<৯, ১৬.৫, ৪৭৪-৪৭৮>
হেমায়েত বাহিনী
(ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘গণমন’ (ডিসেম্বর, ১৯৭৭)- প্রকাশিত ‘হেমায়েতউদ্দিন বীর বিক্রম’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত। হেমায়েতউদ্দিন লিখিত যুদ্ধকালীন ডায়রী এবং সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন এমএ সামাদ)
যে গোপালগঞ্জের এক মহান সন্তানের ভাবমূর্তী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দান করেছে তারই আরেক সন্তান হেমায়েতউদ্দিন গোপালগঞ্জ এলাকায় স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে এ সম্পর্কেই আলোচনার প্রয়াস পাবো।
হেমায়েতউদ্দিন ছিলেন দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টর একজন হাবিলদার। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের কালো রাত্রে হানাদার বাহিনী যখন ঢাকায় আক্রমণকারীর ভূমিকা গ্রহণ করে তখন তিনি জয়দেবপুর ছাউনিতে ছিলেন। এখানে অবস্থানরত ২য় ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট তখনো সরকারী নিয়ন্ত্রণে ছিলো। ২৭ মার্চ সর্বপ্রথম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি) কণ্ঠস্বর ঘোষিত হলো, “আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।” এই ঘোষণা শ্রুত হবার কিছুক্ষণ আগে বা পরে মেজর কে এম শফিউল্লাহ মর্টার প্লাটুন ও একটি কোম্পানী নিয়ে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়লেল। তিনি মেজর মইনুল হোসেনকে একটি গোপন নির্দেশ দিয়ে গেলেন। যার ফলে অল্পক্ষণের মধ্যেই ছাউনির মধ্যস্থ সমস্ত বাঙালি পরিবারকে গ্রামের দিকে পাঠিয়ে দেয়া শুরু হলো। হাবিলদার হেমায়েতউদ্দিন ও আব্দুল আজিজকে ৩৮ জন জোয়ান দিয়ে দক্ষিণের রথখোলার পেট্রোল ডিউটিতে পাঠানো হলো। তারা ডিউটিতে যাবার সময় অন্য কোনো নির্দেশ পাননি। শুধু পরস্পর জানতে পেরেছিলেন যে, গভীর রাতে কয়েকটি গুলির আওয়াজ হলে সবাইকে রানীর ঘাটে একত্র হতে হবে।
হঠাৎ রাত এগারোটায় গোলাগুলি শুরু হলো। অনর্গল গুলি হওয়ার ফলে এটাকে বাইরের আক্রমণ বলে সন্দেহ করলো। হেমায়েত এবং আবদুল আজিজের মধ্যেও মতভেদ দেখা দিলো। ফলে এই দলও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। হেমায়েতউদ্দিন জোয়ান আইয়ুব ও আলমকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঢুকে পড়লেন। তারা ভোর পাঁচটার দিকে বুকে হেটে (ক্রলিং করে) শিবিরের দিকে অগ্রসর হন। তারা লক্ষ্য করলেন যে, অভ্যন্তরে বাঙালি কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বরং কয়েকজন পাঞ্জাবী জোয়ান বাইরের সাহায্যের প্রতিক্ষায় তখনও পূর্বদিকের গেট পাহারা দিচ্ছে। সুযোগ বুঝে এরা তিনজন বালিকা বিদ্যালয়ের গা ঘেষে অগ্রসর হন এবং পাহারারত এই পাঁচজন পাঞ্জাবী সৈনিকের ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের খতম করে দেন। অতঃপর ভিতরে প্রবেশ করে তারা আরো আট জন সৈন্যকে হত্যা করেন এবং আহতদের বেয়নেট দিয়ে শেষ করেন। দক্ষিণ পাশে অফিস সংলগ্ন অয়ারলেস সেন্টারের অপারেটরদের মধ্যে জীবিত দুইজনকে তারা এসএমজির ব্রাশফায়ারে খতম করে ফেলেন। এই নিধনযজ্ঞ সমাপ্ত করে তারা আবার ছাউনিতে ফিরে এসে চতুর্দিক থেকে বাইরের লোক আহবান করেন। বাঙালি কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে চারদিক থেকে লোকজন এসে পড়লো। এদের মধ্যে ইপিআই, ডিসির শ্রমিক নেতা আবদুল মোতালেব ও প্রচুর ছাত্র ও শ্রমিক ছিলো। অল্পক্ষণের মধ্যই শুরু হলো হেমায়েতের নেতৃত্বর অস্ত্র অপসারণ।
