বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের প্রচেষ্টা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দানের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রতি বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের আহ্বান

<৪,১২,১৮-২০>

অনুবাদকঃ মুশররাত আলম মৌ

শিরোনাম সুত্র       তারিখ
১২। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের প্রচেষ্টা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দানের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রতি বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের আহ্বান বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের সভাপতির চিঠি ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১

 

সম্মানিত সংসদ সদস্য,

বাংলাদেশে (প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান) পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের নজিরবিহীন গণহত্যা চালানোর ঘটনায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ও জনগণ যে স্বতস্ফুর্ত নিন্দা জ্ঞাপন করেছে, তা আমরা গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি। পুরো ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এই ঘটনা পুর্ব পরিকল্পিত ও তা নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকার এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এতে আমরা কৃতজ্ঞ এবং আমরা এই সুযোগকে আমাদের মত প্রকাশ করার উপায় হিসেবে নিয়ে প্রয়োজনীয় এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাই –

(ক) অতিসত্বর নিরস্ত্র এবং বেসামরিক জনগণকে হত্যার অবসান,

(খ) অতিসত্বর আক্রান্ত জনগণের এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষকে প্রতিরোধের জন্য ত্রাণ সরবরাহের ব্যবস্থা করা,

(গ) সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি,

বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিয়াফ্রার থেকে ভিন্ন

(i) ২৩ মার্চ, ১৯৪০ এর ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে,

“অখণ্ড ভারত মুসলিম লিগের এই অধিবেশনের নির্ণীত ও বিবেচিত সিদ্ধান্ত অনুসারে কোন সাংবিধানিক পরিকল্পনা এই দেশে কাজ করবে না বা মুসলিম লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষন না পর্যন্ত এটি নিম্নলিখিত কিছু মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, যেমন ভৌগোলিকভাবে পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহকে সীমানা নির্ধারন করে প্রদেশ অনুসারে গঠন করা উচিৎ প্রয়োজন অনুসারে এলাকাভিত্তিক পুনঃসমন্বয়ের মাধ্যমে। যে সমস্ত অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশ ও পুর্বাংশ, তাদেরকে একত্র করে স্বাধীন রাজ্য গঠন করা উচিৎ, যেখানে গঠনকারী এককগুলো হবে সার্বভৌম এবং স্বায়ত্তশাসিত।

লাহোর প্রস্তাব অখণ্ড ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ দল কর্তৃক পাস করা হয়েছিল। এই প্রস্তাব সাংবিধানিকভাবে সংশোধিত হয়নি। প্রস্তাবিত পাকিস্তানের পক্ষে নির্বাচনী পরিষদের নব নির্বাচিত সদস্যদের একটি পৃথক সভায়, জনাব জিন্নাহ কর্তৃক বিধিবহির্ভূতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ” একটি মুদ্রণজনিত ভুল এবং বাংলা মুসলিম লীগের সম্পাদক জনাব আব্দুল হাকিমের প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত বাংলার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।

(ii) যাই হোক, আশা করা হয়েছিল যে, পুরনো এই বিষয়টির গতিবিধি সম্পর্কে নির্বাচনী পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে এবং এই বিষয়ে জনগণের মতামত নির্ধারণের জন্য একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আপনাদের জানা আছে বলে আমরা ধারণা করছি যে, পাঞ্জাবনিয়ন্ত্রিত সামরিক ও বেসামরিক আমলা তন্ত্র এই দেশে বিগত ২৩ বছরে কোন মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি (প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৫৯ সালে, কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে)।

(iii) সামরিক সরকার শেষ পর্যন্ত ১৯৭০-৭১ সালে সাধারণ নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ থেকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাধারণ পরিষদের সদস্যদের অধিকার ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে দেশ কে একটি সংবিধান প্রদান করার। এই গণতান্ত্রিক বৈঠককে গ্রহণ করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করার জন্য পাঞ্জাবনিয়ন্ত্রিত সামরিক সরকার গণহত্যায় নিয়োজিত হল।

বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তান – দু’টি ভিন্ন মানবসভ্যতা

