নির্মম অত্যাচারে নিহত ওসি

৭০। নির্মম অত্যাচারে নিহত ওসি (৪৭২-৪৭৩)

নির্মম অত্যাচারে নিহত ওসি
সুত্র -দৈনিক পূর্বদেশ, ২০ মে, ১৯৭২

নরপশুদের নির্মম অত্যাচারে তিলে তিলে ওসি খালেক মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন

|| নুরুল ইসলাম ||

গত বছর ১৬ই এপ্রিল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের কোন প্রত্যক্ষদর্শী যদি শহরের রাজপথে খোলা এক খানি জীপ গাড়ীর সামনে দু’হাত দু’দিকে দিয়ে বিধ্বস্ত একটা লোককে বাঁধা অবস্থায় হানাদার দস্যুদের গাড়ীতে ঘোরাতে দেখে থাকেন- তবে তিনি নিশ্চয়ই বিবস্ত্র লোকটার ওপর খড়িমাটি দিয়ে সাদা অক্ষরে লেখা ক’টিও পড়ে থাকবেন, ‘’ কোতোয়ালির ওসি খালেক এরেস্টেড’’।

সম্ভবতঃ দস্যুরা গ্রেফতারের পর এভাবে আর কোন বাঙ্গালীকে প্রকাশ্য রাজপথে প্রদর্শনী সহকারে পাশবিক অত্যাচার করেনি- কিন্তু কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার জনাব আব্দুল খালেককে নিয়ে তারা তাই করেছেন। শুধু তাই নয়, চলন্ত গাড়িতে পশুর দল রাস্তার মানুষকে সাক্ষী সাক্ষী করে ওসি খালেকের গায়ে জুতা, লাঠি, কিল, ঘুষি মারতো।

এভাবে সারা বিকেল তারা শহর প্রদক্ষিণ করিয়ে তাকে কোতোয়ালিতে এনে হাজির করে সন্ধ্যায়। তারপর সারারাত নিরামহীনভাবে খালেক সাহেবের উপর চালায় অমানুষিক অত্যাচার। এরপর পাঠানো হয় তাকে ক্যান্টনমেন্টের জল্লাদখানাতে।

১৮ই এপ্রিল বিকেল বেলা জল্লাদখানা থেকে এক ফাঁকে জনাব খালেক তাঁর কাকার বাসায় টেলিফোন করে জানান যে, কাকা যেন তাঁর মুক্তির তদ্বির করেন।

খবর পেয়ে তিনি ক্যান্টনমেন্টে যান- খালেক সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু তিনি অনুমতি তো পানই-নি, বরং খান সেনাদের অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনে বাসায় ফিরে আসেন।

২২শে এপ্রিল সকালের দিকে তিনি আবার তাঁর কাকার বাসায় টেলিফোন করলেন, জানতে চাইলেন কাকা তাঁর জন্য কিছু করতে পেরেছেন কিনা। জনাব খালেকের কাকা করম আলী সাহেব আমাকে জানালেন, ২২ তারিখ সকালে সে টেলিফোন করেছিলেন এবং বিকাল বেলায় আর তাঁকে জীবিত রাখা হয়নি।

প্রথমে হাতের আঙ্গুল ও হাত, এরপর পায়ের আঙ্গুল ও পা কেটে এবং শেষে দু’চোখ উপড়ে ফেলে দেওয়ার পর খালেক আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকেননি। অশ্রুসিক্ত নয়নে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে জনাব আলী বলেন, খালেক পশ্চিম মাদার বাড়ীতে আমার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল- সেখান থেকে বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরে নিয়ে আসে এবং আমার টাকা- পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, রেডিও, সেলাই মেশিন, কাপড়-চোপড়, ট্রাঙ্ক, স্যুটকেস, দলিলপত্র এবং আমাদের যাবতীয় সার্টিফিকেট তারা নিয়ে যায়।

জনাব আলী জানান, তিনি খালেককে ছোটবেলা থেকে লালন- পালন করে মানুষ করেছেন- কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। খালেক সাহেব চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করে, চটগা কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেছিলেন। যদিও তাঁর বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার অন্তর্গত বৈদ্যেরবাজার থানার মুচার চর গ্রামে, তথাপি তিনি তাঁর চাচার লালন-পালনে চাটগাতেই ছিলেন আশৈশব।

জনাব আলী জানান যে, খালেক সাহেব আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাত্রজীবন থেকেই জড়িত ছিলেন। তখনকার অসহযোগ আন্দোলন-পর্ব থেকে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত খালেকের রাজনৈতিক সমর্থন ও কার্যকলাপের ব্যাখ্যাদান বাতুলতা হবে মাত্র।

তিনি বলেন, ২৫শে মার্চের পর ২৬, ২৭ এবং ২৮শে মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণে বার্মা সীমান্তের টেকনাফ থেকে আরম্ভ করে রাঙ্গামাটি, রামগড় ইত্যাদি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে অসহযোগ আন্দোলনকারীদের জন্য বিপুল পরিমাণে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সংগ্রহের কাজ খালেক সাহেব অত্যন্ত সক্রিয় সহযোগীতে দিয়ে এসেছেন।

শহীদ খালেক তাঁর বিধবা স্ত্রী এবং তিনটি শিশুসন্তান রেখে গেছেন। এরা সবাই করম আলী সাহেবের পোষ্য হিসেবে চট্টগ্রামে বসবাস করছেন।

Scroll to Top