বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনের জন্যে বিশ্বের শ্রমিক সংগঠনসমূহের প্রতি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার

<৪,২৭৮,৫৫৯-৫৬৩>

অনুবাদকঃ নাজিয়া বিনতে রউফ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৮। বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনের জন্যে বিশ্বের শ্রমিক সংগঠনসমূহের প্রতি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার ——————–

১৯৭১

 

একটি আবেদন

ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজেশন ও বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষের প্রতি বাংলাদেশ ট্রেডইউনিয়ন সেন্টার, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার”-এর শ্রমজীবি মানুষের পক্ষ থেকে

প্রিয় কমরেড বন্ধুগণ,

পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশে (প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান) চালানো গণহত্যার ব্যাপারে আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন।

আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলো নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। একই ধর্ম হলেও পাকিস্তান পাঁচটি আলাদা জাতিসত্ত্বা- সিন্ধু, বেলুচ, পাখতুন, পাঞ্জাবি ও বাঙ্গালী নিয়ে গঠিত ছিল। পাকিস্তানের সর্বমোট জনসংখ্যার ৫৬% হল বাঙ্গালীরা যারা দেশের পূর্বাঞ্চলে বাস করে, যা কিনা পশ্চিমাঞ্চল থেকে একহাজার মাইলের চেয়েও বেশী দূরত্বে বিচ্ছিন্ন। বাঙ্গালীদের মোট জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি।

একদম শুরু থেকেই কতিপয় বড় পুঁজিবাদী, সামন্তবাদী জমিদার ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থ পূরণ করে চলেছে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। শ্রমিক-কৃষকশ্রেণী ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উপর লাগামহীন শোষণ, নিপীড়ন চালায় তারা। জনসাধারণকে চরমভাবে বঞ্চিত করে দেশের বেশিরভাগ সম্পদ গুটিকয়েকের হাতে কুক্ষিগত করা হয়েছিল। একনায়কতান্ত্রিক সরকারের ছায়াতলে কালো শ্রমিক আইন, বিপুল সংখ্যক বেকার ও শ্রমজীবি শ্রেণীকে সীমাহীন শোষণের মাধ্যমে পুঁজিবাদ অতুলনীয় দরে মুনাফা লাভ করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে একাধিপত্যবাদী গ্রুপ তৈরী হয়, প্রায় পঁচিশটির মতো যাদের বেশিরভাগ শিল্প-কারখানা ও ব্যাঙ্কের উপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং ফলাফলস্বরুপ সরকারের উপরও।

পাকিস্তানের একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল ভিন্ন জাতিসত্ত্বার শোষণ, বিশেষ করে বাংলাদেশে এটি প্রকট ছিল। বেশিরভাগ শিল্প-কারখানার মালিক ছিল পশ্চিমাঞ্চলের পাঞ্জাব অথবা করাচীর শিল্পপতিরা। ভৌগোলিক দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একহাজার মাইলের চেয়েও বেশি দূরত্বে বিচ্ছিন্ন পুর্ব পাকিস্তানের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ছিল পশ্চিমাঞ্চলের জাতিসমুহের থেকে আলাদা। পুর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে মন্থর করতে ও একে কার্যত এক উপনিবেশে পরিণত করতে সম্ভব সবকিছু করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। পুরো জাতিকে দুর্বল ও পরাধীন করার উদ্দেশ্যে শাসকগোষ্ঠী বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতিকে আক্রমণ করে।

পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমজীবি শ্রেণীকেই সবসময়ের মতো সকল শোষণের বোঝা বহন করতে হয়।

শ্রমজীবি শ্রেণীর সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদের অধিকার আন্দোলন সহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করা হয়। গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন ও গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের প্রচেষ্টা শুরুতেই নষ্ট করা হয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সামরিক আইন চাপিয়ে দেয়া হয়।

সামরিক জান্তার নৃশংসতা ও নিপীড়ন সত্ত্বেও প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী দল ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করছিল। আইয়ুব খান বাধ্য হল সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে। ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এতকিছুর পরেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেন ও দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক আইন জারি করেন। কিন্তু এই স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতিকে ঘোষণা দিতে হয় যে, তার শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অপ্রতিরোধ্য সংখ্যক জনগণ জাতীয়তার অধিকার ও জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে ভোট দেয়। জাতীয় পরিষদে এই গণতান্ত্রিক সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ও তাদের উপর অর্পিত হয় দেশের সংবিধান প্রণয়ন ও সরকার গঠনের দায়িত্ব।