(i) পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণ নিজেদের আর্য বংশোদ্ভূত দাবি করে নিজেদের জাতিগতভাবে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং বাংলাদেশের জনগণকে জাতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে নিকৃষ্টতর জীব হিসেবে বিবেচনা করে উপেক্ষা করে। সাবেক রাষ্ট্রপতি আইয়ূব খান পুর্ব পাকিস্তানিদের ব্যাপারে যা লিখেছেন সেখান থেকে এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায়। তার মতে, পুর্ব পাকিস্তানিরা কখনো প্রকৃত স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্বের স্বাদ পায় নি, তাদের মধ্যে আছে পদদলিত জাতির প্রশমন এবং তারা এখনও এই সদ্যোপ্রাপ্ত স্বাধীনতার সাথে মানসিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে সমর্থ হতে পারে নি। (আইয়ূব খান, ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স, ১৯৬৭,পৃ-১৮৭)

সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার প্রতি সংখ্যালঘু পশ্চিম পাকিস্তানিদের এই আচরণ শুরু থেকেই এমন ছিল।  কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রকৃত ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ক) বাঙালি মুসলিমরা ১২০১ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত  দিল্লির মুসলিম শাসকদের থেকে অনেকটাই স্বাধীনভাবে বাংলা ও আসাম, বিহার ও উড়িষ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ শাসন করেছেন।

খ) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর মধ্যে বাঙালি মুসলিমরা ছিলেন প্রথম যারা  ব্রিটিশ ভারতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছিলেন।

গ) বাঙালি মুসলিমরা পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যখন পাঞ্জাবিরা শিখদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল এবং তাদের ঈষদুষ্ণ সমর্থন ছিল এই আন্দোলনে এবং সীমান্তে স্বাধীনতার পরেও কংগ্রেসের পতাকা উড্ডয়ন করা হয়েছিল।

(ii) যাই হোক, এটি কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা পুর্ব পাকিস্তানিদের সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে। পুরো এলাকা মূলত কিছু জমিদারদের মালিকানাধীন এবং তারা শুধু সেখানকার জমিই নয়, অধিবাসীদেরও মালিক (সিন্ধু এলাকায় ৮০ শতাংশ জমি সামন্তবাদি জমিদারদের অধীনস্থ; পাঞ্জাব ও সিন্ধু এলাকায় এই অনুপাত ৫০ শতাংশ)। তাদের মূল্যবোধ স্বাভাবিকভাবেই সামন্তবাদী এবং তাদের সমাজ কিছু সামন্তবাদী নিয়মাবলি দ্বারাই সমর্থিত (পাঞ্জাবে বর্ণপ্রথা ও সীমান্তের গোষ্ঠীগত রীতিনীতি)। পশ্চিম পাকিস্তানে গণতন্ত্র মূল্যহীন যেহেতু সেখানে ভোট নিয়ন্ত্রিত হয় জমিদারদের এবং ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা (ভুট্টো নিজে একজন বড় জমিদার এবং  পাঞ্জাবে তিনি তার অধিকাংশ ভোট পেয়েছিলেন পাঞ্জাবি জমিদারদের সাথে আপোষ-আলোচনার মাধ্যমে। পাগারোর পীর একাই প্রায় চল্লিশ লক্ষ ভোট নিয়ন্ত্রণ করেন।

অপরপক্ষে, বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী। তাদের কোন জাতি বা গোষ্ঠীগত অন্তর্ভূক্তি নেই। সকল জমি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন থাকায় কোন সামন্তবাদি জমিদারের অস্তিত্ব নেই। বাঙালি মুসলিমরা সংখ্যালঘুদের প্রতি সহনশীল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই সহনশীলতা বুঝতে অক্ষম (পাঞ্জাবে ভারতভাগের সময় লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু নিহত হয়েছিল)। তারা এই সহনশীলতাকে ভারতঘেঁষা হিসেবে ব্যাখ্যা করে। বাস্তবে, গণতন্ত্র, সমানাধিকার ও ধর্মীয় সহনশীলতার আদর্শের প্রতি অনেক বেশিগুণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বাঙালিরা সভ্যতার একটি ভিন্ন স্তরে অবস্থান করছে।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের সামন্তবাদি মূল্যবোধ তাদের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। পশ্চিম পকিস্তান কোন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ছাড়াই অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত। বাংলায় স্থানীয় সরকারের ঐতিহ্য বেশ শক্তিশালী এবং প্রশাসন অপেক্ষাকৃত বিকেন্দ্রীভূত। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের সামন্তবাদি জমিদারদের দ্বারা খুন, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং এমনকি মহিলাদের অপহরণসহকারে নিয়ন্ত্রিত (হামজা আলভী ফর ভিলেজ পলিটিক্স ইন ওয়েস্ট পাকিস্তান ইন সাউথ এশিয়ান রিভিউ, জানুয়ারি, ১৯৭১)। অথচ বাঙালি গণতন্ত্র দখল করে আছে এক অদ্বিতীয় স্থান। এমন হাজারও ধরনের উদাহরণ অসংখ্যবার দেখানো যেতে পারে।

