যোগেশ বাবুর হত্যা কাহিনী

৭৬। যোগেশ বাবুর হত্যা কাহিনী (৪৮৩-৪৮৪)

যোগেশ বাবুর হত্যা কাহিনী

সুত্র -‘বাংলাদেশের গণহত্যা’, বাংলার বাণী বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২।

কেউ ভাবতে পারেননি যে যোগেশ বাবুকে

এভাবে হত্যা করা হবে

“শ্রী যোগেশ্চন্দ্র ঘোষ। একটি নাম। একটি ইতিহাস। দুঃস্থ অসহায় মানুষের কল্যাণে নিবেদিত একটি প্রাণ। তাঁর জীবনের একমাত্র ‘সাধনা ঔষধালয়’। যে ঔষধালয়ের বাংলাদেশ ছাড়াও সমগ্র বিশ্বজোড়া রয়েছে খ্যাতি। এমনি নব নব সৃষ্টির মাঝেই যোগেশ বাবু বেঁচে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই বাঁচতে পারেননি। বর্বর খান সেনাদের হাতে তাঁকেও প্রাণ হারাতে হলো। নরপিশাচদের হাতে অবসান হলো একটি অমূল্য জীবনের।

সহকর্মীদের সবাই সেই কালরাত্রিতে কোন গতিকে প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিল। প্রাণের মায়ায় পালাতে বাধ্য হয়েছিল তারা। শুধু যোগেশ বাবুর পোষা প্রিয় বানরটা তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। প্রভূর সমূহ বিপদের আশংকায় সেদিন বনের পশুটি পর্যন্ত চীৎকার দিয়ে ঘোষনা করেছিল বিপদ বার্তা। কিন্তু যোগেশ বাবু তেমনি রইলেন। পালানোর সামান্যতম চেষ্টাও করেননি তিনি। বিপদের আশঙ্কায় তিনি শঙ্কিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু আকস্মিক ভয়াবহ মৃত্যুর কথা বোধ হয় ভাবতে পারেননি।

 পঁচিশে মার্চ। ভয়াল বীভৎস রাত। এই দিন বাংলার বুকে নরপশু খান সেনারা যে হত্যালীলা চালিয়েছিল তার করুণ কাহিনী ইতিহাসের পাতায় কালো কালিতে বাঁধা থাকবে। রাজধানী ঢাকার সমস্ত শহরটা ভয়ে প্রকম্পিত। গ্রামে পালিয়ে যাচ্ছে নগরবাসী। সবাই পালাচ্ছেন- দূরে অনেক দূরে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। বর্বরদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার প্রত্যাশা প্রত্যেকের।

পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার অনেকেই এরই মধ্যে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সমস্ত এলাকার মাঝে শুধু একটি মাত্র বাড়ীই যেন একমাত্র প্রহরী। স্তব্ধ, নিঃঝুম পরিবেশ। বিরাট এলাকা জুড়ে একটা কারখানা সাধনা ঔষধালয়। সমস্ত বাড়ীটার প্রহরী যোগেশ বাবু। কারখানার নির্জন প্রকোষ্ঠে তিনি কাটিয়েছেন জীবনের সুদীর্ঘকাল। তাঁর একমাত্র সাধনাস্থল এই কারখানা। নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সাথী ছিল কারখানার শ্রমিকরা। দিন শেষে পড়ন্ত বেলায় শ্রমিকরা সবাই যখন একে একে চলে যেত, তখন রামপাল আর সুরুজ ছিল তাঁর একমাত্র সাথী।

 রামপাল ও সুরুজ কারখানার দারোয়ান। তারা দীর্ঘ সতের বছর ধরে বাবুর সাথে কাটিয়েছে। পঁচিশে মার্চের পর সবাই যখন একে একে চলে গেল- তখনও ওরা বাবুকে ছেড়ে যায়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ওরা তাঁর কাছে ছিল। রাত দুপুরে বাবু যখন উন্মনা হয়ে উঠতেন- তখন ওরাই ছিল তাঁর একমাত্র সাথী- নিঃসঙ্গ জীবনের দীর্ঘদিনের সহচর।

 আলাপ করছিলাম দারোয়ান দু’জনের সাথে। তখন সূর্যদেব সবে বিদায়ের তোড়জোড় করেছেন। আধো আলো আধো আঁধারের এক প্রকোষ্ঠের মধ্যে বসে কথা হচ্ছিল আমাদের।

 পঁচিশে মার্চের পরের ঘটনা। সম্ভবতঃ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ অথবা মাঝ শেষের দিক। সেই দুর্যোগ রাতের সঠিক তারিখ আজ নাকি ওদের কারো মনে নেই। স্মরণ নেই সেই ভয়াবহ তারিখের কথা।

