সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদ– কোদালকাটির যুদ্ধ

<১০, ২১.৭, ৪৯৮-৫০৪>

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদ

২৮১৯৭৩

 

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কর্নেল (বর্ত্মানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, জাতীয় সংসদ সদস্য, বিমান ও নৌবাহিনীর মন্ত্রী) এম এ জি ওসমানী বেনাপোল পরিদর্শন করতে আসেন। তিনি বেনাপোল পৌঁছে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন এবং আমার ব্যাটালিয়ন পুনর্গঠিত করার কথা বলেন এবং ৬০০ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে  বাছাই করে নিতে বলেন। তাঁর নির্দেশমত আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন যুব শিবির থেকে প্রায় ৬০০ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ও ই-পি-আর বাছাই করে আমার ব্যাটালিয়নে নিয়ে নিই। উক্ত ই-পি-আর এবং তরুণদের বাছাই করার পর কর্নেল ওসমানী আমাকে মেঘালয় প্রদেশের তেলঢালা নামক জায়গায় যেতে বলেন। আমি পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে তেলঢালা চলে যাই। তেলঢালায় ১ম, ৩য় এবং ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের একত্রিত করা হয় এবং একটা ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেডের নাম ছিল ‘জেড ফোর্স’। উক্ত ব্রিগেড ফোর্সের কমান্ডার হন মেজর জিয়াউর রহমান। এখানে ব্যাটালিয়নের নতুন রিক্রুট করা সৈন্যদেরও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়।

১৩ই জুলাই মেজর (বর্তমানে লেঃ কঃ) মঈনুল হোসেন চৌধুরী আমার ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত হন এবং আমার নিকট থেকে ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব গ্রহন করেন। তাছাড়া আরো কয়েকজন অফিসারকে ব্যাটালিয়ন অফিসার নিযুক্ত করেন- তারা হলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, লেফটেন্যান্ট (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আব্দুল মান্নান,  লেফটেন্যান্ট (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন আমাদের ব্যাটালিয়ন এ যোগদান করেন।

কামালপুর যুদ্ধঃ মোটামুটি  ট্রেনিং এর পর প্রথম অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। ময়মনসিংহ জেলার কামালপুরে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিকে আঘাত করার পরিকল্পনা আমরা প্রথম নিই। কামালপুর এলাকার চতুর্দিক দিয়ে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে আমরা প্রথম ‘রেকি’করি।

২৮ জুলাই গভীর রাতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মোমতাজ, লেফটেন্যান্ট মান্নান, নায়েক সুবেদার আব্দুলহাইসহ আরও দু’জন সৈন্য ‘রেকি’করতে করতে কামালপুর শত্রুঘাঁটির ভিতর ঢুকে একটা বাঙ্কার এর মধ্যে উঁকি মারে। এমন সময় পাকিস্তানী দুজন সৈন্য অন্যদিক থেকে বাঙ্কারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন তাদের দেখে ফেলেন এবং তৎক্ষনাৎ তাদেরকে “হ্যান্ডস আপ” করতে বলেন। দু’জনের একজন “হ্যান্ডস আপ” করে। অপরজন না করাতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন লাফ দিয়ে উক্ত পাকিস্তানী সৈন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর যখন তারা বুঝতে পারে যে, তারা মুক্তিযোদ্ধার দ্বারা ঘেরাও তখন তারা পালানোর চেষ্টা করলে সুবেদার হাই তাদের উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন এবং হত্যা করে রাইফেল দুটি নিয়ে নিয়ে নেন। পরে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন সহ সবাই ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। এ ঘটনায় আমাদের সৈন্যদের মনোবল অত্যন্ত বেড়ে যায়। নায়েক সুবেদার আব্দুল হাইকে এজন্য বাংলাদেশ সরকার “বীর প্রতীক” উপাধীতে ভূষিত করেন।

