৮৯। শরণার্থীদের উপর আই,আর,সি-র একটি রিপোর্ট (৫৫৩-৫৫৮)
বাংলাদেশ রেসকিউ কমিটির ইমার্জেন্সি মিশন টু ইন্ডিয়া ফর পাকিস্তানি রেফিউজিস
সূত্রঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২৮ জুলাই, ১৯৭১।
রিপোর্টদাতাঃ মিস্টার এঞ্জিয়ার বিডল ডিউক (চেয়ারম্যান, আইসিআর)
রিপোর্ট গ্রহীতাঃ এফ, আই কেলোং (ইউএসএ সরকারের শরণার্থী বিষয়ক সেক্রেটারির অব স্টেটের স্পেশাল এসিস্ট্যান্ট)
রিপোর্ট প্রদানের তারিখঃ ২৮ জুলাই, ১৯৭১
#ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ, সময়ের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থানের একটির সূচনা হয়,যেখানে লোকজন প্রানের ভয়ে তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে পালিয়ে আসতে শুরু করে। প্রায় ৬ মিলিয়ন বাঙালি, মুসলিম, হিন্দু পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আসাম,পশ্চিম বঙ্গ,মেঘালয় আর ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহন করে। প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন শরণার্থী তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। বর্ধমান এই জনসংখ্যার এই স্রোত ইন্ডিয়ার উপর ভয়াবহ চাপের সৃষ্টি করছে।
জুলাইয়ের ৫ তারিখে,ভারতে নিযুক্ত প্রাক্তন আমেরিকান এম্বাসেডর চেস্টার বাওয়েল নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেন,
“যদি অচিরেই দুটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা না হয়, তবে দক্ষিন এশিয়া অচিরেই একটি এন্ডলেস যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে।
এর প্রথমটি হল,ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের তাদের এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিত্যাগ করতে হবে এবং একটি সমঝোতায় আসতে হবে। যা পূর্ব পাকিস্তানের গৃহহারা এবং প্রানভয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ভারতে আসা থেকে বিরত করবে।
এবং দ্বিতীয়টি হল -বিশ্ব প্রতিনিধিদের একটি বৃহৎ পরিসরে ক্যাম্পেইন শুরু করতে হবে। যাতে করে বর্ডার পার করে আসা এই সুবিশাল ৬ মিলিয়ন শরনার্থীকে পালনের চাপ ভারত সামলে নিতে পারে।”
শরনার্থীদের ফেরত পাঠানোর ব্যপারে রাজনৈতিক সমাধান অবশ্যকরণীয়। এর সাথে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের এই সুবিশাল শরনার্থীদের চাপ ভারতের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া উচিত। আমেরিকান ভলান্টারি এজেন্সির উপরেও এই দায়ভায় বর্তায়। এই মুহূর্তে মানবতাবোধ ও আত্মত্যাগের মনোভাবই বর্তমান সময়ের এই ভয়াবহ ও করুণতম শরনার্থী সমস্যার মোকাবেলা করতে পারে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মূলত দুইটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত-পূর্ব ও পশ্চিম,যা হাজার মাইল ব্যাপী বিস্তৃত ভারতীয় ভূখন্ড দ্বারা পৃথককৃত। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৭৫ মিলিয়ন (৭.৫ কোটি)।অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৫ মিলিয়ন (২.৫ কোটি)। উভয় অঞ্চলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। তবে পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ৮ মিলিয়ন (৮০ লক্ষ) হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বাস ছিল।