৩। বাংলাদেশে গণহত্যা

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বাংলাদেশে নিরস্ত্র ও নির্দোষ মানুষদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের অমানবিক গণহত্যার উপর অনেক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই বিস্মিত হওয়ার বিষয় এই যে, বিংশ শতাব্দীতেও মানুষ এতটা অসভ্য হতে পারে। যাই হোক, আমরা বাংলাদেশের জনগণ, যারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে বিগত ২৩ বছর ধরে আছি, তারা মোটেও বিস্মিত নই। পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষত পাঞ্জাবিরা নিজেদের রাজপুত গোত্রের বলে দাবি করে। এটি বলা যাবে না যে, আর্য বংশোদ্ভূত রাজপুতেরা কোন রকম বিতর্কের উর্দ্ধে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, অধিকাংশ পাঞ্জাবি মুসলমান রাজপুত হান বা সিথিয়ান যোদ্ধাদের সজাত যারা বৌদ্ধ সভ্যতা ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণদের সহায়তা করেছিল এবং পুরষ্কার হিসেবে দ্বিজাতিদের পদমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন, জে এম উইকিলি, পাঞ্জাবি মুসলমান, দ্য বুক হাউস, লাহোর, পশ্চিম পাকিস্তান)। বর্তমানে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা হল এক প্রকার “হান আক্রমণ”,  যা এবারে বাঙালিদেরকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য বদ্ধপরিকর, যেমনটি তারা করেছিল পূর্বে বৌদ্ধদের সাথে এবং পশ্চিমে শিখদের সাথে।

অতএব, আপনাদের কাছে আমাদের নিবেদন রইল এই পরিস্থিতির তাৎপর্য উপলব্ধি করার। আমাদের পরিস্থিতি বিয়াফ্রার পরিস্থিতির মত নয়, লাহোর প্রস্তাব যেকোন ভবিষ্যৎ মীমাংসার মুল ভিত্তি হওয়া উচিৎ যেমনটি ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের মূলভিত্তি হিসেবে এবং সেটি এখনও পর্যন্ত অবিসংবাদিত। পশ্চিম পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র হতে পারে না, কারণ তাদের সভ্যতা, মূল্যবোধ, আশা-আকাঙ্ক্ষা সবই ভিন্ন। আমরা বাংলায় হান বংশোদ্ভূত বর্বরদের আক্রমণের শিকার হয়েছি, আপাতভাবে ইয়াহিয়া বা ভুট্টোর কূটনীতি এই নগ্ন সত্যকে ধামাচাপা দিতে পারবে না, বৌদ্ধদের মত আমরাও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি; বর্বরেরা আমাদের ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। আমরা নিদারুণভাবে সকল সভ্য দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের প্রতি আমাদেরকে সাহায্য করার আবেদন করেছি, কারণ ব্রিটিশ জনগণ শুধুমাত্র গণতন্ত্রের ধারকই নয়, তারা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের স্বরূপ সম্পর্কে শুরু থেকেই অবহিত। যেহেতু আমাদের সকল বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পাঞ্জাবি বেনিয়াদের হাতে নিহত হয়েছেন, আমরা আশংকা করছি যে, আমরা আমাদের পরিস্থিতিকে সফলভাবে বিশ্বদরবারে উপস্থাপনে সক্ষম নাও হতে পারি। সুতরাং, আপানাদের নিকট আমাদের পরিস্থিতির বিবরণ জাতিসংঘে আরেকটিবার পেশ করার নিবেদন করছি।

                                                                                        আপনার বিশ্বস্ত                                                                                     এম মোজাম্মেল হক                                                                                         সভাপতি                                                                                     বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট                                                                                    ১০, লিচেস্টার গ্রোভ                                                                                                লিডস-৭

Scroll to Top