শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১। দ্বন্দ্বের মূলে | ওয়াশিংটন পোস্ট | ৪ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১৪,১১,২৩-২৪>
ওয়াশিংটন পোস্ট, ৪ এপ্রিল ১৯৭১
দ্বন্দ্বের মূলে
–সেলিগ এস হ্যারিসন
গত সপ্তাহে রাজধানী ঢাকার রাজনৈতিক ডেডলক হবার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সামরিক প্রতিশোধের উন্মত্ততা বাংলাদেশের ৭৩ মিলিয়ন মানুষের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম যেন চাকার মধ্যে আরেকটি চাকার কাহিনী।
জেনারেল ইয়াহিয়া এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাবশালী নেতারা পূর্ব পাকিস্তানে সস্বায়ত্তশাসনের ফলে কেন্দ্রে ক্ষমতায়নের ভারসাম্যের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন আছেন। কারণ মূলত পশ্চিমের সামরিক শাসকরাই কেন্দ্রীয় সরকারে আছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানে আভ্যন্তরীণ বিভাজন রয়েছে। সেখানে একদিকে প্রভাবশালী পাঞ্জাব সিন্ধ প্রদেশ আছে যারা শিল্প, সামরিক ও জমিদারি প্রধান অঞ্চল এবং অন্যদিকে আছে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ও বেলুচিস্তানের সংখ্যালঘু প্রদেশ।
জেনারেল ইয়াহিয়া বাঙালিদের মুক্তি আন্দোলন এড়ানোর জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন কারণ তা না হলে ৬০ মিলিয়ন মানুষের শক্তিশালী পশ্চিম প্রদেশের সাথে স্বৈরশাসনের তুলনামূলক পরিমাপের প্রয়োজন হবে।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশ, খাইবার পাসের কারণে বিখ্যাত। এখানে মানুষ পুশতু ভাষায় কথা বলে। তারা দির্ঘদিন ধরে তাদের স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বতন্ত্র “পুশতুনস্তান” এর মাধ্যমে স্বশাসন চায়।
প্রতিবেশী জনবহুল বালুচিস্তান দ্রুত বেড়ে উঠেছে – সম্প্রতি সময়ে অনেকদিন মরুভূমি হয়ে পরে থাকার পর সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি পাওয়া যাওয়ায় তারা নিজেদের ব্যাপারে সজাগ।
বালুচ উপজাতীয় নেতারা বেলুচিস্তানের শিল্পায়ন জন্য গ্যাস চাইছেন যা প্রতিবেশী পাঞ্জাব থেকে চ্যানেলের মাধ্যমে দেয়া যেতে পারে।
জেনারেল ইয়াহিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান ও পশ্চিমাঞ্চলীয় সংখ্যালঘু প্রদেশের মধ্যে জটিল ত্রিমাত্রিক বিরোধিতার মধ্যে গত সপ্তাহটি ছিল সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার ভুট্টো, পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা, তিনি ন্যাশনাল এসেম্বলিতে পশ্চিম অঞ্চলের দলগুলোর মধ্যে একক বৃহত্তম গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসবে আবির্ভূত হন।
জনাব ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়াকে একটি একক, একীভূত পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন, যেহেতু চারটি আলাদা প্রদেশে স্থানান্তরিত হলে তিনি পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলের স্থানীয় নেতা হিসেবে পরিগণিত হবেন।
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু প্রদেশ পাঞ্জাব ও সিন্ধু – অনেক দিন ধরে বাঙালির দিকে তাকিয়ে ছিল – তাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। তারা চেয়েছিল মুজিবের যেন পূর্বাঞ্চলে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসনের পাশাপশি পশ্চিমাঞ্চলের চারটি পৃথক প্রাদেশিক পরিষদের নেতাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে জোর দাবি জানান।
তারপর চেয়েছিল তিনি যেন তার জাতীয় পরিষদে ৩১৩ টির মধ্যে পাওয়া ১৬৭ টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন এবং একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেন। ট্রেড ইউনিয়ন এবং সিভিল লিবার্টী, প্রেস লিবার্টী এবং শ্রম অধিকারের জন্য পশ্চিমের সংস্কারবাদীদের মনোভাবও সেটাই ছিল।
