পূর্ব বাংলা লিবারশন ফ্রন্ট সংক্রান্ত তথ্য এবং প্রদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক তৎপরতার উপর সরকারী গোপন প্রতিবেদন

<2.010.033-034>

শিরোনাম

পূর্ব বাংলা লিবারশন ফ্রন্ট সংক্রান্ত তথ্য এবং প্রদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক তৎপরতার উপর সরকারী গোপন প্রতিবেদন।

 

সূত্র : সরকারী

 

তারিখ : ১৯৫৯

 

[একটি নাম আলী আছাদ। সে আজ আমাদের ধ্রুবতারা। তার দিকে চেয়ে আমাদের পথ চলতে হবে। চলবো আমরা কাফেলাকে পথ দেখিয়ে। গন্তব্যস্থলে পৌছাতে হবে যেকোন মূল্যে। আলী আছাদ (ওরফে কালো খোকা) ছিল সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক। ১৯৪৮ সাল থেকে সে ছাত্রলীগে যোগদান করে এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জামালপুর মহকুমায় ঘুরে ঘুরে বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করায় প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ সরকার তাকে ১৯৫২ সনে গ্রেফতার করে এবং বিনা বিচারে ময়মনসিংহ কারাগারে আটকে রাখে। এর পর যতগুলি আন্দোলন হয় প্রত্যেকটিতে সে পুরোধারে ছিল। জামালপুর প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে সেই ১৯৫৬ সনে কাগমারী সম্মেলনে মরহুম প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাাওয়ার্দী বাংলাদেশ প্যারিটি মানার কথা বললে প্রথম সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদ করে সে। আলী আছাদ জামালপুর আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক ছিল। যখন আওয়ামী লীগ করতে সাবই ভয় পেতো তখন সে বলিষ্ঠ কন্ঠে সারা মহকুমা তথা দেশময় আওয়ামী লীগের বাণী ছড়িয়েছে।]

 

পূর্ব বাংলা লিাবরেশন ফ্রান্ট, ১৯৫৮*

আঃ আমান

 

১৯৫৮ সনে জেনারেল আইয়ুব খান গণতন্ত্রকে হ্যা করে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ভেঙ্গে ডিক্টেটর হন।ডিক্টেটর হয়েই উনি সারাদেশে সামরিক আইন জারি করেন এবং দেশপ্রেমিকদের কারাগারে নিক্ষেন করেন। তম্মধ্যে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখযেগ্য। দেশে তখন নীরব নিশ্চুপ অবস্থা। কারো টু শব্দ করার উপায় নেই। এই সময়ে বিপ্লবী বীর আলী আছাদ ঢাকা গিয়ে তরুণদের সঙ্গে পরামর্শ করে চলো এলা জামালপুরে। এই অসীম সাহসী তরুণের দল একটি বিপ্লবী দল গঠন করেন, তার নামই হলো ‘পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্ট’। আলী আছাদ তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ঐতিহাসিক জামালপুরেই দলের গোপন সেল স্থাপন করা হয়। ধীরে ধীরে দলের সদস্য সংখ্যা বাড়তে লাগলো। তখন আলী আছাদ একদল তরুনকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে উচ্চতর ট্রেনিং নিতে। প্রথমে পশ্চিম বাংলা সরকার তাদেরকের প্রবেশ করতে দিয়েছিল। পরে যখন তারা কাজ শুরু করে তখন হঠাৎ করে সরকার গুপ্তচর আখ্যা দিয়ে কারাগারে আবদ্ধ করে। পরে এখান হতে আইয়ুব সরকার যে তার উপরে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করেছিল তা পাঠানো হয়। এই সকল কাজগপত্র দেখে পশ্চিম বাংলা সরকার তাদের জেল হতে ছেড়ে দেয়। সেখানে বসে তরুণ বিপ্লবীরা অন্যান্য দেশের কুটনৈতিক মিশনগুলোকে পূর্ব বাংলায় যে কি উৎপীড়ন শুরু হয়েছে তা জানায় এবং তাদের সপক্ষে সহানুভুতি কামনা করে।

 

অতঃপর তারা গারো পাহাড়ের সীমান্ত দিয়ে প্রথমে শ্রীবর্দ্দী থানার পাখীমারা গ্রামে এসে পৌছায়। সেখানে এক সদস্যের বাদীতে তারা আস্তানা গাড়ে। হঠাৎ করে সামরিক জান্তার গুপ্তচর বাহিনী তাদেরকে অবরোধ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু পলকে তারা চলে যেতে সমর্থ হয়। বাড়ীওয়ালা সদস্য মিঃ আশরাফ হুসেনকে পুলিশ সন্দেেহের বশবর্তী হয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ময়মনসিংহ নিয়ে গেলো। পরে তোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

 

অনেকদিন পর পুলিশ ময়মনসিংহের আব্দুর রহমান সিদ্দিক ও আ. এম. সাইদকে প্রেপ্তার করলো। কিন্তু কোন তথ্য না পাওয়ার দরুন শেষে নিরাপত্তা আইনে তাদের আটকিয়ে রাখে।

 

আলী আছাদ তখন সম্পূর্ণভাবে ক্ষেতমজুরের বেশ ধরে সারা পূর্ব বাংলা ঘূরে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি কর ও বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তখন সে দিবারাত্রি কাজ করতো। দাড়ি-গোফ এরুপভাবে রাখলো যে, কেউ আর তাকে আলী আছাদ বলে চিনতে পারে নাই। আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন উঠিয়ে রাজনৈতিক দল আবার পুরুজ্জীবিত করা হলে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব পার্টির কাজে ময়মনসিংহ সদের আসেন। আমরা তখন আলী আছাদের কথা তাকে জানালাম। মুজিব ভাই আলী আছাদকে প্রকাশ্যে বের হয়ে কাজ করার কথা বলে দিয়েছিল। আমরা এ সংবাদ বন্ধু আলী আছাদকে জানালাম কিন্তু সে প্রকাশ্যে বের হলো না। সে বললো যে রক্তস্বাক্ষরে শপথ নিয়েছি দেশকে মুক্ত করবো কিন্তু বেঈমানি করতে পারবো না। সে তখন ছদ্মবেশে সহানুভুতিশীল সারা ভারতে ঘুরে ঘুরে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সাহায্য কুড়াচ্ছিল। একদিন আসাম হতে তার লেখা পত্র পেলাম। তার খোজেঁ আসামে লোক পাঠালাম কিন্তু সেখানে তাকে পাওয়া গেল না। লোক এসে বললো যে, সে তখন দিল্লীর পথে পাড়ি জমিয়েছে। এর পর হতে সে নিরুদ্দেশ। কথা ছিল যে ভারতে সুবিধে না করতে পারলে সে চলে যাবে সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন অথবা রাশিয়াতে সাহায্যের জন্য। আমরা আশা করেছিলাম যে ফিরে আসবে কিন্তু সে আর ফিরে এলো না। কোনদিন হয়তো আর আসবে না। সে হারিয়ে গেছে। তার বীরত্ব ত্যাগ, তিতিক্ষাই আমাদের পাথেয়। ধ্রুবতারার মত সে আমাদরে চোখের সমানে জ্বলছে। তাকে অনুভব করা যায়, কিন্তু ধরা ছোয়া যা না। দেশ স্বাধীন হয়েছে। সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে কিন্তু হােয়ে গেছে একটি সৈনিক। আমরা অশ্রু ভারাক্রান্ত্ হৃদয়ে তাকে স্মরণ করবো- সে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য। (অসমাপ্ত)

 

* পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্ট সম্পর্কিত এই নিবন্ধটি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জামালপুরের একটি সংকলনে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে আর কোন সংখ্যা বের হয়নি।

<2.010.035>

ব্যক্তিগত হেফাজতে রাখতে হবে এবং সম্মেলন শেষে অবিলম্বে স্যার মুনির হোসেন, উপ সচিবমন্ত্রিপরিষদএর কাছে ফেরত দিতে হবে।

 

গোপনীয়

পাকিস্থান সরকার

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

গভর্নর সম্মেলনে দ্রষ্টব্য

 

বিষয়ঃ পূর্ব পাকিস্থানে পোস্টার প্রচারাভিযান।

 

          লক্ষনীয় যে, বিভিন্ন সময়ে পূর্ব পাকিস্থানে সামরিক আইন শাসনের উৎখাতের সমর্থনে, তার নেতাদের হত্যা, স্বশাসিত এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তার নিজের সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনী, পশ্চিম পাকিস্থানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদে পোস্টার, লিফলেট এবং অন্যান্য বিষয়গুলো নির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষনা পরবর্তী সহিংসতা ও যুদ্ধোত্তর আর্তনাদ অবলম্বনে স্বাভাবিকভাবেই গুরুতর সন্দেহ ও ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ভয়কে আরো যা বাড়িয়ে দিচ্ছে তা হচ্ছে এই কার্যকলাপ অপসারণের কোন পথ নেই এবং আরো শক্তিশালী ভাষায় নতুন নতুন সব স্লোগান  ক্রমান্বয়ে নতুন নতুন লিফেলেট আবিষ্কার হচ্ছে। তিক্ত এবং শক্তিশালী ভাষা হচ্ছে এইসব পোস্তারের মর্মার্থ এবং এটা যদি সত্যিই তাঁদের অর্থাৎ জনগণের মানসিক অবস্থার প্রতিফলন করে বা এর আংশিকও যদি হয়, তবে তা তাঁদের অমঙ্গলজনক ও শয়তানি মনোকামনাকে প্রকাশ করছে। এই গবেষণার উদ্দেশ্য তাঁদের বাস্তব শক্তির শক্তির মূল্যায়ন করা এবং যে বিপদ বিদ্যমান তা বিশ্লেষণ করা।

