২৬। ধামরাই আজ শ্মশান (৪০০-৪০১)
সূত্র – সংবাদ, ৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২
রথযাত্রা উপলক্ষে আর ভীড় জমবে না এখানে
ধামরাই আজ শ্মশান
বাংলাদেশের একটি স্থানের নাম ধামরাই। নামটাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত আছে অনেক কিংবদন্তি। অনেক ভক্ত প্রাণ এই নামটিকে স্মরণ করে ভাবাবেগে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এখানকার প্রাচীন কীর্তি ধামরাইয়ের রথ। বাংলাদেশের এত বড় রথ আর কোথাও ছিল না। শোনা যায় এই রথটাকে টানতে প্রায় একশত মণ পাটের দড়ির দরকার হতো।
রথযাত্রার সময় ধনাঢ্য ব্যাক্তিরা এ পাট দান করতেন। রথযাত্রা উপলক্ষে বসতো মেলা। ভক্তজনেরা এসে ভীড় জমাতো এই ধামরাইয়ে। অসংখ্য সাধু সন্ন্যাসীর পদধুলিতে পবিত্র হয়ে উঠতো ধামরাইয়ের পথ ঘাট।
গত এপ্রিলের প্রথম দিকে ধামরাইয়ে প্রবেশ করলো পাক-ফৌজের একটি দল। লুট করলো মন্দিরের সোনাদানা টাকা-পয়সা ও মূল্যবান আসবাবপত্র। বাংলার এই বিখ্যাত রথটাকে লাগালো আগুন। কয়েকদিন ধরে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেল রথটি। পাক সেনারা রথটি পুড়িয়ে ক্ষান্ত হলো না। এর স্মৃতি বাঙ্গালীর মণ থেকে মুছে ফেলবার জন্য ছাই ও কয়লাগুলো ট্রাকে বোঝাই করে নিয়ে গেল।
বাংলাদেশ থেকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দিল একটা ঐতিহ্যকে। ভক্তজনের কলগুঞ্জনে ধামরাই আর জেগে উঠবে না সহসা। ভক্ত রথীরা আর আসবে না এখানে। রথটিও কোনদিন নতুন করে গড়ে উঠবে না। ধামরাই কালের বুকে জেগে থাকবে ধ্বংসের ইতিহাস হয়ে। পাক হানাদার এ ঐতিহাসিক রথটিকে নিশ্চিহ্ন করে থেমে যায়নি। এখানকার বহু লোককে গ্রেফতার করেছে। নির্যাতন করেছে। হত্যা করেছে। পাক হানাদারদের সাথে জুটেছিল বাংলার কতিপয় ঘৃণ্য নরপিশাচ। তারাই পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত হানাদারদের। এখানেও পথ দেখিয়েছিল কতিপয় এদেশী মোহাম্মদী বেগ। ধামরাইয়ে নিহত হতভাগ্য বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে ধামরাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক দীনেশ বাবুর কথা। হার্নিয়ার রোগী ছিলেন দীনেশ বাবু। তাঁর স্ত্রী মস্তিষ্ক বিকৃত। তাঁর তিনটা ছেলে। তৃতীয় ছেলে হাবুল জগন্নাথ কলেজর বাণিজ্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
বাবার সঙ্গেই বাড়ীতে ছিল গোলযোগের সময়। ৯ই এপ্রিল বেলা ১২টা। তিনি রান্না করছিলেন। এর ফাঁকে উঠতে হল তাঁকে। কারণ প্রানের ভয়ে পালাচ্ছে লোক। বেলা ১২টার মধ্যে ৩/৪ বার দৌড়ালেন আবার ফিরে এলেন। অদৃষ্টে যা আছে তা খন্ডাবে কে? পাক বাহিনী রাস্তা কেমন করে চিনবে বা তাঁকে খুঁজে বের করতে পারবে? কিন্তু ঘরের শত্রু বিভীষণ।
বাংলার মাটিতে ছিল অসংখ্য মীরজাফর আর জগত শেঠ। এই মীরজাফর, জগতশেঠের বংশধররাই একজন দীনেশ বাবুকে শনাক্ত করে দিল। দীনেশ বাবু ধরা পড়লেন। ছেলে হাবুল বাড়িতেই। তাঁর সঙ্গে ৪/৫ হাজার টাকা। হাবুল ভেবেছিল হয়ত টাকা পেলেই বাবাকে ছেড়ে দিবে। তাই এগিয়ে গিয়েছিল দালালদের হাতে পায়ে ধরে বাবাকে ছাড়াতে। তাই বুঝি কাল এসেছিল। তাকেও রেখে গেলনা বর্বর ডাল কুত্তার দল।
তাদের থানায় রেখে দেয় একরাত। দীনেশ বাবু এবং তাঁর ছেলে হাবুলের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় এতেও দন্ড শেষ হল না দুটি নিষ্পাপ প্রাণের। দীনেশ বাবুর দিন শেষ প্রায়। হাবুলের জীবন যাত্রা হয়েছে শুরু। অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া হয় সম্ভাবনাময় প্রাণটিকে। এদের সাথে আরো যাদের ধরা হয়েছিল তারা নিতান্তই গরীব। তাদের প্রতিদিন কাজ না করলে পেটের খোরাক জোটে না।
এরা হচ্ছেন গান্ধীপাল (দোকানদার), বুদ্ধ সূত্রধর (লোহার কামার), গনেশ পাল (পান বিক্রেতা), চিনু বণিক (হকার), গয়া রাজবংশী (মাছ বিক্রেতা), প্রবেশ সুত্রধর (লোহার কামার) আরো ৪ জন নাম না জানা লোক। দীনেশ রায় এবং ছেলে হাবুলকে সহ এদের ধামরাই থেকে ৩/৪ মাইল দূরবর্তী কামালপুর বাজারে নিয়ে যায়। সবার চোখ বাঁধা। বাজারের পাশে কালামপুর আতাউর রহমান হাইস্কুলের মাঠ। মাঠের পাশ দিয়ে একটা খাল নদীতে গিয়ে পড়েছে।
বাজার থেকে স্কুলে আসতে একটা কালভার্ট। উপরে সিমেন্টের আস্তরণ নেই। বাঁশ দিয়ে সাঁকো বেঁধে লোক যাতায়াত করার মত ব্যাবস্থা করে রাখা হয়েছে। তখনও খালে জল গড়ায়নি। কালভার্টের নীচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হল ১৪ টি মানুষকে। সবার পুরোভাগে সর্বজন শ্রদ্ধেয় দীনেশ রায় এবং তাঁর পিছনে আদরের দুলাল হাবুল।
এভাবে ১৪ জনকে দাঁড়াতে হয়েছিল। তারপর আর বলা যায় না। বাংলার বুকে হানাদার ডাল কুত্তারা কত বীভৎস কান্ডই না করেছে। সবাই শেষ বারের মত ঘুমিয়ে পড়ল বাংলা মায়ের কোলে চিরনিদ্রায়।
এ নিদ্রা থেকে আর তারা জাগবে না।