শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৬। চূড়ান্ত পর্যায়ে সঙ্ঘঠিত যুদ্ধের বিবরণ | …………… | ১৯৭১ |
<১০, ২৬, ৫২৯-৫৩৭>
চূড়ান্ত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী
(প্রতিবেদনঃ মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম)
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রতিটি সেক্টর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, ক্ষিপ্রতা অবশ্যম্ভাবী বিজয় দেখে পাকিস্তানী বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। সীমান্ত অঞ্চলে বিরাট এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। সারাদেশে গেরিলা তৎপরতা এত বৃদ্ধি পায় যে পাকসেনারা আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং তাদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে।
পরিস্থিতি ক্রমশঃ পাকিস্তানী ও ভারতের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। সৃষ্টি হয়। ভারত বৃহৎ শক্তিবর্গকে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বারবার অনুরোধ জানানোর জন্য কোনো ফলপ্রসূ সমাধানে পৌছানো সম্ভব হয়নি। বিবিসির সাথে ২ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, “পূর্ব পাকিস্তানী ও ভারতের সীমান্ত বরাবর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলে ট্যাঁ ভয়াবহ যুদ্ধে পরিনত হতে পারে।” আমেরিকান টেলিভিশন সংস্থার সাথে এর সাক্ষাৎকারে ১১ আগস্টিয়াহিয়া খান বলেন, “দুটো দেশই এখন যুদ্ধের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। আমি হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য আমরা যুদ্ধ করবো।”
ইয়াহিয়া খান প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘লা ফিগারো’ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ১ সেপ্টেম্বর বলেন, “আমি এই মর্মে সমগ্র বিশ্বকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, তারা যদি মনে করে বিনা যুদ্ধে তারা এক বিন্দু জমি দখল করতে পারবে, তবে তারা মারাত্মক ভুল করছে। এর অর্থই হবে সররাত্মক যুদ্ধ।” পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ, এ, কে নিয়াজী ৭ই অক্টোবার পকিস্তান টাইমস-এ প্রকাশিত এক ঘোষ্ণায় বলেন, “যদি ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ চায়, তাহলে সে যুদ্ধ হবে ভারতের ঘাঁটিতে।”
পাকিস্তানী সমরনায়কদের এসব বল্গাহীন বক্তব্যে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠছিলো যে ভারত ও পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এমন একটা একটি সর্বাত্মক পাকিস্তান চীন ও আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপ আশা করছিলো। অবশেষে ইয়াহিয়া ২৫ নভেম্বর আমেরিকান সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করলেন, “আগামী দশদিন পর আমাকে এই রাওাল্পিন্ডিতে বসে থাকতে দেখবেন না। আমি তখন সীমান্তে যুদ্ধ করবো। ইয়াহিয়া খান তার কথা অক্ষরে অপক্ষরে পালন করলেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনী ৩ ডিসেম্বর বিকেল পৌনে ছ’টার সময় অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর ও আগ্রার বিমানবন্দরগুলোতে অঘোষিত বোমাবর্ষণ করে সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করলো।
স্মরণাতীতকালের ইতিহাসে এই প্রথম একটি আক্রমণকারী দল অতিসহজেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। এর কারণ, দেশবাসী আক্রমণকারীদলকে শুধু অভ্যর্থনাই জানায়নি, অত্যাচারী হানাদার বাহিনির পরাজয়ের জন্য তারা আক্রমণকারীদলকে সর্বপ্রকার সাহায্য করেছে।
বাংলাদেশ অসংখ্য নদী-নালার দেশ। আক্রমণকারীকে বিলম্বিত ও প্রতিহত করার জন্য নদী-নালা অত্যন্ত সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করা যায়। কয়েকটি নদী খুবই বিশাল। এই বিশাল নদীগুলো সমগ্র দেশকে কয়েকতি ভৌগলিক এলাকায় বিভক্ত করেছে। রাস্তার উপরে ব্রীজগুলো ভেঙ্গে দিলে আক্রমণকারীকে বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এছাড়া বিরাট এলাকা ক্রমাগতভাবে নিচু ও জলাধারে পূর্ন। এই সমস্ত এলাকায় ভারি অস্ত্রসহ অগ্রসর হওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার।
যুদ্ধ-কৌশল অনুযায়ী পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা ছিলো সবচাইতে বেশী, কারন সমস্ত পাকা রাস্তা উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকেছে এবং বড় বড় নদীগুলো উত্তর থেকে দক্ষিন দিকে প্রবাহিত। তাছাড়া পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধের সম্ভার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেছিলো।