 

অশুভ পোস্টার

 

গবেষণায় অগ্রসরের পূর্বে এটা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, এমনকি স্বাভাবিক এবং সুস্থ সমাজ ও দেশেও সরকারের এবং শাসক শ্রেনী সমালোচনা করা হয় এবং এর বিরুদ্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, আইন ভঙ্গ হয় এবং নৈরাশ্যজনক পন্ডিতেরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগজনক সংবাদ তৈরী করে থাকেন। এইসব স্বল্প গুরুত্ববহ যদি এর সমস্ত ভুল এবং পার্থক্যগুলো সামাজিক শৃংখলার সাথে স্বাভাবিকভাবে গৃহীত হয় এবং যার একটিও যা বিদ্বেষপূর্ণ এবং অবশ্যম্ভাবী নয়, অতএব, তা নির্মুল করা হবে এবং অন্য পদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে। শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টারগুলো এবং এর নেতাদের পশ্চিম পাকিস্থানে এবং  সহিংস উদ্বেগজনক পরিস্থতি ঘটানোর মাধ্যমে শাসন হতে উৎখাত করার দুইটি ষড়যন্ত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছে  এবং মার্শাল ল’য়ের অধীনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও, তারা সাধারণ্যে খুব কম প্রভাব তৈরী করতে পেরেছে এবং তা অতো গুরুত্বও বহন করেনি, অন্যদিকে তাদেরকে পৃথক পৃথক ভাবে ক্ষমতাচ্ছন্নদের তামাশা ও বোকার কাজ বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্থানে, এই হামলাটি সরকারের প্রতি বা স্বতন্ত্ব বা এইরূপ নীতির বিরুদ্ধে ছিল। পাকিস্থান আক্রমণের ধারণা কোন পোস্টার বা ষড়যন্ত্রেই ছিল না। পূর্ব পাকিস্থানে, পোস্টারগুলো আপোষহীন এবং মৌলিকভাবে ভিন্ন কিছু ধারণার প্রতিফলন করেঃ তারা পাকিস্থানভিত্তিক ধারণাটি বাদ দিয়ে দেয়। তারা পশ্চিম পাকিস্থান হতে সম্পূর্ণ আলাদা একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্থানের আবেদন তৈরী করে। যিনি পাকিস্থানের আদর্শে বিশ্বাসী এবং তার কাছে এই ধারণাটি ঘৃণ্যতম, অন্যথায়,ভীত যে মুসলিম জাতি হিসেবে টিকে থাকা কঠিন হবে। হিন্দু আক্রমণে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্থান যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে তেমনই হবে পশ্চিম পাকিস্থান এবং

 

<2.010.036>

 

কোন পক্ষেরই এভাবে টিকে থাকা সহজ হবে না বলে বুঝতে পারবে। এইজন্যই পূর্ব পাকিস্থানে স্বাধীনতা এবং পরম স্বায়ত্তশাসনের আর্তনাদ ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এইসব বিপথে চালিত পৃথক ভন্ডদের কাজ হিসেবে দূরে সরিয়ে আড়াল করা যাবে না। যাই হোক না এইসব প্রচার পত্র এর লেখকের বা বিশাল সংখ্যক জনতার মানসিকতাকে  প্রতিফলিত করে, এতে একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার যে যেইসব লোক এইগুলো লিখে তারা পাকিস্থানকে ধ্বংস করতে চায়।  পূর্ব পাকিস্থানীদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতার সাথে প্রাদেশিক পর্যায়ে প্রায় সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিষেবাগুলো প্রাদেশিকীকরণ এবং শিল্প ও বাণিজ্যে স্বাধীন ভাবে নিয়ন্ত্রণের দাবী নতুন নয়। প্রতিটি প্রাদেশিক নির্বাচনের আগে এই ধরনের দাবী জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীগুলোর মধ্যে এইসব দাবী স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছিল। মূলত, একটি দলের সাফ্যল্যের ব্যাপ্তি তা তাঁদের প্রস্তাবনারগুলোর উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা ক্রমান্বয়ে পরিবর্ধনে ছিল কিন্তু যাই হোক, কেন্দ্রের সাথে এর যোগাযোগ ক্ষীণ ছিল যা একজন ব্যক্তি বা দলের ধারণাপ্রসূত। পূর্ব পাকিস্থান পাকিস্থানের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অংশ হিসেবে এগুতে পারতো। বর্তমানে প্রথমবারের মতো, সেই ১৯৪৭ সাল হতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্থানের দাবীসহ পশ্চিম পাকিস্থানের কোন সাথে কোন সংযোগ ছাড়াই প্রকাশ্যে তৈরী করা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ছোট্ট একটি দল ছিল যারা এমনকি ১৯৪৭ সালেও স্বাধীন, অবিচ্ছিন্ন বাংলার পক্ষ নিয়েছিল। জনাব সোহ্‌রাওয়ার্দী এই ধারণার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন এবং এর পরিণাম হিসেবে শেষপর্যন্ত পাকিস্থানের প্রথম গণপরিষদ থেকে কায়েদ-ই আযম দ্বারাই নির্বাসিত হয়েছিলেন। পাকিস্থানের অনুকূলে মতামত সেই সময় এতোই শক্তিশালী ছিল যে জনাব সোহ্‌রাওয়ার্দী কলকাতায় আশ্রয় নিতে বাদ্য হয়েছিলেন। জনাব ফজলুল হকের আনুগত্য পাকিস্থানের প্রতি ছিল,সেই সময় তাকেও সন্দেহ করা হতো (সীমান্তের উভয় পক্ষে দীর্ঘকালীন বসবাসে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জের ধরে) এবং সম্ভবত, বামপন্থী হিসেবে, তিনি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার পক্ষে ভোট দিতেন। এই রকম মানুষও ছিল, যাইহোক, অল্প এবং বিরল এবং তারা তাঁদের মতবাদ সাবর্জনীন করতে সাহস পাননি। আজ, সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সমর্থনে পোস্টারগুলো বৃহৎ পর্যায়ে দায়মুক্তিসহ সম্প্রচারিত হচ্ছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় যা তারা জাগিয়ে তুলেছিল বিস্ময়করভাবে তা পশ্চিম পাকিস্থানে একেবারেই কম, অন্যদিকে, আজকের দিনেও পাকিস্থানকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার কোন আলাপ সহিংস অনুভূতি ও আবেগের উদ্রেক করে। এক রাতের জন্য হলেও যদি অনুমান করা হয় যে পাকিস্থানকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার চিন্তা পূর্ব পাকিস্থানেও কি একই রকমের অনুভূতির উদ্রেক করে না যা এক সময় করেছিল? এই উদাসীনতার সম্মুখে, প্রতিরোধকারীদের শক্তি কি তবে বেপরোয়াভাবে আত্মবিশ্বাসী এবং আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠেনি এবং একটি কঠিন আঘাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি?

 

III-দিল্লীর বিরুদ্ধে পশ্চিম বাংলায় ক্রমবর্ধমান

 

পোস্টারের প্রভাবের প্রকৃত মূল্যায়ন  দুই গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির সম্পর্কে হওয়া উচিত। বর্তমানে পূর্ব পাকিস্থান ও পশ্চিম বাংলা উভয়ের মধ্যে, এমন একটি অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে  রাওয়ালপিন্ডি এবং দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকার অসহানুভূতিশীল, বিমাতাসুলভ এবং  শত্রুভাবাপন্ন এবং এই দুই প্রদেশের সম্পৃক্ততার দরুণ জনগণের আশা ও আকাঙ্খাগুলো চরম ভোগান্তিতে। এই অনুভূতি মোটামুটি ব্যাপকভাবে এবং আরো অনেক বেশী করে পশ্চিম বাংলায় উচ্চারিত হচ্ছে, যেখানে জনাব নেহরু, কংগ্রেস হাই কমান্ড এবং ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আরো বৃহৎ বৈরীতা বিদ্যমান। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পশ্চিম বাংলার মানুষের মেজাজ বিরূপ, অসন্তোষজনক এবং হতাশাজনক। আসামে দাঙ্গা নিঃস্ব উদ্বাস্তুদের দ্বারা কলকাতাকে আরো প্রতিবাদী করে তোলে এবং অস্বস্তিকে আরো বাড়িয়ে তোলে। পশ্চিম বঙ্গীয়রা আগস্টের শেষে স্বাধীনতা উদযাপনে অংশ নিতে অস্বীকার করার মাধ্যমে তাঁদের ক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং তারা অসমীয় যারা তাঁদের বাংলা বাংলা স্বদেশবাসীদের ধ্বংস করতে এমনতরো কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে অবস্থান না নেওয়ায় নেহরু এবং কংগ্রেস হাই কমান্ডকে  দোষারোপ করে। পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে কলকাতা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। প্রশাসন দূর্বল এবং অকার্যকর এবং কংগ্রেস হাই কমান্ড পর্যন্ত একজন বাঙ্গালীকে ভারতের প্রধানমন্তী বা রাষ্ট্রপতি করার ধারণা নিয়ে হৃদ্যতার অভিনয়

