বাংলার সংগ্রামী জনতা প্রস্তুত
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
মোহাম্মদপুর কলোনীর একমুঠো মাটি একটা কাগজে মোড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে টেবিলের ওপর। কালচে মাটি। রক্ত আর মাটি মিশে জমাট বেঁধে গেছে। কার রক্ত? হয়তো মুনীর চৌধুরী কিংবা ডাঃ ফজলে রাব্বির। ডাঃ আলীম চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, গোলাম মোস্তফা, সিরাজউদ্দিন হোসেন খানকার রক্ত মিশে আছে এ মাটিতে? জানিনে। হয়তো সকলের রক্তই মিশে একাকার হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বরতার জঘন্যতম নিদর্শন। বুদ্ধিজীবীদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বিশ্বমানব ঘৃণায় শিউরে উঠেছে; বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গেছে তাদের কণ্ঠ। মোঙ্গল হালাকু খাঁ বাগদাদ আক্রমণ করেছিলো। বাগদাদের রাজপথে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েও তার তৃপ্তি হয়নি। আব্বাসীয় খলিফাদের যুগ যুগ ধরে সযত্নে সঞ্চিত গ্রন্থাগারে আগুন দিয়ে বহ্নি-উৎসব করেছিলো। রাশি রাশি পোড়া গ্রন্থের ছাই ইউফ্রেটিস নদীর জল কালো করে দিয়েছিলো। ৮০০ বছর পর ঢাকার বুকে বিংশ শতাব্দীর হালাকুরা যে ঘটনা সংঘটন করলো তাতে অতীতের হালাকুও লজ্জা পেতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শরিক। কারাবরণ করতে হয়েছিলো তাঁকে। ফজলে রাব্বি বিখ্যাত হৃদরোগ চিকিৎসক, ডাঃ আলীম চৌধুরী চক্ষুরোগ বিশারদ, সন্তোষ ভট্টাচার্য ইতিহাসের অধ্যাপক, সাংবাদিক মোস্তফা, নজরুল, কেউই রেহাই পেলো না। বাংলাদেশের মাটিকে, বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসার এবং পণ্ডিত বুদ্ধিজীবী হবার চরম খেসারত দিতে হলো তাঁদের। থোকা থোকা রক্তে বাংলা মায়ের পায়ে আলপনা একে গেলেন তাঁরা।
বাংলাদেশের বিগত চব্বিশ বছরের ইতিহাস এক রক্তাক্ত ইতিহাস। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য বাংলাদেশের জনতার রক্তদানের ইতিহাস। ১৯৫০ সালে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের খাপরায় সামান্য মানবিক দাবী আদায়ের জন্য আনোয়ার, হানিফ, কম্পরাম এদের সাতজনকে প্রাণ দিতে হলো। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবী করার অপরাধে স্বৈরাচারী পাকিস্তানী শাসকচক্রের সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হলো বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারদের। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল আন্দোলনে বাস কর্মচারী ওয়াজিউল্লা প্রাণ দিলেন। ১৯৬৬ সালে ছয়-দফা দাবী, বাংলার স্বাধিকার দাবিতে আবার কৃষকশ্রমিকের বুকের খুনে লাল হলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, টঙ্গীর মাটি। ১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এবং ১১-দফার দাবীতে আসাদ, ডাঃ শামসুজ্জোহামতিউর, রোস্তম এমনি শত শত লোক বুকের রক্তে দেশমাতৃকার তর্পণ করলেন। ১৯৭১ সালে স্বৈরাচারের অবসানের জন্য আবার শুরু হলো প্রাণ বলিদান পর্ব। ফারুক, ইকবাল, পাবনার এ্যাডভোকেট আমীরুদ্দীন, যশোহরের মসীউর রহমান, রাজশাহীর বীরেন সরকার, ঢাকার ডক্টর মনিরুজ্জামান, ডঃ গোবিন্দ দেব, ডাঃ ফজলে রাব্বি, ডাঃ আলীম চৌধুরী এমনি লক্ষ লক্ষ লোকের বুকের রক্তে বাংলার মাটি আজও ভেজা। একটা অপূর্ব গৌরবোজ্জ্বল রক্তদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা বাংলাদেশের পবিত্র মাটিকে শত্রুর কলুষ স্পর্শ থেকে মুক্ত করেছে।
বিগত চব্বিশ বছরে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়েছে। সেই মহান অপূর্ব সংগ্রামের পরিণতি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনতার চূড়ান্ত বিজয়, আজকের গণজপ্রতান্ত্রী বাংলাদেশ। বাংলার মাটি শত্রুমুক্ত হবার সংগে সংগেই বাংলাদেশের জনতার সংগ্রামের অবসান হয়েছে- এই চিন্তা ভ্রান্তিমূলক। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনতা আজ এক কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এই সংগ্রাম হলো দেশ পুনর্গঠনের সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর হানাদাররা বিগত নয় মাসে সুপরিকল্পিত উপায়ে একদিকে যেমন বাংলাদেশের মনীষা এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের সর্বত্র এক প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা চালিয়ে সোনার বাংলাদেশকে আপাত-শ্মশানে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, ছাত্রাবাস, হাসপাতাল, কলকারখানা এবং হাজার
হাজার বাড়ি তারা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। আত্মসমর্পণ করবার প্রাক্কালে বাংলাদেশের ব্যাঙ্কগুলো লুট করে সমস্ত টাকা পুড়িয়ে দিয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সমগ্র পাকিস্তানের Gold Reserve রাখা হতো করাচী ষ্টেট ব্যাঙ্কে। বাংলাদেশের ব্যাঙ্কে কোন স্বর্ণ রক্ষিত হতো না। এর অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ সদ্যজাত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে বৈদেশিক বাণিজ্য এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন। যে কোন দেশের অস্তিত্ব এবং সমৃদ্ধির জন্যে স্বর্ণের একান্ত প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধান শুধু বাংলাদেশ সরকারের একার হাতে নিবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের যে সাড়ে সাত কোটি জনতা তাদের অতুলনীয় দেশপ্রেম এবং নিষ্ঠার দ্বারা বাংলার মুক্তি অর্জন করলো, সেই সাড়ে সাত কোটি জনতাকেই আজ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ কঠিন সমস্যার সমাধানে অগ্রসর করবে। আর এ কথাও জানা যে, বাংলার সংগ্রামী জনতা এককণ্ঠে সেই দাবীর প্রতি জানাবে তাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা। প্রস্তুত সংগ্রামী বাংলার সংগ্রামী জনতা। জয় বাংলা।
(গাজীউল হক রচিত)