এখান থেকে হেমায়েতউদ্দিন শতাধিক অস্ত্র, প্রচুর গোলাবারুদ, ৩টি গাড়ী এবং কয়েকজন জোয়ান নিয়ে পূর্বদিকে মাত্র হাইস্কুলে চলে যান। অবশ্য দুদিনের মধ্যেই ২০ জন ছাড়া বাকী সকলেই অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। অবস্থা দেখে ৩০শে মার্চ তিনি ২০ জন জোয়ানসহ কাপাসিয়া থানার দিকে অগ্রসর হন। সেখানে পৌঁছে তিনি জানতে পারলেন ২৭শে মার্চ রাত্রে জয়দেবপুর থেকে মেজর কেএম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বেরিয়ে আসা বাহিনী এখান দিয়ে চলে গেছে। ইতিমধ্যেই পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ জোরদার হবার ফলে কাপাসিয়া অবস্থান নিরাপদ নয় দেখে হেমায়েতউদ্দিন তার লোকজন নিয়ে একটা বিশেষ লঞ্চে বর্মী গমন করেন। যেখান থেকে পায়ে হেটে ঢাকা-ময়মনসিংহ সীমান্ত বরাবর ‘কাওরাইদ’ নামক স্থানে পৌঁছেন। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আবুল বাশার ও নায়েব সুবেদার মীর মোশারফ হোসেনর নেতৃত্বে এখানে একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে উঠেছিলো। হেমায়েত তার ২০ জন সঙ্গীসহ এখানে তাদের সাথে যোগদান করেন। এই ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর লোকের চেয়ে আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোক বেশী থাকার ফলে তাদের কার্যকলাপে ‘কাওরাইদ’ ক্যাম্পে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং নিয়মিত বাহিনীর জোয়ানদের মন বিগড়ে যায়।
ফলে ৯ এপ্রিল ফরিদপুর ও বরিশালের মাত্র ১১ জন সঙ্গী নিয়ে হেমায়েত ফরিদপুর রওয়ানা হন। তার সাথে কাপাসিয়ার ইব্রাহিম নামক একটি যুবকও ছিলো। এদের প্রত্যেকের সাথে ছিলো ১টি করে চাইনিজ রাইফেল ও ৮০০ রাউণ্ড গুলি। এছাড়া ২টি হালকা মেশিনগান, ৪টি চাইনিজ এসএমজি ও ৪০০০ গোলা বারুদও তাদের সাথে ছিলো। গ্রাম থেকে লোক ধরে এনে তাদের দিয়ে বোঝা টানিয়ে এবং পথ দেখিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছিলেন। গজারী বন পার হয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে পাকবাহিনীর একটি ইউনিটকে তারা আক্রমণ করেন। এই সংঘর্ষে হেমায়েত বাহিনীর ৪ জন শহীদ হয়ে যান। কিন্তু তারা পাক বাহিনীর ৫ খানা জীপসহ বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন।
এভাবে কয়েকটি অপারেশন চালিয়ে অবশেষে ১৭ এপ্রিল অপরাহ্ন ২টায় এক জেলে নৌকায় পদ্মা পাড়ি দিয়ে হেমায়েত ও তার সঙ্গীরা নারারটেক চরে অবতরণ করেন। তারা ফরিদপুরে পৌঁছে খন্দকার ওবায়দুর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার সাথে জেলা বোর্ডের কমলাপুরস্থ ডাকবাংলায় দেখা করেন এবং জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করে পুলিশ বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হাতে পাবার দাবী করতে থাকেন।
ইতিমধ্যে ২১ এপ্রিল প্রত্যুষে পাকবাহিনী গোয়ালন্দে পৌঁছে যায় এবং ফরিদপুর শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের প্রতিহত করার কাজে সংশ্লিষ্ট কারো সহযোগীতা না পাওয়ায় সঙ্গীদের নিয়ে তিনি ভাঙ্গা উপস্থিত হন। সেখানে কিছু প্রশিক্ষণহীন যুবক প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু তাদের মধ্যে দলাদলি দেখে হেমায়েতউদ্দিন নৌকাযোগে টেকেরহাট হয়ে ‘বাঘিয়ার বিল’ অতিক্রম করে ২৬ এপ্রিল ‘ফান্দি’ নিজ গ্রামে উপস্থিত হন। তার গ্রামের নিরীহ জনসাধারণ ও আত্মীয়স্বজন ইতিমধ্যেই পাক বাহিনীর অত্যাচারের কথা শুনে এবং দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। হেমায়েত বাড়িতে যেতেই নিরীহ গ্রমাবাসী তাকে এ বিদ্রোহের পথ পরিত্যাগ করতে অনুরোধ করে, আর দালাল দুর্বৃত্তরা ভয় দেখাতে থাকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হেমায়েতের স্ত্রী হাজেরা ৭ মে এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। চান মিয়া নামক একজন মাতবর শ্রেণীর লোক এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে দল পাকাতে শুরু করলে ৯ মে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অতঃপর হেমায়েত বাড়ি থেকে লোকজনসহ পার্শ্ববর্তী ‘পিঠা বাড়ী’ গ্রামে চলে যান। অবশ্য তিনি তার সাথীদের আগেই বিদায় করে দিয়েছিলেন। ইব্রাহীম এবং সোলায়মান ছাড়া আর কেউ তার সাথে ছিলো না।
