প্রতিবেদনঃ সহকারি অধ্যাপক আহমেদ কামাল

ফরিদপুর শহরে প্রাথমিক প্রতিরোধ

(প্রতিবেদনটি ১৯৮৪ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহমেদ কামালের কাছ থেকে সংগৃহীত)

 

২৬শে মার্চ রাত প্রায় ২/৩টার দিকে কোতোয়ালীর ওসি আমাদের বাসায় আসেন। বাবা তখন এমএনএ আদিলউদ্দিন আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি এসে জানালেন ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ এবং ফরিদপুরের দিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক-বাহিনী আসছে। এ অবস্থায় ও-সি সাহেব থানার চাবি আব্বাকে দিয়ে সরে যেতে চাইলেন। তখন আব্বা এ অবস্থায় থানার দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইলেন না। এরপর আব্বা এবং আমি ডি-সি সাহেবের বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। ফরিদপুরের ডি-সি তখন জনাব এ, এম, এন ইউসুফ। এস-পি ছিলেন মিহির সাহেব। উভয়কে আমরা ডি-সি সাহেবের বাসার অফিসে দেখতে পাই। ডি-সি সাহেবের সাথে ঢাকা এবং ফরিদপুরের অবস্থা নিয়ে আলাপ হয়। তিনি বললেন, এখনও যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মি আসছে। তারা আজকেই শহরে এসে পৌছাবে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা এবং কর্মীদের শহর থেকে সরে যাওয়াই উচিত। তখন আমরা ঠিক করলাম যে, আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিদের সাথে যোগাযোগ করে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তখন তিনি গাড়ী পাঠালেন তাদেরকে আনার জন্য। জনাব শামসুদ্দিন মোল্লা (এমএনএ), জনাব হায়দার হোসেন (এমপি) এরা সবাই আসলেন। পরিস্থিতি জানার পরে আপাতত শহর থেকে সরে যাওয়ার জন্য সকলেই সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর আমি একটা জীপসহ বেরিয়ে শহরের বিভিন্ন দলের ছাত্র নের্তৃবৃন্দকে ঢাকার ঘটনা জানাই এবং যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফরিদপুরের দিকে সেনাবাহিনীর আসার পথে বাধা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এতে ঐ সময়ে অনেকে ব্যাপারটিকে অবাস্তব মনে করে প্রতিরোধে অংশীদার হতে চাইলেন না। কিন্তু সৈয়দ নাসির হোসেন আহমেদ, জামাল ও আরো কয়েকজন মিলে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে সেনাবাহিনীর পথ রোধ করতে হবে। তখন গাড়ি নিয়ে আমরা দরবেশের পুলের ওপারে গিয়ে গ্রামবাসীদের ডেকে জড়ো করলাম এবং ঢাকার পরিস্থিতি ও পরিকল্পনাও জানানো হলো। এখানে গ্রামের লোকদের গাছ কাটার জন্য প্রচুর উৎসাহ দেয়া হয়। তারা নিজেরাই কুড়াল নিয়ে গাছ কাটতে শুরু করলো। এবং পরামর্শ দেওয়া হলো যে, আর্মি এলে যেন তারা গ্রাম থেকে সরে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে তারা ২০/২৫টি গাছ কেটে রাস্তার উপরে ফেলে ব্যরিকেট সৃষ্টি করে। তারপর আমরা শহরের একটু বাইরে অপেক্ষা করতে থাকি পাক-সেনা শহরে ঢোকার আশঙ্কায়, কিন্তু সময় গড়িয়ে গেল পাক-সেনাবাহিনী আসার কোন লক্ষণই দেখা গেল না। পরদিন হঠাৎ চট্টগ্রাম  বেতারের জিয়াউর রহমানের ঘোষনায় আমরা সবাই খুব উজ্জীবিত হয়ে উঠি এবং ডি-সি সাহেবকে অনুরোধ করি শহরের প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধের জন্য তৈরী হতে। এ ব্যাপারে সামর্থ এবং মওজুদ অস্ত্রের পরিমান জানতে চেষ্টা করি। কিন্তু পুলিশ বাহিনী সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করে। আমরা এ সময়ে জানতে পারি যশোর ক্যান্টনমেন্টের জনগণ এবং পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে আছে।  ২৮ মার্চ ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এবং ঢাকায় অবস্থানরত ফরিদপুরবাসীরা ফরিদপুর আসতে শুরু করে। তাদের মুখে ঢাকার সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কাহিনী শুনে আমাদের মধ্যে প্রতিরোধ স্পৃহা আরো বেড়ে ওঠে। তখন আমরা কোনরকম প্রতিরোধের তৎপরতা না দেখে শহরের কতিপয় তরুনদের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪/৫জন ছাত্র নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পদ্ধতি হবে গেরিলা যুদ্ধ এবং অবিলম্বে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হওয়া উচিৎ এবং এ প্রশিক্ষনে ষোল বছরের উর্ধ্বের সকল সুস্থ্য লোকের অংশগ্রহণে আহবান জানানো উচিৎ। এই  বৈঠক চলাকালে আমাদের সাথে যোগাযোগ এবং উৎসাহিত করেন নৌ-বাহিনীর একজন প্রাক্তন সদস্য জনাব হাবিবুর রহমান। তিনি নিজেকে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের একজন ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচয় দেন। এই সিদ্ধান্ত হবার পর শহরে মাইকযোগে ঘোষনা
 করা হয় যে, প্রতিরোধের যুদ্ধ অংশগ্রহণ করার জন্য সামরিক ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে এবং রাজেন্দ্র কলেজ প্রাঙ্গণে সকলকে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। সেইসাথে আরো ঘোষনা করা হয় যে, ছুটিরত পাক বাহিনীর বাঙালি সৈনিক ভাই এবং প্রাক্তণ সৈনিক ভাইদেরও কলেজ প্রাঙ্গণে আসার জন্য বলা হচ্ছে। এই ঘোষনার পর প্রায় দু’শো লোক কলেজ ময়দানে হাজির হয়। এদের মধ্যে ছুটিরত এবং প্রাক্তণ পাক-সেনাবাহিনীর সংখ্যাও ছিল প্রায় ৬/৭ জন। ষ্টেডিয়ামের একটি রুমকে এই প্রশিক্ষনের হেডকোয়ার্টারে রূপান্তরিত করা হয়। প্রথমে কলেজের ইউ-এ-সি ইউ-ও-সি ইউনিটের ডামি রাইফেল এবং পুলিশ লাইন থেকে রাইফেল এনে ট্রেনিংয়েন ব্যবস্থা করা হয়। ফরিদপুর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটির নাম দিয়ে এই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করা হয়।

