<৯, ১৩.৪, ৩৫৫-৩৫৬>
মুক্তিপাগল এক সরকারী অফিসার
(দৈনিক বাংলা, ১৫ জানুয়ারী, ১৯৭২-এ মনজুর আহমদ প্রদত্ত প্রতিবেদন)
তিনি শুধু একজন মহকুমা প্রশাসক বা সিএসপি অফিসারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অগ্রসেনা, এক নির্ভীক যোদ্ধা। মুক্তি সংগ্রাম শুরুর সেই প্রথম ক্ষণেই সিরাজগঞ্জে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিপাগল এই বীর সেনানী। শুধু সিরাজগঞ্জেই নয়, সারা উত্তরবঙ্গই উত্তাল হয়ে উঠেছিল তার সেই বলিষ্ঠ সংগ্রামী ভূমিকায়। সবাই তাকে ভূষিত করেছিল কর্নেল উপাধিতে। সবাই তাকে ডাকতো কর্নেল শামসুদ্দিন নামে। নাম ছিল তার এ, কে, শামসুদ্দিন।
শামসুদ্দিন তখন ছিলেন সিরাজগঞ্জের এসডিও। গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবার মিথ্যা প্রলোভনে এদেশের মানুষকে মাসের পর মাস সন্দিগদ রেখে সেই পঁচিশে মার্চের যে ভয়াল রাতে পাকিস্তানী হানাদাররা তাদের হিংস্র বিষাক্ত থাবা মেলে ঝাপিয়ে পড়েছিল গ্রামবাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ওপর, সেই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দিনে এদেশের অসহায় মানুষের পক্ষে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম যারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন জনাব শামসুদ্দিন তাদের অন্যতম।
শুধু রুখে দাঁড়িয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি রীতিমত গড়ে তুলেছিলেন এক বিরাট সংগঠন। সামান্য মাত্র অস্ত্র সম্বল করে তিনি ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সম্মুখযুদ্ধে। বাংকারে বাংকারে নিপুন যোদ্ধার মত অস্ত্র হাতে নিয়ে চালিয়েছিলেন লড়াই, শত্রুর সাথে মোকাবিলায় দেখিয়েছেন চমৎকার নৈপুণ্য, দেখিয়েছেন পারদর্শিতা।
বাঘাবাড়ীর প্রতিরোধঃ শত্রুবাহিনীর অগ্রাভিযানের বিরুদ্ধে বাঘাবাড়ীতে যে প্রচণ্ড প্রতিরোধ তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। হানাদাররা ৯ই এপ্রিল নদী পার হয়ে চারদিকে যখন হত্যা ও ধ্বংসের হাহাকার তোলে এগিয়ে চলছিল উত্তরবঙ্গের শহর-বন্দরের দিকে তখন এই বাঘাবড়ীতেই তাদেরকে বাধা দেন জনাব শামসুদ্দিন তার সামান্য সামর্থ্য, সামান্য শক্তি নিয়ে। একদিন দুইদিন এভাবে একটানা পাঁচদিন তিনি এই প্রতিরোধ এড়াবার জন্য হানাদার বাহিনী গতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল।
সোজা পথে সিরাজগঞ্জে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে তারা শুরু করেছিল বোমাবর্ষণ। ২৬শে এপ্রিল সিরাজগঞ্জবাসীদের ওপর নেমে আসে হানাদারদের এই বর্বর অভিশাপ। আর এই বিমান হামলারই আবরণে সুযোগ বুঝে ২৭শে এপ্রিল তারা ঢুকে পড়ে শহরে।
জনাব শামসুদ্দিন এই সময়ে চলে যান চর এলাকায়। চর এলাকার অধিবাসীদের নিয়েই তিনি চেষ্টা করতে থাকেন একটি সশস্ত্র দল গঠনের। চেষ্ঠা করতে থাকেন অস্ত্র সংগ্রহের। এই অস্ত্র সংগ্রহের জন্যই তিনি ঘুরতে থাকেন এখানে-ওখানে। তিনি যান টাঙ্গাইলে। যোগাযোগ স্থাপন করেন সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।
আর এই ঘোরাঘুরিই তার কাল হল। সর্বনাশা মৃত্যু যেন দুই ব্যাগ্র হাত মেলে বসেছিল তাকে ছিনিয়ে নিবার জন্য। আর সেই কঠিন মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দেবার জন্যেই বুঝি তিনি ঢাকায় এসেছিলেন মে মাসের গোড়ার দিকে। এসেছিলেন তিনি গোপনে। এসেছিলেন কর্তব্যের ডাকে। এ কর্তব্য ছিল তার পরিবারের।
কিন্তু তিনি গোপনে এলেও গোপন তিনি থাকতে পারেননি। ১৭মে তিনি ধরা পড়ে যান খানসেনাদের হাতে। তার পরের ইতিহাস বর্বর খানসেনাদের নারকীয় নির্যাতনের ইতিহাস। তার পরের ইতিহাস ক্যান্টনমেন্টের একটি ছোট্ট সেলে অমানুষিক নির্যাতনে তার মৃত্যুবরণের ইতিহাস। বাঘাবাড়ী-সিরাজগঞ্জে যিনি ছিলেন খানসেনাদের ত্রাস সেই প্রতিভাধর তরুণ বাঙালি অফিসারকে হাতের মুঠোয় পেয়ে বুঝি উল্লাসে নেচে উঠেছিল হানাদারদের চোখ।
অত্যাচার-নির্যাতনে অর্ধমৃত জনাব শামসুদ্দিনের ওপর শেষবারের মতই তাদের আক্রোশ মিটিয়ে নেবার জন্যেই বোধ হয় ২৯শে মে বিকেলে সেলের ভেতরে তার ওপর লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল মেজর সরফরাজের জল্লাদ দল- ক্র্যাক পার্টিকে। নিষ্ঠুর এক পৈশাচিকতা নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জনাব শামসুদ্দিনের ওপর। মৃত্যুপথযাত্রী এই অসহায় মানবসন্তানের ওপর তারা তাদের আক্রোশ মিটিয়েছিল সর্বশক্তি দিয়ে।
এ অত্যাচার আর তিনি সইতে পারেননি। মৃত্যুর প্রান্তে পৌছে সেলের মধ্যে তাঁরই সাথে আটক সিলেটের এক ভদ্রলোকের কোলে মাথা রেখে তিনি খেতে চেয়েছিলেন এক ফোঁটা পানি।