শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৬। বাংলাদেশ সশস্ত্র সংগ্রামের ওপর একটি পর্যালচনা-প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বক্তৃতা | বাংলাদেশ আর্কাইভস, মুজিবনগর | ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
ট্রান্সলেটেড বাই-Razibul Bari Palash
<১১, ৬, ১৭৮-১৮০>
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীনের জাতির উদ্যেশ্যে ভাষণ-
আমার প্রিয় দেশবাসী ওসহযোদ্ধারা-
শেষবার আপনাদের সাথে কথা হবার পর পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের জনগন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পাঠানো অসংখ্য শত্রুসেনাদের এদেশের আনাচে-কানাচে গড়া সুরক্ষিত ও নিরাপদ সামরিক ঘাঁটিতে বীরবিক্রমে ক্রমাগত যে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে তা এক অভূতপূর্ব ঘটনা। আমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ, জলে-স্থলে আমাদের গেরিলাদের অসাধারণ মেধাবী আক্রমণকৌশল, ক্রমাগত শক্তিশালী ও প্রবল হতে থাকা আমাদের প্রতিরোধ-শক্তি-ইত্যাদি প্রমাণ করে যে তাঁদের পরাজয় খুব-ই সন্নিকটে। তবে আমি, ধৈর্য ও সংযমের উপর জোর দিতে চাই। আমি মনে করি শত্রুকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য এবং এই নিষ্ঠুর যুদ্ধ শেষে দেশ পুনর্নির্মাণের জন্য এই দুটো গুণের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হবে।
বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্যে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষমতার এই পরিবর্তনকে ব্যাবহার করে শত্রুপক্ষ তাঁদের স্বার্থ নগদায়ন করার যে কুপ্রচেস্টা নিয়েছিল সেটা ব্যার্থ হয়েছে-আমার সে প্রমাণ পেলাম সাম্প্রতিক ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তিতে। বাঙালি নিঃসন্দেহে তাদের নিজস্ব ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। তারা তাদের ত্যাগ, সংগ্রাম আর প্রচেষ্টা দিয়ে সেটা জেনেছে ও শিখেছে। কিন্তু তবুও সান্ত্বনা এই যে-যাদের কাছ থেকে শুধু ‘সতর্ক’ থাকার চেষ্টা করেছি সেটা এখন ‘সমর্থন’এর পর্যায়ে রূপ নিচ্ছে। কিছু দেশের সরকার যদিও রক্ষণশীল ভূমিকায় থেকেছে তবু তাঁদের জনগণের আকুন্ঠ সমর্থন, সমবেদনা ও একাত্মতা প্রকাশের খবর আমরা পাচ্ছি। তাই আমরা আশা করি সেইসব সরকার খুব দ্রুত তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান থেকে সরে এসে আমাদের পাশে দাঁড়াবে।
বিশ্বের বেশীরভাগ দেশ একথা বিশ্বাস করেনা যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ধ্বংসলীলা চালিয়ে জনগণের স্বস্তি ফিরিয়ে আনার যে নীতি গ্রহণ করেছে তা বাস্তবে সম্ভব হবে। যদিও জাতিসংঘ মনে করেনা যে দখলদার পাকবাহিনী দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া ত্রাণসামগ্রী বাঙ্গালীদের মাঝে বিতরণ সুষ্ঠু হচ্ছেনা! একথা বলাই বাহুল্য যে পাকসেনারা তাদের হেলিকপ্টার, নৌযান আর যানবাহন দিয়ে বাঙ্গালীর জন্য ত্রাণ বিতরণ করে বেড়াবে! এসব ত্রাণসামগ্রীর সবই পাকবাহিনী ব্যাবহার করছে। শুধু তাই নয়, ইউ এন রিলিফ টিমের কমিউনিকেশন এক্সপার্টরা প্রশ্নাতীতভাবে পাকবাহিনীকে নানারকম লজিস্টিক বেনিফিট দিয়ে যাচ্ছে। এই ভয়ানক মিশনটিকে তারা মানবতার-সেবা বলে আখ্যা দিচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বিশ্ব সংস্থার মর্যাদা সম্পর্কে যত্নবান হলে এখনই তার ইউএন রিলিফ অপারেশন নামের এই উপহাস বন্ধ করার সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দখলদার বাহিনী শুধুমাত্র অতিবর্বর নয়-যেমনটি তাদের গণহত্যা এবং ধ্বংসের দ্বারা প্রমাণিত হয়-তারা আসলে তিলে তিলে আমাদের সব শুষে নিতে চাইছে নানারকম মিথ্যা আর প্রতারণার ফাঁদ দিয়ে। কিছুদিন পর পর তারা নানারকম আপসের ফর্মুলা দিয়ে তাদের চতুর স্বার্থ বজায় রাখার চেষ্টা করত এবং আমাদের মানুষকে বিভ্রান্ত করে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের যে দৃঢ় সংকল্প সেটাকে দুর্বল করে দেবার চেষ্টা করত।
জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সামরিক জান্তারা বাংলাদেশে খুব দ্রুত বেসামরিক প্রশাসন ফিরিয়ে আনার ব্যাবস্থা করার মিথ্যা বানী দিয়ে আসে। জেনারেল ইয়াহিয়া আর ঘৃণিত টিক্কার প্রতিস্থাপন, বাঙ্গালীদের ব্যার্থ করার চেষ্টা, জনবিচ্ছিন্নতা, জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব, এই সবই ছিল মূলত প্রতারণার ফাঁদ যাতে নির্লজ্জ সামরিক শাসন, গণহত্যা ও শোষণ অব্যাহত থাকে।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সম্মেলনে কিছু কিছু সদস্যের সাথে বিশদ প্রদর্শনী করে আর কাউকে বসার সুযোগ না দিয়ে ইয়াহিয়া কাদের খুশি করতে চান আমাদের জানা নেই। জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ-যারা তাদের জনগণের ইচ্ছার ধারক-তাদের কর্তৃত্ব হরণ করে-তাদেরকে অনুপস্থিত রেখে ঐ অংশের জনগণের সমর্থন প্রমাণ করতে চাওয়া ব্যার্থ চেষ্টা মাত্র। এমএনএ ও এমপিএ গন গত জুলাইয়ে তাদের চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ব্যাপারে তাদের মতামত বলবত রাখেন। তাদের বিরুদ্দে নেয়া কোন প্রকার অনৈতিক ট্রায়াল অথবা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করনে তাদের এই সিদ্ধান্তে কোন পরিবর্তন হবেনা।
বাঙালিদের উপর ভয়ানক গণহত্যা ও একনায়ক ইয়াহিয়া বাঙ্গালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি সামরিক আদালতে গোপন বিচারে তার নিযুক্ত এটর্নীদের প্রভাবিত করে জোর করে অপরাধী দেখিয়ে কারারোধ করে রেখে মিথ্যা হোয়াইটওয়াশ করার চেষ্টায় সমগ্র বিশ্বে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর বিচারের ট্রায়াল সম্পর্কে আমি সমস্ত বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিতে চাই-যে বিচার করাই হোক না কেন-সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর ভালবাসাসিক্ত যে বঙ্গবন্ধু বাঙলীর চোখে স্বাধীন বাঙলার স্বপ্ন এঁকে দিয়েছেন-যাকে শত্রুরা বন্দি করে রেখেছে-সেই প্রাণপ্রিয় ব্যাক্তিটিকেই তারা এদেশের ক্ষমতায় দেখতে চান। বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের অন্যান্য দেশ, সরকার, জনগণ ও জুরিদের সাথে সব রকমের পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে। এর কাছে কোন চতুরতা সামান্য প্রভাব ফেলবে না বলে আমি আশা করি। কিন্তু আমি আমার দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, যারা তথাকথিত ট্রায়ালের নামে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন অনিশ্চিত করতে চাচ্ছেন তাদের প্রত্যেককে বিচারের সম্মুখীন করা হবে। পাশাপাশি যাদের ইসলামাবাদের সঙ্গে প্রভাব আছে তাদের কাছে অবিলম্বে শেখ মুজিবের নিরাপদ মুক্তির জন্য সাহায্যের আবেদন করছি।
সম্প্রতি পাকিস্তান সরকারের অধীনে কর্মরত বাঙ্গালী কূটনীতিকরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে যোগ দিয়েছেন। এতে আমাদের শক্তি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি বহিঃবিশ্বে আমাদের সরকারের ভাবমূর্তি ও স্বীকৃতি প্রাপ্যতা আরও সহজ হবে। দেখা যাচ্ছে স্বীকৃতি দ্রুত যুদ্ধ সমাপ্তির নির্দেশক এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় সূচক বহন করে। বাংলাদেশের জনগণ, যারা শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন-যারা এতোটা শারীরিক ও মানসিক ভুক্তভোগী হয়েছেন-যে বোধ হয় আর কেউ কোনোদিন ভোগ করেনি। যারা গণতন্ত্রে ও মানবিকতায় বিশ্বাস করে তারা নিশ্চয়ই আমাদের সমর্থন দেবে।
পশ্চিম পাকিস্তানীদের অত্যাচার, নির্যাতনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বন্যাও দুঃখকষ্টের একটি নিষ্ঠুর মাত্রা যোগ করেছে।। দুঃখের সাগরের মত বন্যা আমাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গ্রাস করেছে। শোষণ ও বিদ্রূপনীতির আরেকটি হল বাংলাদেশে এই বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকসরকারের চরম অবহেলা। এটা খুব স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ও বাঙ্গালীর নিয়তি নির্ধারনে বাঙ্গালীদেরকেই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে।
বাঙ্গালীর জীবন যাপনের সূচক আর অন্তর্বেদনা পরিমাপ যোগ্য অবস্থায় নেই। কিন্তু আমি বিশ্বাস ও অনুভব করি বাঙ্গালীর হৃদয়ের কম্পন-যা দিয়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও যুদ্ধের মত সবকিছুর উপর বিজয় অর্জন সম্ভব।
পরিশেষে, আমি শ্রদ্ধাভরে ধন্যবাদ জানাই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের-যাদের অসীম সাহস, আত্মাহুতি এবং সাফল্য জাতিকে গর্বিত করে আর ভবিষ্যতের আশা জাগায়। বাংলাদেশের জনগণ এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের সংহতি সুসংহত করেছে। এই সংহতিই যেন তাদের অদম্য শক্তিতে পরিণত হয় এই কামনা।
জয় বাঙলা