বিভিন্ন কারণে জেনারেল ইয়াহিয়াও চেয়েছিলেন যেন মুজিবুর রহমানকে তার অধীনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যেখানে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার হবে যা সেনাবাহিনী দ্বারা প্রভাবিত।
কিন্তু বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী বিচ্ছিন্নতাবাদী দ্বারা মুজিবুর রহমানকে টেনে ধরা হল – রাওয়ালপিন্ডিতে অফিস গ্রহণের মাধ্যমে সেটি ভার্চুয়াল রাজনৈতিক আত্মহত্যার সামিল হত।
তা না করে মুজিব জোর দিলেন যে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি প্রাথমিকভাবে দুটি অংশ হবে – পূর্বের জন্য একটি এবং পশ্চিমের জন্য একটি, – পূর্ববাংলার গোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বাঙালি পরিচয়ের পরিবেশিত হবে।
পশ্চিমা সংখ্যালঘু প্রদেশগুলি যেমন জেনারেল ইয়াহিয়া হিসাবে বিরোধিতা করেছিল, তেমনি ভয় ছিল যে, ভুট্টো তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলবে এবং তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তাদের পৃথক প্রাদেশিক অবস্থান প্রত্যাখ্যান করবে।
পাশাপাশি আরেকটি ইস্যু হল দুই উইংয়ের জন্য পৃথক অধিবেশনের ব্যাপারটি। জেনারেল ইয়াহিয়ার জন্য এটা ভাববার বিষয় ছিল যে অ্যাসেম্বলির সেশনের উদ্বোধনের পূর্বে তিনি প্রাদেশিক শাসকদের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জোরালোভাবে ব্যাবস্থা গ্রহণ করবেন কিনা।
শুক্রবার তার সম্প্রচারে জেনারেল ইয়াহিয়া যুক্তি দেন যদি এসেম্বলিকে একই সাথে নতুন অথরিটি বেইজের সেশন না বলা হয় তাহলে মুজিবুরের সামরিক আইন বন্ধ করতে হবে এই মর্মে যে দাবি ছিল তা কাগজে লেখা ছিল না।
জেনারেল ইয়াহিয়া বিবৃতিতে বলেন যে মুজিবুর মঙ্গলবার রাতে এসেম্বলি ইস্যু নিয়ে আলোচনার প্রাক্বালে তার চূড়ান্ত অবস্থান অস্বীকার করেন। এভাবেই তিনি তার বাঙ্গালী নেতাদের “অস্থির এবং স্বেচ্ছাচারী’ কথা বলাকে সম্পূর্ণ নিন্দা করেছে। জেনারেল ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন, “আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাই যে, যে মানুষ ও দল পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চায় তারা পাকিস্তানের শত্রু।’’
কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে মুজিবুরের ঘনিস্টজন বলেন যে আলোচনায় প্রতিষ্ঠিত হল নিয়মানুযায়ী, জেনারেল ইয়াহিয়া ও শেখের মধ্যে ক্ষমতার হস্তান্তর করার প্রক্রিয়াসহ অমীমাংসিত সমস্যা নিয়ে একটি চূড়ান্ত “আলোচনা” হবে।
পশ্চিম পাকিস্তান সূত্রে জানা যায় যে জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকায় মুজিবুরের সাথে প্রাথমিক আলোচনার পর একটি সমঝোতার ব্যাপারে স্বল্প আশাবাদী ছিলেন কিন্তু সামরিক প্রস্তুতির জন্য সময় ক্ষেপণের জন্য তিনি আলোচনা করার প্রয়াস চালিয়ে যান।
এই সূত্রে জানা যায় যে জেনারেল ইয়াহিয়া মুজিবুর অনুভূতি ও আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা এবং তার স্বতন্ত্র মনোভাবের দ্বারা ক্রমশ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তাই জেনারেল ইয়াহিয়াই শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসলেন।
মুজিবুর এসেম্বলিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রধান বিষয়টি মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন যদি জেনারেল ইয়াহিয়া প্রকাশ্যে পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলে অবিলম্বে সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি রেজুলেশনের আগাম ঘোষণা দিতেন।
তিনি ভীত ছিলেন যে এসেম্বলিতে হয়ত অফিসিয়ালি একটি যুদ্ধক্ষেত্র হবে এবং ক্ষমতার স্থানান্তর করার জন্য কোন ফর্মুলা বের হবে না।