৩১শে জুলাই ভোর সাড়ে তিনটার সময় দুই কোম্পানী সৈন্য (‘বি’কোম্পানী, যার কমান্ডার ছিলাম আমি নিজে এবং ‘ডি’কোম্পানী যার কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মোমতাজ ) নিয়ে কামালপুর বর্ডার আউট পোস্ট আক্রমণ করি। আমরা একটা ফিল্ড ব্যাটারির সাহায্য নিই। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ‘এ’কোম্পানীকে পাঠানো হয় উঠানীপাড়াতে (কামালপুর হতে ২ মাইল দক্ষিণে)। ‘এ’কোম্পানীকে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল তারা ‘কাট অফ’পার্টিতে যেন যোগ দিতে পারে। এফ-ইউ-পি’তে যোগ দিতে পারে এফ-ইউ-পি’তে পৌঁছার পরই আর্টিলারী ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু এফ-ইউ-পি তে পৌঁছার পুর্বেই আমাদের পক্ষ থেকে আর্টিলারী গোলাগুলি শুরু হওয়ায় আমাদের সৈন্যরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।  এ সময় শত্রু পক্ষও আর্টিলারী ও ভারী মর্টারের সাহায্যে গোলাগুলি শুরু করে। তা সত্ত্বেও আমি এবং সালাহউদ্দিন আমাদের কোম্পানীদ্বয়কে একত্রীত করে শত্রুদের আক্রমণ করি এবং সম্মুখ দিকে অগ্রসর হই। দু’দিকেই আর্টিলারী ব্যবহার হওয়া স্তত্বেও আমরা ‘জয় বাংলা’ধ্বনি দিতে দিতে শত্রুর দিকে অগ্রসর হই। আমরা কাঁটাতার এবং মাইনফিল্ড অতিক্রম করে অগ্রসর হই এবং গোলাগুলি চলাকালীন সময়ের মধ্যেই শত্রুপক্ষের অর্ধেক জায়গা দখল করে নেই। ফলে শত্রুরা পিছনের দিকে হটে যায় এবং তাদের পূর্বস্থানে আর্টিলারী ও মর্টারের গোলাবর্ষন করতে থাকে। এ সময় ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন যিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে ‘ডি’কোম্পানীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, শত্রুর গুলিতে শহীদ হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর সৈনিকদের উৎসাহ ও সাহস দিতে থাকেন এবং বার বার শত্রুপক্ষকে নির্মূল করার আকুল আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর মত দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন সৎসাহসী বীর ও আত্মত্যাগী যোদ্ধার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। যে কোন দেশের যে কোন জাতি গর্ববোধ করতে পারে তাঁর মত বীর যোদ্ধার বীরত্বের জন্য। একটু পরে আমি নিজেও শত্রুর মর্টারের গুলির আঘাতে আহত হই এবং আমাকে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার শরীরের পাঁচ জায়গায় মর্টারের গুলির টুকরো বিদ্ধ হয়। উভয় কোম্পানীতে কোন অফিসার ও অফিসার কমান্ডিং না থাকায় এবং ইতিমধ্যে যথেষ্ট সৈন্য হতাহত হওয়ায় আমাদের সৈন্যদের মনোবল সাময়িকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। ফলে তারা পিছিয়ে আসে। এই আক্রমণ এবং যুদ্ধে আমাদের পক্ষে একজন অফিসারসহ ৩১ জন যোদ্ধা শহীদ হন এবং দুইজন জুনিয়র কমিশন অফিসারসহ ৬৫ জন আহত হন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, শত্রুপক্ষের প্রায় ৫০ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হয়। এই আক্রমণ যদিও পুরোপুরি সফলকাম হয়নি তবুও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটা একটা স্মরনীয় আক্রমণ ছিল। এই যুদ্ধে এটা প্রমাণ হয় যে, বাঙ্গালী সৈন্যরা সম্মুখসমরে যথেষ্ট দক্ষতার অধিকারী এবং সাহসী। এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যদের দ্বারা কাঁটাতারের ঘেরা এবং মাইন বসানোকে উপেক্ষা করে আমাদের যোদ্ধারা যেভাবে অসীম সাহসিকতার সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন তা থেকেই প্রমানীত হয় যে, স্বল্পকালীন সাময়িক ট্রেনিং নেওয়া যুবকরাও অসীম বীরত্বের অধিকারী। এ যুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করায় নিম্নলিখিত কয়েকজনকে বাংলাদেশ সরকার বীরত্বের পুরস্কার দেনঃ (১) শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম), (২) ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম) (৩) লেফটেন্যান্ট আব্দুল মান্নান (বীর বিক্রম), (৪) সিপাই আবদুল আজিজ (বীর বিক্রম) (৫) সিপাই গোলাম মোস্তফা কামাল (বীর বিক্রম) (৬) নায়েক সুবেদার আঃ হাই (বীর প্রতিক) (৭) নায়েক  শফিকুর রহমান (বীর প্রতিক) (৮) শহীদ ল্যান্সনায়েক সিরাজুল ইসলাম (বীর প্রতিক), (৯) ল্যান্সনায়েক রবিউল্লাহ (বীর প্রতিক) (১০) ল্যান্সনায়েক তাজুল ইসলাম (বীর প্রতিক) (১১) সিপাই তারিকুল ইসলাম (বীর প্রতিক) (১২) সিপাই শফিউদ্দিন (বীর প্রতিক) (১৩) সিপাই সাইদুর রহমান (বীর প্রতিক)।

