শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০। পাকিস্তানঃ একটি আদর্শের মৃত্যু | নিউ ইয়র্ক উইক | ১২ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ২০, ৪৬–৪৯>
পাকিস্তানঃ একটি আদর্শের মৃত্যু
সুত্রঃ নিউ ইয়র্ক উইক
তাঃ ১২ এপ্রিল, ১৯৭১
নিউজ উইক
তাদের অবাধ্যতা ছিল দীর্ঘ সময়ের, অস্ত্র ছিল সামান্যই, যেন একদল ক্রিশকায় অদক্ষ কৃষকের দলে যাদের মুল অস্ত্র বলতে কোদাল, গাইতি আর বাশের লাঠি। কিন্তু তারা দাবী করেছে যে পূর্ব পাকিস্তানের একটি শহর যশোরের দুই মাইল উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টে ১০০০ এরো বেশি পাকিস্তানি সেনাদের ঘেরাও করেছে। এখন তারা শপথ করেছে যে পাকিস্তান থেকে আগত এই পাঞ্জাবি সৈন্যরা অনাহারে মৃত্যুবরণ করার আগে তারা এই অবরোধ তুলে নেবেনা। একজন বিদ্রোহী প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে নিউস উইক প্রতিনিধি টনি ক্লিফটনকে বলেন- “আমরা সৈন্যদের ঘেরাও করে রেখেছি, এবং তারা খাবার সংগ্রহ করার জন্য বের হতে পারবে না। এই হতভাগারা অনাহারে আছে এবং অবশ্যই এভাবে তারা মারা যাবে, তাদের মরতেই হবে।”
এই ক্রোধ আর ঘৃণায় জর্জরিত পূর্ব পাকিস্তানের রুপ আমাদের সামনে আসে গত সপ্তাহে যখন ক্লিফটন ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে একদিনের জন্য ওপারে যান এবং সীমান্তের নিকটবর্তী কিছু গ্রাম ঘুরে আসেন। তা নাহলে, পাকিস্তানের এই গৃহযুদ্ধর সকল খবর প্রকাশনা্র উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত আছে, গোটা পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ক সংবাদ প্রকাশনাই কঠিন প্রহরাধীন, সকল বিদেশী সাংবাদিকদের সেখানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তার উপর বিভ্রান্তিমুলক বা অনিশ্চিত সুত্র থেকে আসা গুজবে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠছে, ফলে সেখান থেকেও যোগাযোগ রক্ষা করা কঠিন করে তুলেছে।
সকল দিক থেকেই বিদেশী রাষ্ট্রসমুহগুলো এধরনের সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের উপর নিরভরযোগ্য সংবাদ যোগার করার ক্ষেত্রে। ওয়াশিংটন থেকে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি জানান যে তার রিফিউজি সাবকমিটির প্রাপ্ত রিপোরটে নির্বিচারে হত্যা, রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা, হাজার হাজার ছাত্র ও সাধারন মানুষের কষ্ট ও প্রতি ঘন্টায় মৃতের সংখ্যা কেবল বেড়ে যাওয়ার তথ্য আছে। যদিও, কেনেডি তাদের খবরের উৎস নিশ্চিত করেননি। স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর মুখপাত্র রবার্ট জে ম্যাকক্লস্কি একথা অস্বীকার করছেন যে নিক্সন প্রশাসন ঢাকার রিপোর্ট চেপে যাচ্ছে এবং ঘোষণা দিয়েছেন যে এরকম পরিস্থিতিতে ঘটনাসমুহ ও তাদের ফলাফল এর নিশ্চয়তা নিরুপন করা অসম্ভব। তার উপর সপ্তাহান্তে, যুক্তরাষ্ট্রীয় সকল কুটনৈতিক কর্মকর্তাদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের নিচ্ছে।
প্রতিবাদঃ
যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান এর বিষয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ করছেনা, অথচ এমন নির্লিপ্ততা ভারতের নেই। তাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব বাংলার উপর আর্মিদের এরুপ অত্যাচারকে “গনহত্যার পর্যায়ের নিয়মতান্ত্রিক ধ্বংসলীলা” বলে নিন্দা জানিয়েছেন। দিনের পর দিন একেকটি উত্তেজনাপূর্ণ শিরোনামে পূর্ণ ভারতের সংবাদপত্রগুলো, তাদের প্রথম পাতার মুল সংবাদের বিষয়বস্তু এখন ভয়ংকর যুদ্ধ আর সেনাবাহিনীর রক্তপাত আর অরাজকতার খবর। আবার এদিকে ইসলামাবাদ প্রশাসন ভারত সরকার ও তার সংবাদপত্রগুলোকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সংবাদ ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। গত সপ্তাহে দুই দেশের কর্মকর্তাগণ পাল্টাপাল্টি প্রতিবাদ জানানোতে মনে হচ্ছে এই দুই দেশের মধ্যকার বৈরিতা আবারো নতুন করে সঞ্চালিত হবে।
যদি ভারতের প্রতিবেদন অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে ৭,০০,০০০ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হবার খবর অত্যুক্তি মনে হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের এই দাবী যেখানে বলা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সবকিছু ভালভাবে চলছে ও শান্তি বিরাজ করছে, সেটিও একিরকম্ভাবে অসম্ভব। যেসব টুক্রো খবর আমাদের কাছে এসে পৌছেছে তাতে মনে হচ্ছে মুল শহরগুলোতে সেনাবাহিনীর আধিপত্যই প্রকট হলেও গ্রামাঞ্চলগুলো তা একিরকম নয়। সেনাদল ক্যান্টন্মেন্ট থেকে হামলা চালাতে পারে, এবং তারা সেটি করেও যেহেতু তাদের প্রচুর মজুদ অস্ত্র রয়েছে। ক্লিফটনের প্রতিবেদন অনুযায়ী- তবুও তারা তাদের সেনানিবাসের বেশি দূরে যায়না বা বাইরে বেশি সময় কাটায়না, এবং অবশ্যই অন্ধকার হবার পূর্বে ফিরে যায়, নতুবা গুপ্ত হামলার স্বীকার হওয়ার ভয় খুব বেশি। তাদের উদ্দেশ্য থাকে ঝটিকা হামলা চালিয়ে লোকজনদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করানো, যদিও তারা এই অবস্থানে কতদিন থাকতে পারবে, তা নিশ্চিত নয়। কারন শীঘ্রই বর্ষাকাল শুরু হবে আর রাস্তাঘাটে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পরবে।
ধ্যানমগ্ন
পূর্ব পাকিস্তানের এই গনবিরোধের হাওয়া ১০০০ মাইল দূরে ভারত সীমান্তের ওপারে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানে খুব সামান্যই লেগেছে বলে মনে হয়। নিউস উইক পত্রিকার মিলান জে কুবিক এর মত অনুযায়ী সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা খুবি স্বাভাবিকভাবে চলছে। কিন্তু একি সাথে কুবিক এর মনে হয়েছে বুদ্ধিজিবী ও রাজনিতিবিদগন ২৩ বছর আগে স্থাপিত এই রাষট্রের ভিত্তির পতন আসন্ন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। লাহোরের একজন কুটনৈতিক দুঃখের সাথে বলেন- “ আমরা যখন এই দেশটি গড়ে তুলেছিলাম, তখন ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে আসার ক্ষেত্রে একমাত্র বিষয় ছিল এমন একটি দেশ গড়ে তোলা যেখানে সকল মুসলিম একসাথে স্বাধীনভাবে ও সমান অধিকার নিয়ে বেচে থাকবে। এখন সেই আদর্শের মৃত্যু ঘটেছে এবং যে পাকিস্তানের বীজ আমরা বপন করেছিলাম তাও ধুলিস্যাত হয়ে গেছে’।
