রক্তে রাঙা ঈদ
শরীফ- দেখছিস ঐ ভাঙা বাড়িটার দেয়ালের ওপর দিয়ে, পোড়া গাছটার মাথা ছুয়ে ঈদের চাঁদ উঠেছে একফালি সরু চাঁদ।
কবীর – হ্যাঁ, অসংখ্য শহীদের বুকের পাঁজরার হাড় যেন চাঁদ হয়ে ফুটে উঠেছে আকাশের গায়ে। পড়িসনি- নজরুলের ‘কৃষকের ঈদ’?
শরীফ- নিশ্চয়ই পড়েছি। বাংলার নিঃস্ব শোষিত জনগণের মর্মকথাকে নজরুল প্রাণর্স্পশী ভাষায় ছন্দে প্রকাশ করেছেন –
জীবনে যাদের হররোজ রোজা
ক্ষুধায় আসে না নিদ
ক্ষুধাতুর সেই কৃষকের ঘরে
এসেছে কি আজ ঈদ?
কবীর – আমারও প্রশ্ন তাই রে- লক্ষ লক্ষ মানুষের লাশ বুকে নিয়ে সারা বাংলা যখন গোরস্থান- নির্যাতিত শিশু, নারী, বৃদ্ধার কান্নায় বাংলা যখন
ক্রন্দসী, মজলুম মানুষের ফরিয়াদে বিশ্বের বাতাস ভারাক্রন্ত তখন ঈদকে খুশির ঈদ বলে মোবারকবাদ জানাতে পাচ্ছি না।
শরীফ – তবু তো প্রকৃতির নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে না। রোজই সূর্য উঠছে ভোরকে রাত্রির কোল থেকে ছিনিয়ে আনতে। আবার সে সূর্য অস্ত
যায়, সন্ধ্যে আসে ছায়াভীরু পদক্ষেপে –
কবীর – কিন্তু আমরা কি আগের মত- সেই ভয়ংকর রাক্ষুসে রাত ২৫ শের পূর্বে, যেমন করে সকালের সূর্যের আলোয় নেয়ে উঠতাম- তেমনটা কি এখন পারি? সন্ধ্যা মায়াময় গন্ধ ছড়ায় না। একটা ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে ঐ অন্ধকারে গা ঢেকেই পাক হানাদাররা আমাদের আক্রমণ করেছিল- আজও করছে- দিন-রাতে আমরা সবসময়ই মৃত্যুর মুখোমুখি- শয়তানের সম্মুখীন।
শরিফ – জানি কবীর, আমরা তাই গতানুগতিকভাবে ঈদকে মোবারকবাদ জানাতে পারবো না, জানাতে পারবো না, তেমন করে খুশির ঢেউয়ে গা ভাসাতে পারবো না। কিন্তু তাই বলে ঈদ-উল ফিতর তো ফিরে যাবে না আমাদের দ্বার থেকে।
কবীর – না, ফিরিয়েও দিবো না আমরা- আমরা নতুনভাবে ঈদকে স্বাগত জানাবো। (নেপথ্যে মেশিনগানের শব্দ) ঐ শোন- গুলির শব্দ- সংঘর্ষ চলছে হানাদারদের সাথে মুক্তিবাহিনীর- (একটু হেসে) ঢাকায় ঈদের চাঁদ দেখলে ছোট ছেলেরা পটকা ফুটাতো উল্লাসে- আজকের পটকা ঐ গুলির আওয়াজ, বোমার আওয়াজ।
শরীফ – বেশ তো আজকের ঈদকে আমরা সম্বর্ধনা জানালাম বন্দুকের গুলি ছুড়ে, শপথ নিয়ে কসম খেয়েবাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে ঈদের প্রকৃত তাৎপর্যে খুশির বন্যা বইয়ে দেবো ঘরে ঘরে। আমাদের জীবনের ঈদকে যারা চির স্নান করে দিতে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়েছে, আমাদের মা বোনের ইজ্জত নিয়েছে তাদের পশুহস্তকে চূর্ণ করেই পালন করবো ঈদোৎসব।
মা – হ্যাঁ বাবা শরীফ, তোরা কি কেবল গল্প করবি? একটু কিছু মুখে দিবি না? ইফতার করেছিস দুটুকরো রুটি খেয়ে দেবো মা-
শরীফ – দেবো মা এক মাসের সিয়াম আমাদের চরিত্রে এনেছে দৃঢ়তা, হৃদয়ে দিয়েছে বল, অনুভূতিকে করেছে তীক্ষ, বাহুতে দিয়েছে লড়াই-এর শক্তি-
কবীর – সেই শক্তিকে আমরা নিয়োগ করব শত্রুবিতাড়নের সংগ্রামে।
নার্গিস – ভাইয়া শুনেছ, পাক বেতার কি জঘন্য প্রচার চালাচ্ছে!
শরীফ – কীরে?
নার্গীস – ওরা বলছে ঈদের দিনে মুক্তিবাহিনী ঈদের জামাতে আক্রমণ করবে, দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধাবে-
কবীর- ওরা প্রচারপত্রও ছেড়েছে ঢাকা শহরে, আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসা রটিয়ে।
নার্গীস – কী জঘন্য! আমরা ইসলাম ধর্মের শত্রু-এই কথাটাই প্রচার করতে চায় তারা, অথচ মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করে ইসলামের কি নাম তারা করলো?
শরীফ – যারা মানবতার শত্রু তারা ইসলামের সকল ধর্মের শত্রু।
কবীর – তাছাড়া মসজিদের উপর গোলাবর্ষণ করে ভেঙে চুরমার করেছে খোদার ঘর ! কারা নামাজরত মুসুল্লিদের হত্যা করে রক্তে ভাসিয়েছে মসজিদের পবিত্র অঙ্গন ? আমরা না পাক হানাদাররা ?
শরীফ – আজ বিশ্বের সকলেই জানে ওদের ঐ ধর্মবিরোধী বর্বরতার ইতিহাস- তবু তাদের মিথ্যা ভাষণের বিরাম নাই।
কবীর – আসল মতলব কি জানিস! ৪৮ সালে পেশোয়ারের সীমান্ত এলাকায় ঈদের জামাতে বোমাবর্ষণ করে কাইউম-লীগ সরকার হাজার হাজার পাঠানদের হত্যা করেছিল- ৫৮ সালে আয়ুবী আমলে এই নররাক্ষস টিক্কা খান বেলুচিস্তানে ঈদের জামাতে বোমা ফেলেছিল- এবার বাংলাদেশে একই পৈশাচিকতার পুনরাবৃত্তি করতে চায় ওরা।
নার্গীস – আর তাই করে দোষ চাপাতে চায় বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণের উপর।
শরীফ – কিন্ত ওদের সে পরিকল্পনা সফল হবে না। আজকের বাঙালী অনেক বিচক্ষণ- আল্লাহ এই অপরাধ ক্ষমা করবেন না। লানৎ নেমে আসবে ওদের মাথায়।
শরীফ – শহীদ-ই-ঈদগাহে জমায়েত ভারী- আমাদের দুঃখকে আমরা ভুলেছি শহীদের আত্মদানের শিক্ষায়, বীর সেনাদের বীরত্বের গৌরবে, শত্রুর প্রতি চরম ঘৃণায়। রক্তে রাঙা ঈদের চাঁদ শত্রুমুক্ত শোষণমুক্ত বাংলার পতাকায় ছড়াবে নতুন আলো।
(বদরুল হাসান রচিত জীবন্তিকা)