 

 

<2.010.037>

 

করে যাচ্ছিল এবং অন্যান্য আরো সুযোগ সুবিধা প্রদান করার কথা বলছিল কিন্তু বৈরিতা ও সন্দেহ অপ্রতিহতভাবেই ক্রমবর্ধিত হচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্থানে সংবিধান বাতিলের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্থানের মন্ত্রীদের, এমপিদের কর্মী এবং এদের সাথে  একই শিবিরের অনুসারী এবং সেই সকল ব্যক্তিদের যারা তাঁদের সমর্থন পুষ্ট এবং সরকারী ক্ষমতা সবই করাচীতে স্থানান্তর করা হয়েছে। রাওয়ালপিন্ডিতে থাকা পাঞ্জাবী এবং পাঠানদের শাসনের সমার্থক হয়ে ওঠে মার্শাল ল’। যদিও দুর্নীতির চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, রাজনৈতিক অত্যাচার শেষ হয়েছে এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে, অশান্তি সৃষ্টিকারীরা এবং নাশকতামূলক গ্রুপগুলো এই বিশ্বাস করতে উৎসাহিত করা অব্যাহত রেখেছে যে পূর্ব পাকিস্থানীরা তাঁদের তৎকালীন পদ ও ক্ষমতা নিয়ে প্রতারিত হয়েছে। এমনিভাবে সীমান্তের উভয় পক্ষ, এইরকম মনে করে যে জনতার প্রতি জুলুম একইভাবে প্রকাশ্য হয়েছে এবং এভাবেই চাপ সৃষ্টিকারী দল দ্বারা তা একাগ্রতার সাথে গড়ে তোলা হচ্ছে। কলকাতায় শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেরই ক্ষোভ  এবং অভিযোগগুলো প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে কিন্তু সংবাদপত্রে পূর্ব পাকিস্থানের কথিত ক্ষোভগুলোর জন্যেও বিশেষ স্থান উৎসর্গিত হচ্ছে। ‘দ্য হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, কোলকাতা, তাঁদের পত্রিকায় ‘পাকিস্থান এক্স-রেয়ড’ শিরোনামে বিশেষ কলাম প্রচার করে যেখানে পূর্ব পাকিস্থানের ক্ষোভগুলো প্রচারিত হয়।

 

পশ্চিমবঙ্গে পুনর্মিলনের সমর্থনে পোস্টার

 

          দ্বিতীয় অগ্রগতিটি হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে দুই বাংলার পুনর্মিলনের সমর্থনে পোস্টার বের করা হচ্ছে এবং তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। এখানে অবশ্যই একটি পার্থক্য আছে এবং তা হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের পোষ্টারগুলো সাধারণত একটি যুক্তবঙ্গীয় যা বৃহৎ স্বশাসিত ক্ষমতার সাথে ভারতের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে যদিও চরমপন্থীরা একটি স্বাধীন বাংলার পুনর্মিলনকে সমর্থন করছে তৎস্বত্তেও পূর্ব পাকিস্থানে তা সংখ্যায় অনেক কম, অন্যদিকে  প্রধান দাবী হচ্ছে পূর্ব পাকিস্থান স্বাধীন হউক এবং আলাদা হউক। আবার চরমপন্থীদের মনে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্থান পশ্চিমবঙ্গের সাথে একত্রিত করা উচিত মনে করা ছাড়া অন্য কোন প্রস্তাবনা নেই। গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি যাই হোক না কেন তা হচ্ছে যে সীমান্তের দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য যা পোষ্টার দ্বারা প্রতিফলিত হচ্ছে এবং ক্রমানয়ের তা সংক্ষিপ্ত করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য আন্দোলন সঞ্জীব চৌধুরী দ্বারা সংগঠিত হচ্ছে ( কুখ্যাত নেপাল-নাগ-পূর্ব পাকিস্থানে আত্মগোপনকারী কম্যুনিস্টের শ্বশুর), যিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একজন উকিল। তিনি এমন একটি জায়গায় কাজ করেন যা ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস নামে পরিচিত। মূল পরিকল্পনা ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে পুনর্মিলনে প্রভাব তৈরী করা। পরবর্তীতে, এমনকি ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস পর্যন্ত আক্রমনাত্মক উপায়ের প্রচার শুরু করে এবং সহিংসতা অবলম্বনের বিশেষ পরামর্শও দেওয়া হয়। জনসাধারণ্যে  পূর্ব পাকিস্থানের সীমান্ত চক্রান্তের প্রতি কৌতুহল বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয় এবং নভেম্বরের শেষে খুলনা জেলার সীমান্তেও একই রকম চক্রান্ত  তৈরী করা হয়।

 

পূর্ব পাকিস্থানে পোস্টারগুলো সংঘবদ্ধ দল দ্বারা নয়

 

          পূর্ব পাকিস্থানে প্রচারপত্রজনিত কাজগুলো কি পশ্চিমবঙ্গ হতে অনুপ্রেরণার ফসল নাকি তদ্বিপরীত তার উত্তর অবশ্যই অনুমিত কাজের বিষয় হিসেবে থাকবে। পুর্ববর্তী যেসব পোষ্টার পূর্ব পাকিস্থানে দেখা গিয়েছিল, আদতে, এদের একটার সাথে অন্যটার সামান্য সংজ্ঞাগত মিল আছে এবং এদের মধ্য নুন্যতম তিনটির ভাব ও লিখিত আবির্ভাব হয় একেবারে স্থানীয় নিরেট অনুপ্রেরণায়। ইস্ট পাকিস্থান লিবারেশন পার্টির নামের অধীনে এইসব প্রচারপত্রের বিলিবন্টনের জন্য দায়ী একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যদিও তিনি কলকাতা ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেখানে কিছু মানুষের সাথে দেখাও করেছেন, তার বক্তব্য হচ্ছে এইসব পোষ্টার

 

<2.010.038>

 

আওয়ামিলীগের একজন প্রাক্তন মন্ত্রীর,একজন অধ্যাপকের এবং অন্যান্য কিছু স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অনুরোধে প্রস্তুত করা হয়। যে চিঠি নিজস্ব সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং নৌ বাহিনী সহ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্থানের জন্য অজুহাত তৈরী করছিলো, যার মধ্যে যেইসব ব্যক্তি শীর্ষ পদের  অধিকারী ছিলো তাঁদের তালিকাভুক্ত করা হয় এবং যার অনুলিপি ইউএসএ,ইউকে এবং ইউএসএসআর কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল প্রতীয়মান যে এই কৃতকর্মটি পূর্ব পাকিস্থানের একজন অসন্তুষ্ট বৈমানিক পেশোয়ারে প্রকাশ করে। সাম্প্রতিক কালে ঢাকাতে সচিবালয়ের বাইরে তৃতীয় গুচ্ছের পোষ্টার ঝোলানো হয়, যাতে ডি-ডে নামে নামাঙ্কিত আছে এবং শাসকদের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ বিদ্রোহের পক্ষপাতীত্ব করছিলো, যা সচিবালয়েরই কিছু কর্মচারী দ্বারা লিখিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটা, তাই যে সময় পশ্চিমবঙ্গের সকল কার্যকলাপ এক কেন্দ্রিভূত এবং সংগঠিত, তখন পূর্ব পাকিস্থানে এটি, যে কোন পর্যায়েই, একক ব্যক্তির কাজ ছিল, সম্ভবত, যাদের একের সাথে অপরের কোন যোগাযোগও ছিলো না। যেহেতু পোস্টারগুলোর বহিঃপ্রকাশ ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছে, তাই এটা অসম্ভব নয় যে নিকট ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট  বিভিন্ন গ্রুপগুলোর একে অন্যের সাথে যোগাযোগের এবং কার্যকলাপগুলো আরো নিয়মানুগভাবে করার প্রবণতা তৈরী হতে পারে। অবশ্য, এটাও অসম্ভব নয় যে সীমান্তের দুই প্রান্তে যে সব দল কাজ করছে তারা অনেক আগেই হাত মিলিয়েছে এবং একই রকম কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যেমন সহজাত উপাদানগুলো লাইনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং তেমনই পুলিশের কাছেও আছে, দূর্ভাগ্যবশত, তারা কোন দল বা ব্যক্তিকে সুস্পষ্টভাবে দায়ী করে একটি মামলা করার মতোও কিছুই জোগাড় করতে পারেনি যাতে আমরা এইরূপ আরো কর্মকান্ডের বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই প্রস্তুত হতে পারি। হতাশা এবং নৈরাশ্যজনক অনুভূতি সাথে সীমান্তের দুই পাশেই বিদ্বেষমূলক একটি গোষ্ঠী তৈরীর ধারণা চতুরতার সাথেই ছড়িয়ে যাচ্ছে।

 

পোস্টারগুলো সমালোচিত দলগুলোর বিরুদ্ধে নির্দেশিত

 

