<৯, ১৬.১০, ৪৯০-৪৯২>
ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-৫
প্রতিবেদন: শাহাদাত চৌধুরী
(‘দৈনিক বাংলা’ ১ ডিসেম্বর ১৯৭২-এ প্রকাশিত ‘মানুষের সঙ্গে মিশে যুদ্ধ করেছে গেরিলারা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের অংশ)
নভেম্বরের প্রথম দিকে বিবিসির খবরে বলা হয়েছিল ঢাকা শহর ঘিরে রেখেছে ৮ হাজার মুক্তিবাহিনী। তাঁরা বিচ্ছিন্নভাবে গেরিলা তৎপরতা চালাচ্ছে, কিন্তু যে কোন সময় একসঙ্গে শহরে প্রবেশ করবে।
গেরিলা রণনীতিতে বেছে নিতে হয় শত্রুর দুর্বলতম অংশ। সেক্ষেত্রে শত্রুর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি রাজধানী শেষ লক্ষ্যস্থল হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকা শহরে যেসব আক্রমণ চালানো হয় তার রুদ্দেশ্য সামরিক কৌশলগত আধিপত্য অর্জন ছিল না। উদ্দেশ্যটা মূলতঃ ছিল পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া যে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করছে, এবং সহজেই আঘাত হানছে শত্রুর সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যূহে।
এ সম্পর্কে খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন অধিনায়ক। “শহরে যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। শত্রুকে শুধু জানিয়ে দাও যে তোমরা আছো”, দুই নম্বর সেক্টর এবং “কে” ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল খালেদ মোশাররফ সবসময় বলতেন গেরিলাদের উদ্দেশ্যসম্বন্ধে। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার কয়েকটি দুঃসাহসিক গেরিলা প্লাটুন কে প্রত্যাহার করা হয়। কারণ, এদের কিছু যোদ্ধা ধরা পড়েন শত্রুর হাতে। তখন কর্নেল খালেদ বলেছিলেন, “কাউবয় এডভেঞ্চার গেরিলা যুদ্ধ নয়। গেরিলা যুদ্ধ বীরত্ব দেখাবার জন্য নয়।”
বিবিসির ভাষ্যকারের তথ্য নির্ভুল বলা যেত যদি তিনি গেরিলার সংখ্যাকে দ্বিগুণ বলতেন। শহরকে ঘিরে থাকা গেরিলাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, যা-ই হোক, মাথা তুলবে না প্রয়োজন ছাড়া। ঢাকার পুরোনো যে দলটা কে প্রত্যাহার করা হয়েছিল তারাও নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘ক্র্যাক’ নাম নিয়ে ঢাকার পাশের ত্রিমোহনী, গোরানবাহিরদা অঞ্চলে ঘাঁটি করে। কর্নেল খালেদ আশা করতেন নভেম্বর মাসে মেজর হায়দার কে দিয়ে ঢাকা শহরে মিরাকল দেখাবেন। সে জন্যই মেজর হায়দার তাঁর প্রিয় দলটাকে অনেকদিন ক্যাম্পে আটকে রেখেছিলেন। অক্টোবরে কর্নেলঅখালেদ আহত হলে পুরো দায়িত্ব মেজর হায়দারের উপরে এসে যায়। তাই মেজর হায়দার নভেম্বরে ঢাকায় আসতে পারেননি।
মে মাসে ঢাকা শহরে একটা গোপন কথা প্রবাদের মত লোকের মুখে মুখে ফিরত, “ক্যাপ্টেন হায়দার আসছেন।” কথা টা মেজর হায়দার কে জানানো হলে তাঁর চোখে মুখে অদ্ভুত আনন্দ, প্রত্যয় দেখা যেত। বলতেন, “আমি যাব।” কিন্তু তাঁর পক্ষে আসা সম্ভব ছিল না। কারণ গেরিলা অ্যাকশনের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে ছেলেদের শিক্ষা দেয়া, ব্রিফ করা, গাড়ি করে বাংলাদেশের ভেতরে তাদের নামিয়ে দেয়া তাঁর দৈনন্দিন কর্মসুচী ছিল। তিনটার আগে ঘুমাতে পারতেন না।
২নং সেক্টরের বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর নিজস্ব ট্রেনিং ক্যাম্প। ভারতের সাথে চুক্তি হবার আগেই মেজর হায়দার কাঠালিয়া তে কুমিল্লার কিছু ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে ঢুকিয়ে দেন দালাল হত্যার জন্য। ঘরের বিভীষণকে আগে শেষ করা প্রয়োজন। তারপর প্রথম ব্যাচের শিক্ষা দেয়া হয় নবীনগরে, পরে মেলাঘরে। এদেরকে নিখুঁত গেরিলা হিসাবে তৈরী করার জন্য নানাভাবে ট্রেনিং দেয়া হত। সুবিধে ছিল এই যে, মেজর ছিলেন কমান্ডো বাহিনীর লোক।