একটি জাতির জেগে ওঠা
গত মাসের শেষ দিকে, যখন পশ্চিম পাকিস্তানে গন্ডগোল প্রচন্ড পরিমানে বেড়ে যায়, নিউস উইকের সাংবাদিক লরেন জেঙ্কিন্স বাঙ্গালীদের স্বাধীনতার এ সংগ্রামের খবর সংগ্রহ করতে সেখানে যান। সেখানে গ্রিহ যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, এবং পাকিস্তানি আর্মি পুরা এলাকাতেই কঠোর প্রহরা মোতায়েন করেছিল। জেঙ্কিন্সসহ সকল বিদেশী সাংবাদিকদেরই তখন সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়। গত সপ্তাহে বৈরুতে ফেরত যাওয়ার পূর্বে জেঙ্কিন্স তার ব্যক্তিগত প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তানের করুন পরিনতির কথা এভাবে ব্যক্ত করেনঃ
‘তপ্ত সুরযের নিচে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার কপাল এবং মসৃণভাবে আচড়ানো চুলের গোড়া থেকে ফোটায় ফোটায় ঘাম ঝরে পরছিল, তার চোখ অনিদ্রায় লাল, কিন্তু তার চেহারা গর্ব এবং আশায় উজ্জল। মাত্র কিছুখন আগেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একটি মিছিল ধানমন্ডিতে অবস্থিত তার বাসভবনের সবুজ লোহার গেট দিয়ে ঘুরে তার বাগানে এসে দাড়িয়েছিল, এবং তার সমর্থনে আবেগমন্ডিত কণ্ঠে স্লোগান দিচ্ছিল “জয় বাংলা” বলে। এই ৫১ বছর বয়সী বর্ষীয়ান নেতা পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা। তার উদ্দিপনা এখন আকাশচুম্বী, মুজিব (যেভাবে স্থানীয়রা তাকে সম্বোধন করেন) আমাদের বিদেশী সাংবাদিক দলের দিকে এগিয়ে এলেন এবং তার বাগানে দাড়িয়েই উত্তেজিত স্বরে কথা বললেনঃ “ আমার জনগন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তাদের থামানো যাবেনা। তোমাদের কি মনে হয় মেশিন গানের গুলিতে আমার লোকেরা তাদের মনোবল আর উৎসাহ হারাবে?
এই কথাগুলো উচ্চারন করার ঠিক ৩৬ ঘন্টা পর পাকিস্তানি আর্মি, বিশেষ করে পাঞ্জাবি আরমিরা এর নিষ্ঠুর প্রত্যুত্তর দিতে বাঙ্গালীদের উপর ঝাপিয়ে পরে, প্রচন্ড রক্তপাত এবং বিপুল অস্ত্র নিয়ে তারা নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ঝাপিয়ে পরে প্রথম বারের মতন জিতে যায়। এবং সেই সাথে মুজিবের ভাগ্য (তাকে নিয়ে নানারকম খবর আসছে, কেউ বলছেন তিনি আর্মিদের হাতে বন্দী আবার কেউ বলছেন তিনি আত্মগোপন করে আছেন) এবং সংক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সংগ্রামের ভবিষ্যতকেও এক নিমিষে ধংশ করে দেয়। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা যেন বাংগালীর ঐক্যকে আরো মজবুতভাবে ঝালাই করে দিয়েছে এবং সেই সাথে সেনাদের জোরদখল নেয়ার পর একটি তিক্ত অসন্তুষ্ট মনোভাব বাঙ্গালীদের মধ্যে বেরেই যাচ্ছে। গত মাসে মুজিবের ভক্তরা বাংলাদেশ নিজেদের নাম পূর্ব পাকিস্তানি থেকে পরিবর্তন করে ‘বাঙালি’তে রুপান্তরিত করে, যার ফলে একদল পাঞ্জাবিদের হাতে ২৩ বছর ধরে শোষিত, অত্যাচারিত, বঞ্চিত, অপমানিত এই মানুষগুলো এক দারুন স্প্রিহায় জেগে উঠেছে।