সেইসব পোস্টারগুলোতে স্লোগান এবং আকর্ষক শব্দ থাকে, তা অবশ্যই সাধারণের মনকে বিষিয়ে তুলেছে এবং ঘৃণা ও সন্দেহের প্রচ্ছন্ন অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলছে। তারা সমালোচিত দলগুলোতে দৃষ্টিপাত করে। পূর্ব পাকিস্থান লিবারেশন পার্টির পোস্টারগুলো লাল তারকা সম্বলিত অত্যন্ত আকর্ষণীয় নকশার ছিল এবং পোস্টারগুলো বিভিন্ন জেলার সচিব এবং বার এসোসিয়েশনের সদস্য, সাংবাদিক ও ছাত্রদের ঠিকানায় ছিল। এসবের বিষয়বস্ত ছিল আঞ্চলিক উগ্র জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোড়িত করা এবং গভীরভাবে চিন্তার করার। এই অভিন্ন দুর্ভাগ্যের জন্য  বলির পাঁঠা হিসেবে প্রস্তাবিত হয়। অতএব, যদি না চিহ্নিত হয়, এই প্রকারের পোষ্টারগুলো অতি অবশ্যই প্রচুর সংখ্যক সহজ এবং ভাল মানসিকতার জনতার চিন্তাভাবনাকে বিষদভাবে ক্ষতিগ্রস্থ এবং প্রভাবিত  করতে পারে। বড় আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ছোট করেই,  যদি না যে আইন তাঁদের দুষ্কর্মের চেষ্টাকে মোকাবেলা করতে পারে এবং ব্যর্থ করতে না পারে, তবে তা পাকিস্থানের বিরুদ্ধে জনগণের মনকে ক্রমাগতই কলুষিত করবে এবং বিষিয়ে যাবে।

 

ভারতের ভূমিকা

 

এই মর্মে বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, এই কার্যকলাপ ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট এবং পাকিস্থান হতে পূর্ব পাকিস্থানকে বিচ্ছিন্ন করা যা ইদানীংকালে সরকারের উচ্চ পর্যায় হতে বাস্তবায়িত হয়নি। একটা পর্যায়ে ভারত ভাষানী, মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য অনেককেই সমর্থন করেছে ও উতসাহীও করেছে। কিন্তু বর্তমানে, ভারতের নিজেদেরই অসংখ্য সমস্যা আছে এবং সে আঞ্চলিকতাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের হার এড়াতে লড়াই করে যাচ্ছে। বাংলায় ভারতের কর্তৃত্ব দূর্বল এবং সে যদি কোন সমস্যার উদ্ঘাটনে প্ররোচিত করেও থাকে, তবে সেই কৌশল তার নিজের কাছেই ফিরে আসবে এবং নিজের যন্ত্রণা বাড়াবে। যুক্তবঙ্গ তার নিজের প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রার উৎস এবং অত্যন্ত উর্বর মাটির কারণে স্বয়ং ভারত ফেডারেশনের কার্যব্যবস্থাকেই উৎখাত করতে পারে অথবা এমন দাবী করে বসতে পারে যা কিনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা এবং তিব্বতের সাথে দৃশ্যমান নৈকট্যলাভকারী অংশগুলোতে

 

<2.010.039>

 

চীনাপন্থী কমিউনিস্টদের উপস্থিতি আপাতত ভারতকে ঠেকিয়ে রাখছে। সরকারের নীচু স্তরে অবশ্য ইতোমধ্যেই এই কার্যকলাপ সক্রিয়ে হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি, এই বিশ্বাসের প্রমাণস্বরূপ, করাচিস্থ ভারতীয় হাই কমিশনারের অফিসে পূর্ব ও পাকিস্থানের মধ্যকার ভিন্নতার বিষয়ে প্রচারপত্রের বিশালাকার স্থুপ পাওয়া যাওয়ার মতো তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। ভারতীয় গোয়ান্দা, করাচি ও ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের স্টাফদের কেউই নিষ্কলঙ্ক নয়। এইদিকে উচ্চপর্যায়ে, ভারতীয়রা এটাও চিন্তাভাবনা করতে পারে যে তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াই সবকিছু সন্তোষজনকভাবে চলছে এবং আপাতত, এই বিষয়ে সর্বসম্মুখে তাঁদের পদক্ষেপ না নিলেও চলবে।

 

যে বিষয়গুলো প্রতিরোধ গড়ায় যোগান দিবে

 

পূর্ব পাকিস্থানে আমাদের এখন সেই আইন প্রয়োগকারী শক্তি হতে হবে যা তাঁদের বিচ্ছিন্নতার সাথে জড়িত ও অন্যান্য নাশকতামূলক প্রবণতাকে স্বাভাবিক ভাবে বাঁধা প্রদান করবে। এই আইন প্রয়োগকারী শক্তি হয়তো বা প্রশাসনিকভাবে, বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে, মধ্যবিত্তদের নিয়ে এবং সেইসব দল যারা রক্ষণশীল, যাদের অধিকাংশই দৃঢ়ভাবে পাকিস্থানের মতাদর্শী তাঁদেরকে বর্ণিত করতে পারে।অর্থনৈতিক উন্নতি অতিরঞ্জিত বিষয় এবং তা যদি কোন উল্লেখযোগ্য পরিমাণেও অর্জন সম্ভবপর হয়, তবুও তা পরিবর্তণের দাবীতে আটকে থাকতে পারে না। বিপ্লব বা পরিবর্তণ “অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সমাজে, ব্যাপক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বিপাকগ্রস্থ বা বিষন্নতা মধ্যে চলতে থাকা সমাজে ঘটে না”, কিন্তু দেশের ক্ষেত্রে “ সেই সমাজে যা অর্থনৈতিকভাবে প্রগতিশীল”। বস্তুত, এটা আরো সরলীকরণ করা নিরাপদ যে যত বেশী সমৃদ্ধ কৃষক সম্প্রদায়, ততো বেশী অসন্তুষ্টতা চলে আসে। অন্যান্য কারণে রাজনৈতিক আদেশ বা সিস্টেমের মধ্যে তীব্র পরিবর্তন হয়।

 

পুনর্জাগরণের ধারণাগুলো যা পাকিস্থানের দাবীতে চালিত করে

 

ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক স্বদেশের চাহিদা বিগত প্রজন্মের যা হিন্দুদের ছল-চাতুরী, তুচ্ছতা ও স্বৈরশাসনের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে চাপা ছিল। সেই প্রজন্মের নারী ও পুরুষ পুনঃ স্মরণ করে যে হিন্দুরা কিভাবে সুস্পষ্টভাবেই যেসব প্রতারণাগুলো চর্চা করতো এবং জানতো যে যদি মুসলমানেরা আবারো যদি হিন্দুদের মামুলি করুণার সম্মুখীন হয়ে তবে কি বিপদ হতে পারে। পার্টিশনের পরে যে নতুন প্রজন্ম বড় হয়েছে তারা এইসব সম্মান ভুলে গিয়েছে এবং হিন্দুদের প্রতি আরো উদারমনস্ক এবং মুসলিম ও হিন্দের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপের প্রতি সহানুভূতিশীল। বয়স্কদের অধিকাংশই যে কোন মূল্যেই পাকিস্থানের পাশেই থাকবে। অবশ্য এই প্রজন্মের, আংশিকভাবে বার্ধক্যজনিত জড়তা এবং আংশিকভাবে উদাসীনতা ভিতরে তাঁদের দাবী-পূর্ণ কন্ঠ অতোটা শক্তিশালী নয়। যে মুসলীম লীগ পাকিস্থানের দাবীর ধারণা দিয়েছে এবং মুসলমানদের একই প্লাটফর্মে নিয়ে এসেছে, দুঃখজনকভাবে তা লুপ্ত এবং এর নেতাদেরকে বিদ্বেষপূর্ণভাবেই নেওয়া হয়েছে। পূর্ব পাকিস্থানে মুসলিম লীগ, যা পাকিস্থানকে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে দাঁড়িয়েছিল, খুব তাড়াতাড়ি তাকে ধ্বংস করা হয় এবং এর জায়গা দখল নিয়েছে স্লোগানভিত্তিক যুদ্ধপ্রিয় লোক ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের দল এবং আবেগে পরিপূর্ণরা। যদি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্থান সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয় তবে যে আদর্শ ও বিশ্বাসে পুরনো প্রজন্ম পাশে ছিল, তাঁদের অবশ্যই পুনরুত্থিত হতে হবে।

 

শাসক শ্রেণী

 

” সামরিক গুণাবলী, প্রতিষ্ঠিত চিন্তা ও আচরণ সমূহের প্রতি সম্মান এবং আপোষের ইচ্ছে ও প্রয়োজনবোধে, উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে,সম্ভবত,

<2.010.040>

 