মেঘালয় সীমান্ত থেকে অপেক্ষাকৃত শক্ত মাটির জন্য সৈন্য চলাচল সম্ভব ছিল। কিন্তু গৌহাটি থেকে শিলং পর্যন্ত একটিমাত্র পাকা রাস্তা এবং তারপরই পাহাড়ী এলাকা দিয়ে সীমান্ত আসার পথ। এই এলাকায় বড় ধরনের সামরিক অভিযান সম্ভব ছিল না বলেই সৈন্য সমাবেশ ছিলো সীমিত।
ত্রিপুরা ও শিলচর এলাকায় গোলাবারুদ ও রসদসম্ভার পর্যাপ্ত মজুত করা হয়নি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে ধর্মনগর পর্যন্ত রেললাইন বিস্তৃত। তারপর একটিমাত্র রাস্তা ধরে দক্ষিন দিকে আগরতলা পর্যন্ত আসা যায়। পরিষ্কারভাবে অনুমান করা যায় যে এখানে বড় ধরনের অভিযান সম্ভব ছিলো না। অক্টোবরের শেষের দিকে অবশ্য পাকিস্তানীরা ভারতীয় সৈন্য সমাবেশের কথা জানতে পারে।
যেভাবেই হোক ভারতীয় বাহিনীকে সীমান্ত এলাকায় বাধা দিয়ে বিলম্ব ঘটানোই ছিল নিয়াজীর পরিকল্পনা। সিমান্তে সব ক’টি পাকা রাস্তার উপর শক্ত প্রতিরক্ষাবূহ্য রচনা করে অগ্রসরমান সম্মিলিত বাহিনীকে প্রতিহত করাই ছিলো এর উদ্দেশ্য। ১৪০০ মাইল বিস্তৃত সীমান্ত এলাকায় শক্ত-ঘাঁটি, প্রচুর, গোলাবারুদ, এবং রসদপত্র সরবরাহ নিশ্চিত করে নিয়াজী অনির্দিষ্টকালের জন্য সম্মিলিত বাহিনীকে বলম্বিত করতে চাইলেন।
অন্যদিকে সম্মিলিত বাহিনী এইসব শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলো এড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। প্রথম লক্ষ্য ছিলো ক্ষিপ্রতা ও গতি। বিদ্যুৎ গতিতে খুব কম সময়ের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ সীমান্তের সব দিক দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে পাকসেনাদের ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করা। তৃতীয়তঃ ছড়িয়ে পড়া পাকবাহিনী যেন একত্রিত হয়ে পদ্মা ও মেঘনার মাঝামাঝি এলাকায় সমাবেশ না করতে পারে ট্যাঁ নিশ্চিত করা। চতুর্থতঃ পাকা রাস্তা বাদ দিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা বুহ্যকে এরিয়ে যাওয়া। পঞ্চমতঃ মনস্তাত্বিকভাবে যুদ্ধ চালিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিতে হবে, যাতে তারা যুদ্ধ না করে আত্মসমর্পণ করে।
পাকিস্তানী সমরনায়করা সম্ভবত ভেবেছিলেন ভারত সরকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শুধুমাত্র সীমান্ত এলাকায় কয়েকটি জেলা বা মহাকুমা শহর দখল করেই ক্ষান্ত হবে। সম্ভবত এই কারনেই তারা সীমান্ত এলাকায় শক্ত প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা করেন। পাকিস্তানী জেনারেলরা যুদ্দের গতি ও পরিণতি সম্পর্কে উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। ফলে, ঢাকা রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় বাধা দিতে ব্যর্থ হয় পাকবাহিনী। বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই পলায়নপর পাকসেনারা আত্মসমর্পন করে।
পাকিস্তানীদের সৈন্য সমাবেশ ছিল নিন্মরুপঃ
যশোর এলাকাঃ নবম ডিভিশন জেনারেল আনসারীর নেতৃত্বে যশোর এলাকায় মোতায়েন করা হয়। ১০৭ ব্রিগেড যশোরে এবং ৫৭ ব্রিগেড ঝিনাইদহে অবস্থিত ছিলো। এছাড়া ২টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী ও একটি রেকি এবং সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন ছিলো।
উত্তর বাংলাঃ মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহের নেতৃত্বে ১৬ ডিভিশনকে উত্ত্র বাংলা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৬ ডিভিশনের সদর দফতরে নাটোরে অবস্থিত ছিলো। ২৩ ব্রিগেড রংপুরে এবং ২০৫ ব্রিগেড বগুড়া এলাকায় মোতায়েন করা হয়। একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী, ২টি মর্টার ব্যাটালিয়ন, একটি রেকি ও সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন এবং একতি আর্মড রেজিমেন্ট ছিলো।
পূর্ব এলাকঃ মেজর জেনারেল আবদুল মজিদ কাজীর নেতৃত্বে চতুর্দশ ডিভিশনকে পূর্বাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে মেজর জেনারেল জামসেদের নেতৃত্বে ৩৯ ডিভিশন চাঁদপুরে গড়ে তোলা হয়। অবশ্য এ দু’টি ডিভিশন কোনক্রমেই পাকশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেনি, কারন বিভিন্ন ইউনিট পুনর্বিন্যাস করেই এই ডিভিশন দু’টি গড়ে তোলা হয়। ১১৭ ব্রিগেড কুমিল্লায়, ২৭ ব্রিগেড ময়মনসিংহ ও ২১২ ব্রিগেড সিলেটে মোতায়েন করা হয়। সিলেটে একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী ও দুইটি মর্টার ব্যাটারী ও মাত্র চারটি ট্যাংক ছিলো।