১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে আওয়ামীলীগ সমগ্র পাকিস্তানেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু নতুন সরকার ঘটনের প্রক্রিয়া ব্যহত হয় এবং অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে। ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পুলিশ পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের উপর আক্রমন করে এবং অপরিসীম আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এতে প্রায় ২ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনুমিত হচ্ছে।
এই শরনার্থী সমস্যার পরিধি ও গুরুত্ব যখন ক্রমশ বাড়তেই লাগল,”আন্তর্জাতিক ত্রান কমিটি” তখন পাঁচ জন স্বেচ্ছাসেবক নেতার সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দলকে ভারতে প্রেরণ করেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন IRC এর সাবেক প্রেসিডেন্ট জনাব এঞ্জিয়ার বিডল ডিউক। দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন,ভাইস প্রেসিডেন্ট মর্টন হামবুর্গ। এছাড়া আই,আর,সি-র বোর্ড মেম্বারদের মধ্যে ছিলেন মিসেস লরেন্স কপলি থ এবং থমাস ডব্লিও ফিপস এবং আইনস্টাইন মেডিকেল স্কুলের ডা.ড্যানিয়েল এল। এই মিশনের লক্ষ্য ছিল শরনার্থীদের সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা লাভ করা এবং পূর্ব পাকিস্তানের শরনার্থী,বিশেষ করে পেশাদার শ্রেনীদের জন্য একটি ইমারজেন্সি কর্মসূচির সূচনা করা। আইআরসি-র বোর্ড অব ডিরেক্টরের কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে সকল দিকে হাত না বাড়িয়ে আইআরসি-র সামর্থ্য অনুযায়ী সমস্যার যে কোন একটি বিশেষ অংশের দিকে মনোযোগ দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া দেশের টিকে থাকার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ডাক্তার, শিক্ষক, লেখক, চিত্রকর, একাডেমিশিয়ান ও সাংস্কৃতিক নেতাদের টিকে থাকাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরবর্তী লেখাগুলোতে মিশনের ফাইন্ডিংস, সুপারিশ ও সম্পূর্ণ কর্মসূচির সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলোঃ
১) সমস্যার অবস্থা (the scope of the problem):
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী সমস্যার ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু দায়ভার এড়ানো যায় না। With which most of us react to what appears as an elemental disaster of unmanageable scope.
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পুলিশ জনমনে যে ভয়াবহ আতংক ও ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল,তার লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি সংবাদ ছিল এইরকম,
“লোকজন একে অপরকে হত্যা করছিল কেবল একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ন বর্ণভিত্তিক মনোভাব, রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত ও সাম্প্রদায়িকতায় অন্ধ হয়ে। কোন গোষ্ঠীই পরিপূর্ণভাবে দোষমুক্ত নয়। কিন্ত হত্যা ও ঘৃণার প্রধান এজেন্ট ছিল পাকিস্তানি আর্মি। এবং এই হত্যাকান্ড ছিল উদ্দেশ্যমূলকভাবে,বাছাইকৃত। পূর্ব পাকিস্তানের এক গ্রহণযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়,পাক সেনাবাহিনীর মূল টার্গেট ছিল বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, সাংস্কৃতিক নেতা, ডাক্তার, প্রফেসর,ছাত্র এবং লেখকগোষ্ঠী।” (এন্থনি লুইস, ‘দুর্দশার পরিমাপ’, দা নিউ ইউর্ক টাইমস, ৭ জুন, ১৯৭১)
