পরিশেষ

পরিশেষ

 

রণাঙ্গনে এবার নেমে আসে প্রশান্ত নীরবতা।

 

রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার,কামানের  গোলাগুলির শব্দ থেমে যায়।থেমে যায় আহতের কান্না,মুমূর্ষের  করুণ আর্তনাদ।নতুন এক রাত্রির প্রহর আসে কোন এক হারানো অতীতের স্বপ্ন নিয়ে। এমনি সুন্দরের স্বপ্নে আহবান কাল ধরে মানুষের সংগ্রাম চলেছে।

 

ভাটিয়ারীতে মহাসড়কের উপর সেতুটি পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আর স্বেচ্ছাসেবক ১৬ই ডিসেম্বর সারারাত ধরে কাজ করলো ভাটিয়ারীর খালের মধ্যদিয়ে একটা বিকল্প রাস্তা তৈরি করতে। রাতেই আমরা সমস্ত সৈন্য এবং গেরিলাদের চট্টগ্রাম শহরে এবং চট্টগ্রামও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকা নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেই। ফেনীর অংশবিশেষ সহ শুভপুর পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণভার আমরা আগেই নিয়েছিলাম। আমার সম্পূর্ণ বাহিনীকে পরদিন খুব সকাল বেলায়ই চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণের নির্দেশ দিলাম। একটি ব্যাটালিয়নকে অবশ্য রাতেই খাল পার হয়ে শহরের অভিমুখে যতদূর সম্ভব এগিয়ে অবস্থান গ্রহণ করতে পাঠিয়ে দেই।

 

শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সার্কিট হাউসকে আমরা হেডকোয়াটার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্দেশ দেয়া হলো পোর্ট এলাকায় নৌবাহিনীর হেডকোয়াটার এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টে আত্মসমর্পণের জন্য জমায়েত হতে। পাকিস্তানী বন্দীদের দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর ন্যস্ত হয়। চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ১৬১ জন অফিসার, ৩০৫ জন জেসিও এবং নৌও বিমানবাহিনীর সমপর্যায়ের লোক এবন তিন বাহিনীর ৮৬১৮ জন্য সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।

 

১৭ই ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত বিকল্প রাস্তার কাজ সম্পন্ন হলো না। ফলে তখন পর্যন্ত সে স্থান দিয়ে গাড়ী পার করাও সম্ভব ছিল না। আমি পুলের এপারে গাড়ী থেকে নেমে পড়লাম একটি ছোট প্যাকেট হাতে নিয়ে। তারপর একটি লাঠিতে ভর দিয়ে খাল পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। দুদিন আগে কুমিরার যুদ্ধে আহত হওয়ায় আমাকে লাঠিতে ভর দিয়ে বেশ খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছিলো।

 

পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে লোকজন তখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও কিছু লোক আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য ভাটিয়ারীর ভাঙ্গা সেতু পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলো। আমি আমার এক বন্ধুর গাড়ীতে উঠে বসলাম। গাড়ী সোজা ছুটে চলল সোজা সার্কিট হাউসের দিকে।

 

অগণিত নারীপুরুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। পথের দুই দাঁড়িয়ে তারা হাত তুলে যৌথবাহিনীর সৈন্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাচ্ছিল।জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। কেউ কেউ বোধহয় তখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি সত্যিই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে তারা সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখছিল। পাকিস্তানিদের তখন অস্ত্র সংবরণের পালা। বাস ও ট্রাকে করে তারা দ্রুত ছুটে পালাচ্ছিল নৌবাহিনীর হেড কোয়াটার এবং ক্যান্টমেন্টের দিকে।

 

সার্কিট হাউসে তখন বহু লোক জমা হয়ে গেছে। জনতার ভিড় ঠেলে আমি এগিয়ে যাই। যুদ্ধের এই কয়মাসে আবার দাঁড়ি বেশ বড় হয়ে যাওয়ায় অনেক বন্ধু এবং পরিচিত জনি আমাকে চিনতে পারলো না। 

 

এমনি এক সুন্দর মুহূর্তের জন্য সযত্নে এই প্যাকেটটি সাথে রেখেছি দীর্ঘ নয়মাস। এবার ওটাকে খুলে ফেললাম। সুন্দর করে ভাঁজ করা বাংলাদেশের পতাকাটি একটি কিশোর ছেলের হাতে দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলাম সার্কিট হাউসের ছাদে। সেখানে তখনও পাকিস্তানী পতাকা উড়ছিলো। ছেলেটি পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিচে। সেখানে ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতীক জাতীয় পতাকা।সে সময় হাজার হাজার মানুষ দৌড়ে আসছে সার্কিট হাউসের দিকে। সমস্ত এলাকা ভরে গেছে মানুষের ভিড়ে।পতাকা উত্তোলনের সময় মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয় উত্তাল জনসমুদ্র সেই অবিস্মরণীয় সেই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য। তারপর বাতাসে দোলা লাগে, উড়তে থাকে নতুন পতাকা। নিস্তব্ধ জনতা উদ্বেলিত হয়ে উঠে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে সেই জন সমুদ্রে উঠে জয়ধ্বনি জয় বাংলা।