চট্টগ্রাম এলাকাঃ চট্টগ্রামে ৯৩ ইন্ডিপেন্ডেন্ড ব্রিগেদ অবস্থিত ছিলো, যার অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আতাউল্লা।
অপরদিকে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডার অধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার অধীনে ছিলো তিনটি নিয়মিত কোর, একটি কমিউনিকেশন জোন ও প্রায় এক লাখ মুক্তিযোদ্ধা সম্বলিত ১১টি সেক্টর।
দ্বিতীয় কোরঃ কৃষ্ণনগরে ছিলো দ্বিতীয় কোরের সদর দপ্তর। লেঃ জেনারেল টি, এন, রায়না ছিলেন কোর কমান্ডার। এতে ছিলো নবম ও চতুর্থ পার্বত্য ডিভিশন। এছাড়া ছিলো টি-৫৫ (রাশিয়ান) ট্যাংক সমন্বয়ে গঠিত একটি মাঝারি আর্মড রেজিমেন্ট, একটি পি-টি ৭৬ (রাশিয়ান) ট্যাঙ্ক সজ্জিত একটি হাল্কা ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, ১৩০ মিলিমিটার (রাশিয়ান), একতি মাঝারি গোলন্দাজ ইউনিট ও ব্রিজিং ইউনিট।
তেত্রিশ কোরঃ তেত্রিশ কোরের সদর দপ্তর ছিলো শিলিগুড়িতে। লেঃ জেনারেল, এম এল, থাপন ছিলেন এই কোরের কমান্ডার। ৬ পার্বত্য ডিভিশন ও ২টি ব্রিগেড নিয়ে এই কোর গঠিত হয়। এছাড়া পিটি-৭৬ (রাশিয়ান) ট্যাংক সমন্বয়ে একটি হালকা আমার্ড রেজিমেন্ট, একটি মাঝারি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট (বৃটিশ ৫.৫”) ও একটি ইঞ্জিনিয়ার ব্রিজিং ইউনিট ছিলো।
চতুর্থ কোরঃ চতুর্থ কোরের সদর দপ্তর ছিলো আগরতলায়। লেঃ জেনারেল সাগত সিং এই কোরের কমান্ডার ছিলেন। অষ্টম, সাতান্ন ও তেইশ পার্বত্য ডিভিশন নিয়ে এই কোর গঠিত হয়। এছাড়া দুই স্কোয়াড্রন পিতি-৭৬ ট্যাংক ও মাঝারি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট (বৃটিশ ৫.৫”) ছিলো।
১০১ কমিউনিকেশন জোনঃ ১০১ কমিউনিকেশন জোনের সদর দপ্তর ছিলো গৌহাটিতে। মেজর জেনারেল জি, এস, গিল ছিলেন এর কমান্ডার। যুদ্ধে জেনারেল গিল আহত হলে মেজর জেনারেল নাগারা কমান্ডার নিযুক্ত হন। একটি পদাতিক ব্রিগেডের সমান ছিলো এর আকার ও শক্তি। এছাড়া সমস্ত সীমান্ত এলাকা জুড়ে ছিলো মুক্তিবাহিনীর ১১টি সেক্টর।
দ্বিতীয় কোর ফ্রন্টে জেনারেল রায়নার কমান্ডে দুই ডিভিশন সৈন্য মধুমতি নদীর দিকে ধাবিত হয়। পদ্মা থেকে শাখা নদী মধুমতি দক্ষিন দিকে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবন এলাকায় পতিত হয়েছে। এই ফ্রন্টের দায়িত্ব ছিলো পদ্মার পশ্চির তীরবর্তী সমস্ত এলাকা মুক্ত করা। দ্বিতীয় কোর কমান্ডার পাকিস্তানী শক্ত প্রতিরক্ষার উপরে আক্রমণ অব্যাহত রেখে দ্রুতগতিতে একাধিক দলে মধুমতির দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
একটি দল কুষ্টিয়ার দিকে, অন্য একটি মাগুরা হয়ে যশোর বরাবর এবং অপর একটি দল খুলনা ও বরিশালের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। খুলনা-যশোর-কুষ্টিয়া রেলওয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আত নম্বর সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল মনজুরের নেতৃত্বে আগেই মুক্তিবাহিনী চৌগাছা দখল করে। ২৪ নভেম্বর সংঘটিত চৌগাছা যুদ্ধে পাকসেনারা ৪টি শাফি ট্যাংক হারায়। একটি ভারতীয় ব্রিগেড ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে। একইভাবে কুষ্টিয়ার পথে দর্শনা আক্রমণ করা হয়। আট নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বরের তিন তারিখে সিংহঝুলিতে পৌঁছায়। ঝিকরগাছার পতন হয় ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে। তারপর তিনদলে বিভক্ত হয়ে যশোর আক্রমণ করা হয়। উত্তর দিকের দলটি যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক ধরে আক্রমণ অব্যাহত রাখে। মধ্যবর্তী দলটি ধাঙ্কখেতের ভিতর দিয়ে চিতের বিল এলাকা দিয়ে অগ্রসর হয়। দক্ষিন দিকে বেনাপোল-যশোর সড়কে অগ্রসর হয় অপর একটি দল।
ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে কোটচাঁদপুরে যশোর-কুষ্টিয়া রেলওয়ে জংশন দখল করে রেলওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। অগ্রসরমান এই দলটি উত্তরদিকে ধাবিত হয় এবং ৭ ডিসেম্বর আরও ৩০ মাইল অগ্রসর হয়ে ঝিনাইদহ দখল করে। ঝিনাইদহ যুদ্ধে মেজর মুস্তাফিজ আহত হন।
