লতি টিলার অপারেশন
(১৯ জুন, ১৯৭১)
যুদ্ধের সময় সবার আগে দরকার শৃংখলা। শৃংখলার প্রশ্নে কোন আপস করা চলে না। নিয়মিত বাহিনীকে নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু গনবাহিনীকে শৃংখলার মধ্যে রাখা বেশ কঠিন কাজ ছিল।
১৮ জুন, ১৯৭১। একটা জরুরি কাজে আমি বাইরে ছিলাম। ২টার দিকে যখন ফিরলাম, হেড কোয়ার্টার এ আমার জন্য ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছিল। ফিরে আসার সাথে সাথে আমাকে জানানো হলো, আমার এক কোম্পানি কুকিতাল বিওপি(ভারত) এর দিকে রওনা হবে, পাকিস্থানি লতি টিলার বিওপিতে অপারেশন করতে। আমাকে বলা হলো, প্রয়জনীয় সব সহযোগিতা সেখানে পাওয়া যাবে। অপারেশন চালাতে আরটিলারী সাপোর্ট ও পাওয়া যাবে।
যাই হোক, রাতের দিকে এক কোম্পানি নিয়ে আমি কুকিতালে চলে আসলাম। আসার পরে ৭ রাজপুত রাইফেলের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল দেব আমাকে ব্রিফ করলেন, এক প্লাটুন পাকিস্থানি সেনা লতি টিলার বিওপির প্রতিরক্ষায় অবস্থান করছে। আরটিলারি কামানের গোলাবর্ষণ এর পরে তাদের পজিশনে হামলা করা হবে। তিনি আরও জানান, তাঁর অধীনে থাকা ২ কোম্পানি সেনাও আমাদের পিছনে থাকবে। যদি দরকার পরে, তাঁরা আমাদের সব রকমের সাহায্য করবে। সত্যি বলতে, এই পরিকল্পনা আমার একদম পছন্দ হয়নি। আমি তাকে বললাম, এটা আমার পছন্দ না। হয় আমাকে অপারেশনের কাজ আমার মত করে করতে দেবা হোক, অথবা, তাঁরা তাদের সেনা নিয়ে অপারেশন করুক। তিনি জানালেন, তাঁর একার পক্ষে এই প্ল্যান বদল করা সম্ভব না। এরপরে আমি তাকে বললাম আমাকে কিছু সময় দিতে যাতে আমরা ঐ জায়গাটা রেকি করে আসতে পারি, কিন্তু তাতেও তিনি রাজি হলেন না। আমাদের দলের কেউ এরকম তাড়াহুড়া টাইপ প্ল্যান পছন্দ করেনি।
মাঝ রাতে আমি তাঁর থেকে বিদায় নিলাম এবং কোথাও বিশ্রাম নিতে চাচ্ছিলাম। একটা পাহাড়ের নিচে আমার সাথে ক্যাপ্টেন কুমার (ভারতীয় সেনাবাহিনি)এর দেখা হলো। তিনি আমাকে অপারেশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি খেয়াল করলাম, তিনিও অপারেশনের প্ল্যান নিয়ে সন্তুষ্ট নন। আমরা একটার পর একটা সিগারেট ধরাতে লাগলাম। হঠাত বৃষ্টি শুরু হলো। এভাবে সারারাত পার হয়ে গেল। ভোর ৪ তাঁর দিকে আমি আমার কোম্পানি কে প্ল্যান মোতাবেক অগ্রসর হবার জন্য নির্দেশ দিলাম।
সীমান্ত থেকে জায়গাটা বেশী দূরে ছিল না। ভোর পোনে ছয়টার দিকে আমরা পাকিস্থানী ঘাটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেললাম এবং তাদের টেলিফোন এর লাইন কেটে দিলাম। শত্রুর ঘাটি একটা ছোট পাহাড়ের উপড়ে ছিল এবং সুরক্ষিত ছিল। সমস্ত বাংকার শেল প্রুফ ছিল।১০০ মিটার দূর থেকেও বাইরে থেকে বুঝার কোন উপায় ছিল না ভিতরের অবস্থা সম্পর্কে। দেখে মনে হচ্ছিল, ভিতরে বোধহয় কেউ নেই।