কঠোরতার সাথে প্রায় যথাযোগ্য পর্যাপ্ত মিশ্রণ হচ্ছে সফল শাসক শ্রেণীর গুণাবলী-গুণাবলীগুলো পরিষ্কারভাবেই পুনিক যুদ্ধকালীন রোমান এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইংরেজের অর্জিত গুণাবলী। ” বিদ্রোহী মৌলবাদী হচ্ছে যাদের নিজেদের এবং তাদের অবস্থানের উপর বিশ্বাসের অভাব বা যারা ধরে নেয় তাদের অন্যায়ের ক্ষমতা আছে বা যারা পরিমার্জনের ভান করতে লাগলেন এবং সাংস্কৃতিক অনুগ্রহ যা সুস্পষ্টরূপে শাসক শ্রেণীর কার্য সম্পাদনে অযোগ্য হয়। আমি স্বাভাবিকভাবেই মন্তব্য প্রদানে বিরত থাকছি কিন্তু এইসব শর্ত কতটুকু পূর্ণ হচ্ছে তা বিবেচনা করার ভার পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম। সামরিক আইন তুলে নেওয়ার পর পূর্ব পাকিস্থানে রাজনৈতিক কার্যকলাপ রধ করতে বাধ্য করা হয় এবং কঠোর বিচারের জন্য প্রশাসনিক ক্ষমতাকে আনা হবে। গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার সামর্থ্য ও আচরণকে পরীক্ষা করা উচিত এবং প্রয়োজনে পুনর্বিন্যাসও করা হবে। এই অংশে কিছু কর্মকর্তার অপরাধ প্রবণতার প্রতিবেদন পাওয়া গিয়েছে এবং সেই মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

 

বুদ্ধিজীবিদের অবাধ্যতা

 

যে সমাজ বিশাল পরিবর্তনের জন্য তৈরী হয়, বুদ্ধিজীবিদের সেখানে পরিত্যক্ত হওয়া শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্থানে যে কোন প্রকারের, বিশালতার কোন প্রমাণ নেই। ১৯৪৭ সাল হতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধারাবাহিকভাবে শাসনের জোরালো প্রভাব আছে। মুসলিম লীগ পাকিস্থানের দাবীতে ছাত্রদের ব্যবহার করেছে এবং পরবর্তীতে ছাত্ররা এতোই ক্ষমতাধর হয়ে উঠে যে সরকারকে এমনভাবে ব্যবহার করে যা তাদের হাতের দাবার গুটি হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যথেষ্ট সংকীর্ণ এবং আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্বকারী বুদ্ধিজীবিদের ছোট্ট একটি দল আছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অধ্যাপক ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার পদক্ষেপের রেকর্ড গৌরবময় করা হতে অনেক দূরে আছে এবং এতে কোন সন্দেহ নেই যে ছাত্রদের বিদ্বেষপূর্ণ চিন্তাধারা এই দলের দ্বারাই প্রভাবিত। যদিও কিছু বুদ্ধিজীবিকে বর্জন করা হয়েছে তবে অধিকাংশই এখনো সরকারের সাথে আছে। অতএব, সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবিদের উন্নত করা এবং যেসব বিদ্রোহী বুদ্ধিজীবি আছেন তাদের পরিবর্তন করার দিকে লক্ষা স্থির করাই এখন প্রচেষ্টা হওয়া উচিত। ন্যাশনাল রিকনসট্রাকশন ব্যুরো এতদুদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। পুর্বের অনুচ্ছেদে উল্লেখিত পুনরিজ্জীবিত প্রবীণদের দলকে বুদ্ধিজীবিদ শ্রেণীতে পরিণত করা আরো দৃঢ় হতে হবে।

 

মধ্যবিত্ত শ্রেণী

 

সমাজের মধ্যে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী হচ্ছে এর স্থায়িত্বের প্রতিশ্রুতি। অতীতে, দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা ধন-সম্পদের অধিকার প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে হিন্দুদের উপরেই ন্যস্ত ছিল, মুসলিমদের নিয়ে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপস্থিতি ছিলোই না। নতুন অর্থনৈতিক ও সেবার সুযোগ উন্মোচন করে দিয়েছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের প্রক্রিয়া দ্রুতই। তবে পশ্চিম পাকিস্থানে তা অতোটা রক্ষণশীল নয়। পরবর্তী প্রজন্মের বধ্যবিত্তের রক্ষণশীলতার প্রতি ঝোঁক থাকবে এবং অতঃপর তা হঠকারী ও অপরিমাণদর্শী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং মন্দবোধের পরিবর্তণ নিয়ে আসাতে প্রভাব প্রয়োগের চেষ্টা করবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি যা এখন গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে তাকে অবশ্যই যে কোন মূল্যে সাহায্য ও শক্তিশালী করতে হবে। এই শ্রেণীর অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনবোধে গণ কল্যানের উপর জোর কমিয়ে দিতে হবে। পশ্চিম পাকিস্থানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে  অনেক কলঙ্কিত সামন্ততান্ত্রিক যে সমাজ, যার অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়ার দিকে ঝুঁকছে, তা এর স্থায়িত্বের জন্য দায়ী হবে।

 

পুলিশের পক্ষ হতে আরো সক্রিয়তা দরকার ছিল

 

কর্তৃপক্ষের, আমি দুঃখের সাথে বলছি যে, পোষ্টার প্রচারণার দিকে এদের উদাসীনতা ছিল। যদি, এর পিছনে যারা ছিল, লেখক ও সংগঠনগুলোর সন্ধানে প্রতিটি উদ্যোগের দরকার ছিল।

 

 

<2.010.041>

 

যদি কোন কর্মচারী এবং অন্যান্য সংস্থার কমই ছিল, তাহলে বিশেষভাবে মনোনীত কর্মচারীর নিয়োগ দেওয়া উচিত ছিল। অপরাধীদের সন্ধান ও তাদের তালিকা আনার ব্যর্থতা তাদের ও অন্যান্যদের তাদের কার্যক্রম চালানোর প্রতি একরকমের আমন্ত্রণ ছিল। এই কার্যকলাপের কতটুকু ব্যক্তির, দলীয় অনুপ্রেরণার অথবা বাইরে থেকে পরিচালিত ছিল কিনা তা গোয়েন্দা সংস্থার খুঁজে পাওয়া উচিত ছিল। কমিউনিস্টদের ভূমিকা ও সমর্থনের ব্যাপ্তি এবং ভারতীয়দের কৌশল এ সবই অবশ্যই খুঁজে পাওয়া উচিত ছিল। এছাড়াও আরো যা পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল, তা হচ্ছে বিক্ষুব্ধ হওয়ার উপাদানের সম্ভাবনায় যারা মনে করে যে, তাদের উপর জুলুম করা হচ্ছে এবং সীমান্তের ওপারে একই রকম উপাদানসহ অভিন্ন ফ্রন্ট পরিত্যাগের মাধ্যমে তাদের পরিত্রাণ নিহিত রয়েছে। লোকেরা অবশ্যই তাদের ভবিষ্যৎ ও কুশল পাকিস্থানের সাথে সংযুক্ত বলে প্রভাবিত হয়েছে এবং পরিশেষে, পূর্ব পাকিস্থানিদের ভয় ও আশঙ্কা কাল্পনিক ও মানসিক হিসাবে অতি অবশ্যই বাতিল করা যাবে না। পাকিস্থানের ভৌগলিক অবস্থান এবং  এই বিষয়টি সত্য যে কেন্দ্রীয় সরকারের সীলমোহর, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্থানে, যদিও উচ্চতর পদে পূর্ব পাকিস্থানীদের ঘাটতি রয়েছে (এর জন্যে তারা পশ্চিম পাকিস্থানের দোষ দিতে পারবে না), সরকারের অধীনে প্রেসিডেন্সিয়াল ফর্ম যার ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্থানে কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতার জন্য যে অবিশ্বাস তাদের হয়েছে, তা পূর্ব পাকিস্থানীদের পার্থক্যকে জোরালো করে তুলতে এবং সন্দেহপ্রবণ করে তুলতে ভূমিকা রাখছে। আমার কোন সন্দেহ নেই যে, যদি সরকারের অবস্থান রাওয়ালপিন্ডি না হয়ে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হতো তবে পশ্চিম পাকিস্থানীদের মানসিক অবস্থান একই রকম হতো না।  এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারতের আঞ্চলিক উগ্রতা দেশের একাত্মতা ও সংহতিকে ধ্বংস করার খেলায় মেতে উঠেছে। প্রাদেশিকতা পাকিস্থানেও বিদ্যমান এবং মনে হচ্ছে তা বর্তমানে ইন্দো-পাকিস্থান উপমহাদেশের আলোচ্য বিষয় হয়ে গিয়েছে। ভারতীয়রা এটা সমাধানের একটা উপায় প্রস্তাব করেছে যা হচ্ছে ভবিষ্যতে পুলিশে এবং উচ্চ আদালতের কর্মীবৃন্দ প্রদেশ হতে দুই তৃতীয়াংশের বেশী থাকতে পারবে না এবং বাকিদেরকে বাইরে থেকে আনা হবে। কেনই’বা পাকিস্থানেও এমন করা যায় না? রেল সংযোগ পূর্ব পাকিস্থানের সাথে বিচ্ছিন্নতাকে ভাঙতে সাহায্য করতে পারে এবং তাহলে ঢাকা অমৃতসর থেকে মাদ্রাসের চাইতেও লাহোরের কাছাকাছি হয়ে যাবে।