লেঃ জেনারেল নিয়াজী ৫ ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনীকে পেছনে সরে আস্তে নির্দেশ দেন। সম্ভবত ঢাকার পথে পেছনে এসে মেঘনার তীরে সৈন্য সমাবেশ করে ঢাকা রক্ষার পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু ট্যাঁ আর সম্ভব ছিলো না, কারণ যশোর-ঢাকা সড়ক মিত্রবাহিনীর দখলে চলে গেছে। মধুমতি অতিক্রম করে মিত্রবাহিনীর একতি দল খুলনার দিকে এবং অপর একটি দল কুষ্টিয়ার দিকে অভিযান অব্যাহত রাখে। পাকিস্তানী নবম ডিভিশন যশোর সেনানিবাস ছেড়ে মাগুরার দিকে চলে যায়। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হয়। পরবর্তীকালে মেহেরপুর দখলের পর চুয়াডঙ্গা ও কুষ্টিয়ার দিকে যাত্রা অব্যাহত থাকে।
ডিসেম্বরের ১২ তারিখে ফরিদপুরের ভাটিয়াপাড়ার মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকসেনাদের সংঘর্ষ হয়। লেঃ সিদ্দিক ও ক্যাপ্টেন হুদা এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। লেঃ সিদ্দিক ১৪ ডিসেম্বর এই যুদ্ধে একটি চোখ হারান। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রচন্ড রূপ ধারন করে এবং ১৮ ডিসেম্বর ১৫০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পন করে।
মেজর জলিলের নেতৃত্বে নয় নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী বীর বক্রমে অগ্রসর হচ্ছিলো। ৩ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা শত্রুমুক্ত হয়। ১০ ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তিবাহিনী খুলনা দখল করে। ৭ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত হয় এবং পাকসেনারা ক্যাপ্টেন বেগ ও নূরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছে আত্মসমর্পন করে। ১৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হায়াত তার সৈন্যসমন্তসহ আত্মসমর্পণ করে।
৩৩ কোর ফ্রন্টে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন দল পাকিস্তানী শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলোকে আক্রমণ করে এবং মুল আক্রমণ পরিচালিত হয় হিলিতে।
একটি ব্রিগেড জলপাইগুড়ি সীমান্তে এবং অন্য একটি ব্রিগেড কুচবিহার সীমান্তে অবস্থিত পাকঘাঁটি আক্রমণ করে। এক ডিভিশন সৈন্য হিলি আক্রমণ করে। হিলিতে পাকসেনারা প্রচন্ড যুদ্ধ করে।
ডিসেম্বর পাঁচ তারিখে পীরগঞ্জ ও খানপুর দখল হয়। ৭ ডিসেম্বর লালমনিরহাট শত্রুমুক্ত হয়। দুর্গাপুর ৮ ডিসেম্বর দখল হয় এবং ৯ ডিসেম্বর রংপুর ও দিনাজপুর পাকঘাঁটি আক্রমণ করা হয়।
মিত্রবাহিনীর একটি দল হিলিকে এড়িয়ে পলাশবাড়ীর দিকে অগ্রসর হয়।
উইং কমান্ডার এম, কে, বাশারের নেতৃত্বে ছয় নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ৫ ডিসেম্বর ধরলা নদী অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম দখল করে। পাকসেনারা কুড়িগ্রাম থেকে পালিয়ে লালমনিরহাটে চলে যায়। ৬ ডিসেম্বর তিস্তা নদীর তীরে মুক্তিবাহিনী অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর তারিখে ভজনপুর সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুরগাঁও বীরগঞ্জ দখল করে। ১২ ডিসেম্বর রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। পাকসেনারা ১৭/১৮ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে।
সাত নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা নবাবগঞ্জের দিকে অভিযান শুরু করে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে এই অভিযান শুরু হয়। অপর একটি দল লেঃ রফিকের নেতৃত্বে মহানন্দ নদী অতিক্রম করে রোহনপুর-নাচল-আমনুরা বরাবর অগ্রসর হয়ে নবাবগঞ্জ আক্রমণ করে। অপর একটি দল লেঃ রশিদের নেতৃত্বে গোমস্তপুর হয়ে নবাবগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ১৩ ডিসেম্বর বারঘরিয়ার নদী অতিক্রম করে প্রতিটি বাংকার চার্জ করার সময় এই নির্ভীক যোদ্ধা শহীদ হন। এই সেক্টরের তপন ও হামজা সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পদ্মা নদী পার হয়ে রাজশাহী আক্রমণ করে এবং শেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর অপর একটি দল পাবনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। পাকসেনারা রাজশাহী ছেড়ে নাটোরে আশ্রয় নেয়। ১৭ ডিসেম্বর সমবেত পাকসেনারা নাটোরে আত্মসমর্পণ করে।