কিছুদিন পরই মেজর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কঃ) মোঃ জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) বজলুল গনি পাটওয়ারী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন। মেজর জিয়াউদ্দিনকে ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত করা হয়। ৮ই সেপ্টেম্বর ‘ডি’কোম্পানী ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে কামালপুরের ১ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ঘাসিপুর গ্রামে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

 ১০ই সেপ্টেম্বর শত্রুপক্ষকে দুই কোম্পানী সৈন্য মর্টার নিয়ে ঘাষিপুর আক্রমণ করে। ‘ডি’কোম্পানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এ আক্রমণ প্রতিরোধ করে ও তাদের আক্রমণকে ব্যররথ করে দেয়। শত্রুপক্ষের প্রায় ৪০ জন সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষে তিনজন শহীদ এবং ৮ জন আহত হন। নায়েক সুবেদার মোজাম্মেল হক এবং ল্যান্স নায়েক ইউসুফ আলী পূর্বেও কয়েকটি যুদ্ধে বিরত্বের পরিচয় দেন। বাংলাদেশ সরকার তার বীরত্বের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধি প্রদান করেন। এর দুইদিন পর আরো দুইজন অফিসার আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন, তারা হলেন ফ্লাইং অফিসার আলী খান এবং ডাঃ (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট) মজিবর রহমান ফকির। লিয়াকত আলী খানকে ব্যাটালিয়নের এ্যাডজুটেন্ট নিযুক্ত করা হয়।

.

কোদালকাটির যুদ্ধ

 

১৬ই সেপ্টেম্বর ‘সি’কম্পানীর একটি প্লাটুন লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে রৌমারীর চর কোদালকাটিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়। ২১ শে সেপ্টেম্বর শত্রুর দুই কোম্পানী সৈন্য মর্টারের সাহায্যে চরকোদাল আক্রমণ করে। আমাদের সৈন্যরা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সহিত তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ৫ জন নিহত হয়।  ২৪ সেপ্টেম্বর সকালবেলা শত্রুপক্ষ পূনরায় ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে কোদালকাটি আক্রমণ করে। এবারে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং আমাদের সৈন্যরা এবারেও তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেয়। যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ৭০ জন নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ১৫ জন আহত হয়। কোদালকাটির এ যুদ্ধে নায়েক সুবেদার আবুল হাশেম, হাওলাদার মকবুল হোসেন, ল্যান্স নায়েক আতাউর রহমান, ল্যান্স নায়েক আব্দুল হক প্রমুখ সৈন্যগণ অপূর্ব বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এ যুদ্ধে নিম্নলিখিত সৈন্যগণ সাহসিকতার পদকপ্রাপ্ত হনঃ (১) ল্যান্সনায়েক আবদুল হক (বীর বিক্রম) এবং (২) হাবিলদার মকবুল হোসেন (বীর প্রতিক)।