পরিশেষে, আমি আবারো বলছি যে পোস্টারগুলো অমঙ্গলজনক এবং পূর্ব পাকিস্থানে চরমপন্থীদের মানসিকতা রাষ্ট হিসেবে পাকিস্থানের প্রতি আস্থায় ধাক্কা দিয়েছে।  পশ্চিম বঙ্গে অগ্রগতি সেই প্রদেশের জনতার ভারতের বিরুদ্ধে স্মৃতিকাতর ও তিক্ত করে তোলার কারণ যা শুভ ছিল না এবং সেই সাথে একটি অভিন্ন ফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও হতে পারে। ধারণা করা যাচ্ছে যে, যখন মার্শাল ল তুলে নেওয়া হবে তখন ক্রোধ আর বৈরিতা বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত ভেঙ্গে পড়বে। পশ্চিম পাকিস্থানের নির্বাহী ব্যবসায়ীরা পূর্ব পাকিস্থানে কাজ করার ব্যাপারে অস্বস্তি প্রকাশ প্রকাশ করেছে। তাদের ভয় অতিরঞ্জিত হতে পারে, কিন্তু আসল যে বিষয় তা হচ্ছে বর্তমানে পূর্ব পাকিস্থানে পোষ্টার প্রচারাভিযান অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্থানকে দূর্বল করে তুলবে।

 

<2.010.042>

 

গোপনীয়

 

১ম খন্ড

 

বিষয়ঃ  পূর্ব পাকিস্থানে জ্বালাতনকারী এবং লিফলেটের প্রচারাভিযান।

 

        পূর্ব পাকিস্থানে একজন ব্যক্তির ও দলের মতামত প্রকাশের উপায় হিসেবে পোষ্টার ও লিফলেট গ্রহণ করা হয় যা সাধারণত বেনামী হয়। এইটি এই প্রদেশের অনেকটাই ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য। ১৯৫৭ সালে একাই প্রায় ৬০০ পোষ্টার এবং লিফলেট বিলি করা হয়। এই রকমের কার্যকলাপে সাধারণত স্বতন্ত্র সদস্য বা ন্যাপের সদস্যদের এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরোধী অন্যান্য দল লিপ্ত হয়। এগুলোর একটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে স্লোগানে তাই থাকে যা  দেশের পররাষ্ট্র নীতি, সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী, নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের দাম কমানো, ইত্যাদি। যদিও সংসদীয় শাসনামলে জনগণের মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু এইসব পোষ্টার এবং লিফলেটের কোনটাই কোনদিন পূর্ব পাকিস্থানের স্বাধীনতা বা পশ্চিমবঙ্গের সাথে একাত্মতা নিয়ে ছিল না। এটাই দেখিয়ে দেয় যে কোন রাজনৈতিক দল বা এদের সমর্থকেরাই সবসময় পাকিস্থানের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া বা  অধঃপতনের ইচ্ছা পোষণ করতো।

 

          ২। মার্শাল ল চলাকালীন, ৪৪টি পোষ্টার এবং লিফলেটের খবর পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে ৩৩টি ছিল আভ্যন্তরীণ এবং বাই ১১টি বাহ্যিক। এই ১১টি লিফলেট বাহির হতে পাওয়া গিয়েছে যা সঞ্জীব চৌধুরী, জেনারেল সেক্রেটারী, ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস হতে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশনের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এইসব লিফলেটেই পাকিস্থান ও ভারতের পুনঃমিলনের বিষয়ে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস একটি পুরনো সংগঠন এবং এর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সরকারী পর্যায়ে প্রতিবাদ ১৯৫৭ সালেই করা হয়েছিল। এই আন্দোলন খুব সম্ভবত সমসাময়িক প্রকাশনা- স্বাধীনতাকালীন সময় (১৯৪৭-৪৮) এর পিঠ-পিছেই চিহ্নিত হয় যখন ‘সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কলকাতা বার-এট-ল’য়ের জে.পি. মিত্র যা পাকিস্থান এবং ভারতের পুনঃমিলনের উদ্দেশ্যের মতো হুবহু এক। পূর্ব পাকিস্থানে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন পার্টির জন্য ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের প্রভাব একেবারেই শূন্য। কিছু মানুষ, যাদের উদ্দেশ্যে কোলকাতা হতেই লিফলেট পাঠানো হয়েছিলো, তারাই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে কাগজপথগুলো হস্তান্তর করেছিল।

 

          ৩।  ৩৩টি আভ্যন্তরীণ পোষ্টার এবং লিফলেটের ৩টি পূর্ব পাকিস্থান লিবারেশন পার্টি (ইবিএলপি) দ্বারা, ১২টি জন সংঘ দ্বারা এবং বাকিগুলো অন্যান্য উৎস হতে প্রচার করা হয়েছিলো। ইবিপিএলপি ধরেই রেখেছিল যে পূর্ব পাকিস্থানের জনগণ একটি পৃথক জাতি এবং এদের লক্ষ্য ছিল এই প্রদেশকে সম্পূর্ণরুপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এই দল কোন প্রকার সংগঠনের মর্যাদা অর্জন করেনি এবং শুধুমাত্র ৫ থেকে ৬ জন ছিল এই দলের পিছনে। য়ার্ল্ড কংগ্রেস এই ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশনে জন্য, এই দলের কাগজপত্রগুলো যারা পেয়েছে তারা কি পেয়েছে তাও স্থানীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের কাছে এর পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হস্তান্তর করে দেয়। এই দলটি পাকিস্থান ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মতো ধ্বংসাত্বক দল দ্বারাও সমর্থিত হয়নি যা এই আন্দোলনে উভয় পক্ষের অন্তর্ভূক্ত শ্রমিকদের মাঝে ফাটল ধরাবে। এভাবেই ইবিএলপি জনগণ বা ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক দলগুলোর উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

          ইবিএলপি নামের সংগঠনটিকে খুব দ্রুত সময়েই চিহ্নিত করা হয়, এদের দুইজনকে নিরাপত্তাজনিত বন্দী করা হয় এবং অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হয় যার ফলস্বরূপ ১৯৬০ সালের জুলাই হতে এই দলের কোন প্রকার কার্যক্রম ছিলো না।

 

 

 

 

 

 

<2.010.043>

 

          ৪। জন সংঘ ১৬টি বিষয়ে দাবী নিয়ে এগিয়ে আসে যার মধ্যে ফেডারেল গভর্নমেন্টের সংসদীয় রূপ নিয়ে স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ, সকল বিষয়ে সাম্যতা, নিরাপত্তাজনিত বন্দীদের মুক্তি সহ অন্যান্য বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত ছিল। এই সংঘ এই প্রকারের হুমকি দেয় যে যদি তাদের দাবিদাওয়াগুলো ১-৯-১৯৬০ হতে ছয় মাসের মধ্যে মেনে না নেওয়া হয় তবে পশ্চিম পাকিস্থান হতে পূর্ব পাকিস্থানকে স্বাধীন করার জন্য ১৪-৪-১৯৬০ হতে সশস্ত্র বিপ্লবের আশ্রয় নিতে হবে। এই সংঘ দ্বারা প্রচারিত সকল লিফলেটের খসড়া করা এবং লেখা হয়েছিলো সেই একই ধারায় যা সম্ভবত শুধুমাত্র অল্প কিছু লোকের এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততাকে নির্দেশ করে।  এই দলের কার্যক্রম এখন পর্যন্ত গুটি কয়েক মানুষের গোপনে চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সাধারণ্যে যারা এই আন্দোলন সম্পর্কে অবগত নয় তাদের মাঝে কোন প্রকারের প্রতিক্রিয়া নেই। তাদের মধ্যে কিছু লোক  যারা চিঠি পেয়েছিলো, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। সংঘটি প্রায় ছয় মাস বয়েসী এবং কিছু তথ্য যা ইতোমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে তা নিয়ে সতর্কতার সাথে কাজ করা হচ্ছে।

 

          ৫। অন্যান্য পোষ্টার ও লিফলেটগুলোর দুটি ঘটনা- একটি কুমিল্লায় এবং অন্যটি নোয়াখালী জেলায় যা ব্যক্তি শত্রুতার পরিণাম ছিল। এই লিফলেটগুলোর রচয়িতারা, মার্শাল লয়ের বিধানের অধীনে হত্যা মামলায় তাদের শত্রুদের ফাঁসাতে চেয়েছিল এবং এই ধরণের অনিষ্টকারী কার্যকলাপের জন্যে তাদেরকে যথাযথ আইনসংগতভাবেই বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। আরো হয়রানি চিহ্নিত হয়েছে যা চতুর্থ শ্রেণীর বিপথগামী কর্মচারীদের অন্তর্বর্তীকালীন অব্যাহতি, বেতনবৃদ্ধি ইত্যাদির চাওয়াকে অবলম্বন করে করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে গত অন্তর্বর্তীকালীন অব্যাহতি শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্থানের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দেওয়া দেওয়া হয়েছিলো যা এই শাখার একই শ্রেণীর কর্মচারীদের মাঝে বেশ কিছুটা অপমান ও হতাশা সৃষ্টি করে।

          পোস্টারের ভাষা পরিমার্জিত নয় এবং এ থেকেই বোঝা যায় যে এটা কোন শিক্ষিত ব্যক্তির দ্বারা উদ্ভাবিত নয়। এর রচয়িতাকে সনাক্ত করতে অত্যন্ত শক্তিশালী অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।