এদিকে যশোর দখলের পর লেঃ আকতার কালীগঞ্জের দিকে এবং লেঃ অলীক কুমার গুপ্ত ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হয়। মিত্রবাহিনী খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। রুপদিয়া ও নোয়াপাড়া দখলের পর শিরমনিতে যুদ্ধ শুরু হয়। এখানে পাকিস্তানী ১৫ এফ এফ রেজিমেন্ট সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে। পশ্চিমে জলাধার আর পূর্ব্দিকে নদী। পাকসেনারা এখানে প্রবল্ভাবে বাধা দিতে সক্ষম হয়। পাঁচ দিনব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধের পর শিরমনির পতন হয় ১৬ ডিসেম্বর সকালে। মেজর জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রুপসা নদীর তীরে এসে পৌঁছায় এবং খুলনা আক্রমণ করে। ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরার পতন হয়। নবম সেক্টর সৈন্যরা লেঃ হুদার নেতৃত্বে এবং অষ্টম সেক্টর সৈন্যরা ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা দখল করে।
ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহি, ফ্লাইং অফিসার কালাম ও লেঃ নূরুন্নবী কুষ্টিয়ায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মেজর আযম চৌধুরী দুই কোম্পানী নিয়ে ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর দখল করেন ও পরদিন চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত করেন।
ফরিদপুরের দিকে অগ্রসরমান যৌথবাহিনী কামারখালি ঘাটে ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানীদের সাথে সংঘর্ষ আসে। মধুমতি নদীর সকল সম্ভ্যাব্য অতিক্রম স্থানে পাকসেনারা প্রহরারত ছিলো। লেঃ মোস্তফা স্থানীয় জনগনের কাছ থেকে নৌকা সংগ্রহ করে। ১৪ এপ্রিল (ডিসেম্বর হওয়ার কথা) মধুমতি নদী অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের পিছু হটিয়ে দেয়। মিত্রবাহিনী এয়ারব্রিজ অপারেশন করে মধুমতি অতিক্রম করে।
৪ নম্বর সেক্টর এলাকায় ৭ ডিসেম্বর পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে দরবশত ছেড়ে হরিপুরে পলায়ন করে। ১১ ডিসেম্বর পাকবাহিনী নদী পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। এই আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১২ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী হরিপুর আক্রমণ করে এবং ১৩ ডিসেম্বর হরিপুর শত্রুমুক্ত হয়। ডিসেম্বর ১৫ তারিখে পাকিস্তানী ঘাঁটি খাদিমনগরের ডান দিক থেকে মিত্রবাহিনী ও বাম দিক থেকে সেক্টরবাহিনী আক্রমণ করে। সিলেট শ্ত্রুমুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর।
পাঁচ নম্বর সেক্টরে ৩ ডিসেম্বর গোয়াইঘাটে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ৩ ডিসেম্বরই গোয়াইঘাট মুক্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর করিমগঞ্জ থেকে মৌলবীবাজার হয়ে সিলেটের পথে যাত্রা শুরু করে মিত্রবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ মুক্ত হয়। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল শওকত ছাতক আক্রমণ করেন ৭ ডিসেম্বর এবং ঐ দিনই রাত আটটায় ছাতক দখল হয়। মেজর শাফায়াত জামিল সালুটিকর বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ৯ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জ আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী। ১৫ ডিসেম্বর এই বাহিনী বিশ্বনাথ দখল করে। প্রায় তিনশ’ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে ক্যাপ্টেন নবী রাধানগর গোয়াইঘাট আর্টিলারী সাপোর্ট ছাড়াই আক্রমণ করে দখল করেন। এর আগে ভারতীয় গুর্খা রেজিমেন্ট দুইবার আক্রমণ করে বিফল হয়।
চতুর্থ কোর ফ্রন্টে তিন ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনী উত্তরে মেঘালয় সীমান্ত থেকে ত্রিপুরার দক্ষিনে ফেনী পর্যন্ত ২৪০ মাইল বিস্তৃত এলাকায় ধাবিত হয়। এই কোরের দায়িত্ব ছিলো সুরমা নদী থেকে মেঘনার পূর্বতীর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা মুক্ত করা। চট্টগ্রাম যাওয়ার রেল-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মেঘনা পার হয়ে ঢাকার পথে অভিযান করার পরিকল্পনা নেয়া হয়।
পরিকল্পনা মোতাবেক জেনারেল সগত সিং এক ডিভিশন সৈন্য শিলচর-করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের দিকে পাঠান। অন্য একটি ডিভিশন আখাউড়া-আশুগঞ্জ বরাবর পাঠানো হয়। পরিকল্পনা মতো অপর ডিভিশনটি তিন দলে বিভক্ত হয়ে প্রথম দলটি কুমিল্লা আক্রমণ অব্যাহত রাখে এবং অন্য দল দুটির একটি লাকসাম-চাঁদপুর এলাকায় এবং অপরটি ফেনী থেকে দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকে।
মুক্তিবাহিনী করিমগঞ্জ জয় করে মুন্সীনগরের দিকে এগিয়ে চলে। মুন্সীনগরের পতন হয় ৫ ডিসেম্বর। এরপর একটি দল মৌলবীবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। ডিসেম্বর ৮ তারিখে মৌলবীবাজার দখল হয়। অন্য একটি দল সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।
