শিরনাম | সূত্র | তারিখ |
২৩। বাঙালি যোদ্ধাদের সাথে | নিউইয়র্ক টাইমস | ১৪ই এপ্রিল ১৯৭১ |
হাসান মাহবুব
<১৪, ২৩, ৫৪–৫৬>
দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস, ১৪ই এপ্রিল ১৯৭১
“বাঙালি যোদ্ধাদের সাথে”
যখন কেন্দ্রীয় সরকার, যা পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্বে রয়েছে, ধারাবাহিক ভাবে প্রচার করে যাচ্ছে- পশ্চিম পাকিস্তানের পরিস্থিতি শান্ত এবং অবস্থা স্বাভাবিকের দিকে ফিরে যাচ্ছে, তখন সরেজমিনে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা গিয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতে প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছিলো প্রতিটি সেক্টরে লড়াইয়ের খবর। দলে দলে স্বাধীনতাকামী পূর্ব পাকিস্তানীরা শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল হয় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে অথবা মুক্তিবাহিনীর দলে যোগ দিতে, হাজারো শরণার্থী তাঁদের যৎসামান্য সম্বল নিয়ে যাচ্ছিল কাঠের বাক্সে এবং ট্রাংকে করে।। ইন্ডিয়া নামক দেশটি তখন তাদের কাছে এক টুকরো স্বর্গ।
পাকিস্তানী সৈন্যরা তখন তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে সবুজ বাংলার বুকে। মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেকাতে এবং লুকানোর ব্যাবস্থা বন্ধে জ্বালিয়ে দিচ্ছে ঘরের পর ঘর, গ্রামের পর গ্রাম। শুকনো তালপাতা, ঘাস আর খড় থেকে মৃত্যুগন্ধী ধোঁয়ার আস্ফালন। আকাশ থেকে শকুনেরা নেমে এসেছে। এপ্রিলের এই সময়টায় সবচেয়ে উপদ্রুত অঞ্চল ছিলো কুমিল্লা। পাকিস্তানী হায়েনাদের সাথে সঙ্গত করেছে শেয়াল-কুকুরেরা। জীর্ণ কৃষকের রুগ্ন শরীরের উচ্ছিষ্ট দিয়ে চলছে মহাভোজ, দু তরফ থেকেই।
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ঠিক কতজন শহীদ হয়েছে তার পুঙখানুপুঙ্খ তথ্য দেয়া অসম্ভব, তবে নির্ভরযোগ্য সামরিক সূত্র গুলি মোটামুটি একমত যে সংখ্যাটা ২০ হাজার থেকে ১ লক্ষ হবে। কিছু কিছু রিপোর্ট আরো বেশি সংখ্যার কথা বলে।
পূর্ব পাকিস্তানের চলমান ঘটনা অনুসন্ধান করতে বিদেশী সাংবাদিকদের অফিশিয়ালি বাধা দিয়ে যাচ্ছিলো পাকিস্তানী কেন্দ্রীয় সরকার। তবে মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রত্যন্ত এলালাকা গুলো (যা কিনা প্রায় সময় পাক আর্মির আক্রমণের স্বীকার হত) থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ মতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের এবং রাজনৈতিক নেতাদের মেরে ফেলেছে এবং এই প্রদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি চূর্ণ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে মুক্তিসংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য।
সরাসরি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে যুক্ত থাকুক আর না থাকুক- সামরিক নির্দেশে, পাকিস্তানি আর্মি যার পুরোটাই এখন পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার এবং সৈন্য দ্বারা পূর্ণ- ছাত্র, বুদ্ধিজিবি, প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, এবং অন্যান্য নেতৃত্য দেওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যাক্তিদের হত্যা করেছে।
২৫শে মার্চের আর্মি অভিযান শুরু হবার পর থেকে, সামরিক আক্রমণ এবং মৃত্যু দন্ড এই দুইয়ের মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের আর্মি অফিসার এবং সৈন্যদের মেরে ফেলেছিল যারা কিনা পালিয়ে গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিতে ব্যার্থ হয়েছিল। বেশিরভাগ অফিসারের পরিবারের সকলকে মেরে ফেলা হয়েছে, তাঁদের মাঝে অল্প কিছু মানুষ পালাতে সক্ষম হয়েছেন।
পদাতিক বাহিনীর পাশাপাশি বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীও ছিলো সমান সক্রিয়। খাদ্যের গুদাম, চায়ের কারখানা, পাটকল, প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র; বেছে বেছে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তি গুলোকে তারা গুড়িয়ে দিয়েছে।