 

          ৬। বেশীরভাগ পোষ্টার এবং লিফলেট ঢাকা হতেই উদ্ভূত। বগুড়া শহরে ৪টি পোস্টার চিহ্নিত হয়েছে। কিছু ছাত্র দ্বারা এসব লেখা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে যারা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিরোধীতাকারী। হয়রানিমূলক দু”টি ঘটনায় যেখানে কিছু ব্যক্তি অধুনালুপ্ত ন্যাপের সাথে একাত্মতাকারী বলে চিহ্নিত হয়েছে। এর একটি ভোলায় (বরিশাল জেলার অন্তর্গত) সংগঠিত হয়েছে, দুষ্কৃতিকারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে করা মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অন্যটি সিলেটে হয়েছিলো এবং তা তদন্তাধীন আছে।

 

          ৭। এটা লক্ষ্য করা যায় যে সকল প্রকারের পোস্টারিং মার্শাল লয়ের সময় হতেই যা নীতিভ্রংশ ব্যক্তির ছিল এবং কোন সুসংগঠিত দল তাদের পিছনে কাজ করছিল না। উদাহরণ হিসেবে উদ্বৃত করতে ঢাকার হায়াত খানকে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৬০ সালের মার্চ মাসে যখন লোকেরা ঈদ-উল-ফিতর উদযাপনে ব্যস্ত ছিল সে তখন একাই বেশ কিছু পোস্টার লিখে ফেলে এবং এর কিছু ঢাকা শহরেই লাগিয়ে দেয়। তাকে হাতে-নাতে গ্রেফতার করা হয়। তাকে দোষী সাব্যস্ত করার মধ্যে এই ঘটনার শেষ হয়।

 

          ৮।  পোস্টারিং এবং লিফলেটের প্রচার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি নয় যেহেতু তা কোন সুসংগঠিত দল হতে উদ্ভুত হয়নি। খুব বেশী হলে এটাকে ছোট বিন্দুর মতো ছিদ্র বলা যেতে পারে যা কিনা আসছে কিছু ধান্ধাবাজ ও বিপথগামীদের থেকে যারা নিজেদের বৈ অন্য কাউকে প্রতিনিধিত্ব করে না। প্রদেশে নিরাপত্তা বাহিনী নিজেদের পায়ের নীচে ঘাস জন্মাতে দেওয়ার জন্যেও অনুমতি দেওয়া হয়নি।  ডাকের মাধ্যমে পাঠানো  লিফলেট এবং পোস্টারগুলোতে দ্রুতই  হস্তক্ষেপ করা হয় এবং জনসাধারণ্যে যেসব পোস্টার লাগানো হয়েছিলো তা সাথে সাথেই তুলে নেওয়া হয় এবং এসবের রচয়িতাদের সন্ধানে অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে। সুতরাং আপামর জনতার মনকে প্রভাবিত করার মতো কোন সুযোগই তাদের নেই।

<2.010.044>

গোপনীয়

উপরোক্ত তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে এসব পোস্টারগুলো  এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের সামান্যতম অংশের জনগণের মানসিকতাকেও প্রতিনিধিত্ব করে না। এদের মধ্যে কয়েকটি পোস্টার পশ্চিম বাংলার কিছু কট্টর হিন্দুদের ক্রমাগত প্রচেষ্টাকে প্রতিনিধিত্ত্ব করে যারা এখনো পাকিস্তানের সাথে সহজে [সমস্যা] মিটমাট করতে পারছে না  কিন্তু বিগত দশকজুড়ে পূর্ব পাকিস্তানে কোন রকমের সমর্থন তৈরী করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যান্য কাজগুলো সেইসব ব্যক্তিদের যারা নিজেদের ছাড়া অন্য কারও প্রতিনিধিত্ব করে না।  সুতরাং এসব [প্রচারণা]  ‘অশুভ’ কিংবা ‘কুলক্ষণে ভরপুর’ এমন কিছু নয়। এসব পোস্টারে পূর্ব পাকিস্তানে আসন্ন ঝামেলার যেসব আশংকাজনক ভবিষ্যৎবাণী প্রকাশ করা হয়েছে যেগুলো, এমনকি কয়েক মাস কেটে যাবার পরেও,  কোন নিপীড়নের মাপকাঠি ছাড়াই  আগে থেকেই করা বিপদের ভবিষ্যৎবাণীবদ্ধ বিপদ ঠেকাতে কোন দমন-পীড়নমূলক ব্যবস্থা নেয়া ছাড়াই,সত্য প্রমাণিত হবার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। যে কোন স্বনামধন্য প্রশাসনেরই দায়িত্ব আশেপাশে যা ঘটছে তা সম্পর্কে অবহিত থাকা এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অখন্ডতা নিশ্চিত করা। তবে, এই গুরুভার পালনের আবশ্যিক দায়িত্ব হিসেবে প্রশাসনের বিস্তৃত দূরদর্শিতা, সত্য থেকে মিথ্যার আবরণ সরিয়ে ফেলার সামর্থ্য, অতুলনীয় মানসিক দৃঢ়তা বজায় রাখতে হবে, যাতে রাষ্ট্রের কোথাও ঘটে যাওয়া কোন  ক্ষুদ্র ও অর্থহীন ঘটনায় নিজের জন্য যেন সমস্যা তৈরী হয়, অল্পতেই যাতে প্রশাসন কেঁপে না ওঠে। বর্তমান শাসনব্যবস্থা ছোটখাটো বিষয়ের পাঁকে আটকে গেলে, আতংকিত হয়ে ভুল পদক্ষেপ নিলে শত্রুদেরই সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে, কেননা এসব কারণে জনমনে সৃষ্ট বিরক্তি-অস্বস্তিকে তারা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক প্রচারিত কাগজে এসব পোস্টারের গুরুত্ব সম্পর্কে বাস্তবতাবিবর্জিত দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে, যা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তে সঠিক প্রমাণিত হয় নি। কাগজে প্রকাশিত মতামত এবং সুপারিশসমূহ  মৌলিকভাবে ভুল প্রস্তাবনা থেকে উদ্ভুত। এই গবেষণাপত্রে উত্থাপিত প্রধান বিষয়গুলো নিমরূপে উল্লেখ করা যেতে পারে :

          (a) পোস্টারে উল্লিখিত পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তাবের “বিস্ময়জনকভাবে মৃদু” প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, যা থেকে মনে হয়, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে এ প্রস্তাবটি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য।

          (b) পূর্ব পাকিস্তানিরা বর্তমান শাসন ও কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা দিল্লীর ওপর অসন্তুষ্ট, সুতরাং এ দু’প্রদেশ ধীরে ধীরে একত্রিত হয়ে ভারতীয় গণপ্রজাতন্ত্রের অভ্যন্তরস্থ অথবা বহিঃস্থ অখণ্ড বঙ্গ গঠন করবে।

          (c) সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলেই “বাঁধভাঙ্গা ক্রোধ এবং বৈরিতা” ছড়িয়ে পড়বে।

          (d) পূর্ব পাকিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তাদের আনুগত্য পরখ করা উচিত এবং সেই হিসেবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

          (e) নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অগ্রগতির স্বার্থে, পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় পাকিস্তানেই প্রয়োজনে ব্যাপক হারে জনকল্যাণের উপর জোর দেওয়া কমিয়ে আনতে হবে।

          ৩) এইসব কিছু বিবেচনা করার আগে পূর্ব পাকিস্তানিদের মনোভাবের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কয়েকটি এবং তাদের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত পটভূমি উল্লেখ করা সুবিধাজনক হতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের পটভূমি ছাড়া এর [বর্তমান] অবস্থা সঠিকভাবে বোঝা যাবে না।

<2.010.045>
(ক) পূর্ব পাকিস্তান বেশিরভাগ সময় ব্রিটিশ ও হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে । কিন্তু তারা কখনোই তাদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেনি পলাশী যুদ্ধের পর থেকে । তারা অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছিল তবে মানসিকভাবে নয় । তাদের ইসলাম ভক্তি প্রবল ছিল । গত শতাব্দীতে মুসলিমদের এই প্রবল ইসলামভক্তিই পাকিস্তানের উত্তর অঞ্চলের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেছিল শিখ ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধ্যে লড়াই করতে ।

(খ) ব্রিটিশ ও হিন্দুদের সাথে তাদের বিরোধিতা এতটাই প্রবল ছিল যে “কাফের” দের ভাষা শেখা থেকে নিজেদের বিরত রেখে বেশ বেকায়দা অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। ভাষা এক হওয়া সত্ত্বেও পৃথক সত্ত্বা সৃষ্টিকল্পে তারা কখনোই হিন্দুদের সাথে এক কাতারে পরিচিত হতে চায় নি সেটা ছোটোখাটো যেকোনো বিষয় যেমন পোশাকের ক্ষেত্রেও হোক। 