ভারতে আই আর সি মিশন শরনার্থীদের সাথে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ওখানে আসলে কি ঘটছে,সে সম্পর্কে একটি ধারণা পায়। লোকজনকে বাসা থেকে ধরে এনে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা হয়। নারী, পুরুষ ও শিশুদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। মহিলাদের ধর্ষন করা হয়। প্রায় দুই লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয় বলে রিপোর্ট আসে। আরো লাখ লাখ মানুষ ভারতে পালিয়ে আসে। এই পর্যায়ে কেবলমাত্র সেই সব মুসলিমরাই টার্গেট ছিল,যারা আওয়ামীলীগ এর কর্মী ছিল,অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতির বিরুদ্ধে ছিল।
পরবর্তীতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জিঘাংসার স্বীকার হয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগন,যারা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। ফরিদপুরের উপর নিউইয়র্ক টাইমসের একটি রিপোর্ট ছিল,
“যদিও হাজারো বাঙ্গালি মুসলমানকে “দেশদ্রোহী ” বলে আর্মিরা হত্যা করে, তথাপি মূল বলির পাঠা ছিল হিন্দু জনগন। সামরিক সরকার হিন্দুদের ভারতের দালাল ও স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবির পিছের মূল চালিকাশক্তি বলে প্রচার করে। এদেশে যে সকল মুসলিম লোকজন হিন্দুদের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব প্রকাশ করতো, তাদের এই বলে হুমকিও দেয়া হয় যে,যদি তারা হিন্দুদের উপর আক্রমন না করে,তবে তাদেরকেও হত্যা করা হবে। এভাবে তাঁরা মুসলিমদেরকে হিন্দুদের উপর অত্যাচার,তাদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে বাধ্য করে।” (দা নিউ ইউর্ক টাইমস, ৪ জুলাই, ১৯৭১)
ভারতীয় সরকার শরনার্থীদের সঠিক পরিসংখ্যান এর জন্য একটি কার্যকর রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালু করে। জুনের ৩ তারিখ নাগাদ,শরনার্থী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪.৮ মিলিয়নে। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের জায়গা হয় আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়,পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব পূর্ব-পাকিস্তানে, প্রধানত পশ্চিম বঙ্গে। নিচে অঞ্চলভেদে শরনার্থীদের অবস্থানের একটি হিসাব দেয়া হল:
রাজ্য | জেলা | অভ্যর্থনা কেন্দ্রে অবস্থান (জন) | বন্ধু বা আত্নীয়দের সাথে অবস্থান (জন) |
আসাম | – | ৮১,৮০০ | ৬৫,৬৭৭ |
ত্রিপুরা | – | ৩,৮১,৩৭৩ | ৩,৬৩,৪৬৪ |
মেঘালয় | – | ১,৮৬,০৫২ | ৪৯,৩৩২ |
পশ্চিমবঙ্গ | নদীয়া | ২,১৪,৭৮৮ | ১,৭০,৯৫১ |
চব্বিশ পরগণা | ৫,০৩,৪৬৭ | ১,৭৯,২৫০ | |
মুর্শিদাবাদ | ১,৩৪,৫০৭ | ১৫,৯৫৩ | |
পশ্চিম দিনাজপুর | ৭,৬৩,৬৬৪ | ৫,১১,৫৫৫ | |
জলপাইগুড়ি | ১,৪০,৪০২ | ১,৬৫,০০০ | |
কুচবিহার | ১,৮৯,৭৫৫ | ২,১০,৮৭৫ | |
মালদহ | ৯২,১৩৯ | ২,৫৪,৫১৩ | |
মোট | ২৭,০৭,৯৪৭ | ২০,২২,৫৭০ |
(সংখ্যাগুলো পশ্চিমবঙ্গ সরকার সরবরাহ করেছে)
জুনের ১৫ তারিখের মধ্যে শরনার্থীদের সংখ্যা বেঁড়ে দাঁড়ায় ৫.৮ মিলিয়িনে,যার মাঝে প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন শরনার্থীদের আবাস ছিল ক্যাম্পগুলোতে। জুনের প্রথমদিকে কলেরার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লে,সীমান্ত দিয়ে শরনার্থী প্রবেশ কিছুটা কমে আসে। কিন্ত যেই কলেরার প্রভাব কমে আসলো,শরনার্থীদের স্রোত আবারো বাড়তে লাগল। প্রতি রাতে হাজার হাজার শরনার্থী সীমান্ত পার হতে লাগল। যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সীমান্তে মর্টার নিক্ষেপ করছিলো, তথাপি তা এই জনস্রোতের ধাক্কাকে খুব কমই রোধ করতে পেরেছিলো। যদি এই গতিতে শরনার্থী সংখ্যা বাড়তেই থাকে, তাহলে তা অচিরেই ৭ মিলিয়ন এর মাইলফলক স্পর্শ করবে। যেখানে কিউবার মোট জনসংখ্যাই হল ৭ মিলিয়ন!