সিলেট আক্রমণ সহজসাধ্য ছিলো না। নদী অতিক্রম অপারেশনের জন্য যথেষ্ট ব্রীজ তৈরির যন্ত্রাদি ছিলো না। রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টারের সাহায্যে এয়ার ব্রিজিং অপারেশন শুরু হয়। পরদিন সকালে এই দলটি সিলেটের উপকন্ঠে আসতে সক্ষম হয়।
চতুর্থ কোরের যে ডিভিশনটি আখাউড়া অভিমুখে যাত্রা শুরু করে-জেনারেল সগত সিং মেঘনা অতিক্রম করে ঢাকার দিকে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিবাহিনীর তিন নম্বর সেক্টর ও ‘এস’ ফোরস তখন আখাউড়ায় পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
আখাউড়া থেকে রেলওয়ে লাইন আশুগঞ্জের দিকে চলে গেছে। চলাচলের কোন রাস্তা ছিলো না। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে ভৈরববাজার প্রায় এক মাইল দীর্ঘ নদী একটি বিরাট বাঁধা হিসেবে দেখা দেয়।
অগ্রবর্তী ব্রিগেড আখাউড়া ঘিরে ফেলে এবং গঙ্গাসাগরের দিকে এগিয়ে চলে। এইসময়ে পাকিস্তানী স্যাবরজেট বিমানগুলো হামলা চালায়। ভারতীয় জঙ্গী বিমান পাল্টা আক্রমণ চালালে পাকিস্তানী বিমানগুলো পালিয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর আখাউড়ার পতন হয়।
ভারতীয় ৩১১ পার্বত্য ব্রিগেড, ৭৩ পার্বত্য ব্রিগেড তখন নরসিংদীতে অবস্থান করছিলো। মিত্রবাহিনী ১২ ডিসেম্বর ডেমরা দখল করে। ‘এস’ ফোরস পদব্রজে বোলতাপুল হয়ে রূপগঞ্জ দিয়ে বালু নামক স্থানে নদী অতিক্রম করে ডেমরা পৌছায় ১৩ ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বর ১০টা পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ‘কে’ ফোরস দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল চট্টগ্রামের দিকে এবং অপর দল চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হয়। দশম ইষ্ট বেঙ্গল মিত্রবাহিনীর ৮৩ ব্রিগেডের সাথে যৌথভাবে ফেনী শহর দখল করে। এই বাহিনীকে নোয়াখালী সদরে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী বাঁধা দেয় কিন্তু তীব্র আক্রমণের মুখে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঐদিনই তারা চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। ফেনী থেকে চট্টগ্রামের দুরত্ব ছিলো মাত্র ৬৫ মাইল। যৌথ বাহিনী ১৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা পৌছায় দুপুর বারোটায়। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের নেতৃত্বে নবম বেঙ্গল এবং ক্যাপ্টেন গাফফারের নতৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল প্রবল পরাক্রমে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
এখানে সবিশেষে উল্লেখযোগ্য যে, ‘এস’ ফোরস কমান্ডার লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আখাউড়ার প্রতিরক্ষার নিয়োজিত রেখে ভৈরবের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘এস’ ফোরস মাধবপুর হয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া সরাইল পৌছায় ডিসেম্বর ৮ তারিখে। আখাউড়ার যুদ্ধে লেঃ বদিউজ্জামান শহীদ হন। পরিকল্পনা হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দক্ষিণ থেকে অগ্রসর হয়ে একটি দল শহরে ঢুকবে, অপর দল উত্তর দিক থেকে সিলেট সড়ক দিয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া পৌছাবে- আর মিত্রবাহিনী আখাউড়া- ব্রাক্ষণবাড়িয়া রেললাইন এবং উজানী সর-ব্রাক্ষণবাড়িয়া সড়ক হয়ে অগ্রসর হবে। ‘এস’ ফোরসের ১১ বেঙ্গলকে চান্দুরার উত্তরে রোড ব্লক করে চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শক্রুমুক্ত করেন। ১১ বেঙ্গল পাইকপাড়ায় এলে মেজর নাসিম শাহবাজপুর, সরাইল এবং ব্রাক্ষনবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে আদেশ দেন। এই সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানীদের একটি গাড়ী তেলিয়াপাড়া থেকে মেজর ভুঁইয়াকে অতিক্রম করে চলে আসে। ‘এস’ ফোরস কমান্ডার নিজেদের গাড়ী মনে করে গাড়ী থামান। গাড়ী থামালে দেখা গেল গাড়ীতে পাকসেনা। পাকিস্তানী সুবেদারের সাথে কর্নেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি শুরু হয়। পাকসেনার গুলিবর্ষণে কর্নেল শফিউল্লার কোমরের পিস্তলটি বিধ্বস্ত হলো কিন্তু অলৈকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। মেজর নাসিমসহ ১১ জন গুরুতরভাবে আহত হন। মেজর মতিন ১১ বেঙ্গলের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ৭ ডিসেম্বর শাহবাজপুর আক্রমণ করে শক্রুমুক্ত করেন। ৮ ডিসেম্বর মেজর ভুঁইয়া ও ‘এস’ ফরসের দলটি সরাইল হয়ে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়।