কোদালকাটির যুদ্ধে পাকিস্তানী ৭০ জন সৈন্য নিহত হওয়ায় এবং আমাদের নিকট পরাজিত হওয়ায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৈন্যদের মনোবল অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে। ফলে কোদালকাটি ও রৌমারী এলাকা সর্বসময় মুক্ত থাকে এবং সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে।

সিলেটের চা বাগানসমূহ ও অন্যান্য এলাকায় যুদ্ধঃ অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের ব্যাটালিয়নকে সিলেট সীমান্তে যাওয়ার জন্য আদেশ করা হয়। আমরা উক্ত আদেশ পাবার পর কোদালকাটি এবং রৌমারী ত্যাগ করে সিলেট সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাই। সিলেট বিভিন্ন চা বাগানে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে থাকত। পাকিস্তান সরকারের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য আমাদেরকে সিলেটের চা ফ্যাক্টরীগুলো সাময়িকভাবে নষ্ট করার আদেশ করা হয়। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের ‘এ’এবং ‘সি’কোম্পানী শত্রুর ঘাঁটির মাঝখান দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে ধালাই এবং খাজুরী চা ফ্যাক্টরীর উপর ‘রেইড’করে এবং ফ্যাক্টরীগুলোকে সামায়িকভাবে অচল করে দেয়।

১৯শে  অক্টোবর আমি ‘বি’কোম্পানী নিয়ে চম্পারায় চা ফ্যাক্টরীর উপর ‘রেইড’করি এবং সেটা নষ্ট করে দিই। এই রকম রেইডের সাফল্যে পাকিস্তানী সৈন্যদের মনোবল কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে এবং বাঙ্গালী জনসাধারনের মনে অনেক আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয় এ সমস্ত রেইডের সময় ডাঃ মজিবর রহমান অত্যন্ত সাহসের সাথে আমাদের আহত সৈন্যদের চিকিৎসা করেন এবং আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন। এ সময় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনিসুর রহমান ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসান নতুন কমিশনপ্রাপ্তির পর আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন।

২৮শে  অক্টোবর সকালে আমি ‘বি’কোম্পানীকে  নিয়ে পাত্রখোলা চা ফ্যাক্টরীর পাকিস্তানী ঘাঁটিতে আর্টিলারীর সাহায্য নিয়ে আ্ক্রমন করি এবং ঘাঁটিটি দখল করতে সক্ষম হই। একই দিনে লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্ব ‘সি’কোম্পানী ধালাই শত্রুঘাঁটির উপর রেইড করে এবং শত্রু পক্ষের বহু সৈন্যকে হতাহত করে। সিপাই হামিদুর রহমান এ রেইডে অভূতপুর্ব সাহসের পরিচয় দেন এবং নিজে গুরুতর ভাবে আহত হওয়া সত্বেও তার এল এম জির সাহায্যে একাই ২০ জন সৈন্যকে নিহত করে এ যুদ্ধে অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে শহীদ হন। বাংলাদেশ সরকার তার এ অসীম সাহসীকতার পুরস্কারস্বরুপ সর্বোচ্চ পুরস্কার “বীরশ্রেষ্ঠ” খেতাব দিয়ে তার শহীদী আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলে আমরা আশা  রাখি।

