌজ আয়া হ্যায়, তুম লোগ যা কর হঠা দো। আভি হাম নেহি যায়েগা, সুবাহ মে যায়েগা। নিরাশ হয়ে ফিরে এলো দালালের সাগরেদ।

        এখন ফল হয়েছে অন্যরকম। এখন বরং পশুগুলো এলে এইসব ঘা খাওয়া মানুষগুলোই এসে খবর দেয়, ‘ওরা এসেছে। তাদের সংখ্যা এবং শক্তি সমস্তই পুংখানুপুংখরূপে জানিয়ে দেয় মুক্তিবাহিনীকে।

        যারা নেহাৎই প্রাণের দায়ে শান্তি কমিটির সদস্য হয়েছিল বা রাজাকারে নাম লিখিয়েছিল, আজ তারা সর্বতোভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত। শুধু তাই নয়, মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড মারের সামনে টিকতে না পেরে দলে দলে রাজাকার আত্মসমর্পণ করছে। জংগীশাহীর জঘন্যতার রূপটাও ফাঁস করে দিচ্ছে।

        আজ স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে ভাড়াটে সৈন্যের চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সৈনিক। আমাদের গেরিলারা আজ তাই হয়ে উঠেছে অজেয়, দুর্বার।

        আর পক্ষান্তরে এবং মুক্তিবাহিনীর সাম্রাজ্য বাসনা ঘরের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।

        দুঃসাহসী গেরিলাদের এবং মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে খতমকৃত জালেম বাহিনীর অফিসারের জন্য আর কতো কতো কাটের বাক্স লাগবে, তার খতিয়ান কি করছে ইয়াহিয়া খান?

(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)

১ ডিসেম্বর, ১৯৭১

        যাদের চক্ষু আছে এবং চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন, আজ তাঁদেরকে একবার বাংলাদেশের রণাঙ্গনে দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ করবো। একবার চোখ খুলে দেখুন আমাদের সংগ্রামী বীর যোদ্ধা বাঙালী যুবকগণ কিভাবে পশ্চিম পাকের হানাদার পশুদের খতম করে ক্রমাগত জয়যাত্রার পথে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের চূড়ান্ত দুর্দিনে পশু পাকসেনাদের হাত থেকে দেশকে সম্পূর্ণ মুক্ত করবার জন্য মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকগণ আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, বিক্রম, ধৈর্য এবং দেশপ্রেমিকতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার নিদর্শন একান্ত বিরল। একবার চেয়ে দেখুন যশোর রণাঙ্গনের দিকে-আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাত সামালাতে অপারগ হয়ে কিভাবে খানসেনারা পশ্চাদপসারণ করছে। খুলনায় একটি জাহাজ ডুবিয়ে আমাদের সেনারা জাহাজ চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। সিলেট, চাটগাঁ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া সর্বত্রই আমাদের বীর যোদ্ধাদের অগ্রগতি এবং পাকসেনাদের পরাজয় অব্যাহত রয়েছে। ঢাকায় বেসামাল হয়ে সামরিকচক্র বারবার সান্ধ্য আইন জারি করে নিরীহ নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন করছে। কিন্তু তাই বলে বাঙালীর মনোবল হ্রাস পায়নি। আমাদের বীর সেনাদের অগ্রগতি দেখুন এবং জেনে রাখুন, ইনশাল্লাহ সময় আর খুব দূরে নাই যখন ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা গৌরবের সঙ্গেই উত্তোলিত হবে।

        সে কারণেই বলছিলাম যাঁদের চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন আজ তাঁরা চোখ খুলে একবার দেখুনশ্রবণশক্তি যদি বধির না হয়ে থাকে তবে স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের এই বিজয় বার্তাগুলো শুনুন। কথাগুলো এইজন্য বলছি যে বাংলাদেশ এখনো কিছুসংখ্যক বাঙালী আছেন যারা চোখ থেকেও অন্ধ এবং শ্রবণশক্তি থেকেও বধির। ঢাকা, রাজশাহী প্রভৃতি বেতার কেন্দ্রে এই জাতীয় কিছু অন্ধও বধির বাঙালী এখনো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য দেদার চীৎকার করে যাচ্ছেন। এইসব বাতুলদের তখনই জ্ঞানোদয় হবে যখন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গীন তাদের গর্দানকে স্পর্শ করবে। যে প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য এখনো কিছুসংখ্যক জন্মদালাল বাঙালী গলদঘর্ম হচ্ছেন তাদের বোঝা উচিত যে আজ ঐসব প্রভুদের কি অবস্থা। পশ্চিম পাকিস্তানেও বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। বেলুচিস্তানে বেলুচরা এবং সীমান্ত প্রদেশে পাঠানরা এবার অস্ত্ৰধারণ করেছে। এমান কী রাজনীতির ক্ষেত্রে বালকোচিতে চাপল্যই যাঁর বৈশিষ্ট্য সেই জুলফিকার আলী ভূট্টোর খোদ জন্মভূমি সিন্ধু ও আজ বিক্ষুদ্ধ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভূট্টো এবং ইয়াহিয়া চক্রের পালাবার স্থানটি পর্যন্ত থাকবে না। এই দুই জানোয়ারের শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথাই আমরা এখন ভাবছি।