সামন্তবাদী জমিদার, একাধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পরিচর্যাকারী সামরিক জান্তা নির্বাচনী ফলাফলে তাদের অনিবার্য পতন দেখতে পাচ্ছিল। সুতরাং, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান বিভিন্ন অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপার এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলেন। তিনি জনগণ ও তাদের প্রতিনিধিদের বারংবার দাবি সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করতে রাজী হননি।

ফলাফলস্বরুপ, পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে যা পশ্চিম পাকিস্তানের গণতন্ত্রপন্থী শক্তির সমর্থনও লাভ করে। যাহোক, সাংবিধানিক অচলাবস্থার অমীমাংসিত ইস্যুতে ঘোষিত শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা শুরু করেন। কয়েকদফা আলোচনার পর রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষনা আসে যে আলোচনার অগ্রগতি হচ্ছে। রাজনৈতিক অচলাবস্থার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনায় বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ ও গণতান্ত্রিক শক্তি স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে এবং তারা দু’একদিনের মাঝে রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আশা করছিল। জনগণকে বোঝানো হচ্ছিল যে মতৈক্যে পৌঁছানো গেছে ও প্রয়োজনীয় আইনী আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

আলোচনা চলাকালীন সময়েই, হঠাৎ করে ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের শেষ প্রহরে, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে এমন কোন ঘোষণা বা কোন চূড়ান্ত শর্ত না দিয়েই ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে বর্বরতা ও ত্রাসের সাম্রাজ্য স্থাপন করে যা মানব জাতির ইতিহাসে অতুলনীয়। ২৫শে মার্চের কালো রাতে বাংলাদেশের হাজার হাজার নির্দোষ জনগণ, যারা শান্তিপূর্ণ মীমাংসার উচ্চাশা ও সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বিছানায় গিয়েছিল, তারা পরদিন ভোরের আলোই দেখতে পায়নি। সর্বোচ্চ প্রতিক্রিয়াশীল কালো শক্তির দ্বারাও এতটা নগ্ন ও নোংরা বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা মানবতা আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা, ধরপাকড়, লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শহর-নগর ধ্বংস করছে।

সেনাবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম, গুরুত্বপূর্ণ বাজার, উপাসনালয়, ঐতিহাসিক স্থান, ব্যাঙ্ক, কোষাগার, গয়নাগাটি লুট করছে ও টাকা-গয়না সব পশ্চিম পাকিস্তানে চালান করছে। নিরস্ত্র নাগরিকের উপর আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, মেশিনগান, ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ, যুদ্ধ-জাহাজ, বোমারু-বিমান সবকিছু ব্যবহার করা হচ্ছে। আক্রমণটা বিশেষত আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা কল-কারখানার শ্রমিক, শহুরে দরিদ্র মানুষ, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিদের উপরে ছিল। কারখানার শ্রমিক ও অন্যান্য কর্মজীবি মানুষের আবাসস্থল বস্তি ও কুঁড়েঘরে আগুন দেয়া হচ্ছে আর যখন বাসিন্দারা দৌড়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে তাদেরকে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঝড়া করে দেয়া হচ্ছে। ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে ও শ্রমিকরা বেকার ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। কল-কারখানার শ্রমিক, কর্মচারী ও তাদের পরিবার পরিজনকে অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। দখলকৃত জায়গায় আর্মি ঘরে ঘরে তল্লাশী নিচ্ছে, মানুষজনকে ছুড়িকাঘাত করছে, গুলি করছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে, ধনসম্পদ লুট করছে। জনসম্মুখে মানুষজনকে গাছ থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে, অত্যাচার করে খুন করা হচ্ছে। নাৎসী স্টাইলে মানুষজনকে খুন করার আগে বাধ্য করা হচ্ছে নিজের কবর নিজে খুড়তে। দখলকৃত শহরের রাস্তাঘাট থেকে পথচারী তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ও সেনাবাহিনীর ব্লাডব্যাঙ্ক বানানোর জন্য তাদের শরীর থেকে জোরপূর্বক সব রক্ত শুষে নেয়া হচ্ছে। এই রক্তশূন্য মানুষকে তারপর পরিকল্পিতভাবে মেশিনগান দিয়ে গুলি করা হচ্ছে।