ধালাই থেকে শত্রুরা পাত্রখোলার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ক্যাপ্টেন মাহবুব মাত্র চারজন সৈন্য সাথে নিয়ে ধালাই এবং পাত্রখোলার বড় সড়কের মাঝামাঝি স্থানে এ্যামবুশ করেন। পাকিস্থানী সৈন্যরা তাঁর ফাঁদে পা দিলে তিনি শত্রুপক্ষের প্রায় ২০ জন সৈন্যকে নিহত করেন এবং দুইজনকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করেন। ঐ দিনই ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে ‘ডি’কোম্পানী পাত্রখোলা ফ্যাক্টরীর দুই মাইল দক্ষিণে কাট-অফ পার্টি হিসাবে অবস্থান নেয়। শত্রুর দুই কোম্পানী পাত্রখোলার দিকে অগ্রসর হতে থাকলে ‘ডি’কোম্পানী তাদেরকে প্রবলভাবে বাধা দেয়। শত্রু তখন ‘ডি’কোম্পানীর অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায় কিন্তু ডি’কোম্পানী তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেয়। শত্রুপক্ষের একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ৩০ জন নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ৬ জন সৈন্য শহীদ হন।

১লা নভেম্বরঃ এই দিন মিত্র বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়নসহ আমাদের ব্যাটালিয়ন মিলে ধালাই বি. ও পি. এবং ফ্যাক্টরী এলাকা যা শত্রুর সুদৃঢ় ঘাঁটি ছিল তার উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। দুই দিন ধরে অনবরত প্রচন্ড যুদ্ধের পর শত্রুদের ঘাঁটি দখল করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর ৩০তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের প্রায় দুই কোম্পানী  সৈন্য (প্রায় ২০০ সৈন্য) নিহত ও আর বহু আহত হয়।

নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিলেটের চারগ্রাম ও আটগ্রাম এলাকার শত্রুঘাঁটির উপরে কড়া রকমের একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করি। এজন্য আমরা সব কমান্ডিং এবং কোম্পানী কমান্ডারগণ এ এলাকা ভালভাবে রেকি করি। ২২শে নভেম্বর সকালে আমি ‘বি’কোম্পানী  নিয়ে আর্টিলারীর সাহায্য চারগ্রাম শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করি। সারাদিন প্রচন্ড যুদ্ধের পর আমরা উক্ত ঘাঁটি দখল করে নেই। শত্রুপক্ষের প্রায় ৩০ জন হতাহত হয় এবং কয়েকজনকে আমরা জীবিত অবস্থায় বন্দী করি। এ ঘাঁটি থেকে আমরা প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাগুলি, খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য  যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দখল করি। এ আক্রমণে সাফল্য লাফ করাতে আমদের সৈন্যদলের মনোবল অনেক গুনে বেড়ে যায়। এ যুদ্ধে ‘বি’কোম্পানী অত্যন্ত সাহস এবং রণকৌশল প্রদর্শন করে। একই দিনে ‘সি’কোম্পানী ক্যাপ্টেন নূরের নেতৃত্বে আটগ্রাম ব্রীজ আক্রমণ করে। এবং দখল করে নেয়। এ স্থানে আমরা প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র,ও গোলাগুলি দখল করতে সক্ষম হই। এইভাবে আমরা   চারগ্রাম ও আটগ্রাম এলাকাকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করি। এযুদ্ধে বীরত্বের পরিচয়স্বরুপ নিম্নলিখিত সৈন্যগণকে সাহসীকতার পুরস্কার ভূষিত করা হয়। যথাক্রমে তারা হলেনঃ (১) ক্যাপ্টেন নূর চৌধুরী (বীর বিক্রম), (২) নায়েক সুবেদার আবুল হাসেম (বীরবিক্রম), (৩) নায়েক সুবেদার মোঃ ইব্রাহিম (বীরবিক্রম)। পাকিস্থানী সৈন্যরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সিলেটের দিকে পশ্চাৎপদসরন করে। আমরা জিয়াউদ্দিনের সুযোগ্য নেতৃত্বে পাকিস্থানী সৈন্যদের অনুসরন করি। শত্রুরা পলায়নের সময় বেশ কয়েকটি পুল উড়িয়ে দেয় এবং রাস্তাঘাটে মাইন পুঁতে রাখে। মাইন পোঁতা রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে তাদের পশ্চাৎ যেতে থাকি এবং গৌরিপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই।

