শিক্ষা দিবসে ছাত্রলীগের সভার প্রস্তাবাবলী

<02.124.548-550>

 

আজকের বটতলার ছাত্রসভার প্রস্তাবাবলী

 

বিশেষ প্রস্তাবঃ

        ঘুমের দেশের মানুষের ঘুম ‍ভাংগাইতে যাইতে সোনার বাংলার যে সকল সোনার ছেলে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের লেলুয়া পুলিশ বাহিনীর গুলিতে ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর চিরকালের জন্য ঘুমাইয়া পরিয়াছেন, আজকের এই মহতী সভা মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহসহ সেই সকল বীর শহীদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিতেছি । পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ মনে করে যে, সেদিন জাতীয় শিক্ষা কমিশনের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতিকে প্রতিহত করিতে গিয়া যাহারা নিহত হইয়াছেন তাহারা দেশ ও জাতির কল্যান, গণমুখী,গণতান্ত্রিক, সহজলভ্য, বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি কায়েম এবং ভবিষ্যৎ বংশধরগণের মঙ্গল কামনায়ই আত্মাহুতি দিয়াছেন । এই মহতী সভা পুনরায় তাহাদের মহান স্মৃতিকে স্মর‌ণ করিয়া শপথ গ্রহণ করিতেছে যে, যতদিন শহীদের আরদ্ধ কার্য সম্পাদিত না হবে, ততদিন যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে ছাত্রলীগ সংগ্রাম চালাইয়া যাইবে ।

রাজনৈতিক প্রস্তাব

        এই মহতী সভা গভীর উদ্বেগের সহিত দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিতেছে । আগামী ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হইলেও নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য চরম প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী গোষ্ঠী, অতিবিপ্লবী হটকারী বামপন্থী গোষ্ঠী, এক শ্রেণীর সরকারী আমলারা এবং গণবিরোধী অশুভ শক্তি যেমন পাঞ্জাবী পুজিঁপতি, সামন্তপ্রভু, জোতদার, জমিদার যুগপৎ প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইতেছে । নির্বাচনে নিশ্চিত ভরাডুবি লক্ষ্য করিয়া উস্কানিমূলক আচরণ শুরু করিয়াছে, সামরিক আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগ ঘটাইয়া শত শত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কর্মী, ছাত্রলীগ সদস্যসহ বিপুলসংখ্যক ছাত্রকর্মী, শ্রমিককে আজ গ্রেফতার করা হইতেছে, হুলিয়া জারি করিয়া হয়রানী করা যাইতেছে । বস্তুতঃপক্ষে আগামী নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য  সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশকে আজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত । আমরা মনে করি আগামী নির্বাচন কোন ক্ষমতা দখলের নির্বাচন নয়, বরং ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন, ১১-দফার সত্যিকারের সমর্থকদের পক্ষে রায় ঘোষণার জন্য এই সভী দেশবাসীর প্রতি আকুল আবেদন জানাইতেছে । সংগে সংগে নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব দেশবাসী মর্মে মর্মে অনুভব করিতেছে । নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সফল করার জন্য এই মহতী সভা দেশবাসীর পক্ষ হইতে নিম্ন লিখিত দাবীগুলি মানিয়া নিবার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানাইতেছেঃ

          ক) অবিলম্বে পাইকারী হারে ছাত্র, শ্রমিক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদেরকে গ্রেফতার বন্ধ করা হউক, ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ হোসেন, তোহা গাজী, সরদার রশীদ, বিমল দাস, মন্টু, সেলিমসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হউক, দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করা হউক ও খসরুসহ দাজ্ঞা প্রাপ্তদের দন্ডাদেশ মওকুফ করা হউক এবং শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা হউক, লক আউট, লে-অফ প্রত্যাহার করা হউক, ধর্মঘটী শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া মানিয়া লওয়া হউক ।

 

 

 

(খ) নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য সরকারী প্রচারযন্ত্র, প্রশাসনযন্ত্র এবং গনবিরোধী অতি উৎসাহী আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহন কইরা সরকারি ভূমিকা সম্পুর্ন দলনিরপেক্ষ করা হউক।

(গ) সামরিক আইন প্রত্যাহার করিয়া পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরাইয়া আনা হউক।

(ঘ) সর্বোপরি গণপরিষদের সার্বভৌমত্ব খর্বকারী আইনগত কাঠামো আদেশের ২০, ২৫ ও ২৭নং ধারা সংযোজিত থাকায় জনগনের সার্বভৌম অধিকার হরণকারী আইনগত কাঠামো আদেশ, ১৯৭০ প্রত্যাহার করা হউক।