নভেম্বর মাস থেকেই ঢাকায় গেরিলারা তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ‘মানিক গ্রুপ’ সাভার অঞ্চলে আর এদিকে ‘ক্র্যাক’। ‘ক্র্যাক’রা এসেই বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়েছিল স্থানীয় পাঠশালায়, যেখানে তাঁরা থাকত। এই পতাকাকে কেন্দ্র করে পাক হানাদারেরা আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো নামানোর চেষ্টা করেও পারেনি। পুরো রূপগঞ্জ থানা তখন গেরিলা ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা পাড় ধরে মিল্গুলোতে ছিল আর্মি বাংকার। তারা গেরিলা আক্রমণে আস্তে আস্তে কেটে পড়তে আরম্ভ করে। ঢাকায় যখন ৩রা ডিসেম্বরে ভারতীয় বিমান এয়ারপোর্টে বোম্বিং করে তখন ঢাকার লোক শহর ত্যাগ করে। এই শহরত্যাগীরা বাসাবো এবং পরে ভাঙ্গা ব্রীজটা পার হয়েই বাংলাদেশের পতাকা আর অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে অবাক হয়ে যায়।
বিমান আক্রমনের রাতে গেরিলারা সব পজিশন নিয়ে ছিল। কারণ, রাতে বিমান আক্রমণে বিভিন্ন অংশ থেকে পাক আর্মি এবং রাজাকারেরা প্লেনের উদ্দেশ্যে রাইফেল ফায়ার শুরু করে। গেরিলারা প্রথমে ভাবে, চারিদিক থেকে পুরো অঞ্চলটা ঘেরাও করা হচ্ছে। কিন্তু পরমুহূর্তে আকাশে প্লেন দেখে বুঝে নেয় ব্যাপারটা কি।
এর ভেতর ঢাকা শহরের উপর ‘ক্র্যাক’ প্লাটুন বড় কিছু করেনি। কিন্তু যেদিন বেতারে সপ্তম নৌ-বহরের কথা বলা হলো তার পরদিন দু’জন গেরিলাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো আমেরিকান সেন্টার উড়িয়ে দিতে। ঢাকা শহরে হানাদারদের নাকের ডগায় আমেরিকান সেন্টার উড়িয়ে দেয়া হয়।
এদিকে গুল টেক্সটাইল মিলের শত্রুবাংকার আক্রমণ করা হয়। বাইরে থেকে শত্রুর রি-ইনফোর্সমেন্ট ঘটে। পুরো এলাকা নিয়ে যুদ্ধ হয়। শত্রুরা ২৭ টি লাশ রেখে পালিয়ে যায়। গেরিলারা বৃহত্তর আক্রমণ প্রতিরোধের বূহ্য রচনা করে। এ সময় ঢাকা থেকে দাঙ্গার সম্ভাবনার কথা আসে। কিছু গেরিলা শহরে চলে স্টেনগান নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করার জন্য। এদিকে শহর থেকে বেরোবার প্রত্যেকটি পথে অ্যামবুশ পেতে রাখা হয়। প্রত্যেকটা মুক্তিবাহিনীর গ্রুপই এসব অ্যাম্বুশে অংশ নেয়। দু’একটা সিভিলিয়ান গাড়ি করে বিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যাবর্তন করতে দেখা যায় শত্রু অফিসারদের। শহ্রে পালিয়ে আসছিল তারা। তারাই ফাঁদে পড়ে। পাক হানাদারদের নিশ্চল হয়ে যেতে দেখেই গেরিলা রা বুঝেছিল যুদ্ধ করার ক্ষমতা আর তাদের নেই। যুদ্ধ শেষ হলো বলে।
এগারই ডিসেম্বর খবর আসে ভারতীয় বাহিনী তারাবোর কাছাকাছি এসে গেছে। এর পরই এসে পড়েন ক্যাপ্টেন মালেক ২ নং সেক্টরের ট্রূপ নিয়ে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নারায়ঙ্গঞ্জ রোডের পাশে স্লটার হাউজের শত্রুবুহ্য তিনি আক্রমণ করবেন। কিন্তু সকালে খবর এলো শীতলক্ষ্যার উপর সেকেণ্ড বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিরক্ষা বুহ্য রচনা করেছে। সমস্ত মর্টারের মুখ এদিকে, গেরিলারা মনে করে বোধহয় শত্রুর আক্রমন এদিক থেকেই ঘটবে। শহর আর শীতলক্ষ্যার মধ্যবর্তী অঞ্চলের সব গেরিলা হয় আরো সামনে আসে অথবা লক্ষ্যার ওপারেই চলে যায়। অবস্থা বুঝে সেকেণ্ড বেঙ্গল রেজিমেন্ট বালু নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
১৩ ডিসেম্বর তারিখে মেজর হায়দার একা একা পৌঁছান, রূপগঞ্জ এলাকায় ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল শফিউল্লাহর সাথে তার দেখা হয় লক্ষ্যার তীরে।
কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর হায়দার কে জিজ্ঞেস করেন, “হায়দার, তোমার ছেলেরা এখানে এভাবে ঘোরাফেরা করছে কেন?”
মেজর হায়দার বলেন, “স্যার, এরা ন’মাস ধরে এখানেই আছে, এদের সব চেনা।”
মানুষের সাথে মিশে যুদ্ধ করেছে গেরিলারা। প্রত্যেকটা ঘরে ছিল তাঁদের ঠাঁই। লোকের বিশ্বাস তাদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছে শত্রুকে প্রতিহত করার। গ্রামবাসিরা তাদের ভেতর জাগিয়ে দিয়েছে দায়িত্ববোধ।
এক সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ গেরিলারা করতে পারেনি। মেজর হায়দার কে সঙ্গে পেয়েও নতুন আক্রমণে পরিকল্পনা রচনার সময় পায়নি, দরকার হয়নি বলে।
১৬ই ডিসেম্বর দুপুরে দশটা হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছিল একসঙ্গে। নিয়মতান্ত্রিক জৌলুসে, অহংকারে। গেরিলারা হঠাৎ বিহবল হয়ে পড়ল। তারপরই ফেটে পড়ল উল্লাসে। চারিদিক থেকে সবাই ঢুকে পড়ল শহরে, নিজের ইচ্ছায়, স্বাধীনতায়।