কে জানে এই অবস্থা কখন বিস্ফোরিত হবে? স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো তাদের মানবসেবামূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা মূলত ভারতকে এই অভ্যন্তরীন চাপ সামাল দেয়ার জন্য সাহায্য করছে এবং একটি সমাধানের পথ খুঁজে পেতে প্রয়োজনীয় সময় দেয়ার চেষ্টা করছে। সেই হিসাবে তারা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
২) শরনার্থীরা ( The Refugees) :
শরনার্থীদের অনেকেই ১৫০ মাইলের মত পথ পায়ে হেটে অতিক্রম করে। তাদের বেশিরভাগের বাড়িই ছিল সীমান্তের কাছাকাছি । প্রশ্নাতীত ভাবে প্রচুর সংখ্যক মানুষ পালাতে পারেনি,কারন তাদের বাড়িঘর ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অনেকটাই ভেতরের দিকে। সেক্ষেত্রে তাদের সাধারন রাস্তা ধরে যাতায়াত করে বর্ডার ক্রস করতে হত। সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের তৎপরতা বেশি থাকায়,অনেকেই ১,৩০০ মাইলব্যাপী বর্ডার পার হত বিভিন্ন জঙ্গল ও জলার পথ ধরে। এইসব গ্রুপের লোকসংখ্যা মাঝে মাঝে ৫০,০০০ ছাড়িয়ে যেত। চব্বিশ ঘন্টার মাঝে তারা ভারতের বিভিন্ন রাস্তায় থিতু হয়ে যেত। যেখানে নূন্যতম থাকার যায়গা ও খাবার পানির ব্যবস্থা থাকত,তারা সেখানেই অবস্থান করত। তাঁদের অনেকেই অবশ্য শরনার্থী ক্যাম্প এভইড করেছিল এবং ভারতে জনতার সাথে মিশে গিয়েছিল। শরনার্থী ক্যাম্পগুলো নানা আকারের হত, ক্ষুদ্র গ্রুপ থেকে শুরু করে ৫০,০০০ লোকের বিশাল জমায়েত পর্যন্ত। তবে এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন ও ভারত সরকারের কাজ ছিল প্রশংসনীয়। তারা প্রতিটা ক্যাম্পে নূন্যতম খাবার ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছিল। ক্যম্পগুলো ছিল মোটামুটিভাবে গ্রাম ঘেষা। রিফিউজি ক্যাম্পগুলো উঁচু স্থানে বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ছিল অসম্ভব। আর এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল যে বর্ষা মওসুমে প্রায় অধিকাংশ রিফিউজি ক্যাম্পই পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
শরনার্থী শিবিরের ছাউনিগুলো মূলত তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। ছোট কুটিরের ছাউনি- যেগুলো তৈরী করা হত স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে। আকারে ছোট তাবুগুলো নির্মান করা হত কাঠের কাঠামো আর শরনার্থী শিবিরের দেয়া ত্রিপল দিয়ে। আর কিছু ছিল সিমেন্ট শিট আর ড্রেইনের পানির পাইপ দিয়ে তৈরী। বর্তমানে সমগ্র ভারত জুড়েই ত্রিপল তৈরীর সামগ্রিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করা হয়। শিবিরে একটি কিংবা দুইটি পাম্পের মাধ্যমে পানির যোগান দেয়া হত। তাছাড়া কিছু এক পাম্পওয়ালা লিভারযুক্ত টিউবওয়েলও ছিল। কিন্ত পয়:নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা ছিলো না বললেই চলে। শরনার্থী গ্রামগুলোর পাশেই গর্ত খুঁড়ে কিছু খোলা