শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৫১। বাঙ্গালি শরণার্থীঃ দুঃখের শেষ নেই | টাইম | ২১ জুন, ১৯৭১ |
<১৪, ৫১, ১০৮-১১০>
টাইম ম্যাগাজিন। ২১ জুন, ১৯৭১
বাঙ্গালি শরণার্থীঃ দুঃখের শেষ নেই
একটি ঘুর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একটি গৃহযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে প্রায় আরও ২ লাখের বেশি। দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে এবং আরও বাড়ছে। কলেরা ঠিক মত শুরু হবার আগেই কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৫ হাজার জীবন। মোসাইকের দিনগুলিতে প্লেগের আক্রমণের মত কিছু না ঘটলে এই ঘটনা বাইবেলে উল্লেখিত কষ্টের কাহিনির সাথে অনেকটাই মিলে যায়। এটা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিপর্যয়ের তালিকা আস্তে আস্তে আরও বড় হবে। গত সপ্তাহে নতুন করে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখের মত উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করছে এবং তাদের মুখে মুখে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর ছড়িয়ে পরছে। এছাড়াও ভারতের পাঁচটি প্রদেশের সীমান্তে ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর চাপে শরণার্থী শিবিরগুলোতে দুর্গন্ধ এবং দুর্ভিক্ষ ও অন্যান্য মহামারীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শরণার্থীদের ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয় মার্চে যখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধ্বংস করে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যখনই পাকিস্তানি দুঃসাহসী পাঠান ও পাঞ্জাবি বাহিনীর সাথে বাঙ্গালি মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয় তখনই প্রায় ১৫ লাখ পূর্ব পাকিস্তানি- হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে দেশ ছেড়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও বিহার প্রদেশে আশ্রয় নেয়। পালিয়ে যাওয়া মানুষের বেশিই হিন্দু এবং তারা অত্যাচার, ধর্ষণ ও বেপরোয়া হত্যাকাণ্ডের কাহিনী বর্ননা করছে। নতুন শরণার্থীদের মতে পাকিস্তান সরকার সদ্য অবৈধ ঘোষিত হওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পাকিস্তানের ১ কোটি হিন্দুদের (মোট জনসংখ্যা ৭.৮ কোটি) দোষারোপ করছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে গৃহবন্দি থাকা মুজিবকে সত্যিকার অর্থেই হিন্দুরা অন্ধসমর্থন দেয়। যা মুসলিমরাও দেয়, যার ফলেই গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের ১৬৭ টি তে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়ায় আক্রমনের তুলনামূলক সহজতর লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে মেরে ফেলা হচ্ছে
একজন হিন্দু ঠিকাদার বর্ণনা করেছেন কিভাবে একটি চা বাগানে এসে জিজ্ঞেস করেছে নির্বাচনে কাদের ভোট দিয়েছিল। আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে কথা স্বীকার করায় তারা প্রায় ২০০ জনকে গুলি করেছে। ভারতের আগরতলায় এক হাসপাতালের ডাক্তার খুব বাজে ভাবে দগ্ধ রোগীদের সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। ডাক্তার জানান, শরণার্থীদের জোরপূর্বক একটি কুঁড়েঘরে ঢুকানো হয় এবং সেনাবাহিনী সেই কুঁড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এছাড়াও হাসপাতালটিতে ৩৭০ জন গুলিবিদ্ধ পুরুষ, নারী ও শিশুকে সেবা দিয়ছে যাদের মধ্যে ১৭ জন মারা গিয়েছেন।
পশ্চিম বঙ্গ-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের পেট্রাপোলের শরণার্থীশিবিরে এক ষোড়শী বলছিল কিভাবে সে ও তার বাবা-মা ঘুমিয়ে ছিল, “তখনই আমরা বাইরে পায়ের শব্দ পেলাম। দরজা একরকম ভেঙে ফেলেই আমাদের ঘরের ভিতরে কয়েকজন ঢুকে পরে। তারা আমাদের গোলায় বেয়নেট তাক করে রাখে এবং আমার চোখের সামনেই আমার মা-বাবাকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে নেরে ফেলে। আমাকে মেঝেতে ফেলে দেয় এবং তাদের মধ্যে তিনজন আমাকে ধর্ষণ করে।”