পাকিস্তানী আর্মি তাদের যাত্রাপথের রাস্তার উভয়পাশের সকল বাজার, গ্রাম পুঁড়িয়ে ফেলে ও গুলি করে নির্মমভাবে নিরস্ত্র মানুষকে খুন করে। যেসব শহর বা গ্রামে তারা ঢুকার সাহস করে না সেখানে তারা আকাশ থেকে বোমা ও গোলাবারুদ বর্ষণ করে পুঁড়িয়ে ছাই করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়।

দখলদারী বাহিনীর এ নিষ্ঠুর বর্বরতায় আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে ও বাধ্য হচ্ছে জীবন বাঁচানোর জন্য দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে। গণহত্যার ফলে ঘরবাড়ি, জমিজমা, বিষয়সম্পত্তি সবকিছু ফেলে কৃষিজীবি মানুষ বাধ্য হচ্ছে পালিয়ে যেতে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হল, হোস্টেলে গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে, আগুন দেয়া হচ্ছে, হাজার হাজার ছাত্র নিহত হচ্ছে। প্রসিদ্ধ বুদ্ধিজীবি, দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবীদকে তাদের সন্তানের সামনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

সংবাদমাধ্যম ও পত্রিকা অফিসে গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে, আগুন দেয়া হচ্ছে। শুধু ২৫শে মার্চ রাতেই কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা হয়েছে এবং এই গণহত্যা এখনও একইভাবে চলছে।

এসব ঘটনাবলী নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, সামরিক জান্তা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে, গণতন্ত্র স্থাপন ও আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত জাতিগত আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তৈরী ছিল না। ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা প্রকাশ্যে গণহত্যা হোক বা সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে রাখ করে, যেভাবেই হোক ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। দৃশ্যত, বাংলাদেশের আমজনতার উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা ও স্বায়ত্বশাসনের অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ জুড়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ তৈরী হয়। বাঙ্গালী সামরিক, আধা-সামরিক ব্যক্তিবর্গ, পুলিশ যারা খুন হবার পূর্বেই জনতার সাথে মিশে যেতে পেরেছিল তারা বাংলার মানুষকে সাহায্য করছে ও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ সসস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। বাংলাদেশের শ্রমজীবি জনতা বিগত তেইশ বছরের (শোষণ, দারিদ্র, দুর্দশা, নির্মম দমন পীড়নের বছর) তীক্ত অভিজ্ঞতা থেকে অনুধাবন করে যে, কায়েমী শক্তির শেষ অবলম্বন পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাত থেকে বাংলার জনতা মুক্তি না পেলে বৈষম্যহীন শ্রেণী স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে শ্রমজীবি মানুষ সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের সসস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করছে।

  “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার” নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে । এবং  শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও জনাব তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে ;একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছে। যেহেতু ডিসেম্বর ১৯৭০ এ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনগণ দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের পক্ষে রায় দিয়েছে, তাই এই সরকারই বাংলাদেশের একমাত্র আইনগতভাবে বৈধ সরকার।

অবস্থাদৃষ্টে বুঝা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের জনগণের ধ্বংসসাধন করার পরিকল্পনা আনেক আগে থেকেই নেয়া হচ্ছিল। ফ্যাসিস্ট আর্মি ও কমান্ডো ইউনিট তৈরী করে গণহত্যা, ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ, লুট ও ধর্ষণে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। রাষ্ট্রপতি যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন আর সময় সময়ে তিনি যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছিলেন সেগুলো আর কিছুই না শুধু সময়ক্ষেপণ ছিল যার আড়ালে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। আমরা ভাল করেই জানি শত্রুকে পরাজিত করতে আমাদের এক দীর্ঘ, সুসংগঠিত সসস্ত্র সংগ্রাম চালাতে হবে। আমরা জানি যে, সংগ্রামে বিজয়ী হতে হলে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্প্রদায়, সকল গণতান্ত্রিক শক্তি ও শান্তিপ্রিয় মানুষের নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন খুবই জরুরি। এটা উল্লেখ করতে পারা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক যে অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয় শক্তির সাথে সাথে বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠন ও নিপীড়িত জনতা আমাদের ন্যায্য উদ্দেশ্যে সমর্থন জানিয়েছে ও পাকবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত নিষ্ঠুর কর্মকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে।

বাংলাদেশের শ্রমজীবি ও সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে বিশ্বের শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে ও বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি শ্রেণী ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের কাছে আমাদের আবেদনঃ