ভিতরের অবস্থা বুঝার জন্য আমি ৪ জন জওয়ান পাঠালাম হ্যান্ড গ্রেনেড সহ এবং তাদের বললাম, বাংকার এর যত কাছে সম্ভব যেতে। প্ল্যানটা ছিল, শত্রুর শক্তি এবং অবস্থান সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা পাবার পর আমরা সেটা পাস করে দিব এবং সেই মোতাবেক কামানের গোলা ছোড়া হবে। তারপরে আমরা সেই ঘাটি আক্রমণ করব।
আমার ৪ জন সেপাই ফিরে এসে খবর দিল, বিওপি তে কেউ নেই। কিন্তু তারপরও নিশ্চিত হবার জন্য আমি ১ জন হাবিলদার আর ২ জন সেপাইকে পাঠালাম বাংকার এর একদম কাছে যেয়ে গ্রেনেড চার্জ করতে। নির্দেশ মত তাঁরা বাংকার এর কাছে গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করতেই পাকিরা ফায়ারিং শুরু করল। আমার ৩জন সিপাহীই গুলিবিদ্ধ হলো কিন্তু তাঁরা ফিরে আসতে সক্ষম হলো। ২০ মিনিটের মধ্যে ৫০০ আরটিলারি শেল শত্রু বিওপি তে আঘাত হানল। আরটিলারি শেলিং থামার সাথে সাথে আমরা বিওপি আক্রমণ করলাম। আমরা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে এত জোরে চিৎকার করে ঝাপিয়ে পড়লাম যে পাকিস্থানীরা হতভম্ব হয়ে পড়ল। আমরা তাদের ঘাটির কাছে আসার আগেই তারা কাছাকাছি জঙ্গলে পালিয়ে গেল। পশ্চাদপসরণ করার সময় পাকিস্থানী সেনাদের বেশীরভাগ গুলি খেল। হঠাত অবাক হয়ে দেখলাম অর্ধনগ্ন একজন মেয়েও দৌরে পালাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্থানী সেনাদের সাথে সেও রাইফেলের গুলি থেকে বাচতে পারল না। আমরা ঐ বিওপি সম্পুর্নরুপে ধ্বংস করে দিলাম। প্রচুর অস্ত্র আর গোলাবারুদ আমাদের হাতে আসল এবং ২২ বালুচ এর ১ জন সেপাই আর ১জন হাবিলদার কে আমরা জীবন্ত আটক করলাম। মুক্তিযুদ্ধ এর শেষ পর্যন্ত পাক আর্মি এদিকে আর আসেনি।
জুন, জুলাই, আগস্ট মাস আমাদের জন্য সবচেয়ে ভাল সময় ছিল। এসময় আমরা শত্রুর সবচেয়ে বেশী ক্ষয়ক্ষতি করলাম। এসময় উল্লেখযোগ্য পরিমানে মুক্তিযোদ্ধা ছোট ছোট অপারেশন পরিচালনা করে। সত্যি বলতে, সিলেট শহর এর ভিতরে আমরা শুরুতে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমানে সাহায্য পাইনি। আমাদের বেশ কিছু ছেলে অস্ত্র সহ ধরা পড়ে। সহযোগিতার অভাবে আমাদের বেশ কিছু পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কিছু অসাধু উলেমা ভিতরে তৎপর ছিল। আবার এমন অনেক মানুষও ছিল, যারা আমাদের সাহায্য করেছে এবং যতদূর সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করে গেছে। যুদ্ধদের শেষদিকে আমরা যখন একেবারে গভীরে ঢুকে গেছি, তখন আমরা লোকাল মানুষজনের থেকে অনেক বেশী সাহায্য সহযোগিতা পাই। তাদের যা কিছু ছিল, তাই দিয়ে আমাদের সব ভাবে সাহায্য করেছে।
এসময় আমার সাব-সেক্টরের সদস্য সংখ্যা এক হাজার নিয়মিত বাহিনী ছাড়িয়ে যায়। এর বাইরেও কয়েকশ গেরিলা যোদ্ধা ছিল, যারা একেবারে ভিতরে ঢুকে দুঃসাহসিক অপারেশন করে এসেছে। এটা ছিল যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় এবং এসময়ে আমাদের কাজ ছিল শত্রুর সর্বোচ্চ ক্ষতি সাধন করা।