পাকবাহিনীর ১৪ ডিভিশনের সুদৃঢ় ঘাঁটি নির্মাণ করেছিলো। ১০ ডিসেম্বর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট পাকিস্তানী ব্যূহ ভেদ করে আশুগঞ্জে ঢুকে পড়ে। ‘এস’ ফোরস ও তিন নম্বর সেক্টর সৈন্যরা বিপুল বিক্রমে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১০/১১ ডিসেম্বর পাকসেনারা আশুগঞ্জ ছেড়ে ভৈরব চলে যায় এবং ভৈরব ব্রিজটি ধ্বংস করে। ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় ১৯ পাঞ্জাবকে হেলিকপ্টার যোগে নদীর অপর পাড়ে নামানো হয়। দ্বিতীয় বেঙ্গল ও তিন নম্বর সেক্টর সৈন্যরা পায়ে হেঁটে নরসিংদী অগ্রসর হয়। ১১ বেঙ্গল ভোইরব অবরোধ করে রাখে।
কুমিরাতে পাক ঘাঁটি ছিলো খুবই শক্তিশালী। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম দশম বেঙ্গলের এক কোম্পানী কুমিরায় রেখে পাহাড় পার হয়ে হাটহাজারী যাত্রা করেন। ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী হাটহাজারী পৌছে যায়। চতুর্থ বেঙ্গল চট্টগ্রাম- রাঙামাটি সড়ক দিয়ে হাটহাজারী দিয়ে হাটহাজারীর সন্নিকটে এসে পড়ে। নবম বেঙ্গলও এখানে এসে পৌঁছায়। ১৫ ডিসেম্বর হাটহাজারীতে সন্নিকটে এসে পড়ে। নবম বেঙ্গলও এখানে পৌঁছায়। ১৫ ডিসেম্বর হাটহাজারীতে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী অফিসার মেজর হাদী এক কোম্পানী পাকসেনাসহ আত্মসমর্পণ করে। অপরদিকে পাকসেনারা কুমিল্লা ছেড়ে ফৌজদিরহাটে এসে অবস্থান নেয়। সম্মিলিত বাহিনী ফৌজদিরহাট আক্রমণ করে। ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম অবস্থানরত পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করেন।
এক নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে ছাগলনাইয়া দখল করে। ক্যাপ্টেন মাহফুজ ‘কে’ ফোর্সের সাথে যোগ দিয়ে ফেনী চট্টগ্রাম সড়ক ধরে একটি দল মুহুরি নদী ধরে এবং ওপর দলটি চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
ক্যাপ্টেন মাহফুজ সম্মিলিত বাহিনীর সাথে ৯ ডিসেম্বর যোরারগঞ্জ এসে পৌঁছায়। যোড়ারগঞ্জ যুদ্ধে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের ফলে পিছু হটতে থাকে। শুভপুর ব্রিজটি পলায়নপর পাকবাহিনী ধ্বংস করে দেয়।
সীতাকুণ্ড দখল করার জন্য ক্যাপ্টেন মাহফুল ডান দিক থেকে অগ্রসর হয়। এবং মিত্রবাহিনী সম্মুখভাগে এগিয়ে চলে। যৌথবাহিনী চন্দ্রকান্তের মন্দিরে এসে পৌঁছালে পাকসেনারা আর্টিলারির সাহায্যে প্রবল ভাবে বাঁধা দেয়। ১১ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ডের পতন হয়। ১৪ ডিসেম্বর এই বাহিনী কুমিরায় অবস্থানরত দশম বেঙ্গলের সাথে যোগদান করে।
চতুর্থ কোর ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে দ্রুত গতিতে ঢাকার ভেতরে ঢুকে পড়ে। ওপর একটি দল চট্টগ্রামের দিকে ধাবিত হয়। দ্বিতীয় কোর ও মুক্তিবাহিনী মধুমতী অতিক্রম করে অগ্রসর হতে থাকে। একটি দল মাগুরার দিক ও অন্য দলটি যশোর দখলের পড় খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী ফরিদপুর দখল করে। দৌলতপুরের পতন হয় একই দিনে। পাকসেনাদের কুষ্টিয়া যশোরের দিকে পালানর পথ বন্ধ হয়ে যায়।
উত্তর-পশ্চিম দিকে লালমনিরহাটের পতন হয়। এর আগে জয়মনিরহাট যুদ্ধে লে সামাদ শহিদ হন। ১২ ডিসেম্বর ঘোড়াঘাট দখল হয়। এবং মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বগুড়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। গোবিন্দপুর পরদিন শত্রুমুক্ত হয়। ১৪ ডিসেম্বর বগুড়ার পতন হয়।
১০১ কমিউনিকেশন জোন এলাকায় সম্মিলিত বাহিনী টুরা থেকে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হয়। পাকবাহিনীর একটি ব্রিগেড এই এলাকায় মোতায়েন ছিল। ব্রিগেড সদর দপ্তর ও দুইটি ব্যাটালিয়ন ময়মনসিংহে ও একটি ব্যাটালিয়ন জামালপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়।
ডিসেম্বর ৯ তারিখ সম্মিলিত বাহিনী জামালপুরের নিকতবর্তি অঞ্চলে পৌঁছায়। একটি দল ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করে জামালপুরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পাকবাহিনী ময়মনসিংহ থেকে একটি ব্যাটালিয়ন জামালপুরে স্থানান্তরিত করে।
