বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু
১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বাংলার মাটিকে বাংলার আকাশ-বাতাস-মাঠ-প্রান্তরকে এবং বাংলার মানুষকে এমন নিবিড় করে বোধ করি আর কোন বাঙালী ভালোবাসতে পারেনি। বাংলাদেশকে ভালোবেসে, বাংলার নির্যাতিত শোষিত লাঞ্ছিত মানুষকে ভালোবেসে শেখ মুজিবের ন্যায় দুঃখ ও নির্যাতন আর কোন মানুষ সহ্য করেননি। বাংলার মাটির প্রবাহ শেখ মুজিবের রক্তে সৃষ্টি করেছে তরঙ্গ, বাংলার নিঃশ্বাস যেন শেখ মুজিবের নিজের শরীরের নিঃশ্বাসে পরিণত হয়েছে- বাংলার সমগ্র অস্তিত্বের সাথে তিনি যেন একাত্ম হয়ে পড়েছেন। তাই বাংলার শরীরে যখন যে ব্যথা বেজেছে সে ব্যথা যেন শেখ মুজিবের শরীরেও ঝংকার তুলেছে। বাংলার মাটিতে যুগে যুগে মানুষ বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ন্যায় বাংলার প্রাণের সাথে একাত্মতা এমন গভীরভাবে কেউ অনুভব করেননিআর পরবর্তীকালে শুধু বাক্যে নয়, শুধু অনুভূতি দিয়েও নয়, দেহের বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে, জীবনের সকল আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে, সকল শক্তি ও সাধনা দিয়ে যিনি বাংলার সাথে একাত্মতা প্রমাণ করেছেন তিনিই বাংলাদেশের নয়নমণি শেখ মুজিব। বাংলার অস্তিত্ব থেকে তাঁর ব্যক্তিত্বকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, “তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব” অথবা “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুজিতে যাই না আর” এই কবিতা শুনে যিনি বাংলার প্রেমে তন্ময় হতেন, তিনি আজ আর প্রিয় জন্মভূমি বাংলার থেকে দূরে-বহু দূরে শত্রুর কবলে, দানব পশুর পাহারায় আবদ্ধবঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ রক্তস্নাত আর জননী বঙ্গভূমির সবচেয়ে আদরের দুলাল শেখ মুজিব আজ হৃদয়হীন পাষণ্ডের দেশ পাকিস্তানে বন্দীজীবনের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত। আজো বাংলার মাটিতে “কাঁঠালপাতা করিতেছে ভোরের বাতাসে” এবং “সেখানে খয়ের ডানা শালিকের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে”- কিন্তু এই দৃশ্য দেখে যে মানুষটি সবচেয়ে অভিভূত হতেন, যে সিংহপুরুষ সমগ্র বাংলাদেশকে হৃদয়ের কাছে আঁকড়ে ধরতে হাত বাড়াতেন সেই শেখ মুজিব বাংলা থেকে বহু দূরে শত্রুর কারাগারে শত অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে দিন অতিবাহিত করে চলেছেন। বাংলাদেশের কাছে এর চেয়ে দুঃখের, এর চেয়ে মর্মান্তিক বুঝি আর কিছুই হতে পারে না। বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে কি এক নিঃসীম শূন্যতা অনুভব করি, মনে হয় –
যতদূর যাই,
নাই নাই সে পথিক নাই,
মনে হয়ঃ প্রভাতের অরুণ আভাসে
ক্লান্ত সন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিঃশ্বাসে
পূর্ণিমায় দেহহীন চামেলীর লাবণ্য বিলাসে
ভাষার অতীত তীরে
কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হতে আসে ফিরে ফিরে
যতদূর চাই
নাই নাই পথিক নাই।
কিন্তু না। কে বলে শেখ মুজিব আমাদের মধ্যে নাই। তুমি যদি বাঙালী হও, তুমিও যদি বাংলাদেশের মাটি ও আলো-বাতাসকে শেখ মুজিবের মতই ভালবেসে থাকো, তুমি একবার চোখ নিচু করে তোমার হৃদয়ের দিকে চেয়ে দেখ- দেখবে শেখ মুজিব তোমার হৃদয়ে বাংলার প্রেমের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন আর তোমার হৃদয়কে বার বার নাড়া দিয়ে আহবান করছেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তুমি যদি মুক্তিযোদ্ধা হও, সংগ্রামী বাঙালী হয়ে পাকিস্তানের হানাদার কুকুরগুলোকে বিতাড়নের শপথ গ্রহণ করে থাকো- তুমি তোমার হৃদয়ে শেখ মুজিবকে খুঁজে পাবে, তোমার বাহুতে অজেয় শক্তি হয়ে, তোমার বক্ষে দুর্বার সাহসের প্রবাহ হয়ে শেখ মুজিব সর্বদা জাগ্রত রয়েছেন। শেখ মুজিব বাংলার আমাদের সবার একান্ত নিকটে। পিণ্ডির কয়েদখানা শেখ মুজিবের দেহকে আবদ্ধ করে একটি বর্বর আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, বাংলাদেশের আজাদীর জনক শেখ মুজিবকে বিশ্বের কোন শক্তির সাধ্য নেই আবদ্ধ করে, কোন শক্তির সাধ্য নেই তাঁকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে। তবু দুঃখ হয়, দুঃখে প্ৰাণমন সংকুচিত হয়ে আসে এই ভেবে যে, পাকিস্তানের বর্বরদের মধ্যে কি নিদারুণ বেদনার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবের। বাংলাকে ভালবেসে জীবনে যিনি সর্বদা যে কোন নির্যাতনকে এমন কি মৃত্যুকে পর্যন্ত মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত, বাংলার সেই সবচেয়ে দরদি সন্তান আজ একটি বাঙালীর মুখ দেখতে পারছেন না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি দেখছেন সেই হীনতম জানোয়ারগুলোর মুখ, যাদের স্মরণ করলেও আজ প্রত্যেকটি
বাঙালীর হৃদয় প্রতিহিংসায়, ঘৃণায় ও ধিক্কারে সংকুচিত হয়ে ওঠে। কবিগুরুর ভাষায়- আল্লাহকে বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করেঃ
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো;
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, বেসেছ তাদের ভালো?
প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করেঃ শেখ মুজিব কি অন্যায় করেছেন, যার জন্য আজ এই নিদারুণ শাস্তি তাঁর ভাগ্যে নেমে এলো? বাংলাদেশকে ভালোবাসা, বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ মোচনের জন্য শপথ গ্রহণ করাই কি শেখ মুজিবের একটি অন্যায় কর্ম? আর তারই জন্য কি এই মহান নেতার ভাগ্যে এমন বিপর্যয়?
(ডক্টর মাযহারুল ইসলাম রচিত)