 

পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী ধ্বংসের পথযাত্রী একটা জাতি  পেয়ে গেলো স্বাধীনতা। দুঃস্বপ্নের রাতের শেষে সেই পতাকার রক্তিম সূর্য বাংলার মানুষের জন্য নিয়ে এলো নতুন আশার বাণী। সমস্ত পৃথিবীতে সে বিজয়ের বার্তা পৌঁছে দিতে যেন মানুষ একযোগে মুহুর্মুহু ধ্বনি দিতে থাকে জয় বাংলা। খুলে গেলো সমস্ত আবদ্ধ দুয়ার। বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো বেরিয়ে আসে সকল মানুষ। দীর্ঘদিনের দুঃসহ যন্ত্রণা শেষে তারা উপভোগ করতে চাইলো উষ্ণ সূর্যালোক, মুক্ত বাতাস, সুন্দর সম্ভবনাময় নতুন স্বাধীনতা। ভয়াবহ গণহত্যার মধ্য দিয়ে তারা বেঁচে থেকে স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করতে পারছে একথা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তবুও সেই সব মানুষ বেঁচে আছে। মেঘমুক্ত নীল আকাশের নিচে সোনালী সূর্যের আলোকে মানুষ চেয়ে থাকে নতুন পতাকার দিকে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকাকে অভিবাদন জানিয়ে আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণের জন্য, অবাক বিস্ময়ে। ভুলে গেলাম আমার চারপাশের উত্তাল জনসমদ্রের কথা।তখন ৯টা ১৫ মিনিট, ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল।

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি ঘরে বিভিন্ন আকারের নতুন জাতীয় পতাকা শোভা পেতে লাগলো। শুধু ঘরের ছাদই নয়, গাছপালা, লাইটপোস্ট, দোকানপাট যেখানেই সম্ভব সেখানে মানুষ উড়ালো নতুন পতাকা। উৎসবের সাড়া পড়ে গেলো সমস্ত শহরে। যুদ্ধের নয়মাস এমনি একটা সুন্দর মুহূর্তের জন্যপ্রতিটি বাঙ্গালীর ঘরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো বাংলাদেশের পতাকা। ধরা পড়ে অনেকে আবার পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে।

 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীর সবচাইতে বেদনাময় ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে হয়তো সাময়িকভাবে। এই নিষ্ঠুর ঘটনা ছিল অবিশ্বাস্য, আর তাই হয়তো এখানে কান্নার ভাষা হারিয়ে গিয়েছিলো। বিকৃত বিকারগ্রস্ত, রক্তলিপ্সু পাকিস্তানীরা নিরীহ নারীপুরুষ এবং শিশুহত্যার নৃশংসতায় হিটলারের নাৎসী বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির পক্ষ অবলম্বনকারী দুটি সরকার ছাড়া আর সমস্ত পৃথিবীর সরকার একযোগে রুখে দাঁড়িয়েছিলো হিটলারের গণহত্যার বিরুদ্ধে। অথচ, বাংলাদেশে পাকিস্তানীরা যখন গণহত্যা চালালো তখন এইসব সরকারের কয়েকটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে না গিয়ে বরং ইয়াহিয়াকে গণহত্যায় সহায়তা করলো। একটা কঠিন সত্য পৃথিবীর মানুষের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ক্রমান্বয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনেকেরই নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। তাদের মুখে মানবতার বুলি আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

 

