বর্ণমালা সংস্কারের প্রতিবাদে ৪২ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি

<2.66.375-376>
বর্ণমালা সংস্কারের প্রতিবাদে ৪২ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি

দৈনিক পাকিস্তান

১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২

 

৪২ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি : বর্ণমালা সংস্কারের সমালোচনা

 

গতকাল শনিবার ঢাকায় ৪২ জন সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, শিল্পী ও সাংবাদিক এক যুক্ত বিবৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে গৃহীত বাংলা বর্ণমালা লিখনরীতি ও বানান সংস্কার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন । তারা বলেন যে, প্রস্তাবিত পরিবর্তন গ্রহন করা হলে হাজার বছরের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সাথে আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ছে, শব্দ তার পূর্বতন ব্যবহার ও ব্যুৎপত্তিগত ভাবার্থেও অনুষঙ্গ হারিয়ে ফেলবে, কবিতার ছন্দ প্রকরণের নিয়মাদি বির্পযস্ত হবে এবং ভাষাকে ব্যাকরণেরসূত্র করায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য হবে, এছাড়াও সৃজনশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক নিদারুনি বন্ধ্যাত্ব দেখা দেবে এবং ভাষা ও সাহিত্যে পঙ্গু হয়ে পড়বে । ধ্বনি বিজ্ঞানের বিচারেও বাংলা অত্যন্ত সুষ্ঠভাবে বিন্যস্ত বলে স্বীকৃত। এই সংস্কার এর বিজ্ঞান ভিক্তিকেও নষ্ট করবে। তারা বলেন, জন শিক্ষার প্রসারের অজুহাতে লিখন পদ্ধাতির পরিবর্তন সাধন জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার কৌশলমাত্র। তারা বলেন, ভাষা বর্ণমালার প্রকৃত মালিক দেশের জনসাধারণ, তাদের অগোচরে এর মৌলিক পরিবর্তন সাধনে কতিপয় ব্যক্তির অধিকারই নেই। বিবৃতিকারীরা এই সংস্কার প্রত্যাখানের জন্য দেশবাসীর নিকট আবেদন জানান। বিবৃতিতে তারা বলেন যে, কেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এককভাবে ভাষার এরূপ সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সাধনে উদ্যেগী হয়েছেন তা জানা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল আজ অবধি তাদের প্রস্তাবিত সংস্কারের পূর্ণ বিবরণ জনসমক্ষে প্রকাশ করেন নি। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, জনসাধারণের অজান্তেই টেক্স বুক বোর্ডের মাধ্যমে তাাঁরা প্রস্তাবিত বর্ণমালা ও বানান পদ্ধতি শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যকারী করতে অগ্রসর হয়েছেন। যতদুর জানা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, বর্ণমালা হতে তারা ঈ, ঊ, ঐ, ঙ, ণ, ষ, এর ঈ-কা, উ-কার, ঐ-কার ঔ-কার ইত্যাদি বর্জন, যুক্তবর্ণেও উচ্ছেদসাধন ব-ফলা, ম-ফলা, য-ফলা ইত্যাদির পরিবর্তে বর্ণ গ্রহন শ-য, জ-য নবোদ্ভাবিত নিয়মে প্রয়োগ, এ-কার বর্ণের ডানদিকে আনয়ন, ঈ-কার দ্বার ই-কারের কাজ সাধনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছেন।

 

বিবৃতিতে তারা বলেন যে, তথাকথিত সরলকরণের মাধ্যমে জনশিক্ষা প্রসারাই যদি এই সংস্কারেরে উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমাদের বক্তব্য এই যে-

 

(ক) প্রচলিত বর্ণমালা এবং বানান পদ্ধতির যে জনশিক্ষা প্রসারের অনুপযোগী তা প্রমাণ হয় নি।

 

(খ) প্রস্তাবিত লিখনরীতি যে জনশিক্ষা প্রসারের মন্ত্রাসিদ্ধ উপায়ের মত কার্যকরী হবে তারই বা নিশ্চয়তা কি ?

(গ) যে সকল রাষ্ট ব্যাপকভাবে জনশিক্ষা বিস্তারে সফলকাম করেছেন, তাঁরা ভাষা বা লিপি সংস্কারের দ্বারা ঐ কার্য সম্পন্ন করেন নি-জনশিক্ষা বিস্তারের প্রকৃত উপায় সর্বস্তরে অপরিহার্যরূপে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষা পদ্ধতির উন্নতি সাধন এবং সকলের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা করা। এ সকল উপায় অবলম্বন না করে জনশিক্ষা প্রসারের অজুহাতে লিখন পদ্ধতির পরিবর্তন সাধন জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার কৌশলমাত্র ।

 