২৮শে নভেম্বরঃ এদিন ভোরে পাকিস্তানী ৩১ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আমাদের ‘এ’ কোম্পানীর পজিশনের উপর আক্রমণ করে। ‘এ’ কোম্পানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। একজন মেজর (মেজর সারোয়ার) এবং একজন ক্যাপ্টেনও নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ১০/১১ জন শহীদ হয় এবং প্রায় ২০ জন যোদ্ধা আহত হয়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র শত্রুপক্ষের মরা লাশে ভরে যায়। ‘এ’ কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহাবুব বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে এই যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁকে মরণোত্তর “বীর উত্তম” খেতাব দিয়ে ভুষিত করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন মাহাবুব শহীদ হবার পর তদস্থলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী যুদ্ধকালীন সময়েই ‘এ’কোম্পানীর কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সাবেক পাকিস্থান এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিলেন। তবে এই ধরনের পদাতিক যুদ্ধে তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলনা। একটু পরে তিনি শত্রুর বুলেটে মারাত্নভাবে আহত হন। কিন্তু তবু তিনি আহত অবস্থায়ই যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং শত্রুর আক্রমণকে ব্যহত করে দেন। এ যুদ্ধে অসাধারন কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তাকে বীর উওম এবং লেফটেন্যান্ট ওয়াকার  হাসানকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ যুদ্ধে আমরা ৩১-পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২৫জন সৈন্যকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করি। যুদ্ধবন্দীদের জবানবন্দীতে জানতে পারি যে, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যে এত বীরেত্বের সাথে এবং সাহসের সাথে যুদ্ধ করতে পারে তা কখনো ভাবতে পারনি।