একদিক থেকে দেখতে গেলে এই জাগরনের কৃতিত্ব কিছুটা ইয়াহিয়া খানের উপরেও বর্তায়, যিনি গত মাসে নিরধারিত নির্বাচন পরবরতী জাতীয় পরিশদের অধিবেশন রুখে দিয়ে এই ক্রোধের মুখোমুখি হলেন, সেই নির্বাচন যেখানে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। পাঞ্জাবিদের প্রতিনিধি হয়ে ইয়াহিয়া যখন পূর্ব পাকিস্তানের এই স্বাধীনতার স্বপ্ন নস্যাত করতে উদ্যত হলেন, বাঙালি তকনি ফুসে উঠল, পুলিশের সাথে তাদের ঘন ঘন সংঘর্ষ বাধতে লাগ্ল, সর্বত্র একটি স্বাধীন রাষট্রের দাবী। এক রাতের মধ্যে পাক্সিতানের সবুজ সাদা পতাকা যেন ঢাকা থেকে অদ্রিশ্য হয়ে গেল আর সেখানে উঠল বাংলাদেশের পতাকা, গারো সবুজ রঙের জমিনের মাঝে একটি লাল ব্রিত্ত আর তার মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ এই পতাকার নকশা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
সমঝোতা
পূর্ব পাকিস্তানের এই অনানুষ্ঠানিক সরকারের মুল কেন্দ্র মুজিবের বাড়িতেই, যেখানে এই নেতা পাইপ মুখে সকল দর্শনার্থীদের সঙ্গে তার অনাড়ম্বর বৈঠকখানায় দেখা করেন। অদ্ভুত বিষয় হল এই স্বাধীনতার ঘোর যখন ছড়িয়ে পরল গোটা বাংলাদেশে, তখন মুজিব উদ্যোগ নিলেন এ স্পৃহাকে নিয়ন্ত্রন করার। মুজিব এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন যে কোন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা করলেই সেনাবাহিনীর রোষ নেমে আসবে সাধারনের উপর। মুজিব চেয়েছিলেন এমন একটি সমঝোতায় আসতে যেখানে বাঙ্গালী তার আকাংখিত স্বায়ত্বশাসন অর্জন করবে, কিন্তু আর্মিদের কথা অনুসারে পাকিস্তানের অখন্ডতাও বিনষ্ট হবে না। যার ফলে, কিছু মানুষ প্রকাশ্যেই মত দিয়েছেন যে, পাকিস্তানের এই দুই দুরতম ও আলাদা দুইটি অঙ্গরাজ্যকে একত্রিত রাখার জন্য মুজিবই এখন শেষ আশা। কিন্তু, শেষপর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিদের উন্নাসিক আচরনে মুজিবের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে পাঞ্জাবি এবং পাঠানদের জন্য যাদের সংখ্যা সেনাবাহিনীতে অনেক বেশি এবং যাদের দেশপ্রেমের আবেগের কাছে বাংগালিরা অবজ্ঞার পাত্র হয়েই এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মতে মুজিব ও আওয়ামীলীগ দল প্রকাশ্যে রাজদ্রোহ করেছে, যদিও মুজিব হচ্ছেন দেশের সবেচেয়ে বেশি আসনে জেতা রাজনৈতিক দলটির নেতা। এই পশ্চিমাদের কাছে মুখ্য বিষয় ছিল পাকিস্তানের একতা ও অখন্ডতাকে ধরে রাখা। অবশ্যই এ বিষয়ে বিতর্ক আছে, তবে একতা অবশ্যই দেশের অর্থনৈতিক, কুটনৈতিক ও সেনাকল্যানে ভুমিকা রাখে। কিন্তু, এই ১০০০ মাইল দূরে অবস্থাঙ্কারী পাকিস্তানের দুই অঙ্গরাজ্যের মধ্যকার শত্রুতা এখন এমনি চরম আকারে পৌছে গেছে যে এখন একতা কেবলই অবাস্তব মনে হয়।
ত্রাশের রাজত্ব
আর্মিরা অতর্কিতেই আক্রমন চালায় বাঙ্গালীদের উপর। ট্রাকে ট্রাকে সৈন্য ঢাকার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে পাড়ি দেয় রাতের অন্ধকারে, সর্বশক্তিতে তারা ঝাপিয়ে পরে বাঙ্গালীদের উপরে। ঘরে ঘরে মেশিন গানের গুলি ছোড়া হয়, কমান্ডারদের নির্দেশে ট্যাঙ্ক গোলাবর্ষণ করতে করতে রাস্তাগুলোতে টহল দিতে থাকে। পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটি ভয়ানক ত্রাশ ও প্রতিহিংশার আক্রমন। এভাবে নিরস্ত্র মানুষের উপর এত গোলা বর্ষণ করার মত কোন কারন থাকার প্রশ্নই আসেনা। পৃথিবীর সবচাইতে দারিদ্র্যপিরীত এলাকার ভাঙ্গাচোরা বাড়ি ঘর এভাবে নিরদয় ভাবে পুড়িয়ে দেয়ার কোন কারন থাকতে পারে না।
