৩১। নাটোরের ছাতনীতে পাক বাহিনীর বর্বরতা (৪০৯-৪১০)
সূত্র – পূর্বদেশ তারিখঃ ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
নাটোরের ছাতনী মাইলাইয়ের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে
হাজার মাইলের এক ছাতনী। বংগবন্ধুর আহবানে সমগ্র বাংলার মানুষ যেমন সাড়া দিয়েছিলো তেমনি ছাতনীর মানুষ ও সমস্বরে শ্লোগান দিয়েছিল : শোষকের মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। আর এটাতেই সমগ্র বাংলার ধ্বংস এর মত ছাতনীর ধ্বংস ও অনিবার্য হয়ে পড়ে।
আমাকে তোমরা খুন করো, তার বিনিময়ে আমার গ্রামের মানুষকে বাঁচাও, তোমাদের খোদার কসম, তোমরা আমার মানুষদের মেরোনা। মৃত্যুমুখো যাত্রী ভাবশী গ্রামের মনি সরকার আর্তি করেছিলেন হানাদার পাক বাহিনীর সৈন্যদের নিকট। হানাদার বাহিনী তাকে হত্যা করেছে। নির্মম ভাবে গায়ের চামড়া উঠিয়ে হত্যা করেছে। ছাতনীর হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী যুবক আবুল কালাম কান্নাজড়িত কন্ঠে শোনাচ্ছিলেন এই মর্মান্তদ কাহিনী। আবুল কালাম বললেন স্বাধীনতা সংগ্রামের দু’ মাস পর্যন্ত আমরা এদিক সেদিক পালিয়ে ভালোই ছিলাম।
হিন্দুদের আমরা পাহারা দিয়ে রাখতাম, কিন্তু এর মধ্যেও আমাদের অনেকবার লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হতো,কখন হয়ত নরপিশাচ অবাঙালী জল্লাদের দল গ্রামে ঢুকে পড়ে। তাদের তিনবার যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসতে হয়। বিংশ শতকে হালাকুর বংশধররা তিনদিন পর সশস্ত্র ভাবে ছাতনী গ্রামকে আক্রমন করতে আসে। গ্রামের মানুষ একত্রে খোদার নাম নিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে দলে দলে তাদের তাড়া করে, হানাদার বাহিনী বিভ্রান্ত হয়েছে ঘটনা দেখে। তারা পিছু হঠেছে।
কিন্তু অবাঙালী পাকিস্তানি অসামরিক নাগরিকদের দ্বিতীয় পিতা, ধর্মের কুলাঙ্গার জল্লাদ হাফেজ আব্দুর রহমান এই পরাজয়কে অপমান মনে করলো। তাই প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা প্রবল হলো তার। খুনের নেশাখোর এই জল্লাদ তাই পথ খুঁজতে চেষ্টা করেছে সর্বক্ষন। আবার হেটেছে সেই পথে। বনবেলা ঘুরিয়ার মসজিদ থেকে টেনে বের করলো ১০৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ সমর্থক বৃদ্ধ সৈয়দ আলী মুন্সিকে। ঘটনা ঘটলো ১৫ই জ্যেষ্ঠ। সৈয়দ আলী মুন্সীর লাশ দেখলো ছাতনীর মানুষ। ওরা কাঁদলো।
এর পরের ঘটনা সুপরিকল্পিত। ছাতনীর বর্তমানে সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ ৮২ বছরের নলিনীকান্ত বললেন, অরা রাত্রে ছাতনী দীঘির পাড়ে জমা হয়। রাত তখন প্রায় দুটো।
সকাল ৫টার দিকে গাঁ ঘিরে নেয়। ঘরে ঘরে ঢুকে সবাইকে বের করে হাত পেছনে বেধে নিয়ে যাচ্ছিল। বৃদ্ধের একমাত্র ছেলেকেও তারা হত্যা করেছে। শিশুকেও হত্যা করতে ছাড়েনি। বৃদ্ধ বলছিলেন ডাক্তার মনিরুদ্দিনের তিনটি বিবাহিত যুবক ভাইকে অরা হত্যা করলো। রুদ্ধ কন্ঠে বৃদ্ধ নলিনীকান্ত বললেন, পিশাচরা মেয়েদের উপর অত্যাচার করলো। লাখ লাখ অভিযোগ বর্বরদের এই রুপ কাজের। এই গ্রামের আরেক যুবক আবুল কাশেম। অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে বেঁচেছে সে। বলল: যখন আমি বুকে ছুটে জমির আইলের পাশ দিয়ে হানাদারদের চোখের বাইরে যাচ্ছিলাম, তখন কয়েকজন যুবতীকে বিবস্ত্র অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি।
আবার দেখলাম একটি বৃদ্ধ এবং কজন লোক পিছনে হাত বাধা মরে পড়ে আছে। ওরা সংখ্যায় ছিলো কমপক্ষে ২৫০ জনের মতো। ৫০ জনের মত পাক বাহিনীর সৈন্য। অবশিষ্টরা ছোরা হাতে অবাঙালী। তারা ছাতনীর সমস্ত কিছু লুট করেছে। ঘরে ঘরে তন্ন তন্ন করে পুরুষদের হত্যা করেছে।
আবুল কালাম আমাকে বলেন, গ্রামের যে এলাকার বেশি লোক হত্যা, নারী নির্যাতন হয়েছে সেদিকেরই এক ধানের জমিতে পানির মধ্যে নিজেকে আড়াল করে সবকিছু দেখছেন তিনি। সৈন্যরা এসেছিলো রাইফেল হাতে নিজেদের পোষাকে। অবাঙালীরা সাদা পাজামা, পাঞ্জাবী পরনে, হাতে ছোরা, মুখে কালো মুখোশ ছিলো হাফেজ জল্লাদের। তার অল্প কিছু দূরেই এক মহিলার কোলের শিশুকে ফেলে হানাদার বাহিনীর সৈন্য জমির ওপরে মহিলাকে অত্যাচার করলো। মহিলার শাশুড়ি শিশুটিকে কোলে নিয়ে সরে গেলো।
একটু পর গুলির আঘাতে শিশুটি নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। গুলির শব্দ, শুধু গুলির শব্দ।সকাল পাঁচটা থেকে নটা। অত্যাচার হত্যার পাশাপাশি পাশবিকতার তাণ্ডবলীলা চললো।হাহাকার, আর্তচিৎকার। গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলো আরো অন্য গ্রামের আত্মরক্ষা প্রয়াসী বহু পরিবার। সব একাকার হলো, ছাতনীর মাঠ, খালের সংগে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৪১ জন শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, মধ্য বয়সী। শুধু পুরুষ দের বেছে বেছে হাত পিছনে বেধে গুলি করেছে বর্বররা। এখানেই শতাব্দীর অভিশাপ মুসলিম কলংক পাকিস্তানি বর্বর শাসক নাটোরের ছাতনীকে লক্ষ মাইলাই এ পরিণত করে গেছে।