“এই যুদ্ধ দেশটাকে ইতিমধ্যে ২৫ বছর পিছিয়ে দিয়েছে”- একজন স্কটিশ চা বাগানের ব্যবস্থাপক এমনটাই বলেছিলেন। যে কিনা দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে তার আবাদি এলাকা থেকে ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে ঠেকাতে রাস্তাঘাট, রেললাইন এবং ব্রিজ উড়িয়ে দিচ্ছিল, তাতে করে যদি মুক্তিবাহিনী জয় লাভ করেও, তাঁদের শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকেই” তার বচনে ছিলো এমনই কঠিন বাস্তব নৈরাশ্য।
পূর্ব পাকিস্তানে তখনও অবস্থানরত তাদের পরিবারের লোকেদের উপর হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় এই স্কটিশ ভদ্রলোক, এবং তার সাথে পালিয়ে আসা আরও দুজন চা-বাগান ব্যাবস্থাপক তাদের নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করেন।
এই তিনজন ব্যাক্ত করেন যে, ভারত থেকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ নিয়ে ৯টি ট্রাকের কনভয় পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করা এবং পরে পাকিস্তানি বিমান হামলায় তা ধ্বংস হবার যে খবর পাকিস্তান রেডিও প্রচার করছে তা প্রকৃত পক্ষে ছিল একটি চা বাগানের আঙিনায় দাড় করানো ৯টি খালি ট্রাকের সমন্বয়।
বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করে যে আনুমানিক শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ মানুষ রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা ছেড়ে চলে গেছেন। এমন কি উপশহর বা মফস্বল গুলিও ফাঁকা হয়ে গেছে। এ সময় ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে পনের লক্ষ, চট্টগ্রামের আনুমানিক ৪ থেকে ৫ লক্ষ, এবং কুমিল্লার ১ লক্ষ।
পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব অংশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভারি আর্টিলারির প্রচণ্ড আঘাতের তীব্র শব্দ প্রতিদিনই, নিয়মিত ভাবে, প্রতিটি সেক্টরে শোনা যাচ্ছে। সংখ্যায় এবং অস্ত্রে পিছিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিটি গেরিলা আঘাত বা লাঞ্ছনার পর পাকিস্তানি আর্মি তাদের অক্ষম ক্ষোভ সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করে মেটাচ্ছিল।
‘কাপুরুষের দল!’ এমনটাই সম্বধন করেন একজন তরুণ বাঙ্গালী লেফটেন্যান্ট। তিনি তখন পালিয়ে এসেছিলেন কুমিল্লা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে যখন পাকিস্তানি আর্মি তাঁর ব্যাটেলিয়নকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তিনি বলেন-‘আমরা ওদের (পাক আর্মি) আমাদেরকে গুলি করার সুযোগ দিয়েছিলাম। আমরা ইউনিফর্মে ছিলাম। কিন্তু ওরা আমাদের না মেরে সাধারণ মানুষের উপর গুলি চালালো।‘
মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র ছিলো না, গোলা-বারুদ ছিলো না, ছিলো না যান-বহন এবং দক্ষ ও প্রশিক্ষিত নের্তৃত্ব। তাদের অনেকেই চলতেন খালি পায়ে!
তাদের কাছে ভারী অস্ত্র বলতে ছিলো তিন ইঞ্চি মর্টার, এবং কিছু ছিনিয়ে নেওয়া ভারী বন্দুক। অপরদিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে ছিলো অত্যাধুনিক জেট-ফাইটার বম্বার, গানবোট এবং আরো ভারী গোলাবারুদ। এগুলোর যোগানদাতা ছিলো আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চিন।
পাকিস্তান দাবী করছিল যে ভারতের সরকার থেকে নিযুক্ত সৈন্যবাহিনী এসে পাকিস্তানে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তবে এই প্রতিবেদক তেমন কিছুই কখনও প্রত্যক্ষ করেন নি।
কিছু পুরোনো এনফিল্ড এবং গ্রান্ড রাইফেল এবং কিছু মেড ইন চিনা রাইফেল এবং ম্যাশিনগান কব্জা করে অথবা অপ্রতুল উৎস থেকে সংগ্রহ করেই লড়ে যাচ্ছিলো মুক্তিযোদ্ধারা।