এ যুদ্ধে পরাজিত হবার পর তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং সিলেটের দিকে পলায়ন করে। এ সময়  মিত্রবাহিনীও  পাকিস্থান সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ৪/৫ গুর্খা  রেজিমেন্টকে ছয়টি আর্টিলারি গানসহ সিলেট শহর থেকে প্রায় দূরে হেলিকপ্টারযোগে নামিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান স্থির করেন  যে সিলেট শহরে অন্যান্য সকল বাহিনীর পূর্বেই আমাদের বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করতে হবে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, পাকবাহিনীর শত্রু ঘাঁটির গুলি ভেদ করে অনুপ্রবেশ করব। মিত্রবাহিনী আমাদেরকে হেলিকপ্টারযোগে খাদ্য, রসদ ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিও দিলেন। আমরা জলাভূমি, খাল, বিল ইত্যাদি অতিক্রম করে অনুপ্রবেশ শুরু করি। এ সময় অত্যন্ত শীত ছিল। আমাদের যোদ্ধাদের নিকট কোন শীতবস্ত্র মোটেই ছিলনা। তবু আমাদের সৈন্যদের মনোবল ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। কেননা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অতি নিকটে। পর পর তিন রাত খাল, বিল এবং জলাভূমি মধ্য দিয়ে চলাচল করে শত্রুঘাঁটি দরবশত ও খাদেমনগর অতিক্রম করে আমরা গভীর চা বাগানের মধ্যে প্রবেশ করি। এ সময় আমাদের সঙ্গে কোন খাদ্যদ্রব্য ছিল না এবং একটানা হাঁটার ফলে আমাদের সৈন্যরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও বিপুল উৎসাহ এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা চা বাগানে প্রবেশ করি। ‘চিকনাগুল’চা বাগানে আমরা মোজাহিদ কোম্পানীকে লেফটেন্যান্ট মুদাসসির-এর নেতৃত্বে রেখে হেলিকপ্টারযোগে খাদ্যদ্রব্য ও রসদ সগ্রহ করার জন্য। অয়ারলেসের মাধ্যমে মেসেজ দেওয়া সত্ত্বেও আমরা কোন সাহায্য পেলাম না। শত্রুপক্ষ কালগুল চা বাগানে আমাদের বাধা প্রধান করে এবং আমাদের অল্প কয়েকজন যোদ্ধা হতাহত হন। তখন আমরা এই শত্রুঘাঁটি এড়িয়ে যাই এবং  ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে সিলেট শহরে ঢুকে এম, সি, কলেজ এলাকায় প্রবেশ করি। এম, সি, কলেজে শত্রুর অত্যন্ত শক্ত ঘাঁটি ছিল। আমরা শত্রুপক্ষ থেকে পাঁচশত গজ দূরে  এম,  সি, কলেজ উত্তর দিকে টিলাগুলোর উপর ডিফেন্স নিই। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে ছিল ‘বি’কোম্পানী এবং ‘সি’কোম্পানী- যথাক্রমে আমার এবং ক্যাপ্টেন পাটাওয়ারীর নেতৃত্বে। পিছনে বি’কোম্পানী এবং ‘সি’কোম্পানী যথাক্রমে ক্যাপ্টেন নূর এবং লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে ছিল। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারসহ মেজর জিয়াউর রহমান এ চার কোম্পানীর মাঝামাঝি একটি টিলার উপর অবস্থান করছিলেন। আমাদের সাথে মিত্রবাহিনী আর্টিলারীর একজন ব্যটারী কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু  অয়ারলেসে সেটের  মাধ্যমে তিনি তাঁর গান পজিশনের সাথে যোগাযোগ রাখতে ব্যর্থ হন। এ সময় আমাদের ৩” মর্টারের মাত্র ১৪টি গোলা অবশিষ্ট ছিল। প্রায় তিনদিন আমাদের সৈন্যরা বলতে গেলে অনাহারে ছিল, তথাপি শত্রুর নাকের ডগায় ট্রেঞ্জ খুঁড়ে পজিশন নিতে থাকে। শত্রুপক্ষ আমাদের অতি নিকটে ছিল এবং নির্বিকারে কার্যকলাপ লক্ষ করছিল। তারা চিন্তাও করতে পারেনি যে আমরা মুক্তিবাহিনীর দল। কারণ আমাদের পোশাক, স্টীল হেলমেট। অস্ত্রশস্ত্র তাদের মতই ছিল। তাছাড়া এ সময় যুদ্ধ চলছিল আমাদের পিছনে এবং বাঁ দিকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে খাদেমনগর। আমরা শত্রুর পজিশনের ভিতর দিয়ে এত তাড়াতাড়ি সিলেট শহরে প্রবেশ করব তা ভাবতেও পারিনি। একটু পরে চিৎকার করে তারা আমাদের পরিচয় জানতে চাইলে আমরা তাদের চিৎকারের জবাব না দিয়ে চুপচাপ ট্রেঞ্জ খুঁড়তে থাকি। এ সময়’ডি’কোম্পানীর পজিশনের সামনের রাস্তার একটি আর্টিলারী গান ও দুটি জীপের কনভয় থামে। তখন ‘ডি’কোম্পানীর কমান্ডার মর্টারের সাহায্যে উক্ত কনভয়ের উপর গোলাবর্ষণ করেন, যার ফলে একটি জীপে আগুন ধরে যায়। শত্রু তখন আমাদের উপর সন্দিহান হয়ে পরে এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক সেদিক চলাফেরা করতে থাকে। এ সুযোগে আমরা মেশিনগান ও হালকা মেশিনগান দিয়ে তদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকি। ফলে পাকবাহিনীর ২৫ জন সৈন্য রাস্তার উপরেই হতাহত হয়। শত্রুপক্ষ তখন মর্টারের সাহায্যে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে মৃতদেহ সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তখন আমাদের নিখুত গুলিবর্ষণের ফলে শত্রুপক্ষের আরও বেশকিছু সৈন্য হতাহত হয়। দুপুরের সময় শত্রুরা বাধ্য হয়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এবং মর্টারের প্রবল গোলাবর্ষণের সাহায্যে আমাদের কোম্পানীর (‘বি’কোম্পানী ‘) উপর প্রচন্ড আক্রমন চালায়। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের মর্টারের গোলা শেষ হয়ে যায়। তবু  আমরা  মেশিনগান, হালকা মেশিনগান, এবং রাইফেলের সাহায্যে দৃঢ়তার সাথে শত্রুর আক্রমন প্রতিহত করি। এ আক্রমণের ফলে পাকবাহিনীর ৮০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। আমাদের ‘বি’কোম্পানী এবং ‘ডি’কোম্পানীর মোট ২০ জন সৈন্য শহীদ হন এবং প্রায় ২০ জন গুরুতরভাবে  আহত হন। আমার কোম্পানীর সবচেয়ে সযোগ্য সুবেদার ফয়েজ আহমদ অসীম সাহস এবং রণকৌশল প্রদর্শন করে শহীদ হন। তাকে “বীর উত্তম” খেতাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এ যুদ্ধে সিপাই বাচ্চু মিয়া, নায়েক নুরুন্নবী, সিপাই ফজর আলী,  সিপাই মহিউদ্দিন ও নায়েক আফসার আলী অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়ে শহীদ হন।