৯ই মে চাঁন মিয়ার হত্যার দিনই কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থানা থেকে পুলিশ ও পাকবাহিনী এসে হেমায়েতের বাড়ি পুড়িয়ে তার শেষ আকর্ষণ নিশ্চিন্ন করে দেয়। এরপর হেমায়েত বেপরোয়া হয়ে উঠেন এবং সত্যিকারভাবে নতুন করে সংগ্রামের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন।
কয়েকদিন পর ১৪ই মে ভোরবেলা হেমায়েত তার সঙ্গী ইব্রাহীম ও সোলায়মানকে নিয়ে কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করে বসেন। তাদের আধুনিক অস্ত্রের মার এবং বেপরোয়া বীরত্বের কাছে মুহুর্তেই ৫৪ জন পুলিশ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। অভ্যন্তরীণভাবে শক্তি সঞ্চয় করে এ ধরনের সাফল্য গ্রাম বাংলায় এটাই প্রথম! এতে স্থানীয় জনসাধারণ বিপুলভাবে উৎসাহিত হলো। হেমায়েত থানা থেকে পাঁচ মণ চাউল ও অন্যান্য রসদ নিয়ে বাঘিয়ার বিলের কলাবাড়ী গ্রামের চিত্ত গয়ানের বাড়ীতে চলে যান। পরে পীরের বাড়ীর আওয়ামী লীগ কর্মী লক্ষীকান্ত বলের অনুরোধে হেমায়েত তার গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এ সময় গৌরণদী অঞ্চলের ১২ জন জোয়ান ও কিছু ছাত্র হেমায়েতের সাথে যোগ দেয়।
পাকবাহিনীর লোকেরা নদীপথে খোঁজাখুঁজি করলেও বিলের অভ্যন্তরে মোটেও প্রবেশ করতো না। তবে এখানে দল সংগঠিত করতে তেমন সুবিধা না হওয়ায় হেমায়েত গৌরণদী চলে যান এবং ২৯ মে বরিশাল গৌরনদী থানার ‘বাটরা বাজারে’ আনুষ্ঠানিকভাবে হেমায়েত বাহিনী উদ্বোধন করেন। এর আগে ২৬ মে এক সফল আক্রমণে এই বাটরা বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
শীঘ্রই বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এই বাহিনীতে যোগ দিতে আরম্ভ করে। স্থান সংকুলানে অসুবিধা হওয়ায় পশ্চিম দিকে পয়সার হাটের উত্তরে রাজাপুর নামক গ্রামে তিনি সদর দফতর স্থাপন করেন।
১লা জুন বরিশাল ও ফরিদপুরের এই অঞ্চলে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। দেশের এই এই অঞ্চলই সর্বপ্রথম মুক্ত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুজিবনগর বেতার কেন্দ্র থেকেও এ কথা প্রচার করা হয়।
৩রা জুন পাকবাহিনীর এক বিরাট দল কোটালীপাড়া থানায় উপস্থিত হয় এবং রাত্রে নৌকাযোগে কোটালীপাড়া ও পয়সার হাটের খাল বেয়ে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করতে এগিয়ে যায়। এই দলে ১২ খানা নৌকায় পুলিশ, লাঠিয়াল ও পাকবাহিনীর প্রায় ৩০০ লোক ছিলো। রাত দুটায় হেমায়েত তার বাহিনী নিয়ে অগ্রবর্তী ‘হন্যহাটি’ নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে খালের দুপাড় থেকে এদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। পথে এই আক্রমণের জন্য পাকবাহিনী প্রস্তুত ছিলো না। তাই এই অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তবে হেমায়েত বাহিনীর ইব্রাহীম শাহাদাৎ বরণ করেন। এই আক্রমণের ফলে ২৪ জন পুলিশ ও লাঠিয়াল ধরা পড়ে।