১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী হালুয়াঘাট ও নালিতাবাড়ি হয়ে ময়মনসিংহের দিকে ধাবিত হয়। ৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শত্রুমুক্ত হয়। জামালপুরের মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকসেনাদের এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ১১ ডিসেম্বর পাকবাহিনী পরাজিত হয়। মেজর জেনারেল গিল গুরুতর ভাবে আহত হলে মেজর জেনারেল নাগরা অধিনায়ক নিযুক্ত হন। পাকসেনাদের একটি দল টাঙ্গাইল চলে যায়। সম্মিলিত বাহিনী টাঙাইলের দিকে অগ্রসর হয়।
১২ ডিসেম্বর টাঙাইলে ছত্রিসেনার একটি ব্যাটালিয়ন অবহরন করে। জামালপুর যুদ্ধে পরাজিত পাকসেনারা টাঙাইলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। পাকিস্তানীদের পালাবার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কারণ ১০১ কমিউনিকেশনের সৈন্যরা টাঙাইলে পৌঁছে যায়। ১৩ ডিসেম্বর পাকবাহিনী টাঙাইলে আত্মসমর্পন করে। পলায়নপর বিপুল সংখ্যক পাকসেনা গ্রামবাসীর হাতে নিহত হয়। সম্মিলিত বাহিনী ঢাকার পথে মির্জাপুরের দিকে যাত্রা করে। ১৪ ই ডিসেম্বর যৌথ দল টঙ্গির কাছা কাছই এসে পরে। এই বাহিনী কালিয়াকৈর হয়ে সাভার এসে পৌঁছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্মিলিত বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে মিরপুর ব্রিজের কাছে এসে পরে। ১১ ই নভেম্বর নাগরা তাঁর এডিসি’র মারফত নিয়াজিকে আত্মসমর্পনের উপদেশ দিয়ে পত্র পাঠালেন।
১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী ১৪ ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ মিরপুর ব্রিজের কাছে এসে ভারতীয় জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার কাছে আত্মসমর্পন করে। মুক্তিবাহিনী লক্ষ লক্ষ মানুষের জয়গান ও উল্লাসের মধ্যে ঢাকা দখল করে।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলে মাত্র ১ এসকোয়াড্রন ১৮ স্যাবর জেট বিমান ছিল। সর্বাত্তক যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে পাকিস্তানীরা বিমানশক্তি সম্পূর্নভাবে হারায়। ভারতীয় বিমান বাহিনী একচ্ছত্র আধিপত্য লাভ করে।
ভারতীয় নৌবাহিনী ফ্লিট এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার ‘ভিক্রান্ত’ বঙ্গোপসাগরে ঢুকে সমুদ্রপথের গতি রোধ করে। ‘ভিক্রান্ত’ থেকে যুদ্ধবিমান গুলো চট্টগ্রাম বন্দর , বিমান বন্দর ও চালনা বন্দর আক্রমণ করে। এই যুদ্দ জাহাজের প্রধান কর্তব্য ছিল সমুদ্রপথে পাকসেনা পালিয়ে যেতে না দেয়া এবং সমুদ্র পথে কোন সাহায্য যাতে না আস্তে পারে তা নিশ্চিত করা।
পাকিস্তান পূর্বাঅঞ্চল নৌবাহিনীর কয়েকটি মাত্র গানবোট সর্বাত্তক যুদ্ধের প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই ধংসপ্রাপ্ত হয়। ১২ অক্টোবর পদ্মা ও পলাশ নামে দুটি গানবোট বাংলাদেশ নৌবাহিনী সংযোজিত করে। ৬ ডিসেম্বর যশোরের পতনের পড় পদ্মা ও পলাশ এবং ভারতীয় গানবোট ‘পানভেল’ হিরণ পয়েন্ট মংলা বন্দর এবং খুলনার খালিস পুরে পাক নৌঘাঁটি পি এন এস ‘তিতুমির’ দখলে জন্য অগ্রসর হয়। ৯ ই ডিসেম্বর কোন বাঁধা ছাড়াই এই গানবোট গুলো হিরণ পয়েন্টে পৌঁছায়। পরদিন ১০ ডিসেম্বর অভিযান শুরু হয়।
বেলা ১২ টার সময় খুলনা শিপ ইয়ার্ডের সন্নিকটে আকাশে তিনটি জঙ্গি বিমান দেখা যায়। ভারতীয় নাবিক বলেন যে বিমান গুলো ভারতীয়। আকস্মিকভাবে জঙ্গি বিমান গুলো বোমাবর্ষন শুরু করে। ভারতীয় নাবিক সবাইকে জাহাজ ত্যাগ করতে বলেন। ইঞ্জিন আর্টিফিসার মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন উপড়ে এসে চিৎকার করে জানতে চান ‘জাহাজ থামতে কেন বলা হয়েছে। আমরা মৃত্যুর ভয়ে ভিত নই – এগিয়ে যাবোই। ’ বীর শ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ‘পলাশ’ এর উপড়ে পাকিস্তানী বোমাবর্ষনের ফলে শহিদ হন।
৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ যুদ্ধ বিরতির জন্য প্রস্তাব পাশ করে। রাশিয়া এই প্রস্তাবে ভেটো দেয় এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোট দানে বিরত থাকে। ইয়াহিয়া খান প্রত্যাশিত আমেরিকা ও চীনের সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে বঞ্চিত হন। পাকিস্তানী এক লক্ষ সৈন্যের শোচনীয় পরাজয় ও আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে মুক্তিবাহিনীর পরম বিজয় সূচিত হল – পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত হল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
*‘রোব্বার’-স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা ১৯৮৩-তে প্রকাশিত মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম, পিএসসি-রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।