মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারিত একটি ঘোষণা

শিরোনাম উৎস তারিখ
৭১। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণা মেজর জেনারেল এম. এ মঞ্জুরের ব্যক্তিগত নথি ১৯৭১

 

 

কম্পাইল্ড বাইঃ রানা আমজাদ

<১১, ৭১, ৫৩৪- ৫৩৫>

স্বাধীন বাংলাদেশের

সংগ্রামী জনগনের প্রতি উদাত্ত আহ্বান

 

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা এক হয়েছি। এক আওয়াজে মিলেছে সাত কোটি কণ্ঠঃ পশ্চিমা শোষণের অবসান চাই সোনার বাংলায়। তবু অগণতান্ত্রিক বেইমান ইয়াহিয়া খানের সামরিক চক্রের ষড়যন্ত্র আমাদের অধিকার দেয়নি, বাধ্য করেছে লড়াই-এর পথ বেছে নিতে।

 

খান নামে কুখ্যাত অমানুষ এই সেনা পিশাচেরা অত্যাচার চালিয়েছে শান্ত স্নিগ্ধ গ্রামের বুকে। আপনারা হাজারে হাজারে বেরিয়েছেন পথে। প্রথম দিন থেকে শহরে বেছে বেছে শিক্ষিত মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তারা। শহরে আজ জনমানুষ মেলা ভার- বলেছেন বিদেশী সাংবাদিকরা । সৈন্যবাহিনি এবং তাদের আওতায় স্বার্থান্বেষী স্থানীয় দালাল অত্যাচারীরা নির্বিশেষে তাদের মেরেছে। চেয়েছে সব কিছু নষ্ট করে দিতে। মাঠে ঘাটে পথের পাশে রয়েছে খানসেনার শিকার অগণন মানুষ। এরা সব আপনার-আমার আত্মীয়। যাঁরা বেঁচে তারা সবাই আজ পথে পথে। যাঁরা রুদ্ধ ঘরে লুকিয়ে তাঁদেরও ঘরে ঘরে হাহাকার।

 

আমরা চেয়েছি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টানের মিলিত বাংলা । শোষণের বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এরা সবাই। পশ্চিমী জঙ্গীশাহীর চুড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার মুখেও বঙ্গবন্ধু আমাদের সাবধান করেছিলেন “শত্রুর চরেরা আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও প্রাদেশিকতার জিগীর তুলবে।” চরম প্ররোচনার মুখেও তিনি জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল সাম্প্রদায়িক ও প্রাদেশিক সংখ্যালঘুদের ধনপ্রাণ ইজ্জত রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।

 

সারা পৃথিবির বিবেকবান মানুষের কাছে ইয়াহিয়া চক্রের অত্যাচার এবং তার বীভৎসতা যতই প্রকাশিত হচ্ছে ততই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনকে বিভ্রান্ত করার চরম হাতিয়ার হিসেবে সংখ্যালঘুদের উপর বিশেষ আক্রমণকে প্ররোচিত করছে জঙ্গীসেনা।এই নীতির তিন লক্ষ্য- (১) স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিভক্ত করা, (২) ভারতসহ অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা ও (৩) ভারত ও  পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এক কোটির অধিক সংখ্যালঘুর দায়িত্ব চাপিয়ে পর্যুদস্ত করা। এ জগন্য চক্রান্ত আমাদের বুঝতেই হবে। এবং এর জবাব চাই। এর জবাবে তৈরি দেশের রক্ষীরা, দেশের ছাত্ররা জোয়ানরা এগিয়ে আসুন। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ,খৃষ্টান- আপনাদের প্রতি অত্যাচার হয়েছে। আসুন সবাই মিলে তার জবাব দিই। “সাত কোটি মানুষেরে দাবিয়ে রাখতে পারবেনা”- বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সে অমর বাক্য সত্য হবেই। কি করে পারবে খান সেনা তাদের অপরিচিত এই সোনার দেশকে, বীর মায়েদের হাতে তৈরি সোনার টুকরো ছেলেদের চেপে রাখতে? এ অত্যাচার ভুলবে কে? আসুন মুক্তিফৌজে যোগ দিই, মুক্তিফৌজকে সাহায্য করি, মোকাবিলা করি এই সুসজ্জিত কিন্তু বর্বর শত্রুসেনার সঙ্গে।

 

তারপর আমরা ফিরে পাবো সেই হারানো বাংলাকে। বাংলাদেশ সরকার আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে নিঃস্ব হয়ে যাঁরা পথে দাঁড়িয়েছেন , এই অবস্থায় শেষে জেলায় জেলায় জমিজায়গা, ভিটেমাটি আপনারা নিশ্চয় ফিরে পাবেন। জমি যে হারিয়েছে সে ফিরে পাবে তাহার জমি। ঘর যার গেছে তাকে দশজন মিলে গড়তে সাহায্য করবে নতুন ঘর। মাঝি তার লুকানো নৌকা আবার বার করবে মুক্ত নদীর বুকে। জেলে ফিরে পাবে তার জাল। তাঁতী ফিরে বুনবে কাপড়। যে যার কাজে ফিরে যাবে।

 

বাংলাদেশ বেশিদিন শ্মশান থাকবে না। দিনে দিনে তার উন্নতি হবে অব্যাহত। কারণ আমাদের ধান পাট মাছ গুড় চিনি, আমাদের সোনাদানা, আমাদের চা কাগজ তামাক এখন থেকে আমরাই খরচ করব। আমরাই বিশ্বের দরবারে কেনাবেচা করবো আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ। খুব তাড়াতাড়ি তাই আবার ফিরে পাবো আমাদের সোনার বাংলাদেশ।আবার জাতি ধর্ম দলমত নির্বিশেষে বাঙ্গালী ফিরে পাবে তার সম্মান।  আর যে শ্মশান বাংলাদেশে এনেছে খানসেনা সেই শ্মশানে দাঁড়িয়ে মনে রাখুন আগামী এই সোনার বাংলার ছবি। জঙ্গীশাহীর কুৎসায় ভুলবেন না। মনে রাখবেন চরম শাস্তি হবে তার যে এই জঙ্গীশাহীর সঙ্গে হাত মেলাবে। জয় বাংলার আদর্শ , শেখ মুজিবুরের আদর্শ ভুলে তুচ্ছতা , নীচতা , সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে জঙ্গীশাহীর চরের কাজ করবে যে সে পাবে চরম শাস্তি – প্রাণদণ্ড।

 

-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

জয় বাংলা প্রেস , মুজিবনগর

Scroll to Top