শিক্ষা সমস্যাঃ

        প্রদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে আজ মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হইয়াছে। উচ্চ শিক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং কারিগরি শিক্ষায়তনসমূহে প্রাপ্ত আসন সংখ্যার প্রায় চার গুন ছাত্র-ছাত্রী দরখাস্ত পেশ করিয়াছেন। সিলেবাসের বোঝা ছাত্র-ছাত্রীদের সুষ্ঠু শিক্ষা জীবনকে পঙ্গু করিতে চলিয়াছে। সম্প্রতি ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ নামক একখানি পুস্তক স্কুল কলেজের ছাত্রদের উপর চাপাইয়া দিয়া শুধু সিলেবাসের কলেবরই বৃদ্ধি করা হয় নাই, বাংলা ও বাঙ্গালীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্যেরও অবমাননা করা হইয়াছে। ছাত্র বেতন বৃদ্ধি, শিক্ষামূলক বৃত্তি বৃদ্ধিতে গড়িমসি এবং জগন্নাথ কলেজসহ প্রদেশের সচ্ছল কলেজগুলির প্রাদেশীকরন অদ্যাবধি প্রত্যাহার করা হয় নাই। অদ্যকার এই সভা গভীর উদ্বেগের সহিত শিক্ষা ক্ষেত্রে সৃষ্ট এই সংকট অবলোকন করিয়া অবিলম্বে দেশব্যাপী শিক্ষা ক্ষেত্রের সকল সংকট অবসানের জন্য নিম্নলিখিত দাবীগুলি মানিয়া লইবার জন্য সরকারের নিকত জোর দাবী জানাইতেছেঃ

(ক) সম্পুর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে শিক্ষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, অভিভাবক, ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করিয়া গণতান্ত্রিক, সহজলভ্য, গণমুখী, বৈজ্ঞানিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হউক।

(খ) ‘পাকিস্তান-দেশ ও কৃষ্টি’ পুস্তক্টি বাতিল করা হউক এবং ব্যাবহারিক বিজ্ঞানে ২৫ নম্বর চালু করা হউক।

(গ) জগন্নাথ কলেজসহ সচ্ছল কলেজগুলির প্রাদেশিকীকরন বাতিল করিয়া নতুন সরকারি কলেজ স্থাপন করা হউক।

(ঘ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসংখ্যা প্রতি বিভাগে বৃদ্ধি করা হউক, নৈশ বিভাগ চালু করা হউক, আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য আরও অধিক হল, হোস্টেল নির্মান করা হউক।

(ঙ) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ রুপদান করা হউক এবং চলতি বছর হইতেই ঢাকায় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি শুরু করা হউক।

অর্থনৈতিক অবস্থাঃ

          বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বন্যার রুদ্র তাণ্ডবে বাঙ্গালী আজ গৃহহারা। বন্যা নিয়াছে ফসল, গোয়ালের গরু। বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে মুনাফাখোর, মজুতদারী গোষ্ঠীর চক্রান্তের ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেশবাসীকে বিপর্যস্ত করিয়াছে এবং ঐ সকল অঞ্চলে রিলিফ ব্যাবস্থার অপর্যাপ্ততা, মহামারী প্রতিরোধ, মেডিকেল ব্যবস্থার অভাব সারা বাংলার পরিস্থিতিকে বিষময় করিয়া তুলিয়াছে। বস্তুতঃপক্ষে  সারা বাংলাদেশে আজ চরম দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করিতেছে। এই সভা গভীর উদ্বেগের সহিত প্রদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্রম অবনতি লক্ষ্য করিয়া উহার আশু নিরসনের জন্য সরকারের নিকট নিম্ন লিখিত দাবীগুলি পূরণের জোর দাবী জানাইতেছেঃ

(ক) অবিলম্বে দেশীয় ও বৈদেশিক সাহায্যের সমন্বয়ে তহবিল গঠন করিয়া ক্রুগ্ব মিশন পরিকল্পনা বাস্তবায়ি করা হউক।

(খ) বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে মেডিকেল স্কোয়াড ও পর্যাপ্ত রিলিফ প্রদান করা হউক এবং মুনাফাখোরী, মজুতদারী ও রিলিফ দ্রব্যের অপব্যাবহারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হউক।
(গ) সারা দেশে দুর্ভিক্ষ অবস্থা ঘোষণা করিয়া পূর্ণ রেশনিং চালু করা হোক, গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা খোলা হউক, বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণ করা হউক এবং কৃষকদের খাজনা, ট্যাক্স এবং সার্টিফিকেট জারি সম্পূর্ণ বন্ধ করা হউক।

(ঘ) দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করিয়া সাধারন লোকের ক্রয়ক্ষমতার উন্নতি বিধান করা হউক।

(ঙ) শ্রমিকদের ৫-দফা মানিয়া লইয়া সাধারণ শ্রমিকদেরকে বাঁচার অধিকার প্রদান করা হউক।

সংগ্রামের ডাকঃ

                      অদ্যকার মহান শিক্ষা দিবসে এই মহতি সভা দলমত নির্বিশেষে দেশের বর্তমান শিক্ষা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার আলোকে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জনতার সংগ্রামী ঐক্য গড়িয়া তোলার জন্য ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকসহ সর্বশ্রেনীর জনতার প্রতি আহ্বান জানাইতেছে। এই মহতী সভা মনে করে যে, নির্বাচন আন্দোলনের অন্যতম পন্থা এবং এই কারনেই নির্বাচনে জনগনের রায়ে কোন মত ও পথ জনগন সমর্থন করে তাহাও সুস্পষ্ট হইবে। অতএব কোন চক্রান্তের ফলে যদি আগামী সাধারণ নির্বাচনের রায়কে অগ্রাহ্য করা হয় তাহা হইলে দুর্বার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে আগামীতে বাংলার জনগনের সঠিক মুক্তির দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য দেশবাসীর নিকট এই সভা আকুল আবেদন জানাইতেছে এবং যে কোন ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য এদেশের সংগ্রামী জনতার প্রতি এই সভা আবেদন জানাইতেছে।

প্রেরক-

এম, এ, রশীদ

দপ্তর সম্পাদক

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ।

Scroll to Top