(গ)  পূর্ব পাকিস্তানিরা কখনোই মৃদুস্বরেও কিছু বলে নি যখন পাকিস্তানের স্বাধীনতা চাওয়া হচ্ছিল । সে কারনে বাঙালি মুসলিমদের আদর্শ রাজনৈতিক নেতা জনাব ফজলুল হক খান তাদের ঘৃণা ও অবজ্ঞার পাত্র হয়ে উঠেছিঃলেন । জনাব সোহরাওয়ারদি ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে সংঘটিত কলকাতা দাঙ্গায় মুসলমানদের জীবন বাচাতে তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি । তিনি যখন সার্বভৌম বাংলায় জয়ী হলেন তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এমন ভাব করছিল যেন কিছুই হয়নি । তখন উভয় রাজনৈতিক নেতাকে পূর্ব পাকিস্তানে পুনর্বাসন করা বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ল পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ।

(৪) ঠিক এমন প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানিরা কখনো ধারণাও করেনি যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দুদের সাথে তাদের হাত মেলাতে হবে । তারা দেখিয়েছে সেটা বরাবরই যখন তাদের এমন কিছু করা উচিত ছিল । মাওলানা ভাসানি ছিলেন ১৯৫৪ সালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবং তার সম্মেলনে সাধারণত সহস্রাধিক লোকের সমাগম ঘটে । এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ চরমে । তখন সম্মেলনে মাওলানা ভাসানি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সদব্যবহার করা হচ্ছেনা । এমন চলতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের হয়তো পাকিস্তানকে বিদায় বলে দিতে বাধ্য হবে । সে সময় মাওলানা ভাসানিও তার জনপ্রিয়তা হারান । এর চেয়ে ভালো তর্কাতীত প্রকাশ কি হয় আর পূর্ব পাকিস্তানের অখন্ড পাকিস্তানের প্রতি থাকা মানসিকতার?

(৫) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সবচাইতে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা মনে করতেন যে, পূর্ব পাকিস্তানিদের পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আন্তরিকতার অভাব আছে এবং তা বিস্তার লাভ করতে পারে মুক্তির চাহিদায়। পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন তাদের এ মনোভাব বুঝতে পারতনা । তারা কেবল একটাই ব্যাখ্যা পাচ্ছে যে এই মানুষগুলো তাদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে এবং এর সাথে পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক কাজে তাদেরকে নিযুক্ত হতে দিচ্ছে না । তারা ভাবত হয়ত কিছু লোক দুই পক্ষ থেকেই পাকিস্তানের মাঝে ভাঙনের চেষ্টা চালাচ্ছে । পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন কলকাতার হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহন করে পাকিস্তানের সংস্কৃতি থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে । অন্যদিকে তারা পশ্চিম পাকিস্তান কে বলছে, পূর্ব পাকিস্তান তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে তাই তাদের উন্নয়নের তেমন কোন প্রয়োজন নেই ।

(৬) এটা ঠিকই দেখা যাচ্ছিল যে রাষ্ট্রদ্রোহী পোস্টারের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই ক্ষীণ । তর্কের খাতিরে বলাই যায় যে কোন প্রতিক্রিয়া ছিলই না বলতে গেলে। যদি কোন প্রতিক্রিয়া দেখানো হতো তাহলে সেটাই বরং বিস্ময়কর হতো.

 

 

 

 

<2.010.046>
এই পোস্টারগুলো জনগণ দেখার আগেই ছিঁড়ে ফেলা হত । প্রতিক্রিয়া তখনই দেখা দিত যখন মানুষজন মনে করত যে যা ছড়ানো হচ্ছে তা আসলেই বাস্তবায়িত হবে । যেমনটা হয়েছিল মাওলানা ভাসানির ভাষনের সময় । পাকিস্তানের লোকজন যদি বুদ্ধিমান হতো তাহলে এমন পোস্টার থেকে কি প্রকাশ পেয়েছে সেটা তারা বুঝতে পারতো এবং উপেক্ষা করতো । যদিও ভেতরে ভেতরে তারা অখুশি হত । ধর্ষণের মত ঘটনায় তারা আহত হত কিন্তু সেটা প্রকাশ করত না । বরং তারা আশা করত সেই অপরাধিকে আইনগতভাবে শাস্তি দেয়া হবে । 

(৭) উপরোক্ত ঘটনা থেকে বুঝা যায় পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা কখনোই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের সাথে হাত মেলাবেনা যদি না তাদের উপর বল প্রয়োগ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানিরা আবেগ ও বস্তুগত চিন্তা দ্বারা পরিচালিত ছিল । তারা এতটুকু বোঝার মতো চালাক ছিল যে শত দুঃখ-দুর্দশা সত্ত্বেও পাকিস্তানে তাদের বৃহৎ অংশ আছে যেটা পাকিস্তানের বাইরে গেলে তারা হারাবে। তাদের দুর্দশা যদিও আগের তুলনায় এখন অনেক তীব্র। তাদের তৎকালীন সরকার বা নেতাদের বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ ছিলনা । কারণ তারা জানতো যে তারা যথেষ্ট পরিমাণ চেষ্টা করেছে ন্যায্যতা পাবার জন্য । তাদের অভিযোগ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কারণ তারা আলাদা হয়ে পড়েছিল । তাদের অভিযোগ ছিল কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানিদের সাথে ন্যায়বিচার করেনি কারন সরকারি প্রায় সব বিভাগে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিযুক্ত ছিল । তারা চাচ্ছিল বিভিন্ন দপ্তর কিছু পরিমান পূর্ব পাকিস্তানিরাও নিয়ন্ত্রন করবে ।

(৮) এটি বর্ণিত আছে যে- ‘একবার যদি মার্শাল ল’ স্থগিত করা হয় তাহলে সারা দেশে দাঙ্গা হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়বে’ । প্রশ্ন হচ্ছে এই অশান্তি অরাজকতা কি খালি পূর্ব পাকিস্তানে থাকবে নাকি পুরো পাকিস্তানেই ছড়িয়ে পড়বে?
পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা ও তাদের সমর্থকেরা, কূটনৈতিক কালো বাজারি, উভয় অংকের বিভিন্ন জিনিসপাতি এবং সমাজতান্ত্রিক দলগুলো বর্তমান শাসনব্যবস্থায় খুব সমস্যায় অতিবাহিত করছে । তারা মার্শাল ল’ এর কারনে চুপ রয়েছে । মার্শাল ল’ উঠিয়ে নিলে তারা ব্যাপকহারে অরাজকতা শুরু করবে । আর বেশিরভাগ সংবাদপত্র গুলোই এদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । তাই এই ক্ষোভ এবং বিদ্রোহ পূর্ব পাকিস্তানের মাঝেই আবদ্ধিত থাকার কথা । এটা একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটা সমাধানে ত্যাগ স্বীকার করা ছাড়া কোন উপায় নাই । এটি খুবই জরুরী বিষয় ।

(৯) পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ পদমর্যাদার অফিসারদের কিছু সময়ের জন্য নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে । বেশকয়েকবার এই আশ্রয় প্রদান করা হয়েছে এবং অবাঞ্ছিতদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এই কাজের জন্য কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি । যখন পূর্ব পাকিস্তানের অফিসারদের ও সাধারন মানুষের আনুগত্যের উপর অভিযোগ তোলা হল, তখন তারা খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে । দুর্ভাগ্যবশত তারা জানতো কেন্দ্রীয় সরকারের কারণেই এমনটা হচ্ছে । যেহেতু তারা তাদের কর্মক্ষেত্রকে মুল্য দিত তাই তাদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোন কারণ ছিলনা । তাই তাদেরকে পিছু হটতে হয়েছিল । তারা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাত না এবং কোন পদক্ষেপ নিতে ভয় পেত । একজন সরকারি কর্মচারীর মুল্য খুবই কম যদিনা সে নির্ভয়ে কাজ করতে পারে এবং তার কর্মক্ষেত্রের প্রতি আন্তরিকটা দেখাতে পারে । এই অবিবেচিত সন্দেহের কারনে জাতি ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ।

<2.010.047>

যত দ্রুত এই সন্দেহ দূর করা যায় তা এই জাতির জন্য ততই মঙ্গলজনক ।

(১০) শেষ বিষয়টি হচ্ছে – জনসাধারণের উন্নয়ন বাদ দিয়ে নতুন মধ্যবিত্তদের দেখাশোনা করা এবং এই মধ্যবিত্তদের ভরন – পোষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল । পণ্যের উচ্চমূল্যের জন্য নিম্ন আয়ের মানুষদের খুবই সমস্যার মুখমুখি হতে হয়েছে । জনসাধারণের উন্নয়নের জন্য পরিপূর্ণ মনোযোগ দেয়া হয়নি তবে এই উচ্চমূল্যের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল । কিন্তু এই প্রস্তাবটি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সাথে মিলে যায় । যে ইসলামিক শাসনতন্ত্রের প্রতি আমাদের আনুগত্য ছিল, তার বিপক্ষে চলে যায় । যদি তা বাস্তবায়ন করা হয় তা সরকারের জন্য খুবই সমস্যার সৃষ্টি করবে । যেকোনো ক্ষেত্রেই এটি কপটচারিতা হবে যখন তারা জনগনের নামে, গণতান্ত্রিক ও ইসলামি শাসনতন্ত্রে দেশ পরিচালনা করতে চাইবে এবং তার সাথে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করবে কেবল এই জন্য কারণ তাদের সরকারের ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই। 

 

Scroll to Top