সর্বাধিনায়কের দরবার

সর্বাধিনায়কের দরবার

জুলাই মাসের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে আমাদের সর্বাধিনায়ক সব আঞ্চলিক অধিনায়কদের নিয়ে প্রথমবারের মত একটা বৈঠক বসেন এবং উপরোক্ত ৬টি অঞ্চলকে নয়টি উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করেন। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, এর আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছিল নিষ্প্রভ। এটা অবশ্য ভাল পদক্ষেপ। কিন্তু বেতারযন্ত্রের অভাবে নদীবহুল বাংলাদেশের  এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর সুষ্ঠভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। এক-একটা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল কমপক্ষে দু’ থেকে তিনটি জেলা। অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে আমি কোন মত প্রকাশ করব না। তারা হয়তো তাদের অধীনস্থ নিয়মিত সেনাবাহিনী নিয়ে ভিন্ন রকম অবস্থার মোকাবেলা করেছিলেন। কিন্তু আমার ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার শক্তির প্রধান উৎস মুক্তিযোদ্ধা এবং নগন্য সংখ্যক সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর লোক। যাহোক এই সময় আমার অবস্থা ছিল খুব নাজুক ও অস্বস্তিকর। কেনা সৈন্যবাহিনী বা অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই আমি অধিনায়ক হয়েছিলাম। সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী সাহেব পরিস্কারভাবে জবাব দিলেন যে, আমাকে কোন অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে না। এমন কি যে অস্ত্রশস্ত্রগুলো পাক হানাদারদের সাথে মোকাবেলার সময় সুন্দরবনে খোয়া গিয়েছিল সেগুলো উদ্ধার করার জন্য আমাকে চেষ্টা করার উপদেশ দিলেন। আমি তার কথাগুলো সন্তুষ্ট চিত্তে হজম করিনি এবং এটাকে আমি একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করলাম। মেজর ওসমানীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু হালকা অস্ত্রপাতি দেয়ার জন্য তাঁকে রাজী করালাম। এইভাবে কাছ থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং অধিনায়ক মুখার্জীর বদান্যতায় আরও কিছু অস্ত্রপাতি যোগাড় করে পাকবাহিনীর ঘাঁটি বসন্তপুরের ঠিক অপর দিকে হিংগলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে একটা আক্রমণ পরিচালনার ঘাঁটি স্থাপন করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্যাপ্টেন মেহদী ও লেঃ জিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য চিন্তা করতে লাগলাম। কোন সহ-অধিনায়কের সাথে আমার কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় আমার অধীনস্ত অঞ্চল থেকে অস্পষ্ট ও অতিরঞ্জিত খবর আমার কানে এসে পৌঁছতে লাগলো। যাহোক নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেলাম যে, বরিশালে হাবিলদার হেমায়েত, পটুয়াখালীতে ক্যাপ্টেন মেহদী এবং সুন্দরবন এলাকায় লেঃ জিয়া হানাদার বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ করছে, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলির অপ্রতুলতা একটা বিরাঠ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সময় ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরাই মুক্তিযুদ্ধে প্রধান শক্তি হিসাবে কাজ করছিলেন। সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাবার জন্য আমি অধিনায়ক মুখার্জীর কাছে ছুটে গেলাম। তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ নম্র ব্যবহারে আমাকে মুগ্ধ করলেন সর্বরকমের সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। একবার যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা যায়, তাহলে আমার অধীনস্থ সেক্টরের ভবিষ্যৎ কি হবে আমি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলাম। সমস্তু আগ্রহ ও ঔৎসুক নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে সাথে করে বিভিন্ন ঘাঁটি পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের আশায় দিনরাত অবিশ্রান্ত ভাবে ছুটতে লাগলাম। কারণ প্রথম ব্যর্থতার বোঝাটা আমি যেখনেই যেতাম সেখানেই আমাকে ধাওয়া করতো। যতক্ষণ না বর্বর পশুগুলোর উপর একটার পর একটার পর একটা প্রতিহিংসা নিতে পারলাম ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যর্থতার গ্লানিকর ছায়াটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন হয়ে আমার কাঁধ চেপে রইল। সর্বক্ষণ আমি চলার উপর ছিলাম। জুন মাসের আগ পর্যন্ত আমার কোন সদর দপ্তর ছিল না।

Scroll to Top