১. বিগত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার আপামর জনতার দ্বারা নির্বাচিত একমাত্র আইনগতভাবে গঠিত “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” এর সরকারকে মেনে নিতে নিজ নিজ দেশের সরকারকে রাজি করানো। এই সরকারের প্রতি বাংলার জনতা অকুন্ঠ সমর্থন ও আনুগত্য প্রকাশ করেছে। কতিপয় ধুলিস্মাৎ হয়ে যাওয়া শহর বাদে সমগ্র বাংলা জুড়ে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

২. বাংলার সরকার ও সংগ্রামী জনতাকে নৈতিক ও বৈষয়িক উভয় সাহায্য প্রদান করা ও নিজ নিজ দেশের সরকারকেও তা করার জন্য রাজী করানো;

৩. গণহত্যা বন্ধ করতে জনমত সংগঠিত করা ও পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সরকার ও সেনাবাহিনীর উপর চাপ তৈরী করা;

৪. পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে যুদ্ধসামগ্রী সরবরাহ, বহন, বোঝাই বা খালাসে প্রত্যাখ্যান করার জন্য নিজ নিজ সরকারকে রাজী করানো

বর্বর পাকিস্তানী সামরিক শাসনে মানবসভ্যতা গভীর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। মানবতার এখন শুধু দুইটা বিকল্প আছে, হয় সে এই গণহত্যা, ধ্বংস ও নিষ্ঠুরতার নিরব দর্শক হয়ে থাকবে যখন গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা পদদলিত হচ্ছিল, যখন বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতার জন্মাধিকার, তাদের আশা-আখাঙ্খা গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল ও প্রতিক্রিয়াশীল কালো শক্তিকে উৎসাহিত করা হচ্ছিল, অথবা শান্তি, প্রগতি, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার শক্তিগুলোকে একত্রিত করতে ও বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত উদ্দেশ্যকে সমর্থন করতে বিশ্ববাসীর বিবেককে আহবান করা যাতে করে পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সামরিক জান্তাকে বিপর্যস্ত করা যায় ও পৃথিবীর সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে শিক্ষা দেয়া যায় যে বিশ্বের জাগরিত জনতা এসব বর্বরতা একদম বরদাস্ত করবে না।

আমাদের সামান্যতম সন্দেহ নেই যে, আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিশ্বের শ্রমজীবি জনতা অবশ্যই এই উদ্দেশ্যে মাথা তুলে দাঁড়াবে ও বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে বিশ্বের শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শক্তিকে একত্রিত করবে।

বন্ধুরা, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে আপনাদের সাহায্য সহযোগিতায় আমরা শেষ পর্যন্ত শত্রুকে ছত্রভঙ্গ করে বাংলার পবিত্র মাটি থেকে দখলদার বাহিনীকে তাড়াতে সক্ষম হব।

হাজার হাজার শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না, যাবেও না। বিজয় আমাদের হবেই।

  “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” দীর্ঘজীবী হোক।

আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী শ্রেণীর ভ্রাতৃত্ব দীর্ঘজীবী হোক।

সমগ্র পৃথিবীর শান্তি, সমৃদ্ধি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শক্তিগুলোর একতা ও ভ্রাতৃত্ব দীর্ঘজীবী হোক।

 

ভ্রাতৃত্বপূর্ণ শুভেচ্ছাসহ

বাংলাদেশ “ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার”

১. সাইফুদ্দিরি আহমেদ মানিক, আহবায়ক, টিইউসি, সভাপতি, লতিফ বাওয়ানী জুট মিল শ্রমিক ইউনিয়ন, ঢাকা, বাংলাদেশ।

২. মনজুরুল আহসান, সভাপতি, উজালা ম্যাচ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ও সাধারণ সম্পাদক, হোটেল ইন্টার-কন্টিনেন্টাল ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, ঢাকা।

৩. আহসানউল্লাহ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, বন্দর শ্রমিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম।

৪. লুৎফুর রহমান, সভাপতি, কাঞ্চন আঞ্চলিক শ্রমিক ইউনিয়ন, ঢাকা।

৫. শামসুজ্জোহা, সদস্য, রেলওয়ে ওয়ার্কার কর্মী পরিষদ, বাংলাদেশ।

৬. আলমগীর কবির, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী ইউনিয়ন, ঢাকা, বাংলাদেশ।

Scroll to Top