        জানি, বহু দুঃখ এবং বেদনা, এবং নিপীড়ন বহু রক্তক্ষয় এবং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দিন কেটেছে এবং এখনো অনেক ক্ষেত্রে সেভাবেই তাঁদের দিন কাটাতে হচ্ছে। জানি, আমরা যারা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে দুদিন পর বিজয়ীর বেশে নতুন করে যাত্রা শুরু করবো, তাদের অনেকেই প্রিয়জন হারানোর গভীর বেদনাকে কোনদিন ভুলতে পারবো না। যে জীবন আমরা হারিয়েছি, যে সম্মান এবং ইজ্জত আমরা পশুদের হাতে বিসর্জন দিয়েছি, যে সম্পদ আমাদের লুষ্ঠিত হয়েছে, জানি, সেসব আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই অবক্ষয়, এই অপরিসীম ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা একটি জাতিকে, একটি দেশকে বিশ্বের ইতিহাসে নবজন্ম দান করতে চলেছি- এই মহান গৌরব একান্তভাবেই আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান বংশধরদের। আমাদের পূর্বপুরুষদের এই গৌরব অর্জনের সৌভাগ্য হয়নি। সেদিকে থেকে আমরা অনেক ভাগ্যবান। দুঃখ আমাদের অনেক হয়েছে, রক্ত এবং জীবন আমাদের প্রচুর দিতে হয়েছে সত্য কিন্তু স্বাধীনতার জন্য এই মৃত্যু এই রক্তদান, এই আত্মত্যাগ সবকিছুর মধ্যেই একটি বিরাট মাহাত্ম্য আছে। সেই মাহাত্ম্যই আমাদের মহীয়ান করে তুলেছে। তার জোরেই ভবিষ্যৎ বংশধরগণ আমাদের ললাটে গৌরবের টিকা দিয়ে বলতে পারবে যে আমরা আজ দেশের কারণে মরতে শিখেছিলাম বলেই তারা মানুষের মত বাঁচতে পারবে। আমাদের

আত্মত্যাগ ও মৃত্যুর মাধ্যমে ভবিষ্যত বংশধরদের সত্যিকার মানুষের মত বাঁচবার একটি স্থান, একটি পথ আমরা আজ তৈরি করে যাচ্ছি। যে মহৎ কারণের জন্য জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে, অনেক অভাব ও দীনতাকে হাসিমুখে বরণ করে এবং দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগের সকল ছোবলকে দু’পায়ে দলিতমথিত করে আজ বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন, তার মূল্য মানুষের ভাষায় নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এই মহান কারণ ও সংগ্রামের উজ্জ্বলতম আদর্শ শুধু বাংলাদেশের নয়, ভবিষ্যতে সমস্ত বিশ্বের সমাজ গঠনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে। বাঙালী জাতি হিসাবে আমরা যে সমগ্র বিশ্বের সম্মুখে এই একট অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনে সমর্থ হয়েছি, তা কম গৌরবের কথা নয়।…

        এটা অত্যন্ত আশার কথা যে বিশ্ববিবেকের ক্ষেত্রে আজ আশানুরূপ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন সকল মানুষ আজ উপলব্ধি করেছেন যে, আমাদের সংগ্রাম ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে। অবশ্য বাংলাদেশের মানবতার যে অপমান সংঘটিত হয়েছে, মানবতার ইতিহাসে তুলনা হয় না। আর এই লাঞ্ছিত মানবতাকে রক্ষার জন্য সভ্যতাগর্বী উন্নত দেশগুলো সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসবেন, আমরা গোড়া থেকেই এমন আশা করেছিলাম। সে আশা আমাদের সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে একথা আমরা বলতে পারবো না। গণতন্ত্রের আদর্শকে সমগ্র বিশ্বে যাঁরা সমুন্নত রেখেছেন বলে গর্ব করেন, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী ভূমিকা আমাদের সম্পূর্ণ নিরাশ করেছে।

        বিশ্বের জনগণ আমদের সাথে আছেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও আমদের সংগ্রামকে সমর্থন করেন। এ ছাড়া বিশ্বের সর্বত্রই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম মোটামুটি একটি সহানুভূতি লাভে সমর্থ হয়েছে। আমরা আশা করব, আমাদের চুড়ান্ত বিজয়ের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বিশ্ব বিবেক আমাদের সপক্ষে আরো জাগ্রত হবে। আমরা একথা জানি,স্বাধীনতা কোনদিন শুধুমাত্র অপরের সাহায্যে আসে না সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে সেই স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষা করতে হবে। আমরা তাই আজ দিকে দিকে সংগ্রামের এমন দুষ্কর যাত্রাপথকে বেছে নিয়েছি। আর এই সংগ্রামই আমাদেরকে বিজয়ের পথে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর জয়পতাকার ছায়া আজ বাংলা সমস্ত অঞ্চলে অঞ্চলে সবুজ ঘাসের ওপর বিপুল এক শুভাবহ মায়ার প্রলেপের মত বিস্তারিত হচ্ছে। সেদিন আর অধিক দূরে নয় যখন এই বিজয়-কেতনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমরা জাগ্রত সাড়ে সাত কোটি বাঙালী কবি নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে গভীর প্রত্যয় জননী জন্মভূমি বাংলাদেশকেও প্ৰণতি জানাবোঃ

নমঃ ননঃ বাংলাদেশ মম

চির মনোরম চির মধুর

বুকে নিরবধি বহে শত নদী

চরণে জলধির বাজে নূপুর।

(ডঃ মযহারুল ইসলাম রচিত)

 

Scroll to Top