পায়খানার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্ত তা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। তাই কর্তৃপক্ষ আরো বড় করে করার সিদ্ধান্ত নেয়। অগভীর কূপ,অপরিচ্ছন্ন পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও শিবিরের খুব নিকটবর্তী হওয়ায় রোগ সংক্রমণ ঘটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনিটারি ব্যবস্থা ও গভীর নলকূপ স্থাপন করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছিলো শরনার্থী শিবিরের নূন্যতম স্বাস্থমান বজায় রাখার জন্য।
খাদ্যের জন্য শরনার্থীরা ক্যাম্পের অথরিটি ও স্থানীয় খুচরা বাজারের উপর নির্ভরশীল ছিল। মাটির পাত্রে সিদ্ধ ভাতই ছিল মূল খাদ্য। অল্প গুড়ো দুধও মিলত কালেভদ্রে। আর ছিল ডাল,যা ছিল মুসর জাতীয় দানা দিয়ে তৈরী এক প্রকার স্যুপ বিশেষ। কিছু বিশেষ জায়গায় সবজির ব্যবস্থাও করা হত। তবে এটা ছিল শিবিরের রেগুলার নিয়মের বাইরে। মোদ্দাকথা হল, যে পরিমান খাদ্যের যোগান দেয়া হত,তা ছিল চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।
৩) স্বাস্থ্য অবস্থা (Health Condition):
স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে শরনার্থীদের মাঝে অধিক পরিশ্রম,কষ্ট,কম ক্যলরি গ্রহন, আর অপুষ্টির ছাপ ছিল স্পষ্ট। তাঁদের বেশিরভাগের পর্যাপ্ত পোশাক ছিল না। শিশুরা তুলনামূলক ভাবে এই পরিস্থিতে একটু ভাল খাপ খাইয়ে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্ত বয়ষ্ক ও শিশু উভয়ের মাঝে চর্মরোগ, পাকস্থলীর সমস্যা,ডায়রিয়া, হুপিং কাশি সহ নানাবিধ শ্বাসকষ্ট জনিত রোগী ছিল প্রচুর পরিমানে। শিবিরের হাসপাতাল গুলোতে কলেরা ও অন্যান্য পাকস্থলীর সমস্যার রোগীও ছিল। কলেরা রোগটি যদিও এখন নিয়ন্ত্রনের মধ্যে আনা হয়েছে, কিন্ত এটি প্রতীয়মান হয় যে, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, হাসাপাতালের কম সুযোগ সুবিধা,তার উপর আরো বেশি শরনার্থীর আগমন কলেরার প্রকোপকে আরো বাড়িয়ে তুলবে।
শরনার্থী শিবিরগুলোতে স্বাস্থ্য সেবা অপর্যাপ্ত। কিছু কিছু ক্যাম্পে গণ টিকাদানের কিছু মোবাইল ইউনিট কার্যকর ছিল। সুনির্দিষ্ট কিছু সেবা দানে সক্ষম ছোট তাবুওয়ালা হাসপাতাল ও ছিল কিছু ক্যাম্পে। কিন্ত সেখানে রোগী রাখার জন্য সর্বোচ্চ ২০-৩০ টা সিট বা স্ট্রেচার ছিল। কিছু ইন্ট্রাভেনাস আর কিছু সিরাপ জাতীয় ওষুধপত্র ছিল কলেরা ও পাকস্থলীর নানা সমস্যা মোকাবিলার জন্য। যেহেতু পারস্পরিক সমন্বয় এর অভাব ছিল,তাই দেখা যেত এমন ঔষুধের যোগান আসছে যা কম গুরুত্বপূর্ণ। আবার অনেক বেশি জরুরী ওষুধের সংকট দেখা দিত।
এই মুহুর্তে রিফিওজিদের জন্য বেশি জরুরী ছিল তাবু নির্মাম সামগ্রী,কারন বর্ষা মৌসুম শুরু হলো বলে। আর দরকার গভীর নলকূপ স্থাপনের, যাতে করে কম সংক্রমণ এর সম্ভাবনা থাকে। পয়:নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত। যে পরিমান খাদ্য যোগান দেয়া হতো,তা শিশু ও বৃদ্ধদের জন্যেই পর্যাপ্ত ছিল না। দিন দিন তা আরো কমতে লাগল।