এবং আমরা পাকিস্তানিদের অভিযুক্ত করা যায়, এমন অনেক কিছু দেখে ফেলেছিলাম। “তোমাদেরকে আধ ঘন্টার মধ্যে সব গুছিয়ে হোটেল ত্যাগ করতে হবে” এ নির্দেশটি আমাদের দেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন সংযোগ বিষয়ক কর্মকর্তা, যেখানে ঢাকায় উপস্থিত সকল বিদেশী সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। আমি তাদের প্রশ্ন করেছিলাম- “ আমাদের কি বের করে দেয়া হয়েছে’। তিনি আমাদের বলেন- “ আমি ঠিক এধরনের কোন শব্দ ব্যবহার করতে চাচ্ছিনা, কিন্তু আপনাদের চলে যেতে হবে’।
দুই ঘন্টা পরে আমাদেরকে চারটি আর্মিদের ট্রাকে ওঠানো হোলো এবং কড়া পাহাড়ায় ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে আমাদের তল্লাশি চালানো হয় এবং আমাদের বেশিরভাগ লেখা ও ছবি জব্দ করা হয়। পাকিস্তানি একটি বেসামরিক জেটলাইনারে করে আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের কড়াচি উড়িয়ে আনা হয় এবং সেখানে আরো এক দফা আমাদের তল্লাসি করা হয়। আমার কাছে থাকা রেডিও, ক্যামেরার দুই রোল ফিল্ম যা আমার রেডিওর কম্পারট্মেন্টে লুকানো ছিল, তা আমার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয়। তারপর আমাকে আরেকটি কক্ষে নিয়ে জামা নগ্ন করে তল্লাসি চালানো হয় এবং আমার অন্তর্বাসের মধ্যে লুকিয়ে রাখা আরেকটি ফিল্ম ও জব্দ করা হয়। একজন পুলিশ অফিসার হাসতে হাসতে আমাকে বললেন, ‘শুধু স্মৃতিটুকুই নিয়ে যেতে পারবে’।
একতা
তা আমার আছে, আমার এখনও মনে আছে সেই সব মানুষদের যাদের আমি দেখেছিলাম। নারী, পুরুষ, শিশু সবাই মিলে গাছের ডাল বা দালানের ইট খুলে ব্যারিকেড দিচ্ছে যেন আর্মিরা প্রবেশ না করতে পারে, যেসকল অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের দিকে গুলি ছোড়া হচ্ছিল, সেগুলো থেকেই আবার ভেসে আসছিল, বীর বাঙ্গালী এক হবার স্লোগান। অবশ্য এই সেনা হামলারও আগে আমি একটি গ্রামে গিয়েছিলাম যেখানে এখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির মাধ্যমে একদল বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবী গেরিলা প্রশিক্ষন নিচ্ছিলেন। আমরা রাস্তাগুলোকে কেটে ফেলব, ফেরি চলাচল বন্ধ করে দিব এবং ব্রিজ উপড়ে ফেলবো, একজন বিদ্রোহী আমাকে সেখানে বলেছিলেন। এবং আমরা আমাদের শত্রুর মোকাবেলা করতে বন্দুক এর যোগান পাব। তার ভবিষ্যৎবানি হয়ত না ফলতে পারে, কিন্তু এই গেরিলা যুদ্ধ যদি গোটা পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে তবে বাংলাদেশের জন্য তা হবে অত্যন্ত দীর্ঘ ও রক্তস্নাত। মুজিবের যাই হোক না কেন, এমন একটি সঙ্ঘাত দিয়েই এ বিতর্কের অবসান হবে যে মেশিনগানের গুলিতে মানুষের চেতনা হত্যা করা যায় কি না।