ত্রিপুরা ক্যাম্পে থাকা আরেক বালিকা বলছিল কিভাবে সে পালিয়ে আসার আগে ১৩ জন পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা পাশবিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েছিল। পলায়নকৃত পরিবারের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তাদের পরিবার মুক্তিপণ দিতে না পারলে সৈন্যদের কাছে পতিতা হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে।
সীমান্ত ঘুরে যাওয়া এক কর্মকর্তার দেয়া তথ্য মতে পাকবাহিনী ও তাদের হিন্দুবিরোধী সমর্থকগোষ্ঠী পূর্বপাকিস্তান ছাড়ার আগে জনপ্রতি ১৪০ ডলার করে দাবি করছে। নিজের স্ত্রীর মুক্তিপণ হিসেবে দাবীকৃত অর্থের মাত্র ২৫ ডলার কম থাকায় একজন দাবি করেন ‘বাকি টাকা আমাকে মেরে উসুল করে নিন’। মারতে মারতে একটা চোখ উপড়ে ফেলার পরেই তারা সেই লোক ও তার স্ত্রীকে যেতে দেয়।
যারা পালিয়ে গিয়েছে তারা গয়ার ‘ডিজাস্টার অব ওয়ার’ এর উদাহরণ হতে পারে। যাদের ভাগ্য ভাল ছিল তারা আগেই পরিপূর্ণ তাবু গুলোতে আশ্রয় নিয়েছে যেগুলো আগে থেকেই কস্টিক সোডা ও মানুষের মলমূত্রের গন্ধ এবং গোড়ালি সমান গত বর্ষার ময়লা পানিতে ভর্তি। ভারী বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে বেশিরভাগই গাছ বা ঝোপের আড়ালে আশয় নেয়। অনেকে কোনমতে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলগুলোর বারান্দায় একটু জায়গা খুঁজে নেয়। অন্যরা যারা কলকাতার কাছাকাছি আছে তারা বড় ড্রেনের পাইপের ভিতরেই ঠাই নিয়েছে। তাদের চতুর্দিকেই এখন দুষিত পানি, রোগবালাই আর মৃত্যু।
প্রতীকী শবদাহ
দুষিত খাবার পানি, পরিচ্ছন্নতার অভাব ও লাখ লাখ শরণার্থীদের সবাইকে কর্তৃপক্ষ টীকা দিতে না পারায় কলেরা ছড়িয়ে পরছে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। কলেরা ভারত ও পাকিস্তানে খুবই পরিচিত একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যা মারাত্মক বমি ও ডায়রিয়া ঘটায় যার ফলে দেহে পানিশূন্যতা হয় ফলাফল প্রাণহানি। আক্রান্তদের ইনজেকশনের মাধ্যমে বা পানীয় হিসেবে প্রচুর পরিমানে লবণের দ্রবন, স্যালাইন ও গ্লুকোজ খাওয়ানো গেলে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু সেখানের মেডিকেল টিমের সামর্থ্যের তুলনায় শরণার্থীদের ঢল এত বেশি যে সবাইকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
শরণার্থীরা যেসব রাস্তা দিয়ে চলাচল করে সেগুলো শুধু ফেলে দেয়া কাপড় আর গৃহস্থালি পণ্যেই পূর্ণ না, এসবের সাথে যোগ হয়েছে কলেরায় মারা যাওয়া মানুষের লাশ যেগুলো তাদের পরিবার কলেরায় আক্রান্ত হবার ভয়ে সৎকার না করেই ফেলে গেছে। যদিও হিন্দুরা শবদাহ করে থাকে, কিন্তু বেশিরভাগ লাশের উপরেই মাত্র ২/৩ টা কাঠি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং বাকিটা রেখে দেয়া হয়েছে অপেক্ষায় থাকা শকুন কিংবা বন্য কুকুরে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যদিও কোন লাশ দাফন করা হয়, সেই লাশ মাংসাশী প্রাণীরা তুলে বের করে আনে। শরণার্থীরা যাতে লাশ নদীতে না ফেলে সে ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ সতর্ক রয়েছে। জনাকীর্ণ হাসপাতালগুলোতে অসুস্থ ও মৃতপ্রায় রোগীদের একসাথে জড়ো করে রাখা হয়েছে এবং হাসপাতালের কাজের চাপে জর্জরিত স্টাফরা সময় বের করে মৃতদেহ সরিয়ে নেবার আগ পর্যন্ত মৃতদের জীবিতদের সাথে রাখা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের একটি জনবহুল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৪৫ বছরের এক চাষি দেখছিলেন তার সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চা