 

ট্রেনিংয়ের সাথে সাথে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সাইক্লোষ্টাইল প্রচারপত্র বিলি করা হয়। এসব প্রচারপত্রের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কি করে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে এবং পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন করার জন্য পাটচাষ বন্ধ করা ইত্যাদি। এই পর্যায়ে আমাদের ধারণা হয় এই যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং সকল বাঙালী শিক্ষিত যুবকই পাক-সেনাবাহিনীর বুলেটের লক্ষ হবে। আমাদের ট্রেনিং চলাকালে কুষ্টিয়া এবং যশোরের প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি। তার নিদের্শ অস্ত্র আনার জন্য যশোরে দুইজন সদস্যকে পাঠান হয়। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে তাদের অস্ত্র দেয়া হয়নি। ইতিমধ্যে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়নি, এপ্রিলের প্রথম দিকে জয়দেবপুর থেকে পাক-সেনাবাহিনীর সদস্য হেমায়েত উদ্দিন তার তিন সদস্য সিপাহীসহ বেশকিছু গোলাবারুদ, গ্রেনেড, এস-এম-জি, চাইনিজ রাইফেলসহ পদ্মার চরে অবস্থান করছে বলে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাংবাদিক ভূঁইয়া ইকবাল আমাদের খবর দেন। আমরা কয়েকজন সদস্য পাঠিয়ে তাদেরকে ষ্টেডিয়ামে নিয়ে আসি এবং আমাদের এই প্রতিরোধ আন্দোলনে তাকে শরিক হতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি একদিন পরে শহরের অন্যত্র অবস্থান করতে থাকেন। আমরা কামারখালী, গোয়ালন্দ এবং ভাংগা পর্যন্ত স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে আমাদের প্রচেষ্টাকে জড়িত করার চেষ্টা করতে থাকি। দ্বিতীয়বার অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যশোরে লোক পাঠানো হয়। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হয়। রাজেন্দ্র কলেজ এবং ষ্টেডিয়ামের মাঠে আমাদের ট্রেনিং অব্যাহত থাকে এবং ক্রমেই ট্রেনিং গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। আমাদের এই প্রচেষ্টার দুটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিলঃ

 

(১) জনগনের মনোবল সুদৃঢ় করার জন্য প্রচারকাজ চালানো।

(২) ফরিদপুর শহর এবং আশেপাশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা। অস্ত্র না পাওয়াতে এবং দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরিকল্পনার কারণে ২২শে এপ্রিল পাক-সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ করার মুহূর্তে আমরা শহর ত্যাগ করি এবং ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ি। আমাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথীরা অস্ত্র যোগাড় করতে না পেরে ভারতে চলে যান এবং ট্রেনিং শেষে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনেকে ফরিদপুরের গ্রামাঞ্চল থেকেই রাজাকার এবং পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।   

Scroll to Top