 নিস্তব্ধ নগরী। রাত নিঃঝুম। সাধনা ঔষধালয়ের গেটে প্রহরারত দারোয়ান। রামপাল, ইউসুফ মিস্ত্রি, ভূমিসিংহ, সুরুজ সেই ভয়াল রাতের প্রহরী। সেই থমথমে পরিবেশে হঠাৎ একটি মিলিটারী জীপ এসে থামলো। তখন রাত দুপুর। পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র সৈনিক গাড়ী থেকে নামলো। তাদের সবার হাতে ভারী অস্ত্র। একে একে গেটের তালাগুলো আঘাতে ভেঙ্গে ফেললো ওরা। তারপর কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলী ছুড়লো। দোতলায় যোগেশ বাবু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। সুরুজ পাহাদারও সন্ত্রস্ত। বর্বরদের বিরুদ্ধে তার বন্দুকটা গর্জন করে উঠলো। পরপর কয়েক রাউন্ড গুলী ছুড়লো সে এলোপাতাড়ি। জল্লাদ খান সেনাদের উদ্যত রাইফেল গর্জিয়ে উঠলো। গুলীর মুহুর্মুহু আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা যেন ভঙ্গ হলো, সারা এলাকাটা যেন কেঁপে উঠলো। উভয় পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ হলো গুলী বিনিময়। সে রাতে খান সেনারা সুবিধা করতে পারলো না। সামান্য একজন অস্ত্রশিক্ষণীয় বাঙ্গালী পাহারাদারের কাছে পরাজিত হলো খান সেনারা। কি যেন ভেবে তারা পালিয়ে গেল।

 বাঙ্গালী বীর সুরুজ সেই স্মরণীয় রাতেই বাবুকে বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলেছিল। বাবু তখনও তার কথায় কর্ণপাত করেননি। ভেবেছিলেন হয়তো মরতে যদি হয়, জন্মভূমিতেই মরবো।

 পরদিন সকাল। রাতের সেই ভয়াবহ ঘটনা তখনো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে। সন্ত্রস্ত যোগেশ বাবু ও তাঁর ভীত সহকর্মীরা ঘটনাস্থল দেখতে নিচে নেমে এলেন। সকাল তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। যোগেশ বাবু নিচে নেমেছেন, সবে গত রাতে খান সেনারা যে ধ্বংসের স্বাক্ষর রেখে গেছে তা অবলোকন করছেন। এমনি সময়ে তিনটি মিলিটারী জীপ কারখানার সামনে এসে থামল। গাড়ীগুলো ভর্তি সশস্ত্র সৈনিক। খান সেনা বর্বরদের সাত-সকালে আগমনে বাবু আরো ভীত হয়ে উঠলেন। এক অজানা আশঙ্কায় মনটা যেন দমে গেল তাঁর। যদিও তিনি নাকি মৃত্যুকে ভয় করেন না। তাঁর সঙ্গী সাথী (সহকর্মীরাও) কেমন যেন মুষড়ে পড়লেন। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন তারাও। জল্লাদ খান সেনারা নিচে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করাল। বর্বরদের কয়েকজন যোগেশ বাবুকে নিয়ে উপরে গেল। উদ্যত রাইফেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ সেদিন কি বলেছিলেন কেউ জানতে পারেনি।

 এদিকে নিচে সবাই ভাবল এই হয়তো সময়। মোক্ষম সুযোগ। প্রথমে একটি বাড়ীতে সুযোগ বুঝে পালাল ওরা। হয়তো বর্বরদের চোখে পড়েনি। তাই সেদিন তারা কয়েকজন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল। কিন্তু একজন বাঁচতে পারলেন না। যিনি ভালবাসতেন এদেশকে। এদেশের মাটিকে। দেশের জনগণকে। যোগেশ চন্দ্র ঘোষ নিহত হলেন বর্বরদের নিষ্ঠুর সঙ্গীনের খোঁচায়। জল্লাদরা তাদের হিংস্র বেয়নেটের আঘাতে একটা অনন্য জীবনের অবসান এনে দিল।

 সাথীরা সেদিন সবাই প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিল সত্যি। কিন্তু ফিরে এসে তাদের মনিবকে পায়নি তারা আর। পরে বর্বর খান সেনারা চলে গেলে অনেকে এসেছিল। এসেছিল সহকর্মীরা। পাড়া-পড়শীরা। তাদের প্রানপ্রিয় যোগেশ বাবুকে একবার দেখতে। না, শ্রদ্ধাভাজন যোগেশ বাবুকে তারা আর দেখতে পারেনি। ওরা যখন দেখতে এসেছে ডোমেরা তখন যোগেশ বাবুর লাশ নিতে এসেছে।

 অবশেষে তাঁর দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হলো রান্নাঘরের মেঝেতে। উপুড় হয়ে পড়েছিলেন। বুকে তাঁর সঙ্গীনের(বেয়োনেটের) ক্ষত চিহ্ন। রক্ত ঝরার ধারা ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে। শুকনো কালো রক্তের মাঝে তিনি পড়ে আছেন। বর্বররা তাঁকে শুধু হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা বাবুর সারা জীবনের অর্জিত সকল ধন-সম্পদ নিয়ে গেছে লুণ্ঠন করে। “

Scroll to Top