কিভাবে তার কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মায়ের বুক থেকে দুধ খাবার চেষ্টা করছিল। “আমার বউ মরে গেছে” খুব ক্ষীণ স্বরে লোকটা বলছিল “আমার বাচ্চারা মরে গেছে। আর কি হতে পারে?” রোগবাহী শরণার্থীরা যেভাবে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছে তাতে করে কয়েক লাখ ভারতীয় এই মহামারী রোগে যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে। একারণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানিদের কলকাতায় প্রবেশে বাঁধা দিচ্ছে যেখানে আগে থেকেই লাখ লাখ মানুষ নোংরা পরিবেশে বাস করে এবং মহামারী কলেরা সেখানে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানের মত।
অসম বিনিময়
যদিও ভারত সাময়িক সময়ের জন্য শরণার্থীদের রাখতে আপত্তি করেনি এবং তাদের সাধ্যমত সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তাদের সাহায্য করার জন্য কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এই দরিদ্র মানুষের এই ক্রমবর্ধমান ঢলকে শুধুই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ হিসেবেই দেখছে। শরণার্থী সমস্যাটা ভারতকে আগস্ট ১৯৪৭ এ উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হবার পর থেকেই পীড়া দিয়ে যাচ্ছে।
উত্তর ভারতে বিনিময়টা প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ, ৬০ লাখ মুসলিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে এবং প্রায় ৬৫ লাখ হিন্দু শিখ ভারতে প্রবেশ করছে। দেশ ভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৪৩ লাখ হিন্দু ভারতে পালিয়ে গেছে, বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গে। মুসলিমদের সেরকম কোন যাত্রা লক্ষ্য করা যায়নি। এই অসামঞ্জস্যের ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে চাঙ্গা করে তোলে যার ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও তার রাজধানী কলকাতা মানবিক বিপর্যয়ের এক আস্তানায় পরিণত হয়।
শরণার্থীদের খাবার ও আবাসের ব্যবস্থা করতে প্রতিদিন প্রায় ১.৩৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে যা শ্রীমতী গান্ধীর সরকার বহন করতে পারবে না যদি এটি গত মার্চে ‘গরীবী হটাও’ প্রচারণায় করা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চেষ্টা করে। শরণার্থীদের রোজকার খাবারের চাহিদা বর্তমান খাদ্য মজুদে ঘাটতি সৃষ্টি করছে এবং স্বয়ং ভারতীয়দের এক দুর্ভিক্ষের হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। শরণার্থীরা ভারতীয়দের কাজও কেড়ে নিচ্ছে; স্থানীয় শ্রমিকদের যে মজুরীতে ভাড়া নেয়া হত তার এক চতুর্থাংশে বিনিময়ে শরণার্থী চাষিদের কাজে নেয়া হচ্ছে।
জায়গার অভাব
এসব সমস্যার মুখোমুখি হয়ে ভারত সরকার শরণার্থীদের ‘উদ্বাস্তু’ বা ‘পলায়নকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে এবং আশা করছে’নিজেরাই গরীব রাষ্ট্র হওয়ায়’ তারা একসময় তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যাবে। পূর্ব ভারতের এক শরণার্থী শিবিরে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, “আমরা চাইলেও আপনাদের সারাজীবন এখানে রাখতে পারব না।” পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সম্ভাব্য গেরিলা যুদ্ধের মুখে তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব না। তাছাড়াও যুদ্ধ ও দেশ ত্যাগের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে বর্ষা মৌসুমের আগে শস্য রোপণের হার খুবই কম। দুর্ভিক্ষ আঘাত হানার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এবং যখন এটা হবে তখন আরও লাখ লাখ মানুষ তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাশের দেশে আশ্রয় খুঁজতে যাবে যেখানে আগে থেকেই থাকার জন্য জায়গার খুব অভাব।