এ যুদ্ধে নিম্নলিখিত যোদ্ধাগণ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁদেরকে খেতাবে ভূষিত করেন। তারা হলেনঃ ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী (বীর প্রতিক), নায়েক সুবেদার হোসেন আলী তালুকদার  (বীর প্রতিক), হাবিলদার নুরুল হক  (বীর বিক্রম), শহীদ সুবেদার ফয়েজ আহম্মদ (বীর উত্তম), হাবিলদার সাইফুদ্দীন  (বীর প্রতিক), হাবিলদার রুহুল আমীন (বীর প্রতিক), হাবিলদার আবদুল গফুর(বীর প্রতিক), সুবেদার খাইরুল বাশার (বীর প্রতিক), নায়েক সুবেদার আবদুল লফিত (বী র প্রতিক), ল্যান্স নায়েক আবুল বাশার (বীর প্রতীক), হাবিলদার আবদুল লতিফ (বীর প্রতিক)।

১৫ই ডিসেম্বরঃ সিলেট শহরের উপর পাকবাহিনীর এই চরম পরাজয়ে তাঁদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে যায়। যার ফলে পরদিনই পাকিস্তানী কমান্ডারগণ আমাদের এবং মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। আমরা বিজয়ীর বেশে সিলেট শহরে প্রবেশ করি এবং শহরের জনগণের মনে বিপুল আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার জনতা আমদেরকে স্বাগত জানাতে থাকে।

১৬ই ডিসেম্বরঃ পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রানা ব্রিগেড নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের এবং মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পন করে। এভাবে আমাদের নয় মাস যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং স্বাধীনতা অর্জন করি। আমাদের সৈন্যরা বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন  হয়েও অসীম সাহসিকতার ও ত্যাগের পরিচয় দেয়। আমাদের তরুণ অফিসারগণ অসীম সাহসিকতা  প্রদর্শণ করেন এবং ত্যাগ ও বীরত্বের নিদর্শণ স্থাপন করেন। তার প্রমাণস্বরুপ বলা যেতে পারে যে, এ ব্যাটালিয়নের তিনজন অফিসার সম্মুখসরে শহীদ হন এবং আরও তিনজন অফিসার গুরুতররুপে আহত হন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুব কম ব্যাটালিয়নই এ ধরনের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে এই ব্যাটালিয়ন অসাধারণ কৃতিত্ব ও নৈপুণ্য প্রদর্শণ করে বহু শত্রুসৈন্যকে হতাহত এবং জীবিত অবস্থায় বন্দী করে। বাঙ্গালী সৈন্যরা  গতানুগতিক সম্মুখযুদ্ধেও যে যথেষ্ট দক্ষ, তা এই ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা শৌর্যবীর্য এবং ত্যাগের মাধ্যমে প্রমাণ করেন।

স্বাক্ষরঃ হাফিজউদ্দীন আহমদ,

ক্যাপ্টেন

২৮-০৯-১৯৭৩

Scroll to Top