বিজয়ের মধ্য দিয়ে নয় মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটলো। বাংলার মানুষ আবার তাঁর ভাগ্য নিয়ন্ত্রনের অধিকার অর্জন করলো। পথে-প্রান্তরে পর্বতাঞ্চলে নদনদী খালে বিলে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে বাঙ্গালী আবার নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে। ছায়ার মতো অনুসারী মৃত্যুর ভয়ে আর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবেনা আর। রাতের অন্ধকারে প্রতিটি অচেনা শব্দ মৃত্যুর অশুভ পদধ্বনি আসবে না। চারদিকে আনন্দ আর উল্লাসের ঢেউ। ২৫ মার্চের সে ভয়াবহ রাতের পর এই প্রথম মহিলারা নির্ভয়ে বেরুতে পারলো। ঘরের বাইরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে ছুটে চলেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।মার্চ করে চলেছে মুক্তিবাহিনী। পথের দুই পাশের উচ্ছ্বসিত  জনতা তাদের জানাচ্ছে প্রাণঢালা অভিনন্দন।সুখী মানুষের আনন্দ কোলাহলের এক অভূতপূর্ব সমাবেশ।মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছে কেউ কেউ। অনেকে গাইছে গান।নির্মল হাসিতে যেন সমস্ত মানুষের রূপ উদ্ভাসিত। কারো চোখে ছিল সুখের অশ্রুজল। একজন আনন্দের আতিশয্যে বাঁধ ভাঙ্গা চোখের জল সামলাতে গিয়ে শাড়ীর আঁচল কামড়ে রেখেছেন দৃঢ়ভাবে। কাছে কোথাও মাইকে বাজছিল অতিপ্রিয় সেই গান ‘’ মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।‘’ এমনি অনেক ফুলের মতো জীবনকে হয়তো  আমরা যুদ্ধ করে বাঁচাতে পেরেছি। আবার অনেককেই বাঁচাতে পারিনি। আমার মনে হলো সেইসব শহীদের কথা, যারা নিজদেশে বন্দীর মতো জীবনযাপন করছিলো। পাকিস্তানীরা এদেশকে পরিণত করেছিলো বন্দীশালায়। যেখানে তারা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষকে। সেই বন্দীশালায় পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত অসংখ্য মানুষের ত্যাগ আর গভীর জীবনবেদনা ছিল এত মহান যে শ্রদ্ধায় নত হয়ে আমি অনুচ্চ স্বরে বললামঃ

 

                  ‘’…… এবং শান্তি আর যুদ্ধ নয়-

                     তোমাদের বিদেহী আত্মার জন্য

                       চাই শুধু শান্তি যুদ্ধ নয়।

                    এই বন্দীশালা, এখানেই ছিল

                        তোমাদের তীর্থের জীবন।‘’

 

ইতিহাসে এই মর্মান্তিক নাটকের যবনিকাপাত সে কি বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত নাকি শোকের বেদনায় আপ্লুত? অথবা সেখানে ঘটেছে বিজয় আর বেদনার  অপূর্ব সংমিশ্রণ? এই নির্মমও অচিন্তনীয় গণহত্যাকে কি পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীর ইতিহাস বদলের অমোঘ বিধান বলেই সমস্ত দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবে?

 

সার্কিট হাউসের সামনে সবুজলনে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম সেই বিষাদময় সমস্ত ঘটনার কথা। যুদ্ধের নয়মাসের শহীদের কথা আবার মনে পড়লো। পাকিস্তানীরা এদের হত্যা করলো গ্রামে গঞ্জে, নগরে-বন্দরে, শহরে- মসজিদ –মন্দিরে।অনেকেই ধরে নিয়েছিলো আরো নিষ্ঠুরভাবে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করার জন্য। বাংলার এই অসহায় মানুষগুলো আর কোনদিনই ফিরে আসবেনা। কিন্ত পাকিস্তানীরা যখনই এদেরকে বেঁধে নিয়ে যেতো হত্যা করার উদ্দেশ্যে সেই মুহূর্তে এইসব অসহায় মানুষ কি ভাবতো কে জানে? তাঁদের আপনজনই বা কি গভীর মর্মবেদনায় ভেঙ্গে পড়তো চিরবিদায়ের সেই মুহূর্তে? এইসব মানুষকে যখন পাকিস্তানীরা লাইনে দাঁড়িয়ে হত্যা করতো, রাস্তায় টেনে নিয়ে যেতো জীপের নিচে বেঁধে বেয়োনেট আর রাইফেলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতো তখন মৃত্যুপথ যাত্রী সেই সব মানুষ কি ভাবতো আমরা কোনদিন তা জানবো না। নিষ্পাপ শিশু, অবলা নারী অসহায় বৃদ্ধ কেউই সেদিন  রক্ষা পায়নি পাকিস্তানীদের হাত থেকে।

 

সেই সব প্রাণের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। আমার চিন্তায় বাধা পড়লো। একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন আমার দিকে। যুদ্ধে তাঁর ছেলে হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। মুখে তার হাসি নেই, নেই অশ্রুজল। তিনি শান্ত, অতিশান্ত। আমাকে জড়িয়ে ধরে তিনি গভীর প্রশান্তিতে চোখ বুজে রইলেন কিছুক্ষণ।

মানব হৃদয়ের সেই অব্যক্ত বেদনা কেউ কোন দিন বুঝতে পারবে না।

 

*একাত্তরের মার্চে রফিক-উল-ইসলাম সাবেক ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন পদে সেক্টর এডজুট্যেন্টের দায়িত্বপালন করছিলেন।

Scroll to Top