এই নাজেহাল অবস্থায় প্রতিশোধ নেবার জন্য ৭ জুন পুনরায় ৩ খানা ‘স্টীল বডি’ লঞ্চ নিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে পাকবাহিনী রাজাপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। হেমায়েত কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে লঞ্চগুলোকে পিছন দিক দিয়ে আক্রমণ করেন। অপর দিকে ঘাঁটির বাঙ্কার থেকে সামনের দিক দিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। উপায়ন্তর না দেখে লঞ্চগুলো পালাতে শুরু করে এবং শাতলা গ্রামের বাঁক ঘুরে কোন রকমে পালিয়ে রক্ষা পায়। এই দৃশ্যে জনসাধারণ বিপুলভাবে আনন্দিত হয়। তারা হেমায়েত বাহিনীর এই দলটিকে কাঁধে তুলে পয়সার হাটে নিয়ে আসে। সেখানে তড়িঘড়ি করে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়ে যায় এবং হেমায়েতকে জনসাধারণ ‘মেজর’ খেতাবে ভূষিত করে। এই যুদ্ধের ফলে প্রায় ২০ মাইল এলাকা মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। এই সময় শাতলা গ্রামের নদীর বাঁকে একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও স্থাপন করা হয়।
এরপর রাজাপুর থেকে সরে গিয়ে জহরের কান্দি হাইস্কুলে ঘাঁটি স্থাপন করে সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। দলে দলে যুবক ছাত্র জনতা এসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে লাগলো। পক্ষান্তরে এ সময় ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারাও কিছু কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে দলে ভিড়তে লাগলো। অতঃপর কালকিনি থানার চলবল গ্রামে অপারেশন ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ১১ জুলাই টুঙ্গীপাড়া শেখ বাড়িতে দেড়শ পাঞ্জাবী সৈন্যের বিরুদ্ধে এক সফল আক্রমণ পরিচালনা করা হয়।
১৪ই জুলাই পাকবাহিনী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও টেকেরহাট, এই তিন দিক থেকে আবার চলবলের ঘাঁটির উপর হামলা চালায় এবং ক্যাম্পের কাছে রামশীল নামক গ্রামে ঢুকে পড়ে। হেমায়েতের সাথে তখন মাত্র ১৩ জন সঙ্গী ছিলো। এদের নিয়েই তিনি অগ্রসর হন এবং এই হামলা প্রতিহত করার প্রয়াস পান।
রামশীল গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি খাল গৌরণদী থানার বাসাইল গ্রামের দিকে চলে গেছে। গৌরণদী থেকে ঐ খাল বেঁয়ে হানাদার বাহিনী আসতে পারে ভেবে পূর্ব দিকে মুখ করে ৩ জন, দক্ষিণ দিকে মুখ দিয়ে ৩ জন এবং সংকেত দেবার জন্য বাইরে একজন বসানো হলো। অতঃপর হেমায়েত বাকী ৬ জনকে পশ্চিমমুখী হয়ে বসালেন। কোটালীপাড়া বান্দাবাড়ী খালের মধ্য দিয়ে হানাদার বাহিনী অগ্রসর হতে পারে মনে করেই তিনি এ জায়গায় অবস্থান নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এদিক থেকেই হানাদারদের অগ্রগামী বাহিনী দেখা গেলো। তারা কাছাকাছি আসতেই হেমায়েত মেশিনগানের গুলি চালালেন। তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলো। হঠাৎ শত্রুপক্ষের একটা বুলেট তার সহকর্মী মকবুলের মাথার খুলি ভেদ করে চলে গেলে সে তৎক্ষণাৎ মারা যায়। মকবুলের লাশ টানতে যেতেই একটা শেলের টুকরা হেমায়েতের গালের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে গেলো। এতে জিহ্বার খানিকটা কেটে গেলো এবং কয়েকটা দাতও পড়ে গেলো। তবুও তিনি কর্তব্যচ্যুত হলেন না। বরং অসীম সাহস আর প্রবল প্রতাপের সাথে পাল্টা আক্রমণ রচনা করে চললেন। এভাবে দীর্ঘ সময় তুমুল সংঘর্ষের পর হানাদার বাহিনী পিছু হটতে শুরু করলো। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর প্রচুর হতাহত হয়। যুদ্ধের পর হেমায়েত বুঝতে পারলেন যে আঘাত খুবই সাংঘাতিক, ফলে তাকে দীর্ঘদিন রাজ্যেশ্ব ডাক্তারের চিকিৎসায় থাকতে হয়।