বিবৃতি তারা বলেন, প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃক একতরফাভাবে গৃহীত বর্ণমালা, বানান পদ্ধতি ও লিখন রীতি চালু হলে বর্তমানে যারা শিক্ষিত তাদের বেলায় এবং যতটুকু শিক্ষার প্রসার হয়েছে তার ক্ষেত্রেও মারাত্নক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। তাছাড়া ভাষা, সাহিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খল ও অরাজকতার সৃষ্টি হবে। শিক্ষিতদের নতুন করে ভাষা লিখন ও পাঠ শিক্ষার ক্ষেত্রেও আরেকটি অতিরিক্ত সমস্যার সৃষ্টি হবে, যা দ্রুত অগ্রগতির সাধন তো দূরের কথা সাধিত অগ্রগতিকে অনেকাংশে ব্যাহত করবে। এর ফল বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যমে হিসেবে চালু করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে বানচাল হয়ে যাবে।

 

বিবৃতিতে আরও বলেন যে, বুৎপত্তি গত অর্থের সাথে সংগতি রেখে বাংলাকে শব্দ বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। শব্দগুলি এমন প্রতীক যা দেখামাত্রই ব্যুৎপত্তির ভাষানুষঙ্গে সে সর্বের মর্ম উপলব্ধি করা যায়। নতুন শব্দ সৃষ্টির সম্ভাবনাও এর ফলে উন্মোচিত থাকে। ভাষা সচল ও বিকাশমান থাকার পক্ষেও অত্যন্ত সহায়ক । আলোচ্য সংস্কার অনেক ক্ষেত্রেই শব্দকে ব্যুৎপত্তি হতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিবে। ভাষা শিক্ষা জটিলতর হয়ে পড়বে এবং ভাষার সৃষ্টিশীলতা ও বিকাশমানতার ক্ষেত্রেও অন্তরায় দেখা দেবে। তারা আরো বলেন যে, কৃত্রিম হস্তক্ষেপের দ্বারা বর্ণমালা ও ভাষা সংস্কার সম্ভব নয়। ভাষা এবং লিখন প্রণালী আপন প্রবণতা অনুযায়ী নিজস্ব নিয়মে স্বাভাবিকভাবে বিবর্তিত হয়, বর্ণমালার সংস্কারদের এই সংগোপন প্রচেষ্টার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাই স্বাভাবিকভাবে সন্দেহের সৃষ্টি হয় ।

 

বিবৃবিতে যারা স্বাক্ষর করেন তারা হলেনঃ

 

ডঃ কাজী মোতাহর হোসেন, জনাব আবুল হাশিম, জনাব মোঃ মনসুর উদ্দিন, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, জনবা মোঃ নাসিরুদ্দিন, বেগম সুফিয়া কামাল, কাজী মোঃ ইদ্রিস, জনাব সিকান্দার আবু জাফর, জনাব জহুর হোসেন চৌধুরী, জনাব আবদুল গণি হাজারী, জনাব শহীদুল্লাহ কায়সার, জনাব হাসান হাফিজুর রমান, জনাব ফজল শাহাবুদ্দিন, জনাব শামসুর রহমান, জনাব আহমেদ হুমায়ুন, সানাউল্লাহ নুরী, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আফরাতুন, মিসেস লায়লা সামাদ, শহীদ কাদরী, কালাম মাহমুদ, কে.জি. মোস্তফা, আতাউস সামাদ, আনোয়ার জাহিদ, আবদুল অফফার চৌধুরী, জহির রায়হান, রোকনুজ্জামান খান, নূর জাহান বেগম, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ, আলী আকসাদ, খালেদ চৌধুরী, ওয়হিদুল হক, কাজী মাসুম, ইসহাক চাখারী, শওকত আলী মোঃ সালেহউদ্দীন, আবদুল আওয়াল, আমালউদ্দিন মোল্লা, গোলাম রহমান, আবু কায়সার, আহমেদ নূরে আলম, শহিদুর রহমান ।

 

কবি জসীমউদ্দিন পৃথক এ বিবৃতিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই বানান সংস্কার হতে নিবৃত্ত থাকার অনুরোধ জানান । তিনি বলেন, তা না হলে জনগণের মধ্যে মারাত্নক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে দেশের শাসকবর্গের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ প্রদর্শিত হবে ।

 

তিনি বলেন যে, উ-কার, ঔ-কার এবং দুই ন,ণ এবং তিনটি শ, ষ, স-ও অত্যাচার সারাজীবন আমাকে ভুগতে হয়েছে। যারা এখন বানান সংস্কার করতে চান, তাদের সাথে আমি কতটা একমত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের হরফ ও বানান সংস্কার মেনে নিলে আমাদের বংশধরদের এক চক্ষু অন্ধ করে দেওয়া হবে ।

Scroll to Top