শিবিরে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে ছিল সদ্য ভূমিষ্ঠ কিংবা ছোট বাচ্চারা। বোতলজাত তরল খাবার কিংবা শিশুখাদ্যের যোগান বলতে গেলে ছিলই না। মাতৃদুগ্ধ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অল্প। বাচ্চাদের খাদ্য তৈরীর জন্য গুড়া দুধ কিংবা গ্লুকোজ পাউডারের ছিল তীব্র সংকট। আর এই অপুষ্টির কারনে শরনার্থী শিবিরে মারা যায় অসংখ্য শিশু ও নবজাতক।
পরবর্তী মাসগুলোতে শরনার্থী শিবিরের পরিধি আরো বেড়ে যাবে। সেই সাথে বেড়ে যাবে অপুষ্টি আর রোগের সংক্রমন। স্থানীয় গ্রামগুলোর সাথে শিবিরের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আর্থিক এই বিশাল চাপ পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন ও ভারত সরকারের জন্য ক্রমশ অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। অবস্থা গুরুতর হওয়ার সাথে সাথে আত্মবিশ্বাস আর আশার পারদও ক্রমশ নিম্নগামী হতে করবে।
খাদ্য ও চিকিৎসার যোগান অবশ্যই বাইরের উৎস থেকে আসতে হবে। এইসব জিনিপত্র ভাগ করে দেয়া সম্ভব। তবে আরো প্রচুর পরিমানে কর্মক্ষম ডাক্তার ও প্যারামেডিক চিকিৎসক এর নিয়োগ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪) শরনার্থী ডাক্তারেরা ( The refuge Physicians):
পূর্ব পাকিস্তানের যে সকল ডাক্তারেরা দেশ ছেড়েছিলেন, তারা ভারতের ডাক্তার ও অন্যান্য পেশাজীবীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই শরনার্থী শিবিরে রয়ে গিয়েছেন। বেশিরভাগ কলকাতা শহরের আশেপাশে, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। মেডিকেল শিক্ষা প্রসারের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে সাতটি মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল,যা মূলত দুই ধরনের ডিগ্রী প্রদান করত। এম.বি.বি.এস ডাক্তারী সার্টিফিকেট এর জন্য ৫ বছর মেয়াদী কোর্স আর RFP এর জন্য চার বছর মেয়াদী। কিছু প্যারামেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছিল। অধিকাংশ অভিজ্ঞ মেডিকেল প্রফেসরদের হত্যা কিংবা গুম করা হয়। প্রায় ১,৫০০ এর মত ডাক্তার পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসে যাদের অধিকাংশই ছিল যুবক। যেহেতু পশ্চিম বঙ্গে এই ডিগ্রি চিকিৎসা করার অনুমতি পায় না,তাই মাত্র ১৫০ জন ডাক্তারই সরকারীভাবে পশ্চিমবঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল। অধিকাংশ শরনার্থী ডাক্তারেরা বাংলাদেশ রেড ক্রস এর অধীনে নিবন্ধিত হয়েছিল যার পরিচালক ছিলেন ডা.এ হক। এই গ্রুপে সাধারন ডাক্তারদের সংখ্যাই বেশি ছিল,স্পেশালিষ্ট ডাক্তার ছিল হাতে গোনা। তাঁদের নিজের কিছু পোশাক আর জিনিপত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ডাক্তারী সামগ্রীও বলতে গেলে কিছুই ছিল না। এমনকি তাঁরা নিজেদের পরিবারকে পর্যন্ত সাপোর্ট দিতে পারত না। অন্য পরিবারের সাথে তাঁদের মিলেমিশে থাকতে হতো।