একস্থানে বেশীদিন ঘাঁটি রাখা ঠিক হবে না কারণ পাকবাহিনী খোঁজ পেলেই সেখানে আক্রমণের আশংকা দেখা দেয়। তাই রামশীলের যুদ্ধের পর আর চলবল ঘাঁটি রাখা মোটেই নিরাপদ নয়। তাছাড়া যে কোনো সময় বিমান আক্রমণও অসম্ভব কিছু না। তাই ঘাঁটি সরিয়ে গোপালগঞ্জের পূর্ব সীমান্তে বিলের উত্তর প্রান্তে ‘রুথিয়ার পাড়ে’ একটি পরিত্যক্ত বাড়ীতে ছাউনি ফেলা হলো। এ বাড়ীর প্রায় সকলেই ভারত চলে গিয়েছিলো। পাঁচখানা দোতলা ঘর নিয়ে বেশ বড় বাড়ী। এখানেই জুলাই মাসের শেষ দিকে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’র একজন সাংবাদিক হেমায়েতের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ৪ঠা আগষ্ট সংখ্যায় হেমায়েতের ছবিসহ প্রকাশিত হয়।
ওদিকে কোটালীপাড়া থানায় পুনরায় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যশস্য মজুদ করার খবর পাবার পর ১৫ সেপ্টেম্বর তারা আবার কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করেন। ১৪ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর থানা দখলে আসে। প্রচুর খাদ্যশস্য ও গোলাবারুদ হস্তগত হলো। অতঃপর হেমায়েত বাহিনী ৩ ডিসেম্বর শেষবারের মতো কোটালীপাড়া থানা দখল করেন।
কোটালীপাড়ায় আরো তিন জায়গায় পাকবাহিনীর ঘাঁটি ছিলো। ঘাগোর গুদাম ঘর, কুরপালামূ কম্যূনিটি সেন্টার এবং গোপালগঞ্জ মাদ্রাসায়। ডিসেম্বর মাসের শুরুতেই চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে এইসব ঘাঁটি নাস্তানাবুদ করে দেয়া হয়। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধের ফলে চুড়ান্তভাবে এই থানা মুক্ত হয়ে গেলো। এই যুদ্ধে জেলা অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নুর মোহাম্মদ বাবুলও তার সাথে ছিলেন।
হেমায়েত বাহিনীর কর্মক্ষেত্র ছিলো বরিশালের উজিরপুর গৌরণদী থানা, ফরিদপুরের কালকিনি, মাদারীপুর, রাজৈর, গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া। মকসুদপুর, কাশিয়ানী এবং খুলনার মোল্লারহাট থানার অংশবিশেষও তার কর্মক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীনভাবে গড়ে উঠেছিলো এই হেমায়েত বাহিনী। তার দলে মুক্তিযোদ্ধা ছিলো ৫০৫৪ জন। তাদের মধ্যে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীর লোক ছিলো ৩৪০ জন। এদের সাহায্যে তিন কোটালীপাড়া থানার জহরের কান্দি হাইস্কুলে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন এবং তিন মাসে প্রায় চার হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ দান করা হয়। এদের মধ্যে দেড় হাজার গরীব শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ৯৫.০০ টাকা হিসাবে বেতনও দেয়া হতো। কোটালীপাড়া, নারকেলবাড়ীর চার্চমিশনে একটি সংক্ষিপ্ত নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও খোলা হয়েছিলো। সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি হাসপাতালও পরিচালনা করা হতো।
আগেই বলা হয়েছে হেমায়েত বাহিনী ছিলো সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীনভাবে গড়ে ওঠা একটি সংগঠন। এদের অস্ত্রশস্ত্রের বেশীরভাগই ছিলো পাকবাহিনীর কাছ থেকে কেঁড়ে নেওয়া। তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আঠারটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। এই বিরাট সাফল্য মূলতঃ হেমায়েতউদ্দিনের নিষ্ঠা এবং তার সঙ্গীদের দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা ও আনুগত্যের ফলেই সম্ভব হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এমন একক প্রচেষ্টায় অভ্যন্তরীনভাবে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের নজীর বিরল। বাংলাদেশের সরকার এই বীর যোদ্ধার কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি সরূপ তাকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করেন।