পাকিস্তান আর্মির ৩ লক্ষ সৈন্যের মাত্র ১০ভাগ ছিল বাঙ্গালী। তাঁদের প্রায় সকলেই যারা প্রথম দিকের হত্যাযজ্ঞ থেকে পালাতে পেরেছিলেন মুক্তিবাহিনীতে এসে যোগ দেন এবং তাঁরাই মুক্তিবাহিনীর একমাত্র প্রশিক্ষিত অংশ।
এ পর্যন্ত হাতে পাওয়া সংখ্যা গুলো নির্দেশ করে যে এই বাহিনীর (মুক্তিবাহিনী) কেন্দ্রে রয়েছেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ হাজার জন সদস্য যারা পূর্বে ছিলেন নিয়মিত বাহিনী রূপে। ৯ হাজার জনের মত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সদস্য, যারা পূর্বে একটি প্যারা মিলিটারি বাহিনী হিসেবে ছিলেন এবং মূলত ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পাহারা দিতেন।
মুক্তিবাহিনীর বাকি ফোর্স সংগঠিত করা হয়েছিল পুলিশ, সামান্য ট্রেনিং পাওয়া লোকাল মিলিশিয়া এবং একদম নতুন সদস্য দ্বারা।
রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হবার পূর্বে, ইস্ট পাকিস্তান আর্মির পূর্ব পাকিস্তানে ২৫ হাজার সৈন্য ছিল। বিপুল সংখ্যক নতুন সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উড়িয়ে আনা হয়, যা ছিল (পশ্চিম পাকিস্তান) পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার মাইলের ভারতীয় এলাকা দারা বিভক্ত।
কিছু অনুমান থেকে ধারণা করা হয় পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য সংখ্যাটি ছিল প্রায় ৬০ থেকে ৮০ হাজার এর মত যাদের বেশির ভাগ ছিল পাঞ্জাবী এবং পাঠান। পাঞ্জাবীরা বিশেষত ঐতিহ্যগত ভাবে বাঙ্গালীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত যদিও তারা উভয়েই মুসলমান ছিল।
যদিও একজন গেরিলা যোদ্ধার কাছে গড়পড়তা ৩০ থেকে ৪০ রাউন্ড আমুনিশন থাকত, তবুও তাঁরা ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, বেশীরভাগ সময় এর কারণ ছিল পাকিস্তানি আর্মি দ্বারা পরিবারের কোন সদস্য নিহত হওয়া বা কখনও একদম সবাইকে হারানো।
‘ওরা আমাকে এতিম করেছে,’ একজন মুক্তিযোদ্ধা একথা বলেন।
যার চোখগুলো ছিল তাঁর অন্যান্য কমরেডদের মতই অপলক এবং স্থির। দেখে মনে হচ্ছিল যা হচ্ছে তাঁরা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। ‘আমার জীবনের এখন আর কোন প্রয়োজন নেই’।
এর দু দিন আগেই কুমিল্লার প্রান্তদেশে, ইন্ডিয়া সীমান্তের এক মাইলেরও কম দূরত্বে জ্বলছিলো গ্রামাঞ্চল। বিমান ঘাঁটির পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে সবগুলো গ্রাম জ্বালিয়ে দেবার পরিকল্পনা ছিলো তাদের। এ চিত্র শুধু কুমিল্লায় না, ছিলো দেশের সবখানেই।
পাকিস্তানি সৈন্যদের জব্দ করতে, ৩২ বছর বয়সী গেরিলা কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এই এলাকায় দশ সদস্যের একটি দল পাঠান। এই সংবাদদাতা তাঁদের সাথে যুক্ত হন, তাঁদের তিন জন সদস্যের পায়ে কোন জুতো ছিলো না।
ধান ক্ষেতের সুবিধা নিয়ে দলটি পাকিস্তানি সৈন্যদের ২০০ গজের ভিতর পৌছে যান, যারা (পাকিস্তানি সৈন্য) তালপাতার ঘরে ফসফরাস গ্রেনেড ছুড়ে মারছিল। বাঙালীরা, যাদের কাছে ছিল কিছু চাইনিজ অটোম্যাটিক অস্ত্র, গুলি করে দিল। সাথে সাথেই পাকিস্তানি সন্যরা পালটা গুলি করা শুরু করল। প্রায় ২০ মিনিট ধরে নিরবচ্ছিন্ন গুলি বিনিময়ের পর বাঙালীরা পিছু হটে একটা বাধের আড়ালে নিরাপদে অবস্থান নিল।
গেরিলা দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছিলো দুর্বল এবং কখনও কখনও বলতে গেলে ছিলোই না। বাঙালীরা এখন নিষ্ঠার সাথে গেরিলা কার্যপদ্ধতি রপ্ত করছে যখন পাকিস্তানি আর্মি বেশীরভাগ বড় শহর, ক্যান্টনমেন্ট এবং বিমান বন্দরের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে সৈন্যরা (পাকিস্তানি) গ্রামের দিকে আক্রমণ পরিচালিত করছে এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রিত শহর গুলোর মাঝে যাত্রিক যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছু যোগাযোগের চেষ্টা সফল হয়েছে কিন্তু সবগুলো নয়, কারণ গেরিলারা প্রায় নিয়মিত ভাবে রাস্তা, পানির লাইন এবং রেল লাইন কেটে দিতে সামর্থ হচ্ছে।
-সিডনি এইচ শ্যানবার্গ